আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পেপার রাইমের মহাকাব্য: যার প্রতিটা ছন্দ, প্রতিটা সুর এখনো বুকে গেথে আছে!

আসেন দুর্নীতি করি। আর এই দুনিয়াটাকেই খুচাই! সঙ্গীতের ভাষা নাকি সার্বজনীন। এই ভাবার্থের আমি কোনো মানে বুঝি না। যখন বিজাতীয় গান শুনি, ইংলিশ গান বাদে সবকিছুর একটাই অর্থ লাগে: কিছুই বুঝি না। তবে সুর, সঙ্গিত অথবা মিউজিক শুনলে বোঝা যায় কি বলতে চায় গায়ক।

বাংলাদেশের ব্যান্ড ইতিহাসের জোয়ার ৮০ এর দশক থেকে। তখন ইংলিশ গানকে ভালো চোখে দেখা হলেও ব্যান্ড সঙ্গীত ছিলো বড়লোকের ডাইলখোর পোলাপানের সঙ্গীত। মফস্বল শহরে যে ঘরে একটা বড় মেয়ে আছে সেই মেয়ের সাহস হতো না কোনো এক উদাস বিকেলে একটু জোর ভলিউমে "লালশাড়ী" অথবা পানকৌড়ির "সে ছিলো যে একটি মেয়ে" অথবা "ঐ দূর পাহাড়ের ধারে"। লোকে তাকাত বাঁকা চোখে। ব্যান্ড কালচার ছিলো বড় বড় বিভাগীয় শহরে বড় বড় ঘরে।

যেটা এখনও আছে। অবস্হার খুব বেশী পরিবর্তন হয়নি। ব্যান্ড জগতে যতো রেভ্যুলেশন, যতো ভালো গান সব এমন ঘরের সন্তানেরাই উপ হার দেয়। অবশ্য এখন আর কোনো ঘরে উচ্চ স্বরে হ্রদয়খান বাজলে কেউ রাগ করে না। এটা এখন চিন্তাও করা যায় না।

কিন্তু একসময় ছিলো। সেসময়েও ব্যান্ড সঙ্গিতের দারুন প্রসার ছিলো। মাইলসের ৩৫ টাকার একটা ক্যাসেট অথবা নিটোলের প্রথম এলবামটা কিনবার জন্য সকাল বেলা উঠে টুকু ভাইয়ের দোকানে দাড়িয়ে থাকতাম। প্রথম কপিটা কিনে স্কুলে যেতাম। বাসায় এসে বারবার শুনতাম।

যদি পকেটে টাকার অভাবে কিনতে না পারতাম তাহলে পুরোনো ক্যাসেটের উপর রেকর্ড করে পুরো এলবামটা যেমন করেই হোক শুনতে হতোই। সেগুলো ছিলো একটা সময় এবং দুঃখ নেই যে তখন তিশমার মতো মুখ বাকিয়ে বাংলা ভাষা বিকৃত করে ফালতু কারো গান শুনতে হয় নি অথবা পাগলি ছাগলি এভ্রিল ল্যাভিগনের গান ভুলেও চ্যানেল ভি বা এমটিভিতে দেখায়নি! ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করেই বাংলাদেশ ট্যুরে বের হই। ঢাকা থেকে বড় খালু নিয়ে যান রংপুরে। যাতে রংপুর থেকে উত্তর বঙ্গের ট্যুর শুরু করতে পারি। মনে পড়ে তিস্তা ব্যারেজের উপর দাড়িয়ে আমি আর আমার খালাতো ভাই হাটছিলাম।

তখনকার নদীর স্রোত দেখলে যে কেউ ডড়াতো। তীব্র স্রোতে নীচে পানি ছুটে যাচ্ছে ফিনকি দিয়ে। ব্যারেজের দু পাশে বিডিআর সদস্য পাহার দেয়। ব্যারেজে যখন ট্রেন যায় তখন কোনো রিক্সা বা গাড়ি চলতে পারতো না। ট্রেন চলে গেলেই রিক্সা বা ট্রেন।

আমি আর খালাতো ভাই বিশাল ব্রীজটা হাটতে হাটতে কখন যে ওপাশে ট্রেন এসে গেছে মনে নেই। পাশে রেলিং এর মতো একটা এক্সটেনশন কিন্তু হায় রেলিং এর মেঝেতে কাঠ নাই। কোনো মতে লোহার রেলিং ধরে ঝুলে থাকা আর কি। ট্রেন যখন যাচ্ছিলো বিপুল বেগে তখন মনে হচ্ছিলো আমাদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমি শিওর আমার মামাতো ভাই প্রমাদ গুনছিলো যদি আমি পানিতে পাড়ে যায়, একেতো জানি না সাতার তার উপর বাসার সবাই দেখেছে আমরা দুই জন বের হয়েছি।

রক্ষে নেই। যাই হোক, অন্নদানগরের বাজারে এসেই মামাতো ভাই একটা ক্যাসেট কিনেন। তার ছোট বেলার শখ ছিলো একটা ব্যান্ড খোলার। কিন্তু ব্যান্ড না খুলে ব্লাক বেল্ট নেয়, পুরো পাকানো ফিগার বানায়। তবু ব্যান্ডের উপর নেশা যায়নি।

তার চাচাতোভাই এর বিশাল এক ডেকসেট ছিলো। গান গুলো যখন পূর্নিমা রাতের আলোয় শুনছিলাম মনে হলো এ গান নয়, এগুলো যেন মহাকাব্য। অনেকটা বৃষ্টিতে আগুন ধরানো অথবা তপ্ত মরুভূমির নূহের প্লাবন ডেকে আনা। গান গুলো এখনো যখন শুনি মনে হয় ১৯৯৬ সালে এরা যা গেয়েছে এখনকার কয়টা নতুন ব্যান্ড এমন গান গাইতে পারে? বাংলাদেশ কতটা সমৃদ্ধ ছিলো সে ইতিহাস যদি আজ লিখতে বসি তাহলে হয়তো এ যুগের সবাই হতাশাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে কারন এখন কেন যেনো সেই সময়ের মতো এতটা শৌর্যবীর্য এদের নেই। যদিও এদের দোষ দিবো না।

দোষটা আমাদের সামগ্রিকভাবে সবাইকেই নিতে হবে ব্যান্ডের নাম পেপার রাইম এলবামটা সেল্ফ টাইটেলড। গান গুলো সফট, মেলো আর হার্ড রক কম্বিনেশন। প্রথমে ব্যান্ডের ইতিহাস জেনে নেই। পেপার রাইমের জন্ম ১৯৯২ সালের ২৪ শে জানুয়ারী। ব্যান্ডের ৫ জনই ঢাকা ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছিলো তখন।

শামসুন্নাহারের হলের পাশে ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টারের গ্যারেজে এর প্রাকটিস প্যাড ছিলো। এর প্রথম এলবামটা ছিলো ৪ বছরের প্রজেক্ট যার প্রথম দুই বছর এটা নিয়েই গবেষনা করতে সময় গেছে যে এর রেকর্ডিং ফরমেট কিভাবে হবে: ৩ ট্রাক/৮ ট্রাক/১৬ ট্রাক/ডিজিটাল/এনালগ/কোয়ার্টার ইন্ঞ্চ/হাফ ইন্ঞ্চ/ ১ ইন্ঞ্চ/অপটিক্যাল/হার্ড ডিস্ক?বাংলাদেশের সকল টেকনোলজী এমনকি এক্সপার্টিজও আমদানী করে আনতে হয় সেখানে ৭০ দশকের মাল্টি ট্রাকের মেশিনে রেকর্ডিং ও একটা বড় ফ্যাক্টর। সেই সময় সাউন্ডট্যাক ছিলা অডিও শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রযোজনা সংস্হা। সঙ্গিতা তখন মাইলসের মাধ্যমে বাজার মাত করছিলো কিন্তু সাউন্ডট্যাক তখন অধিকাংশ ব্যান্ডগুলোকে প্রোমোট করতো। জি সিরিজ তখনও বাংলাদেশের মার্কেটে আসেনি।

যখন মোটামোটি রেকর্ডিং এর খুটিনাটি ব্যাপারগুলো সব চূড়ান্ত হয়ে যায় তখন এরা গানে হাত দেয়। এক বছরের মাথায় দাড়া করায় ১২ টা অসাধারন গান। তখনকার লাইন আপ: আহমেদ সাদ: ভোকাল, হারমোনিকা নাসের হক: কীবোর্ড সুমন জামান: বেস রাশেদ ইকবাল: গীটারস অনিন্দ কবির অভিক: ড্রামস, পারকাশনস মনে পড়ে ক্যাসেট টা খুলে বিশাল একটা পোস্টার ছিলো। পোস্টারের লেখা গুলো ইংলিশে ছিলো আর গান গুলোর লিরিকস দেয়া ছিলো। ছবিগুলো খুবই সুন্দর ছিলো।

মেঘলা আকাশে ৫ যুবক আসমানের দিকে তাকিয়ে কাকের নীচে উকি দিচ্ছে। আমার খালাতো ভাই বলতো,"সবগুলান খাটাশ, কাকের নীচে উকি দেয়!" আহমেদ সাদের ব্যাপার লেখা ছিলো গানের গলা ভালো কিন্তু সর্দি লাগাতে ওস্তাদ সময় মতো নাসের হকের ব্যাপারে লেখা ছিলো যে নোট বাজায় তা কোনোদিন ভুলে না, কিন্তু বছর জুড়ে রিহার্স করতে তার মন বসে না। বসে হয়তো এক দু'বার! সুমন জামানের ব্যাপারে লেখা ছিলো নিজের বাজানোতে প্রতিবার আরো শ্রূতিমধুর করে, সমস্যা হলো শেষবার কি বাজিয়েছিলো সেটাই সে ভুলে যায় অভিকের ব্যাপারে প্রাকটিসে ঝড় তোলে কিন্তু স্টুডিওতে ঢুকলে হুশ হারায়। গান গুলো ছিলো: ১) বল তো আকাশের কি রং প্রোগ্রেসিভ রক ধাঁচের গান। গানটা পুরোটা গায়কী নির্ভর।

এই গানটা শুনলেই মনে হবে এই ব্যান্ডের গায়ক কতটা শক্তিশালী যে পুরোটা গান টেনে নিয়ে গেছে। ২) বৈশাখে ড্রামের কাজটা বাদে পুরো গানটার কম্পোজিশন ছিলো অসাধারন। বিশেষ করে কোরাসের অংশটা খুবই ক্যাচি। কীবোর্ডের সাইরেন সাউন্ড অথবা গীটারের কাজটা গানের জন্য ছিলো পারফেক্ট। দারুন একটা রক ট্রাক।

সলোসটায় রিদমগীটারের ব্যাক আপ তখন খুব কম ব্যান্ডই করতো। লিরিকসে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের ষড়ঋতুর দুর্যোগের সাথে মানুষের যু্দ্ধ। ৩) একবার বলে যাও নাগরিক প্রেমের একটা রক ট্রাক। ড্রামের সাউন্ড রেকর্ডিং এর সময় কম করলেও পারতো। তবে বাকী কাজগুলোতে বিশেষ করে কীবোর্ড সলোসটা প্রথম দিকে ভালোই ছিলো।

গীটারের ব্যাকিংটা বেশ ক্রিয়েটিভ। লিরিকস গুলোতে রূপকের ছড়াছড়ি। ৪) এলোমেলো] এটা ছিলো ক্যাসেটের প্রথম গান। প্রথম দিককার কীবোর্ডটার ইনট্রোটা শুনলে মনে হয় বিদেশী কোনো ব্যান্ডের গান শুনছি। যদিও কোনো নকল সুর বা নকল গান এই এলবামে ছিলো না।

রিমেক হিসাবে একটা ছায়া সঙ্গিত বাদে। পপ রক ঘরানার প্রথম গানটা শুনলেই এই ব্যান্ডের প্রেমে পড়ার জন্য যথেষ্ট! ৫) হাওয়ায় আসে বন্ধু বব ডিলানের ব্লোয়িং ইন দ্যা উইন্ড এর ছায়া অবলম্বনে গাওয়া। গায়কীর স্টাইল ছিলো সাদের নিজস্ব, গীটারের কিছু নোট এক থাকলেও পুরো গানটা শুনলে মনে হবে না যে গানটা এটার নকল ছিলো, গানের লিরিকস টা মনে রাখার মতো যদিও বাঙ্গালী নচিকেতার নাম শুনলেই আদিখ্যেতা শুরু করে আর এটা ভুলে যায় যে বাংলাদেশে এরকম লিরিকসের গান তাদের জন্মের আগে থেকেই লেখা হয়েছিলো। হারমোনিকার কাজটা একটা অন্যরকম মাত্রা এনে দিয়েছে। ৬) যখনি আকাশ গীটারের এতো উন্নত কাজ তখনকার খুব ব্যান্ডের ছিলো।

গানের লিরিকস শুনলেই মনে হবে এক রাজকুমারীর জন্য লেখা এই গান। খুব জানতে ইচ্ছে করে আসলেই কি কোনো রাজকুমারী ছিলো গায়কের। যদিও গায়ক বিয়ে করেছে, ভাবীকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে এই গানটা তার জন্য লেখা কিনা! ৭) কেন যে সে আরেকটি অসাধারন রক ট্রাক। বেস গীটারিস্টের জন্যই এই গানটা। তবে গায়কের গাওয়ার স্টাইলটা শুনলে মনে হবে মিউজিকে জ্যাজ ব্লুজের ধারনা নিয়ে যে গান গাইতে হবে তার কোনো মানে নেই! সাবলীল ভাবেও গান গাওয়া যায়! ৮) কখনো কি খুজেছো গানে এক্সপেরিমেন্ট ছিলো প্রথমে।

তা গানে যতই এক্সপেরিম্যান্ট থাকুক, যখন গানটা একবার গতি পায় তখন আর কোনো বাধা মানে না। শরতের সকালে অথবা কৃষ্ঞচূড়া বিকেলে মনটা হারাবেই। গীটারের সলোটা মনে রাখার মতোই, তাই না? ৯) মনে করো কোনো এক বিকেলে জটিল অসাধারন হার্ড রক। যেমন কীবোর্ড সলোস তেমনি ছিলো কোরাস। এই গানটা শুনবার সময় ভুলে যাই গানের খুটিনাটি কি লিখবো!! ১০) অবসর ভালোবাসা....তুমি কি আমায় ভুল বুঝেছো! কীবোর্ড ইন্ট্রো সাথে বেস গীটারের অসাধারন ব্যাক আপ।

আস্তে আস্তে ড্রাম, গীটার এক দারুন সম্মিলন। গায়কীর কথাগুলো পুরো গানটাকে আরো শ্রূতিমধুর করে তুলেছে। ৮০ এর দশকের চটুল রক গান গুলো ঝাকড়া চুলের কিশোরেরা যেমন গাইতো, ঠিক তেমনি! ১১) অন্ধকার ঘরে পুরো সফট রক। লিরিকস নির্ভর গান। ১২) সময়ের হাতে আরেকটা অসাম পপ ঘরানার হার্ড রক।

পুরো এলবামে সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স ছিলো ভোকালের। বিশেষ করে শুরুর দিকে গায়কের টানটা পুরো গানটাকে ট্রেনের উপর চড়িয়ে নিয়ে শ্রোতাকে খুব সুন্দর একটা জয়রাইড দিতে পারে। এই গানটা শুনলে মনে হবে প্রত্যেকটা কিশোরের একবার করে প্রেম করা উচিত, একবার করে জীবনটা উপভোগ করা উচিত মুক্ত জীবনের খোজে! তারপর ১৩ টা বছর কেটে যায়। মাঝখানে গুজব ওঠে ভোকাল নাকি সুইসাইড খাইছে। আসলে ব্যান্ডটা মাঝখানে ভেঙ্গে যায়।

পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে কিছু সদস্যের বিদেশ যাত্রা, নানা কাজে নিজেদের ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগ দেয়। শ্রোতারা একসময় ভুলেও যায়। তবু ওরা মিলিত হয় একসময়। প্রচারবিমুখ ব্যান্ডের নামে নিজেদের হাতে গড়া নতুন প্রাকটিস প্যাডে জ্যামিং শুরু করে। সময়ের প্রবাহে বুড়িয়ে গেলেও মনে এখনো নতুন কিছু করার বিপ্লব দানা বাধে।

গান গাইতে শুরু করে আবার। রাশেদ যদিও এবার দলে নেই। বয়স হয়েছে, আগের মতো গলা নেই তার। নতুন লাইন আপ গঠন করেছে ওরা। ৩জুলাই ২০০৯ সালে ওরা ইস্কাটনে একটা প্রাকটিস সেশন করে।

অসাধারন একটা গান আবারও গলায় তুলে। আহমেদ সাদ: ভোকাল, হারমোনিকা নাসের এম এ হক: কীবোর্ডস এএএম লনি: গীটারস সুমন জামান: বেস গীটার এএইচকে মিরাজ: ড্রামস অনিন্দ কবির অভিক: অডিও ভি্জ্যুয়াল/ ক্রিয়েটিভ সাপোর্ট নতুন এলবামের কাজে হাত দিয়েছে। প্রথম এলবামের মহাকাব্য গড়তে ওদের সময় লেগেছিলো ৪ টা বছর। তখন ছিলো ওরা যুবক। বার্ধক্য এখন উকি দিলেও মনটা যুবক।

দেখা যাক, শতব্যাস্ততার পরও আরেকটা মহাকাব্য গড়তে ওদের কত সময় লাগে সময়ই বলে দেবে। তথ্যসূত্র এবং ছবি: ফেসবুক! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.