অর্থ নয়, কীর্তি নয়...আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে [আমি জানতাম না, আজ আমার অতি প্রিয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর জন্মদিন। ব্লগার রিতুন ক্লিস কে অসংখ্য ধন্যবাদ। আজকে লেখা তার ব্লগ “শুভ জন্মদিন বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়” Click This Link পড়েই এই লেখাটি লিখছি। ]
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার কৌশোর এর প্রথম শিহরণ। তাঁর অরণ্যভ্রমণের বর্ণনাগুলো পড়ে মন ছুটে যেত প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে।
ছোট ক্লাসে প্রথম যেদিন আরণ্যক নামটা পড়েছিলাম, মনের গভীর গোপন প্রদেশে অরণ্যচারী এক সন্নাসীর জন্ম হয়েছিল। কল্পনায় আমি অনেকবার গহীন অরণ্যের ভেতর হেঁটে বেড়িয়েছি। পায়ের নিচে মরা বাঁশপাতা চুর চুর হয়ে যাওয়ার শব্দে চমকে উঠেছি। স্বপ্নে ঝর্ণার শীতল জলের স্পর্শে গভীর রাতে ঘুম ভেঙেছে অনেকবার।
তারপর অনেক সময় চলে গেছে।
পড়তে পড়তে এবং না পড়তে না পড়তে ছাত্রজীবন এগিয়ে চলছিল। ভাগ্যগুণে কবি মোঃ রফিক এর সরাসরি ছাত্র হয়েছিলাম এবং তাঁর স্নেহ পাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। আমি তখন মাস্টার্সে পড়ি। কিছুদিনের জন্য স্যারের বাসায় আমাকে থাকতে হয়েছিল। আমি তক্কে তক্কে থাকতাম।
কখন স্যার ঘুমাবে। স্যার নিয়ম করে ঠিক রাত দশটায় ঘুমিয়ে যেত। তখন সারা বাড়িতে আমার রাজত্ব কায়েম হত। কোন ঘরের কোথায় কী আছে সব তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতাম। আচমকাই একদিন একটা দরজা আবিষ্কার করলাম।
এর আগেও আমরা সদলবলে স্যারের বাসায় দাপিয়ে বেড়িয়েছি। কিন্তু এই দরজাটা আগে কখনো চোখে পড়েনি। একটু কৌতুহল নিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। অন্ধকার ঘর। কোথায় সুইচবোর্ড তাও জানিনা।
আন্দাজেই এগোতে লাগলাম। কিছুদূর গিয়ে আর যাওয়ার উপায় রইল না। কাঠের একটা বুকশেলফ’এ এসে ঠেকলাম। ডানে-বায়ে কোথাও এগোবার উপায় নেই। সারি সারি বুকশেলফ।
ফিরে গিয়ে মোবাইল ফোনটা নিয়ে এসে তার আলোয় সুইচবোর্ডটা খুঁজে বের করলাম। চোখ ধাঁধিয়ে গেল। এত বই একসাথে আমি কখনো দেখিনি (লাইব্রেরির কথা আলাদা)। এই শেলস ওই শেলফ করতে করতে হঠাৎ একটা বই’এ চোখ আটকে গেল – ‘চাঁদের পাহাড়’। এক মুহূর্তে ফিরে গেলাম সেই ছোটবেলায় যখন বিভূতিভূষণ মনের গভীরে জায়গা করে নিয়েছিলেন।
অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, এতদিন বিভূতিভূষণ থেকে দূরে ছিলাম কেন। কোন উত্তর পেলাম না। সেই অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে কেবলই মনে হতে লাগল মানুষের মন বড় বিচিত্র। মনে পড়ল ছোটবেলায় আনন্দমেলা’র কোন এক সংখ্যাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর একটা কিশোর উপন্যাস পড়েছিলাম ‘ডুঙ্গা’। সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র সুজয় এক সন্ধ্যায় বাড়ি ছিল না।
সেই সন্ধ্যায় তার গৃহশিক্ষক তার অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে ‘চাঁদের পাহাড়’ বইটা পড়ছিলেন। আমি তখন জানতাম না যে এই বই বিভূতিভূষণ এর। শুধু নামটা শুনেই অদ্ভুত ভাল লেগেছিল। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম। কখনো পড়ে নেব।
এতদিন পর এই রহস্যময় অন্ধকারে সেই ‘চাঁদের পাহাড়’! বুকশেলফগুলোতে আরো খোঁজ চালালাম। বিভূতিভূষণের আরেকটা বই পাওয়া গেল – ‘আম আঁটির ভেঁপু’ যাকে আমরা পথের পাঁচালি নামে চিনি। এতদিন পর স্বীকার করতে আর দোষ নেই বই দুইটা অসদুপায়ে সংগ্রহ করেছিলাম। কাজটা করার সময় একটু খারাপ লাগার উপক্রম হয়েছিল। তাড়াতাড়ি মার্ক টোয়েনের কথা মনে করে সাহস সঞ্চয় করেছিলাম।
‘চাঁদের পাহাড়’ পড়ে এক সপ্তাহ আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। বাংলা সাহিত্যে এমন অসাধারণ একটি কিশোর উপন্যাস আছে ভাবতেই পারিনি কখনো। ‘আম আঁটির ভেঁপু’ পড়া শুরু করলাম। মাঝ পথে থেমে গেল। আবার বিভূতিভূষণ কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন।
আবার দীর্ঘ বিরতি। মাস্টার্স শেষ। কর্মজীবনে প্রবেশ করি। ঘটনাচক্রে পাশাপাশি বাসা আমার অতি প্রিয় এক বড় ভাই এর, যার অনুপ্রেরণায় গানকে আমি নতুন করে ভালবাসতে শিখেছিলাম। তার বাসায় হঠাৎ করেই দেখতে পাই ‘শ্রেষ্ঠ গল্পঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’।
বিভূতিভূষণ আবার ফিরে এলেন প্রবলভাবে। এবার যেন তাঁকে অন্যরূপে দেখলাম। এই বিভূতিভূষণ সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। গল্পগুলো কি যে গভীর মমতায় লেখা। বইটির সম্পাদক বিশ্বজিৎ ঘোষ লিখেছেন, “পরিবর্তমান সময়ের স্রোতে মানবাত্মার শাশ্বত মূল্যবোধ এবং স্নেহ-প্রেম-ভালবাসায় জড়ানো জীবন অনন্তে হারিয়ে যায়, গল্পে-উপন্যাসে সেই হারিয়ে যাওয়া জীবনই সন্ধান করেছেন বিভূতিভূষণ।
তাঁর গল্পে প্রকৃতি মানুষের কাছে উপস্থিত হয়েছে বিশল্যকরণী সত্তায়, সঙ্কটদীর্ণ জীবনে তা বুলিয়ে দেয় প্রশান্তির প্রলেপ। বস্তুত মানুষ ও নিসর্গের মাঝে তিনি রচনা করেছেন আত্মীয়তার সেতুবন্ধন। গ্রামীন জীবন, নিসর্গ বৈচিত্র্য, শাশ্বত মানবপ্রেম প্রভৃতি অনুষঙ্গ যেমন তাঁর গল্পে শিল্প-উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে; তেমনি ব্যবহৃত হয়েছে অলৌকিক ঘটনা, অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস কিংবা আধ্যাত্মিক কোন উপলব্ধি। ” এই গল্প সংগ্রহটি বিভূতিভূষণকে আমার কাছে আরো অনেক শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছিল। সবগুলো গল্প অনেকবার করে পড়েছিলাম।
অদ্ভুত এক শব্দময় জগৎ।
চাকরিসূত্রে বাসস্থান পরিবর্তন। স্থানীয় মানুষজন যে ঠিক কেমন তখনো বুঝে উঠতে পারিনি। তাই আমার ঘরকুনো স্বভাব চর্চা বেড়ে চলছিল। এমন এক দিনে পরিচয় হল এক সহকর্মীর সাথে।
তিনি আমারই প্রতিবেশী। একদিন তার বাসায় বেড়াতে গেছি। বসার ঘরে একটা বই এর আলমারি। তাতে অনেক বই এর ভীড়ে হঠাৎ ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র’। আবারও যেন ঘোরের মধ্যে চলে যাওয়া।
বাসায় নিয়ে এলাম। এক সপ্তাহ ধরে ‘আরণ্যক’ পড়লাম। সে যে কী অনুভূতি তা বর্ণনা করা আমার সাধ্যে নেই। বিভূতিভূষণ তাঁর জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় বিহারের এক অরণ্যে কাটিয়েছেন। সেই কথাই এখানে বলা হয়েছে।
এই অরণ্য বিভূতিভূষণকে এক অপার্থিব জগতের স্বাদ দিয়েছিল। পড়তে পড়তে হারিয়ে যাই গহীন অরণ্যের নির্জনতায়। । কখনো কখনো চাঁদনী রাতে বিভূতিভূষণ ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়তেন। দৌড়ে বেড়াতেন ক্রোশের পর ক্রোশ।
কখনো বা পাহাড়ী নদীর ধারে একা একা ঘাসের উপর শুয়ে থাকতে থাকতে প্রকৃতি মাতার গভীর মমতা উপভোগ করতেন। এই অরণ্যে তিনি কিছু অলৌকিক ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেন। তার সব বর্ণনাই আরণ্যকে আছে। একবার এক পাহাড়ী গ্রামে বেড়াতে গিয়ে এক মেয়ের প্রেমে পড়ে যান তিনি। তাঁর দুঃখ হয়েছিল এই ভেবে যে, সব চাওয়া পূরণ হবার নয়।
আবার তাঁকে ফিরে যেতে হবে সেই কুৎসিত নগর সভ্যতায়। এই প্রকৃতি, প্রকৃতির আদরে গড়া এই মেয়েটিকে ফেলে চলে যেতে হবে সেই ভান-সর্বস্ব ইট পাথরের খাঁচায়। এক জায়গায় তিনি অরণ্যের অপার্থিব সৌন্দর্যে সম্মোহিত হয়ে লিখেছিলেন, “যাহাকে সংসার করিতে হইবে, তাহার এই রূপ না দেখাই ভাল। ”
আমি অবাক হয়ে ভাবি, বিভূতিভূষণ আমার মনে ছোটবেলা থেকেই এত গভীর ছাপ ফেলেছিলেন, অথচ তাঁর কোন বই আমি নিজে কিনে পড়িনি। সবই ঘটনাচক্রে পড়া।
আবার যখনই পড়া শেষ, তাঁকে কিভাবে যেন ভুলে যেতাম। কি অদ্ভুত মানুষের মন।
প্রণাম বিভূতিভূষণ। জন্মদিনে তোমাকে শত সহস্র প্রণাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।