আমি যা বিশ্বাস করি না... তা বলতেও পারি না! সফিক এহসান
(২৫ ডিসেম্বর ২০০৩)
আরেক বার ঘড়ির দিকে তাকালাম; বিকেল তিনটা সাইত্রিশ বাজে। এখান থেকে এয়ার পোর্ট কম করে হলেও পঁচিশ-ত্রিশ মিনিটের পথ। অথচ পৌঁছাতে হবে ঠিক চারটায়। তাড়াতাড়ি রাস্তার পাশে এসে হাত তুলে একটা ট্যাক্সি ক্যাব থামালাম। আমার ঠিক সামনে এসে ব্রেক করে দাঁড়ালো কালো গাড়িটি।
বেশি কথা না বলে শুধু বললাম: এয়ার পোর্ট যাব। তারপর উঠে পড়লাম গাড়িতে। মিটার লাগানো থাকায় দর কষাকষির ঝামেলা পোহাতে হলো না।
আমি উঠে দরজা লাগানোর সাথে সাথেই চলতে শুরু করলো গাড়িটি। ভেতরটা একবার দেখে নিয়ে আবার তাকালাম ঘড়ির দিকে; তিনটা একচল্লিশ বাজে।
সময় যেন ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মত; গাড়িটাও তার সাথে পারছেনা পাল্লা দিয়ে চলতে। আমি ড্রাইভারকে বললাম: প্লিজ, আরেকটু তাড়াতাড়ি চালান।
কোন রকম প্রতিবাদ না করে মৃদু একটা ঝাকুনি দিয়ে গতি বাড়িয়ে দিলো গাড়িটি। চলছে বেশ দ্রুতই, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যেন নড়তেই চাচ্ছে না গাড়ির চাকাগুলো। এরচে’ বরং হেঁটে গেলেই তাড়াতাড়ি হতো।
সময় নিয়ে যখন আমার এতো টানাটানি ঠিক সেই সময়ই হঠাৎ গতি কমাতে কমাতে থেমে গেল ট্যাক্সিটা। অবাক হয়ে বিরক্ত গলায় ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম: কী হলো, থামলেন কেন?
ড্রাইভারের হয়ে জবাব দিয়ে দিলো সামনের থেমে থাকা বিশাল গাড়ির মিছিল। ড্রাইভার শুধু সংক্ষেপে জানালো: মহাখালি ফ্লাই ওভারের কাজ চলছে বলে জ্যাম লেগেছে।
কী আর করা! ইচ্ছে হচ্ছিলো হেঁটে রওনা দেই। কিন্তু তা সম্ভব নয়।
ওদিকে রাকিব আর তপু আমার জন্য এয়ারপোর্টের সামনে অপেক্ষা করছে। আমি গিয়ে পৌছুলে তিনজনে মিলে রওয়ানা হবো। না, না বিদেশে না; সাভার স্মৃতি সৌধে। তারপর ফিরবার পথে ফেন্টাসি কিংডমে।
কিন্তু এভাবে জ্যামে পড়ে থাকলে সাভার তো দূরের কথা এয়ার পোর্ট-এ ও পৌছুতে পারবো না।
এসব কথা ভেবে যখন আমি উদ্বিগ্ন ঠিক তখন আবার চলতে লাগলো আমার ট্যাক্সিটা। অনেকগুলো বাস-ট্রাক পিছে ফেলে এগিয়ে চললাম দ্রুত গতিতে। এয়ার পোর্ট যখন পৌছুলাম তখন ঘড়িতে চারটা তেইশ বাজে। আমার বাজে বারটা! গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে চলে এলাম পূর্ব নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে।
রাকিব একটা চেয়ারে বসে আছে, চোখে মুখে বিরক্তি।
তপুকে আশপাশে দেখতে পেলাম না। রাকিব ভ্র“ কুচকে কিছু বলার আগেই আমি লাজুক হেসে বললাম: সরি দোস্ত, রিয়েলি সরি; অনেক দেরি হয়ে গেল।
উদার গলায় রাকিব বলল: কোন অসুবিধা নাই। গত বিশ মিনিটে দুইটা বারগার খেয়েছি, শুধু বিলটা দিয়ে দিলেই সবকিছু মাফ।
: এরমধ্যেই দুইটা হজম করে ফেলেছিস! সত্যি, আল্লাহ পেট একটা দিয়েছে তোকে!
: দেখ, পেট নিয়ে খোটা দিবি না।
তোরা দেরি করে আসবি আর আমি বসে বসে আঙ্গুল চুষব নাকি?
: আমি তো তবুও এলাম, তপুর তো কোন দেখাই নেই। অথচ প্ল্যান প্রোগ্রাম সব ওরই করা। সেদিন এমন ভাব করলো যেন বিকেল চারটা কেন আমরা রাজি থাকলে ভোর চারটায় এসে বসে থাকে!
: যে আসেনি তার প্যাঁচাল বাদ দে। তোর এতো দেরি হলো কেন?
আমি অজুহাতের সুরে বললাম: আর বলিস না, আটকে গিয়েছিলাম মহাখালির জ্যামে। ঐযে ফ্লাই ওভারটা হচ্ছে না, ওটার জন্য।
কবে যে কাজ শেষ হবে আল্লাই জানে।
রাকিব একটু নড়েচড়ে বসলো: যাই বলিস, দেশটার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে আজকাল। বিশেষ করে রাস্তা-ঘাটগুলোর।
আমি মুখ বাকিয়ে বললাম: উন্নতি হলেই আর কী হবে? যে দেশের জন্ম ইতিহাসেরই কোন ঠিক ঠিকানা নেই, নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে যাচ্ছে দিন দিন; সে দেশের আবার উন্নতি!
রাকিবের ভ্র“ কুচকে গেল আমার কথায়: হঠাৎ একথা বলছিস কেন? কোথায় আবার ইতিহাসের ঠিক ঠিকানা রইল না? ফ্লাই ওভারের সাথে ইতিহাসের কী সম্পর্ক?
: আমি ঠিক তা বলছি না। আচ্ছা বলতো স্বাধীনতার ঘোষক কে? জানি, চট করে বলতে পারবি না।
কারণ, উত্তরটা পাঁচ বছর পরপর চেঞ্জ হয়। আমাদের দেশের মন্ত্রিরা, রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় এলে হঠাৎ করেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়। জনগন সব জানে, তবুও তারা মুখ বুজে থাকে। এটা যেন এখন একটা ওপেন সিক্রেট! আর একারণেই বাংলাদেশ বারাবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান হয়। এই জাতির কী উন্নতি আশা করিস তুই?
এক নাগারে অনেকগুলো কথা বলে আমি থামলাম।
রাকিব একগ্লাস পানি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল: হঠাৎ এতো রেগে গেলি কেন? বাদ দে ওসব রাজনৈতিক প্যাঁচাল। অন্য কিছু বল।
আমি এক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করে বললাম: মাঝে মাঝে আমার রাগে গা জ্বলে, মাথা ঠিক থাকে না। মনে চায় সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলি। আচ্ছা যা, রাজনৈতিক প্যাঁচাল বাদ।
এখন বলতো বাংলাদেশের জাতিয় মাছ কী?
রাকিব অবাক হলো: কেন? ইলিশ!
: কিন্তু এই ইলিশই এখন এদেশের সবচেয়ে দুর্লভ প্রজাতির মাছ। বাজারে এখনও যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলো হলো জাটকা। আর কয়দিন পর তাও পাবি না। তখন বাংলাদেশের জাতিয় মাছের নাম হবে পাঙ্গাস। বাচ্চাদের তখন জাদুঘরে নিয়ে গিয়ে ইলিশ মাছ চেনাতে হবে।
একই ভাবে জাতিয় ফুল দাঁড়াবে গোলাপ কিংবা গাধা ফুল। আর জাতিয় পাখি? এক বাক্যে সবাই বলবে কাক।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে রাকিব শুরু করলো: তখনকার কথা বাদ দে। আমরা নিজেরাই তো ছোট বেলা থেকে ভুল শিখছি। যেমন ধর:
“হাট্টি মাট্টিম টিম
তারা মাঠে পাড়ে ডিম
তাদের খাড়া দু’টি শিং”
¬¬
এখানে বলেছে ‘হাট্টি মাট্টিম টিম’ এমন একটা প্রাণি যার মাথায় শিং আছে, তাও আবার একটা না দুইটা।
প্রাণিটি আবার ডিমও পারে। কিন্তু দুনিয়ায় আজও কোন শিং ওয়ালা প্রাণি পাওয়া যায়নি যারা ডিম পারে। অর্থাৎ, শিং ওয়ালা প্রাণি যে ডিম দেয় এটা সম্পূর্ণ ভুল। অথচ এই এতোটুকুন বাচ্চাদের শেখানো হচ্ছে এই আজব চিড়িয়ার কেচ্ছা!
আমি বিরক্ত গলায় বললাম: যা জানিস না তা নিয়ে সমালোচনা করবি না। ‘হাট্টি মাট্টিম টিম’ হচ্ছে শামুক।
আমার কথা শেষ হতেই রাকিব হা-হা করে হেসে উঠলো: তুই শামুকের মাথায় শিং দেখলি কোথায়। আমি তো দেখি বেচারার পুরো মাথাতেই টাক। নাকি কোন দৈত্য শামুকের কথা বলছিস, যেগুলোর মাথায় আলিফ লায়লার দৈত্যদের মত শিং থাকে?
আমি গম্ভীর স্বরে বললাম: আমি না জেনে বলছি না। তুই যেটাকে মাথা বোঝাচ্ছিস সেটা আসলে মাথা না; ওটা শামুকের খোলস। মাথা থাকে খোলসের ভেতরে।
সেখানে সত্যি সত্যিই দুইটা শুড় আছে যেটাকে শিং এর মতই দেখায়। আর শামুক যে বর্ষাকালে মাঠের হাঁটু পানিতে ডিম পাড়ে তা নিশ্চয়ই জানিস?
আমার কথার প্রতিবাদ করতে গিয়েও রাকিব থেমে গেল। মাথা ঝাকিয়ে বলল: তাতো বুঝলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি ইলিশ আর দোয়েলের জায়গায় পাঙ্গাস আর কাক এসে জুটে তাহলে আমাদের কী করার আছে?
: অনেক কিছুই করতে পারি। ইচ্ছা করলেই আমরা জাটকা নিধন বন্ধ করতে পারি, পশু-পাখি শিকার রোধ করতে পারি।
কিন্তু আমরা তার কিছুই করবো না। কারণ, সবাই ভদ্রলোক; নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। রবী ঠাকুর বলেছেন না-
“ভদ্র মোরা শান্ত বড়ো,
পোষ- মানা এই প্রাণ
বোতাম- আটা জামার নিচে
শান্তিতে শয়ান। ”
ফুয়াদ আমাকে বাধা দিয়ে বলল: তোর এই কথা ঠিক না। ইদানিং কিন্তু জাটকা নিধন বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে।
পদ্মা নদীতে...
আমি ওর কথা থামিয়ে দিয়ে বললাম: এখানেও দুর্নীতি আছে। সেদিন টিভিতে দেখলাম পদ্মা নদীতে জেলেদের সাক্ষাতকার নিচ্ছে। বছরে একবার করে পুলিশকে সালামি দিলে নাকি জাটকা ধরা যায়, কোন অসুবিধা হয় না! এখন তুই বল আমরা যাব কোথায়?
আমার কথা শেষ হতে না হতেই রাকিব ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
অবাক হয়ে বললাম: যাচ্ছিস কোথায়?
রাকিব গম্ভীরভাবে বলল: একশনে!
তারপর গটগট করে বেরিয়ে গেল। আমি বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
ওর পেছন পেছন আমিও যাব নাকি এখানেই বসে অপেক্ষা করব বুঝতে পারলাম না। মিনিট পাঁচেক পর অধৈর্য হয়ে উঠতে যাব, ঠিক তখন ফিরে এলো।
: কোথায় গিয়েছিলি? আবার প্রশ্ন করলাম।
রাকিব চেহারায় কৃত্তিম গম্ভীরতা ফুটিয়ে বলল: বললাম না একবার, একশনে! কাল সকাল থেকে দেখবি ‘জাতীয়’ কোন কিছুরই আর অভাব নেই। নদী ভরা ইলিশ গিজ গিজ করছে।
কাঁঠাল গাছের ডালে ডালে দোয়েল পাখি ডাকবে, প্রতিটি পুকুর ভরে থাকবে শাপলা ফুলে। সুন্দর বন ভরে গেছে বাঘে; তাও আবার যে সে বাঘ না- রিতিমত রয়েল বেঙ্গল টাইগার!
আমি বিরক্তি না ঢেকে বললাম: দেখ, সব সময় রসিকতা ভাল লাগে না।
রাকিব ভ্র“ নাচিয়ে বলল: ঘড়ি দেখ!
আমি ঘড়ি দেখলাম, পাঁচটা সাতাশ বাজে। হায় হায়, আসলাম ঘুরতে যাব বলে আর এসে কিনা এখানে বকবক করছি!
রাকিব বলল: গিয়েছিলাম তপুকে ফোন করতে। ওর বড় আপু ফোন ধরে বলল: সকাল দশটার দিকে ওর চাচার সাথে চিটাগাং গেছে।
হঠাৎ পরিকল্পনা, হঠাৎ করেই চলে গেছে। সাভারে যাবার কথা নাকি কাউকে কিছু বলেই নি।
: তাহলে এখন?
: তাহলে এখন মানে? আমরা কী এখনও ফিডার খাই নাকি? তপু না আসলে নাই, আমরাই চলে যাব।
: অনেক দেরি হয়ে গেছে। শুধু স্মৃতি সৌধে যাব।
: দেখ, সব সময় দেশপ্রেম দেখাবি না। সন্ধ্যা বেলা স্মৃতি সৌধ গিয়ে কী করবি। তারচে’ চল ফ্যান্টাসি যাই। কনসার্ট-টনসার্ট কী হয় দেখে আসি।
আমি কোন প্রতিবাদ না করে বাধ্য ছেলের মত ওর পেছন পেছন বেরিয়ে এলাম।
বারগারের বিল দেবার সময় রাকিব বলল: তপুকে পেয়ে নিই। শালাকে হেভি একটা সাইজ দিতে হবে।
বাস কাউন্টারে আমরা দুইটা জামগড়ার টিকিট কাটলাম। জায়গাটার নাম কয়েকদিন পর হয়তো আর জামগড়া থাকবে না, ফ্যান্টাসিই হয়ে যাবে। বাসে উঠে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা জাতীয়তা বিষয়ক কোন কথা আর উঠালাম না।
কিন্তু সেই জিনিষই আবার আমাদের পথ আগলে দাঁড়ালো। হঠাৎ গতি কমিয়ে থেমে গেল আমাদের বাসটা। দেখলাম বাসের সামনে দু'টো মহিষের গাড়ি পড়ে আছে। মহিষ নেই। রাস্তা প্রায় পুরোটাই আটকে আছে।
সাভারে মহিষের গাড়ি প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু এভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায় না। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম একটির চাকা খুলে গেছে। আরেকটার সামনের অংশ নেই। শুনলাম মালবাহি এক ট্রাকের সাথে সংঘর্ষে এই অবস্থা।
এ দু'টোকে সরানোর জন্য তোড়জোর চলছে। আর এজন্যেই এই জ্যামের সৃষ্টি।
রাকিব আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল: নে, তোর ঐতিহ্যবাহি মহিষের গাড়ি। রাস্তার মধ্যে শুয়ে পড়ে ঐতিহ্যের নিদর্শন দেখাচ্ছে।
আমি কাচুমাচু করে বললাম: ওরই বা কী দোষ? তোর এই পিচঢালা রাস্তার বড় বড় বাস-ট্রাকের সাথে কী আর পারে? তাছাড়া আমিতো বলিনি যে সেই আদিম্যতাকে ধরে রাখতে হবে।
আমি বলেছি বাংলাদেশের প্রাণটাকে ধরে রাখতে। যাতে করে আধুনিকতার দৃষ্টিতেও এদেশটাকে আলাদা করে চেনা যায়।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে তাকালাম রাকিবের দিকে। গম্ভীর হয়ে কী যেন ভাবছে ও। মনে মনে ভাবলাম বেশি বিজ্ঞের মত হয়ে গেলো নাতো কথাগুলো?
মাথা দোলাতে দোলাতে রাকিব বলল: তুই ঠিকই বলেছিস; আমাদের এই জাতীয়তাটাকে ধরে রাখা জরুরি।
আর তা করার জন্য সরকারের একার চেষ্টাই যথেষ্ট নয়। এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। সব ক’জন সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিককে।
তারা আসবে কি?
----------০----------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।