আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গুণ্ডাতন্ত্র জিন্দাবাদ!

বসে আছি পথ চেয়ে.... হতাশাবাদীরা যতই হা-হুতাশ করুক, আমাদের দেশ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বিস্ময়করভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভেদ, হানাহানি, সংকীর্ণতা, দুর্নীতি, দুঃশাসন, হরতাল প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমাদের সমকক্ষ দেশ খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে গুণ্ডামি ও সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে আমাদের উন্নতি ঈর্ষণীয়। পেশিশক্তির প্রয়োগ, যুক্তির জোর নয় জোরের যুক্তি প্রতিষ্ঠা, ভয় দেখিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে একজনকে নাজেহাল করাই হচ্ছে সন্ত্রাস বা গুণ্ডামি। গুণ্ডামি বা সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসীদের এমন উদার লীলাভূমি পৃথিবীতে খুঁজে দ্বিতীয়টি আর মিলবে বলে মনে হয় না।

এ দেশের সর্বত্র এখন সন্ত্রাসীদের অপ্রতিরোধ্য দাপট। প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় কোনো না কোনো সন্ত্রাসী বাহাদুরের কীর্তি-কলাপের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তাদের বীরত্ব, তাদের অসাধারণত্ব, জিরো থেকে হিরো হওয়ার দুর্দান্ত সব গল্প। রূপকথার নায়ক বলুন, অলৌকিক মানুষ বলুন, আর মহাপুরুষই বলুন একালে গুণ্ডাবাহাদুররাই সব কিছু। রাজধানীতে, বন্দরনগরীতে, জেলা শহরে, গ্রামগঞ্জে সবখানে গুণ্ডাদেরই জয়জয়কার।

গুণ্ডাপাণ্ডদের এমন ব্যাপক ও বিশাল তৎপরতা অন্য কোন দেশে দেখা যায় না। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে মুসলিম লীগের সময়ে গুণ্ডামি কিছুটা প্রশ্রয় পেয়েছিল। আইয়ুব খানের শাসনামলে গুণ্ডাদের আবির্ভাব মাঝে মধ্যে দেখা গেছে। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্রমেই গুণ্ডামি ও গুণ্ডাবাজি বিকশিত হয়েছে। আমাদের সমাজে গুণ্ডামি উল্লেখযোগ্যহারে বাড়তে থাকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর।

একদল খুনি সন্ত্রাসী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়ার পরই অপ্রতিহত গতিতে সন্ত্রাস শুরু হয়। এর পরের ইতিহাস যেন সন্ত্রাস আর গুণ্ডামিরই ইতিহাস। সন্ত্রাসী-গুণ্ডারাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজের সবকিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। আইনের শাসনের পরিবর্তে দেশে কায়েম হয় শক্তি আর জুলুমের শাসন। বন্দুকের নল ক্ষমতায় থাকার একমাত্র ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে গুণ্ডা বাহিনিকে আপাত উচ্ছেদ করা সম্ভব হলেও তাদের পরোক্ষ থাবা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়নি। বরং গুণ্ডামি বা শক্তি প্রয়োগের নীতি সমাজের সবখানে ছড়িয়ে গেছে। বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গুণ্ডারা এখন কর্মী, সন্ত্রাসী, ক্যাডার, ইত্যাদি নানা নামে প্রকাশিত ও বিকশিত হয়েছে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত গুণ্ডাদের বাহুবল ব্যবহারের ব্যাপারে একটি চরিত্রগত পার্থক্য ছিল। সমাজে তাদের ইমেজও ছিল নেতিবাচক।

গুণ্ডারা গুণ্ডা হিসেবেই চিহ্নিত হতো, তাদের মাথায় তুলে কেউ নাচত না। তারা বিচরণ করত সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে। রাজনৈতিক দলগুলো কালেভদ্রে হয়তো তাদের ব্যবহার করত। কিন্তু নায়কের ভূমিকায় গুণ্ডাদের ভাবাই যেত না। রাজনীতি, বিশেষ করে বাংলাদেশে, আদর্শের ব্যাপার।

চিন্তা-তিতিক্ষা ত্যাগের ফলশ্রুতি। গুণ্ডারা মুখ নিচু করে কোণে বসে থাকত, মঞ্চের ত্রিসীমানায়ও আসবার এক্তেয়ার তাদের ছিল না। দেশে মস্ত যা বিপ্লব ঘটে গেছে তা এ ব্যাপারে। এখন গুণ্ডাদের গুণ্ডা বলার মতো সাহস সবাই হারিয়ে ফেলেছে। তারা এখন মন্ত্রীর হাতা, নেতানেত্রীর আশ্রয়।

দলের দায়িত্বে সন্ত্রাসী, দলের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বেও তারাই। তারা বক্তৃতা দিচ্ছে, কেউ কেউ নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে এবং অনেকে নির্বাচিতও হচ্ছে। টোকাই, ভবঘুরে থেকে সন্ত্রাসী, গুণ্ডাবাহাদুর। ছাত্রনেতা, যুব সংগঠনের নেতা। এমনকি জাতীয় নেতা পর্যন্ত।

কলেজে কোন কোন ছেলেমেয়ে ভর্তি হতে পারবে আর কারা বাতিল হবে, তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। কে কোথায় ব্যবসা করতে পারবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। ঠিকাদারির কাজ কে পাবে সেটা ঠিক করে দিচ্ছে। কোন প্রতিষ্ঠানে কে শিক্ষক হবে, কে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পাবে তাও স্থির করছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, অপহরণ, খুন, ধর্ষণ সব কিছুর মালিক ও নিয়ন্ত্রক আজ তারা।

এই গুণ্ডাবাহাদুররা গণতন্ত্রের সৈনিক সেজে বুলি কপচাচ্ছে; মাননীয় নেতানেত্রীদের সঙ্গে ছবি তুলছে, সে ছবি পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। তারপর এই তারাই নিরীহ লোকজনের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, জমি দখল করছে, ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করছে, অপহরণ করছে, ধর্ষণ করছে, নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছে, প্রতিপক্ষের একজন দুইজন রাজনৈতিক কর্মীকে অবলীলায় নিজের হাতে খুন করছে, দলের মধ্যে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলে তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করছে। নীতি আদর্শ ঝেড়ে ফেলে বর্তমানে চলছে শক্তি দিয়ে সব কিছু দখল করার প্রস্তুতি। প্রশাসন দখল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখল, রাজপথ দখল, আইন বিভাগ দখল, বিচার বিভাগ দখল। এমনকি ভোটার এবং ভোটকেন্দ্র দখলেরও আয়োজন চলছে।

জয় করে কিংবা যোগ্যতা দিয়ে কাছে টানার কোনো প্রচেষ্টা নেই, ভয় দেখিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে বশে রাখার আয়োজন সর্বত্র। নীতি-নৈতিকতা, আইন, আইনের শাসনে কোনো আস্থা নেই। তাই তো আইনের আওতায় গড়ে তোলা হয়েছে গুণ্ডা বাহিনী-র‌্যাব। সন্ত্রাস দমনের নামে তারা গুণ্ডামি করছে। আইন বহির্ভূতভাবে মানুষ হত্যা করছে।

একদিকে পেশাদার সন্ত্রাসীদের দাপট, একই সঙ্গে আইনের তকমাধারী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব। দুয়ে মিলে শক্তির তথা গুণ্ডামিরই জয়জয়কার। ক্ষমতাসীনরা বর্তমানে সন্ত্রাস ও গুণ্ডামি বিকাশের খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। দলের নেতাকর্মী আর চোর ডাকাত ছিনতাইকারী সমার্থক হয়ে গেছে। অপরাধীরা দলে ঠাঁই পাচ্ছে।

আর দলে ঠাঁই পেয়েই তারা বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। যারা সীমা অতিক্রম করছে, র‌্যাবের সাহায্য নিয়ে তাদের পরপারে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। র‌্যাব সন্ত্রাসী তৈরির যে মেশিন সেই মেশিনের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েছে। এদিকে প্রোডাকশন বেশি হয়ে গেলে, সাপ্লাই বাড়িয়ে দিতে হয়। এজন্য মাঝে মধ্যে গুদাম খালি করতে হয়।

এই গুদাম খালির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে র‌্যাবকে। ক্রসফায়ারে দু’চারজন কমলে সঙ্গে সঙ্গে সে শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যাচ্ছে। কারণ সন্ত্রাসী তৈরির মেশিন সারাক্ষণই পূর্ণ শক্তিতে কাজ করে যাচ্ছে। প্রচলিত গুণ্ডাতন্ত্রে এখন চারদিকে অন্যায়, জুলুম, বিশৃঙ্খলা। আইনের শাসনের পরিবর্তে শক্তির শাসন, জোরের শাসন।

দুর্নীতি ছাড়া সমাজে অন্য কোন স্বীকৃত নীতি নেই। এ অবস্থায় সন্ত্রাসই ভরসা, গুণ্ডামিই শেষ আশ্রয়। পুলিশ-প্রশাসনকেও গুণ্ডা বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। গুণ্ডামি প্রতিরোধের নামে, সন্ত্রাস দমনের নামে, তাদেরও গু-ামি ও সন্ত্রাসের পরিপূর্ণ অধিকার দেয়া হয়েছে। সন্ত্রাসীরা এখন পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে পরিকল্পনা করে যেন অভিযান পরিচালনা করছে।

সব কিছুই হচ্ছে পরিকল্পনা মতো, ছক বাঁধা নিয়মে। কে যে কখন গুণ্ডা হিসেবে চিহ্নিত হবেন, আর কে জননেতা তা আগে থাকতে ঠাহর করা যাচ্ছে না। তবে গুণ্ডারা উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জন করছে। অনেক গুণ্ডাই এমপি হয়েছেন, জননেতা বনে গেছেন। এই ধারা অব্যাহত থাকলে গুণ্ডারা আগামীতে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

অবশ্য গুণ্ডাদের নিয়ে বেশি কথা বলে লাভ নেই। ইদানীং ছাত্ররা গুণ্ডামি করছে, শিক্ষকরাও করছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা যেভাবে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, গুণ্ডামি শুরু করেছেন, মন্ত্রীরা যেভাবে গুণ্ডা এবং গুণ্ডামিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তাতে করে গুণ্ডাদের নিয়ে বেশি কিছু বলাটা দুঃসাহস বা বাড়াবাড়ি হবে। আর দুঃসাহসে দুঃখই বাড়ে। তার চেয়ে ভাল গুণ্ডা ও গুণ্ডামির সঙ্গে আপস করে ফেলা।

যাদের ঘাড়ে দেশ চালানোর দায়িত্ব তারাই যদি পরম মমতায় ও শ্রদ্ধায় গুণ্ডাশাহীকে মাথায় তুলে নাচে তাহলে আমাদের আর কিইবা বলার আছে? কাজেই আসুন, আমরা গুণ্ডাদের কাছে নাকে খত্ দিই। গুণ্ডাদের বন্দনায় মেতে উঠি। সাহস নয়, সততা নয়, ভীরু কাপুরুষতা আর নিজেদেরকে সন্ত্রাসী-গুণ্ডা ও ক্ষমতাসীনদের পায়ের তলায় সঁপে দিতে মনস্থির করি। প্রস্তুত হই। সন্ত্রাসবাদ জিন্দাবাদ।

মস্তানতন্ত্র জিন্দাবাদ। গুণ্ডারাজ চিরজীবী হোক! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.