আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অল্পগল্পঃ বাকা চাঁদ

আপাতত ঘুরপাক খাচ্ছি! চাঁদ কখনো বাকা হয় নাকি। এই বলে হাসুনি বেগম হাসা শুরু করলো। যাচ্ছিলাম কক্সবাজার। বউটা মেলা দিন থেকে ঘ্যানর ঘ্যানর করে। আমারে সাগর দেখাও।

সেন্টমার্টিন দেখাও। সাগরের ঢেউ দেখাও। ইত্যাকার দেখাদেখির আবদার থেকে এই ভ্রমণের প্রারম্ভিকা। এমনিতেই হল্লার দেশে খেয়ে পড়ে বাঁচার জো নেই। তার উপর কয়েক দিন পরপর বাড়তি বিল।

এ বিল ও বিল সে বিল। বিল গুনতে গুনতে হাতে আর টাকা পয়সার কোন বালাই থাকে না। যা থাকে ঋণের বোঝা। একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে পাহাড়াকার ধারণ করেছে। এই পাহাড় সরিয়ে ঘুরতে বের হওয়া নিশ্চয়ই গরীবের হাতি দর্শন।

বলছিলাম হাসুনি বেগমের কথা। বউটা আমার অল্পতেই হাসে কাঁদে। অল্পতেই তুষ্ট। বিয়ের পর তেমন ঘুরাঘুরি করাতে পারিনি। এই নিয়ে মাঝে মাঝে মনটা ভীষন খারাপ হয়ে যায়।

মানুষ তো বিয়ের পর বউকে নিয়ে কত দেশেই না ঘুরতে যায়। থাইল্যান্ড ফুকেট সিঙ্গাপুর তো কথায় কথায় চলে যায়। আমার ভাগ্যে দেশের এক কোনার একটা জায়গাও দর্শনের সৌভাগ্য হয়না। এবার হুট করে একটা বাড়তি টাকা পাওয়াতে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করতেই এই প্রয়াশ। যাচ্ছিলাম সেন্টমার্টিন।

হাসুনি বেগমের অনেক দিনের শখ সেন্টমার্টিন ঘুরতে যাবে। বিয়ের দু বছরেও তাকে সেই সপ্তাচার্যের এক আশ্চর্য ঘুরানোর সৌভাগ্য হয়নি। টিভিতে দেখে দেখে আর বিয়ের তৃতীয় বছরে পা রেখে সেই সৌভাগ্যের পদ উন্মোচন হলো। সাথে এক নতুন অতিথি। এই অতিথি পৃথিবীতে আগমনের আগেই বউটা দেখাদেখির ঝামেলা নিস্পত্তি করতে চায়।

অনেক দিন আগে এক নিঃসঙ্গ ঝিঝি ডাকা রাতে শর্ত দিয়েছিল সেন্টমার্টিন নিতে না পারলে কোন দিনই বাচ্চা কাচ্চা নিবে না। শেষমেষ একটা দুর্ঘটনা হয়ে, কোন বাচবিচারের তোয়াক্কা না করেই যেন একটা বাবু পৃথিবীতে আসতে চায়। বউ উপায়ান্তর না দেখে জেদী বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনার জন্য ব্যাকুল হয়ে যায়। কনসিভ করার খুব বেশী দিন হয়নি। তাই যাতায়াতে তেমন বড় ধরনের কোন সমস্যা হওয়ার কথা না।

দুষ্টুটাকে সাথে করেই সেন্টমার্টিনে যাচ্ছি। বাসের মধ্যে পরিবেশটা গুমোট হয়ে আছে। শীতকাল বলে অনেকেই এর মধ্যে বাসের কম্বল মুড়ি দিয়ে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আমরা দুজন রাত জাগা পাখি সেই শত নাক ডাকার ভীরে চাপা পড়ে অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। লোকজন এক দুটা দিনের জন্য ঘুরতে যাবে তার মধ্যেও এত ঘুম কি দরকার! সারা জীবন তো ঘুমিয়েই কাটালো।

দুই দিন পর মরে গেলে তো মহাকালব্যাপী আর চোখই খুলবে না। বাস জার্নির সময় জানালার পাশের সিট আমার অতি আবশ্যক। সেই ছোটকাল থেকে এই অভ্যাস টা জারি আছে। হাসুনি বেগম জীবন সঙ্গী হওয়ার পর তাকে সেই প্রিয় সিটটা ছেড়ে দিতে হয়েছে। কি করবো এছাড়া অন্য কোন দ্বিতীয় উপায় আমার জানা নেই।

তা নাহলে জার্নির ধকলে কাহিল হয়ে গায়ের উপর এসে উপচে পড়বে। ডান পাশের জানালা হালকা খুলে দিলাম। শিরশির করে ঠান্ডা বাতাস মুখের উপর এসে আঘাত করছে। আকাশে একটা ঝকঝকে চাঁদ উঠেছে। মনে হয় চিনামাটির আস্ত থালা।

এর উপর পাটশাক ছড়িয়ে আস্ত আধা কেজী ওজনের একটা আলুভর্তা মেখে মেখে পান্তা ভাত খাওয়া যাবে। হাহাহা। হঠাৎ এই শীতের রাতে গরমের আইটেমের কথা মনে পড়লো কেন! চাঁদ নিয়ে কবি সাহিত্যিক গণ যে ধুন্ধুমার কান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানে আমার আবার ভাতের থাল! মনে পড়ে ছোট থাকতে আব্বা মারা যাওয়ার পর আমাদের সংসারে অনেক টানা হেচড়া শুরু হয়। একটা স্বচ্ছল পরিবার কিভাবে ধূপ করে অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারে আব্বার হঠাৎ বিয়োগ না হলে জানতে পারতাম না। উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন বাবা।

আমাদের যে টুকটাক আবাদী জমি ছিল। তিনি সেগুলো দেখাশুনা করতেন। সাথে ছোটখাট একটা ব্যবসা করতেন। তাই দিয়ে আমাদের সংসারটা দিব্যি চলতো। বড় ভাই তখন এইচ এস সিতে পড়তো।

আব্বা মারা যাওয়ার পর ভারী বিপাকে পড়ি আমরা। বড় ভাইয়ের পড়াশুনা চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। একবেলা খেয়ে না খেয়ে আমাদের সংসার চলতে থাকে। না থাক! আমার ভাঙ্গা থালের গল্পঅব্দি পৌঁছাতে পৌছাঁতে চাঁদের রুপটাই ক্ষয়ে যাবে এই রাতে। বাকী সব যাত্রীদের কর্ণে প্রবেশ না করে এমন গোপনীয়তা বজায় রেখে ফিসফিস করে গান শুরু করলাম।

এই রাত তোমার আমার। এই চাঁদ তোমার আমার---। বউ প্রশংসায় পঞ্চমূখ। আমি জানি আমার কন্ঠ সে এক বাজখাই কাক-কর্কশ কন্ঠ। তবু বউয়ের সুরেলা কন্ঠে প্রশংসা খারাপ লাগছে না।

হাহাহা। মাঝে মাঝে সুন্দরী রমনীদের প্রশংসা অন্য এক মাধূর্য এনে দিতে পারে জীবনে। এই যেমন আমার কন্ঠটা একটু সুর পেয়েছে বোধয়। শ্রোতা একান্ত একজন বিধায় মতাদ্বৈত হওয়ার ঝামেলা কম। সেও আমার সাথে তাল মিলিয়ে গাওয়া শুরু করলো।

আশেপাশে চেয়ে আছি কোন কুম্ভকর্ণের আবার ঘুমে ব্যাত্যয় ঘটে কিনা। নাহ! তেমন কারো কোন নড়চড় দেখা যায় না। ওরা ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। কি গো! তোমার কন্ঠ দেখি দিনকে দিন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হয়ে যাচ্ছে। বউয়ের এহেন প্রশংসায় আর হাসি আটকানো গেল না।

বললাম সব ঐ বাঁকা চাঁদের প্রশ্বস্তি। এবার তাকেও থামানো গেল না। চাঁদ কখনো বাঁকা হয় নাকি। বলে খিলখিল করে হাসা শুরু করলো। হাসি থামতেই চায়না।

একটু পরপর দমকা হাওয়ার মত দমকে দমকে তার হাসি উপচে পড়ছে। সে ভূগোল বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী বিধায় অকাট্য যুক্তি নাজিল করা শুরু করলো। সাথে হাসির বন্যা তো আছেই। আশেপাশের ঘুমপ্রিয় ভাই বেরাদার গণ কেউ কেউ চোখ মেলে সামান্য ভ্রু কুচকে আবারও ঘুমের সাগরে তলিয়ে গেল। কেউবা তলাতে ব্যস্ত।

পেছনের সিটের এক খোকাবাবুর দাঁত উন্মোচিত হয়ে আছে। বাগসবানি কার্টুনের খরগোশটার মত দুটো দাঁত বের হয়ে আছে। সাত আট বছর বয়স হবে। পুরনো দাঁত পড়ে নতুন দাঁত গজানো শুরু হয়ে গেছে। সেই কার্টুনটার মত গাজর খেতে পারে কি না জানি না।

তবে বেশ হাসতে জানে। ঘুম থেকে জেগে কোন কিছু না বুঝেই দাঁত কেলিয়ে হাসা শুরু করেছে। তার দাঁত দেখে আমাদের দুর্দশায় কিছুটা সান্তনার সুর খুঁজে পেলাম। ততক্ষণে হাসুনি বেগমের হাসিও কিছুটা প্রশমিত হয়ে এসেছে। একটা ঝড়ের পর শান্ত আকাশের মত চেহারা হয়েছে।

চাঁদের আলো মুখের মধ্যে পড়ে একটা অদ্ভুত মায়াবী দৃষ্টি ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখে। সেই মুখের দিকে যেন অনন্তকাল চেয়ে আছি--- পরের দিন সকাল দশটার দিকে আমরা টেকনাফে জাহাজে উঠে পড়লাম। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের নীল জলরাশি দেখছি। হাসুনি বেগম সমুদ্র দেখে যেন কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়লো। সংসার সমুদ্রে থৈ থৈ অভাব অনুযোগের মধ্যে সাঁতরাতে সাঁতরাতে যখন সে ক্লান্ত ঠিক সেই সময়ে সে এই সমুদ্র দর্শনে এলো।

কিছুক্ষণ পর আমাদের সামনে সেই বাগসবানি খোকাবাবুটার আগমন ঘটলো। দাঁত দুটো দেখিয়ে তার পরিচয়টা আরও প্রকটভাবে প্রকাশ করলো। মানব শিশুদের এই হাসির কোন তুলনা হয় না। শিশুদের এই নিস্পাপ হাসি শত কোটি টাকা দিয়েও কিনতে পাওয়া যায় না। এক অমূল্য সম্পদ।

এক সময় সে যখন জীবনকে জানতে শিখবে তখন সেই হাসি একদিন হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাবে। আমার হাসুনি বেগম বোধয় এই ব্যাপারটাকে জয় করেছে। সে দুঃখকে, জীবন কে জয় করেছে হাসি দিয়ে। কতজনাই পারে এরকম নির্মলভাবে হাসতে। খোকা বাবুটার নাম মুশফিক।

সে হাসুনি বেগমের শিশুপ্রীতির কারণে খুব অল্পতেই বন্ধু হয়ে গেল। একটু পর মুশফিক পাকা ফটোগ্রফারের মত আমাদের যুগল ফটো বন্ধী করলো ডিজিটাল ক্যামেরায়। খুব সহজেই সে আমাদের অনেক কাছের মানুষ হয়ে গেল যেন। পুরো ট্যুরে সে আমাদের খুব কাছাকাছিই থাকলো। সেন্টমার্টিন পৌঁছে সুন্দর একটা কটেজে আমাদের জায়গা হলো।

অবসর ট্যুরের বেশীর ভাগ যাত্রীই এই কটেজে থাকলো। বাকীদের কাছাকাছি আর একটা কটেজে থাকার ব্যবস্থা হলো। মুশফিক এবং তার আব্বু আম্মু আমাদের রুমের পাশের রুমেরই বরাদ্দ পেলেন। তাদেরকে কাছাকাছি পেয়ে ভালই হলো। এই দুইদিনে ওর আব্বু আম্মুর সাথেও বেশ খাতির হয়ে গেল।

তাদের সাথে কথোপকথনে যা জানলাম। মুশফিক তাদের অনেক আদরের ধন। অনেক চাওয়ার পাওয়া। অনেক সাধ্য সাধনায় দীর্ঘ দশ বছর পর তার মায়ের কোলে তার আগমন ঘটে। আমরা তো না চাইতেই যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি।

সেই তুলনায় অনেক ভাগ্যবান। এই দুইদিনে সেন্টমার্টিনের এপাড় থেকে ওপাড়; ছেঁড়া দ্বীপ তন্নতন্ন করে ছুঁটেছি আমরা। সাথে মুশফিক তো ছিলই। এই সর্বদা হাসিমুখো শিশুটা যেন আমাদের আনন্দটা কয়েক গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু শেষ দিন এসে অপ্রত্যাশিত একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল।

হাসুনি বেগম আর মুশফিক একটা প্রবালের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছবি তোলার জন্য রেডি। ক্যামেরায় ক্লিক করবো এমন সময় মুশফিক ধপাস করে পিছলে পড়লো। সাগরের পানিতে পড়ে যাওয়ার আগেই হাসুনি বেগম তাকে ধরে ফেললো। ধরতে গিয়ে সে পানিতে পড়ে গেছে।

হাসুনি বেগম সাঁতার জানতো বলে এ যাত্রায় রক্ষা। মুশফিকের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। হুট করে লাফ দেয়াতে হাসুনি বেগম একটু আহত হয়েছে। সেই একটু ক্ষতি আস্তে আস্তে প্রকান্ড আকার ধারণ করেছে। তার পেটের বাবুটা নষ্ট হয়ে গেছে।

আমাদের স্বপ্নটা আমাদের চোখের সামনেই এমনভাবে ধূলিসাৎ হবে কল্পনাও করতে পারিনি। সেন্টমার্টিন থেকে এক প্রবাল প্রচীরের মত জমাটবাঁধা দুঃখ নিয়ে ফিরে আসলাম। এই ঘটনার দু বছর হলো। আমার বউ এখন হাসতে ভুলে গেছে। হাসুনি বেগমকে এক প্রকার বাধ্য হয়েই আসল নাম রাজিয়া সুলতানা বলে ডাকি।

মুশফিকের বাবা মা দশ বছর অপেক্ষা করেছেন। আমরা না হলে আরও একটু বেশীই অপেক্ষা করবো। তবু স্বপ্ন দেখতে আমাদের সৃষ্টি দেখতে পিছপা হবো না। কেননা স্বপ্ন বয়ে বয়েই তো জীবন গাড়ির চাকা চলছে। সে গাড়ীতে হাজারটা নয় একটা স্বপ্নই তুলে দিয়েছি।

জানি সে একদিন বাস্তব হয়ে ফিরে আসবে। আবারও রাজিয়া সুলতানা হাসি উজ্জ্বলতা উচ্ছলতায় হাসুনি বেগম হবে। ছবিঃ নিজস্ব এ্যালবাম।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.