মিথ্যেবাদী নই, প্রেমিক আমি ! “ইয়াহুউউউউউ! অবশেষে আমার এতদিনের সাধনা সফল হতে চলেছে”। আমার আনন্দ যেন বাধ ভেঙে গেল। পাশেই বসে আছে আমার গবেষণার সার্বক্ষণিক সেক্রেটারি অরনি। তার চোখ মুখ দেখে আনন্দিত মনে হচ্ছে না। “কি ব্যাপার অরনি? তুমি খুশি হওনি?”
“আমার ভয় করছে স্যার”।
“ভয়ের কি আছে বোকা মেয়ে? অবশেষে আমরা মানুষ আর পশুর কম্বিনেশনে এক নতুন প্রজাতির প্রাণী তৈরিতে সক্ষম হতে চলেছি”।
“সত্যিই কি আমরা পারব স্যার?” অরনির গলায় অনিশ্চয়তার সুর।
“মূর্খের মত কথা বলছ কেন? তুমি ল্যাবের রিপোর্ট দেখছ না? আমরা এখানে বাঘের জিন ব্যাবহার করেছি। নতুন যে প্রাণীটি তৈরি হবে সে দেখতে হবে মানুষের মতই কিন্তু গায়ে থাকবে বাঘের জোর”।
“কিন্তু স্যার...আমার একটা আশঙ্কা হচ্ছে!”
“কি সেটা?”
“যদি সেই মানুষটি বাঘের জোরের পাশাপাশি বাঘের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো পেয়ে যায়?”
“তুমি নিশ্চিত থাক।
অত কাঁচা কাজ আমি করিনা। নতুন প্রাণীটির মধ্যে সব মানবীয় গুণাবলী বিদ্যমান থাকবে। শুধু গায়ের জোর বেড়ে যাবে দশ গুন”।
“এখন কি করতে চান সার?”
“এবার আমরা আমাদের এই ফর্মুলা একজন মানুষের ওপর প্রয়োগ করব। একজন মানুষের শরীরে এই ওষুধ প্রবেশ করালেই বুঝতে পারব আমরা কতটা সফল হয়েছি”।
অরনির শরীর শিউরে উঠল। “কেউ কি এই পরীক্ষার গিনিপিগ হতে রাজি হবে, সার?”
“আর কাউকে এখানে টানব কেন?” আমি মৃদু হাসলাম। “আমি তো তোমার উপর গবেষণাটা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছি”।
অরনির চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক! “না...সার, আমি চাইনা!”
“কেন চাওনা? তুমি কি বুঝতে পারছনা যে তুমি একটা ইতিহাসের সাক্ষী হতে চলেছ? পৃথিবীর প্রথম বাঘমানবী”।
“না, স্যার।
আমি এই শক্তি চাইনা!”
“দেখ! আমি যখন এই ফর্মুলা কোনও কোম্পানির কাছে বেঁচে দেব তারা তখন কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে মানুষের কাছে এই শক্তি বিক্রি করবে। সেই জিনিসটা তুমি ফ্রি ফ্রি পেয়ে যাচ্ছ”।
“আমি চাইনা স্যার!” অরনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
“জানতাম তুমি এমনি রাজি হবেনা”। আমি দু হাতে তালি বাজালাম।
দু পাশ থেকে এগিয়ে এল সাজ্জাদ ও করিম। ওরাও আমার গবেষণার সেক্রেটারি। সাজ্জাদ পেছন থেকে অনিতাকে জাপটে ধরল। অরনি চিৎকার করতে যাচ্ছিল, তার আগেই করিম তার নাকে মুখে একটা রুমাল চেপে ধরল। ক্লোরোফম মেশানো ছিল।
জ্ঞান হারাল অরনি.....
****
এই এলাকাটা অদ্ভুত! দুপুর বেলাতেও রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পরে। শহর থেকে একটু দূরে এই যায়গাটি আমি বেছে নিয়েছি নিরিবিলিতে গবেষণা করার জন্য। ল্যাবরেটরিটা এখনও সম্পূর্ণ গড়ে তুলতে পারিনি। তবে শিঘ্রিই হয়ে যাবে আশা করছি।
নির্জন রাস্তা দিয়ে হাটতে গিয়ে গা ছমছম করছে।
আমি দ্রুত পা চালালাম। একটা গলির সামনে দিয়ে যাচ্ছি এমন সময় পেছনে পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম একটা লোক ছুটতে ছুটতে আসছে। তার হাতে একটা ব্রিফকেস। পেছনে আর কাউকে দেখছিনা।
কেউ তাড়া না করলে দৌরাচ্ছে কেন? লোকটা ছুটতে ছুটতে আমার সামনে এসে একমুহূর্তের জন্য থামল। আচমকা আমার হাতে ব্রিফকেসটা ধরিয়ে দিয়ে আবার দৌড় লাগাল। আমি সাথে সাথে কিছু বুঝলাম না। বুঝলাম একটু পর, যখন সাইরেন বাজাতে বাজাতে একটা পুলিশের জিপ আমার সামনে এসে থামল। আমি কিংকর্তব্যবিমুর হয়ে দাড়িয়ে থাকলাম।
জিপ থেকে একজন পুলিশ নামল। “ইউ আর আন্ডার এরেস্ট! হাত উপরে কর”।
“হোয়াট? কি বলছেন আপনি?” আমি হতবাক।
“কি বলছি একটু পরেই বুঝতে পারবি। থানায় চল আগে”।
“কেন গ্রেফতার করছেন আমাকে? কি অপরাধ আমার?”
“২০ লাখ টাকাভর্তি ব্রিফকেস হাইজ্যাক কইরা এখন জিগাতেছস কি অপরাধ?”
কথাটা শুনে আমি হাত থেকে ব্রিফকেসটা ফেলে দিলাম। “কি বলছেন এসব? এর মধ্যে ২০ লাখ টাকা আছে! আমি তো জানতাম না। এক লোক দৌড়ে এসে আমার হাতে এটা ধরিয়ে দিয়ে পালাল”।
পুলিশটি কোনও কথা না শুনে আমাকে হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিল। আমি অস্থির কণ্ঠে বললাম, “আপনি জানেন আমি কে? আমি একজন হাই প্রোফাইল সায়েন্টিস্ট”।
“চুপ কর বদমাইশ। তর মত চোর কত দেখলাম! ধরা পরলে কেউ সাজে কবি, কেউ সাজে হুজুর, কেউ আবার সায়েন্টিস্ট! আমিও ইন্সপেক্টর মতিন, থানায় নিয়া ডলা দিলে বাপ বাপ কইরা সব স্বীকার করবি”।
ইন্সপেক্টর আমাকে ঠেলতে ঠেলতে জিপে ওঠাল। জিপে আর কেউ ছিলনা, ইন্সপেক্টর ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসল। গাড়ি স্টার্ট দেবে এমন সময় গলির ভেতর থেকে মহিলা কণ্ঠের একটা চিৎকার শোনা গেল।
আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। কিছু বুঝে উঠার আগেই আবার চিৎকার। ইন্সপেক্টর বলল, “তুই এইখানে চুপচাপ বসে থাক, আমি দেইখা আসি কি হইছে”।
***
ইন্সপেক্টর আমাকে জিপে বসিয়ে রেখে গলিতে ঢুকল। একবার মনে হল দৌড়ে পালাই।
কিন্তু সিধান্তটা বাতিল করে দিলাম। এমনিতেই যে অপরাধ আমি করিনি তার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। এখন পালিয়ে যাওয়ার অর্থ হল অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া। দু হাতে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় মানুষ দেখে বুঝবে আসামি পালাচ্ছে, পুলিশের আমাকে খুজে পেতে সমস্যা হবেনা। তাই ইন্সপেক্টর আসার অপেক্ষায় থাকলাম।
হঠাৎ গুলির শব্দ হল, সাথে সাথে ইন্সপেক্টরের আর্ত-চিৎকার। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। গাড়ি থেকে নামলাম না। ২-৩ মিনিট পেরিয়ে গেল। পুলিশ ইন্সপেক্টরের সাড়া-শব্দ পাচ্ছিনা।
গলির ভেতর একটা উকি দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। বলা যায়না, হয়ত এই মুহূর্তে আমার সাহায্য ইন্সপেক্টরের দরকার। সাহায্য করলে আমাকে ছেড়ে দিতে পারে। গলির মাথায় দাড়িয়ে ভেতরে উকি দিয়ে আমি ঘাবড়ে গেলাম। গলির ভেতর কয়েকটা পরিত্যাক্ত ভাঙাচুরা গাড়ি পরে আছে।
তারই একপাশে ইন্সপেক্টরের শরীরটা বেকায়দা ভঙ্গিতে পরে আছে। দেখেই বুঝলাম মারা গেছে। আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম। বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে আমার পালানো দরকার। কিন্তু অদৃশ্য একটা নিয়তি যেন আমাকে টানছে।
ইন্সপেক্টরের মৃত্যুর কারন বুঝতে পেরে আমার বমি পেল। তার মাথার খুলি ফেটে দুই ভাগ হয়ে গেছে। ভিতর থেকে ব্রেইন বের হয়ে আসছে। ইন্সপেক্টরের পাশেই একজন মহিলার মৃতদেহ পরে আছে। তার সমস্ত শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে কেউ যেন খামচি দিয়ে মাংস তুলে নিয়েছে।
এমন একটা বিদঘুটে কাজ কে করতে পারে?
ভয়ে আমার হাঁটু কাঁপছে। হঠাৎ পিছন কিছু একটা ধাক্কা দিল আমাকে। আমি তাল সামলাতে না পেরে ইন্সপেক্টরের মৃতদেহের পাশে পরে গেলাম। ঘুরে দেখার চেষ্টা করলাম কে ধাক্কা দিয়েছে বোঝার জন্য। একটা মেয়ে! তার পরনের কাপর চোপর রক্তে মাখামাখি।
মুখ-হাতেও রক্ত। দাত বের করে ভয়ংকর একটা হাসি দিল। আমি চিনতে পারলাম তাকে, অরনি!
“অরনি, তুমি!”
“চিনতে পেরেছেন তাহলে স্যার?” অরনির কণ্ঠে কি যেন একটা আছে, মানুষের কণ্ঠ তো এমন হয়না! “আমিই আপনার সেই গবেষণার গিনিপিগ!”
আমি আতঙ্কিত কণ্ঠে বললাম, “কিন্তু আমি তো জানিনা সেই গবেষণার ফল কি হয়েছিল। তুমি জ্ঞান ফিরতেই আমার সব গবেষণার কাগজ-পত্র আর ফর্মুলা নিয়ে পালিয়েছ!”
“এখনও বুঝতে পারছেন না কি ফল হয়েছে!” অনিতা আবার সেই ভয়ংকর হাসিটা দিল। “আমার গায়ে এখন ১০টা বাঘের সমান শক্তি এসেছে, আর এসেছে বাঘের অন্যান্য সব বৈশিষ্ট্য।
তার মধ্যে একটা হল মানুষের মাংসের প্রতি লোভ! সেই ফর্মুলা ব্যাবহার করে আমি গড়ে তুলব নতুন এক সম্প্রদায়। ”
অরনি পৈশাচিক হাসি হাসতে হাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি আতঙ্কিত বোধ করলাম, “না...অরনি! আ...আমাকে মেরনা... প্লিজ!”
“ভয় নেই স্যার। আপনি আমার গুরু, আমি আপনাকে মারব না। আপনাকে নিয়ে আমার অন্য একটা প্লান আছে”।
অনিতা রাস্তার পাশ থেকে একটা ইট-ভাঙা তুলে নিল। প্রচণ্ড আঘাত করল আমার মাথায়। চোখের সামনে পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে এল।
***
মনে হচ্ছে কেউ একজন আমার শার্টের কলার ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। মুহূর্তের মধ্যে আমি মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ খুললাম।
দু জন পুলিশ আমাকে টেনে দাড় করাল। আমাদের ঘিরে প্রচুর মানুষের ভিড় জমে গেছে। একজন পুলিশ আমার মুখে প্রচণ্ড একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। “শুয়োরের বাচ্চা! তুই এটা কি করলি?” আমি বুঝলাম না কি ঘটেছে। নিচে পরে থাকা ইন্সপেক্টরের মৃতদেহটা দেখে আঁতকে উঠলাম।
হাত পায়ের বিভিন্ন যায়গায় মাংস সরে গিয়ে হাড় দেখা যাচ্ছে। বুকের পাঁজরগুলো ভাঙা, পেট উন্মুক্ত হয়ে আছে। ফুসফুস, হার্ট, লিভারসহ ভেতরের সবকিছু টেনে বের করা। আমি অনেক কষ্টে বমি আটকালাম। চোখ ফিরিয়ে নিজের দিকে তাকালাম।
আমার গলা থেকে পেট পর্যন্ত রক্তমাখানো। হাত দুটো যেন রক্তে গোসল করছে। কেউ বলে না দিলেও বুঝতে পারছি আমার মুখেও রক্ত লেগে আছে, মুখের ভেতর রক্তের লোনা স্বাদ পাচ্ছি।
পুলিশ আবার বলল, ‘হারামির বাচ্চা! তুই কি রাক্ষস?”
আমি কিছু বলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মনে হল-বলে কি লাভ? ক্রাইম সিনটা সুন্দর ভাবে সাজানোই আছে।
জীপের ভেতর টাকাভর্তি ব্রিফকেস, আমার হাতে হ্যান্ডকাফ, ইন্সপেক্টরের বিকৃত লাশ, তার রক্ত আমার সারাগায়ে। যা বুঝার তা বুঝে নিয়েছে সবাই। এর থেকে বাঁচার কোনও উপায় নেই। পুলিশ দুজন আমাকে টানতে টানতে গাড়িতে উঠাল। ভিড়ের মধ্যে কয়েকটা কিশোর বয়সী ছেলের দিকে আমার নজর পরল।
তারা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে। আমি স্পষ্ট চিনলাম-বাঘের দাঁত!
পরদিন সব পত্রিকায় হেডলাইন হলঃ
“ঝালকাঠিতে একজন স্যাডিস্ট বিজ্ঞানী গ্রেফতার!”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।