আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টিকারী! বলল, তারা তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না!
পান্থসখা পায়রা। প্যাসেঞ্জার পিজিয়ন। কোনদিন ক্লান্তপায়ে হাঁটার পথে এই মোহন-কবুতর দেখার অধিকার হারিয়েছি আমরা। চিরতরে।
রকপাখি
হ্যা ভুল শোনেননি। রকপাখি। সেই সিন্দাবাদের গল্পের পাখিটা নিছক গল্প ছিল না। বরং অভিযাত্রিরা সত্যিই তার দেখা পেয়েছিল।
বিলুপ্তিকাল: অনেক আগেই বিলুপ্ত, এমন কথা বলা হত।
তার পরও, সতের শতকেও তাদের দেখা পাওয়া যেত মাঝে মাঝে। ষোলশ চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ সালের দিকেও তাদের দেখেছে স্থানীয় ফরাসি গভর্নর। বারো-তেরো শতকের মার্কোপোলো যেমন তাদের কথা বলে গেছেন, তেমনি আরো আগে বলে গেছেন এখন মিথ বানিয়ে ফেলা আরব বণিক সিন্দাবাদ।
অঞ্চল: আফ্রিকার শুধু মাদাগাস্কারে। মাদাগাস্কার হল তাসমানিয়ার মতই এক আজব অঞ্চল।
প্রকৃতির তৈরি করা চিড়িয়াখানা, যেখানে বিলুপ্ত প্রাণীর হাট বসেছিল এককালে। জীবন্ত ফসিল সিলাকান্থ বা কোয়েলাকান্ত তো মানুষ বিলুপ্তই জানত।
গড়ন: দশ ফিট বা তারও বেশি উচু, চারশো কেজির মত ওজন। হাতিপাখির ডিমের আকারই ছিল এক ফুটের চেয়েও দু এক ইঞ্চি বেশি।
অবলুপ্তির জৈবিক দিক: ঠিক কী কারণে এরা লুপ্ত হয়, তা আজো অস্পষ্ট।
কোন যুগে লুপ্ত হয়, তাও। কিন্তু জৈবিক কারণ থাকতে পারে না, কারণ তারই মত প্রাণি উটপাখি, কেশরী ও ইমু আজো বেঁচে আছে। তার না বাঁচার কোন কারণ নেই। তবে মানুষের নিয়ে আসা মুরগি ও গিনিফাউল থেকে ভাইরাসের ইনফেকশনে পুরো প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে, এমনটা যে মনে করা হয়, তাও প্রাকৃতিক নয়, মানবসৃষ্টই।
অবলুপ্তির মানবিক (!) কারণ: এই পাখিরা মাদাগাস্কারের উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত থাকত।
তাদের লুপ্ত হবার কোন কারণ থাকে কী করে? একটা তত্ত্ব অনুযায়ী, খুব অল্প সময়ের মধ্যে মানুষ তাদের মেরে সাফ-সুতরো করে ফেলে। এখনো পাওয়া ফসিলগুলোয় আঘাতে মৃত্যুর চিহ্ন স্পষ্ট! মনুষ্যসৃষ্ট আগুনের চিহ্নও। বিশেষ করে, এই পাখির একটা ডিম পুরো পরিবারের খাবারের জোগান দিবে, সুতরাং মেরে সাফ করে দাও।
গ্রেট অক
হয়ত চলে গেছেন প্রশান্তদ্বীপে। এই প্রাণিটাকে জল-স্থলে হুটোপুটি করতে দেখলে যে অনুভূতি হত, সেটার বিলুপ্তি হয়েছে আজ।
বিলুপ্তিকাল: ১৮৫০
অঞ্চল: ন্যাটোর অঞ্চল। উত্তর আটলান্টিক (পশ্চিম ইউরোপ, দক্ষিণ গ্রিনল্যান্ড ও পূর্ব আমেরিকার বিচ্ছিন্ন কিছু দ্বীপে। )
গড়ন: ৩০-৩৩ ইঞ্চি, পাঁচ কেজি।
আজীবন এক সঙ্গী নির্বাচন করত। বসবাস করত খুবই ঘনবসতির সামাজিক কলোনি তৈরি করে।
অবলুপ্তির জৈবিক দিক: পাথরের উপর মাত্র একটা ডিম পেড়ে, সেটাকে ছ সপ্তাহ বাবা-মা তা দিয়ে ফুটাতে হত।
অবলুপ্তির মানবিক (!) কারণ: মানুষ লক্ষ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের শিকার করেছে। নেটিভ আমেরিকান কিছু গোত্র এমনভাবে তাদের শিকার করত যে, একটা কবর পাওয়া যায়, যেখানে লাশকে প্রায় দুইশ গ্রেট অক এর চামড়া দিয়ে কাফন দেয়া হয়েছে। ১৫৫০ এর মাঝামাঝি ইউরোপ থেকে প্রায় হাপিস হয়ে যায় বোকাপাখিগুলো। যত বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যায়, তত তাদের চামড়া ও ডিমের চাহিদা বাড়তে থাকে।
কিঙ আইল্যান্ড ইমু
এই পাখিটাকে তিনশো বার শিকার করে খেতে কতটুকু ভাল লাগবে? এর কোন তুলনা কি আছে স্বর্গমর্ত্যে?
তাসমানিয়া এক দু:খগাঁথার গ্রাম। ওই দ্বীপাঞ্চলটায় মানুষ যে কী পরিমাণ প্রাণ নি:শেষ করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। তাসমানিয়ার দানব, তাসমানিয়ার বাঘ বা থাইলাসিন... তেমনি এক আজব পাখি, রাজার দ্বীপের ইমু। আর ফিরে আসবে না।
বিলুপ্তিকাল: উনিশ শতক
অঞ্চল: অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে।
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া ও তাসমানিয়ার মাঝামাঝি।
গড়ন: পঞ্চান্ন ইঞ্চি। তেইশ কেজি। মূল দ্বীপের ইমু থেকে এরা ছিল অনেক ছোটখাট গড়নের।
অবলুপ্তির জৈবিক দিক: বেরি, ঘাস আর সাগর-শৈবাল খেয়ে বেঁচে থাকা ইমুগুলোর মরার কোন কারণ তো থাকার কথা নয়।
হয়ত উপকূলের দিকে, ছায়াময় লেগুনে থাকাটাই কাল হল তাদের জন্য।
অবলুপ্তির মানবিক (!) কারণ: আঠারোশ দুই সালেও নিকোলাস বাউডিন বলেছিলেন বনভর্তি ইমুর কথা। তারা স্পেসিমেন হিসাবে রাজার দ্বীপের ইমু ও ক্যাঙারু দ্বীপের ইমু পরিবহন করেছিলেন ফ্রান্স পর্যন্ত। অথচ দুটাই আজ লুপ্ত। দ্বীপ আবিষ্কারের পরপরই, ইংরেজ সিল-শিকারীর দল থানা গাড়ে কিঙ আইল্যান্ডে।
প্রচুর সিল পাওয়া যায় সেখানে, আরো অনেক কিছু। ব্যস।
এই সুসভ্য ইংরেজের দল ইমু শিকারের জন্য ট্রেনিঙ দিয়ে ফেলে কুকুরকে। আর কুকুরের সাথে দুলকি চালে চলা ইমু পারবে কেন? মজা করে ইমু খাওয়ার নানা রেসিপিও তৈরি হয় তখন। শুধু একজন সিল-শিকারীই তিনশোর বেশি ইমু খেয়েছে।
তার উপর দ্বীপের নানা প্রান্তে ক্যাম্পফায়ার থেকে আগুন ধরে যেত বনে।
ক্যাঙারুদ্বীপের ইমু
বিলুপ্তিকাল: ১৮২৭
অঞ্চল: দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া ও তাসমানিয়ার মাঝামাঝি ক্যাঙারুদ্বীপ।
গড়ন: আকৃতির জন্য একে ডোয়ার্ফ ইমুও বলা হয়। ছোট্ট। তবে রাজার দ্বীপের ইমুর সাথে ওজন ও আয়তনে মিল থাকার কথা।
অবলুপ্তির জৈবিক দিক: মাত্র পঁচিশ বছরে অবলুপ্তির কোনই জৈবিক কারণ থাকতে পারে না। সদাশয় সুসভ্য ইংরেজ ও ফরাসি জাতির অবদান।
অবলুপ্তির মানবিক (!) কারণ: আঠারোশ দুই থেকে আঠারোশ সাতাশ। মাত্র পঁচিশ বছরে মানুষ মানবিকতা দেখিয়ে দিয়েছে। নিপিয়ান বে’র দিকে প্রচুর দেখা যেত তখন।
এমনকি বোকামার্কা কিঙ আইল্যান্ড ইমু’র মত তারা পাড়ের দিকে থাকত না, বরং বনের ভিতরটায়।
কিন্তু আংরেজ জাত তখন সভ্যতার চূড়ায় অবস্থান করছে। তারা ইতিহাসের আর সব ঘটনার মত করেই, যে কোন কাজ করত বেপরোয়া ও লার্জ স্কেলে। বসতি স্থাপনের জন্য বনের পর বন আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিতে হয়, এ জিনিস ইংরেজ জাতের কাছে শেখার আছে।
ডোডো
ডেড অ্যাজ দ্য ডোডো।
ডোডোর মত লা-পাত্তা। গুম।
মজার ব্যাপার হল, ডোডোরা জেনেটিক দিক দিয়ে বেশি মিল রাখত পায়রা আর ঘুঘুর সাথে। এই পায়রা ধরনের পাখিগুলোর অবলুপ্তির হার খুবই বেশি।
বিলুপ্তিকাল: সতের শতকের প্রথমদিকেই ডোডোরা সব চলে গেছে।
তবে ষোলশ বাষট্টিতে শেষ ডোডো দেখতে পাবার কথা শোনা যায়।
অঞ্চল: পনেরশ আটানব্বই সালের দিকে পালতোলাতে দিকপাল, সেই পুরনো ডাচের দল প্রথম ডোডোর সন্ধান জানায় পশ্চিমা সভ্যতাকে। সেই মাদাগাস্কারের অঞ্চলেই, তবে সাগরের আরো গভীরে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পাওয়া যেত শেষ পর্যন্ত। মরিশাসের তীরবর্তী এলাকায়, শান্তিপ্রিয় ধীরগতির এই পাখিগুলোর বাস ছিল।
উস্তাদ মনসুরের আাঁকা ডোডো দেখে যতটা না তাকে ভারতীয় মনে হয়, তারচে বেশি সন্দেহ হয়, পাখিটাকে জাহাজে করে এনে কোন বণিক হয়ত সম্রাটের সৌখিন চিড়িয়াখানায় উপহার দিয়েছিল।
গড়ন: এমন কিউট দেখতে কোন পাখি যদি ৩.৩ ফুট উচু হয়, ওজন হয় দশ থেকে আঠারো কেজি, তাহলে যারা এর বিলুপ্তির জন্য দায়ী, তাদের কী করতে মনচায়?
অবলুপ্তির জৈবিক দিক: এদের ধীরগতি, সেইসাথে আকৃতির সাথে মানানসই হিংস্রতার অভাব। গড়ন-গঠনের এমন একটা প্রাণির জন্য উপযুক্ত বন্য শিকারী প্রাণি ছিল না, এই হল তার টিকে থাকার কারণ। তারপর মানুষ গেল।
অবলুপ্তির মানবিক (!) কারণ: তো, পুরো কারণটাই মানবিক। সাগরযাত্রায় ক্ষুৎপীড়িত নীতিহীন নাবিক।
সামনে এতবড় সুন্দর সৃষ্টি। যতদিন খুশি থাকা, যতটা খুশি খাওয়া। আরো ভয়ানক হয় অবস্থা, যখন খুব একটা বড় নয়, এমন দ্বীপদেশে এসে থানা গাড়ল ওই নাবিকদের পোষা প্রাণিগুলো। বাকিটাও উজাড়।
অবাক ব্যাপার হল, এই অভিযানগুলোর অনেকটাই ছিল বিজ্ঞান-মনা।
ভূগোল বোঝার জন্য, এমনকি জৈবজগত চেনার জন্যও। তখন যে মানুষ সচেতন ছিল না, তখন মানুষ অবলুপ্তি বুঝত না, বিষয়টা এমন নয়।
পরবর্তীতে আবার এই বিজ্ঞানমনস্ক মানুষজন অনেক যুগ ধরে ডোডোকে রূপকথা মনে করতেন। রূপকথা মনে করতেন হাতিপাখি বা রকপাখিকে। আস্তে আস্তে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা হচ্ছে।
অগ্রযাত্রা হচ্ছে বিজ্ঞানমনা মানুষেরও। বিষয়টা সুখকর।
রোয়েলান্ট সাভেরে'র মত আর সব মানুষও যদি পাখিবৈচিত্র্যকে মূল্য দিতে জানত ষোলশ আটাশ সালের দিকে, পৃথিবীটা হয়ত অন্যরকম হতো। ছবিতে একটা ডোডো'র দেখা পাওয়া যায়।
বিলুপ্ত প্রাণির বিষয়টা একটা ছকে ফেলে এগিয়ে যাব ভেবেছি, যদি এগুনো যুক্তিযুক্ত হয়।
এই পোস্টটা মূলত দুটা বিষয় মাথায় রেখে করা। মাদাগাস্কার, তাসমানিয়া ও উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে থাকার চেষ্টা। সেইসাথে মহাপাখিদের মিলনমেলা, এদের কেউই উড়তে পারে না।
এরচে বুক-মোচড়ানো কিউট সব পাখি হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। আমাদের মুখ হয়ে পাকস্থলিতে।
ওদের জন্য শোক। দৈহিক আকৃতির বৈচিত্রের ভিত্তিতে কয়েকটা ছবি (আশা করি পরে ক্যাটেগরাইজড বর্ণনা আসবে)...
শেষবেলায় শুধু একটা কথা। চলতি পথে আজকাল আর ঘুঘু দেখা যায় কি খুব একটা? কেমন আছে আমাদের দেশের ল্যাজঝোলা পাখিগুলো? আমরাও সেইন্ট মার্টিনে গিয়ে কি ডাচ-মাদাগাস্কারিয়ান আর বিশেষ করে ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ হয়ে যাই না? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।