এক
শুভ্র যখন চোখ খুললো, তখনও অন্ধকার। ভারী পর্দার ফাঁক দিয়ে হালকা আলো আসছে – তবে এই আলো দিন কিংবা রাত, যেকোন সময়েরই হতে পারে। শুভ্র সাধারণত তার ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমায় না। কারণ, তার মা মোর্শেদা বেগম ঘুমের মধ্যেও বার বার এসে শুভ্রকে দেখে যাবেন। মায়ের জন্য একধরণের মায়া হয় শুভ্রের।
মা কখনই বাবাকে নিজের করে পাননি, শুভ্রকেও না। বাবার ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্যের কাছের মা বরাবরই ছিলেন ম্রিয়মান। শুভ্র যখন বড় হতে থাকে, মার মধ্যে আতংক ভর করে তীব্রভাবে, তিনি ভাবেন হয়ত স্বামীর মতন ছেলেকেও হারাবেন। যদিও বাবা মানুষ হিসেবে ভয়ংকর এবং শুভ্র’কে কঠিন অনুশাসনে রেখেছিলেন – তবুও শুভ্র বাবার অন্ধ ভক্ত।
শুভ্র আবার চোখ খুলে বুঝলো তার ঘুম এখনও শেষ হয়ে যায়নি।
মাথার মধ্যে একটা অদ্ভুত শূন্যতা। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশে রাখা ল্যাম্পটা জ্বাললো। সুন্দর একটা ঘর। দেয়ালের রংটা ঘিয়ে রঙের। তার যে এই রঙ খুব পছন্দের তা না, তবে আজকে হালকা আলোয় ঘরের দেয়ালটা খুব ভালো লাগছে।
শুভ্র হাত বাড়িয়ে চশমা নিতে গেলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিলো না। কাঁথাটা বুক পর্যন্ত টেনে নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
দুই
শুভ্র যখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে গেছে, রুপা তখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল। তাদের বাসাটা নুতন ঢাকা থেকে খানিকটা দূরে, এখনও এখানে গায়ে গায়ে দালান গড়ে ওঠেনি।
কিছুটা নিঃশ্বাস নেয়া যায়। এই বারান্দাটা রুপার খুব পছন্দ। বাড়িটা বানানো হয়েছে একটা ডেড-এন্ড এর মতন জায়গায়, তাই বারান্দা থেকে রাস্তার একদম শেষ প্রান্ত পর্যন্ত দেখা যায়। রাস্তাটা যেখানে শেষ, সেখান থেকে খোলা জমি। তারও পরে বিল এর মতন অংশ, কচুরিপানা, কাশফুলের ঝাড়, ২/১টা পাল-তোলা নৌকা – কে বলবে জায়গাটা ঢাকা শহরের এতটা কাছে! বছরে দু’একবার যখন ঝুম বৃষ্টি নামে, আকাশ ঘন কালো হয়ে আসে ঈশান কোণে, তখন ওই বিলের পানিতে মাছ পাওয়া যায় – দেশি মাছ।
জেলেরা জাল ফেলে মাছ তোলে, ঢাকার নানাপ্রান্ত দামি দামি গাড়ি নিয়ে কিছু মানুষ আসেন মাছ কিনতে।
বিলের ওই দিকটায় এখন আকাশ লাল করে গোধূলি নামছে। কোন এক অদ্ভুত কারণে রুপা সূর্যটা দেখতে পায় না। তার কেবলই মনে হয় আজ বোধহয় কোথাও কিছু একটা হয়েছে। কেমন নিঃসঙ্গতা আকাশ পানে।
কিছু পাখি দিকভ্রান্ত হয়ে উড়ে যাচ্ছে দিগন্ত রেখা বরাবর। রুপা চায়ের মাগে চুমুক দেয়। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। সে না খাওয়া চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘরের ভেতরে যায়...
তিন
শুভ্র ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারে সে গত দু’দিন ধরেই ঘুমের ঘোরে আছে। ঘুমুচ্ছে, উঠছে আবার শুয়ে পড়ছে।
মাঝে একবার বাথরুমে গিয়েছে, ভাতও খেয়েছে একবার অনিচ্ছাসত্ত্বে। তার বাসার মানুষদের হাতে মোটামুটি কোন কাজ নেই, তাদের মূল আগ্রহ তার খোঁজ-খবর নিয়ে তাকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে ফেলা। শুভ্র অন্য কোন সময় হলে ঘুম থেকে উঠতো না। এভাবে মাসের পর মাস শুয়ে বসে কাটানো শুভ্রের জন্য কোন বিষয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্স এ মাস্টার্স শেষ করার পর সে একটি বছর কিছুই করেনি।
শুয়ে বসে কাটিয়েছে শুধু – সাথে ছিলো মদ, জুয়া আর নিষিদ্ধপল্লীর সন্নিবেশ। সেখানে ছবি এঁকেছে, গান গেয়েছে – মদের নেশায় বুঁদ হয়ে কাটিয়েছে অজস্র রাত। তবে নারী সান্নিধ্য হয়নি। পতিতালয়ে গেলে অদ্ভুত অনুভূতি হয় শুভ্রের – সেখানে কোন যৌনতা নেই। যৌনতার জায়গায় স্থান নেয় শিল্প, মাদকতা আর অসম্ভব এক উন্নাসিকতা।
বিছানা থেকে উঠে জানালার সামনে দাড়িঁয়ে পর্দাটা আলতো করে সরিয়ে বাইরে তাকাল শুভ্র। মিষ্টি রোদ উঠেছে – যদিও কোন রোদই সে সহ্য করতে পারে না। রোদে গেলেই ঘেমে নেয়ে একাকার, নিঃশ্বাসেও কষ্ট হয়। শুভ্রের বাবা, মাহফুজ সাহেব একটা গাড়ি সবসময়ই অগোচরে রেখে দেন শুভ্রের জন্য। শুভ্র উঠতে না চাইলেও সেটি তার পেছনে পেছনে ঘুরবে, দেখবে সে কোন বিপদে পড়ল কি না।
তেমন কিছু দেখলেই শুভ্রের বাবার কাছে ফোন চলে যাবে, তিনি যে কোন সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন মুহুর্তের মধ্যে। অন্য কেউ হলে কতটাই না খুশী হতো এমন আয়োজনে, কিন্তু শুভ্র’র ভালো লাগে না। শুভ্র আয়নায় তাকায় নিজের দিকে। ফর্সা চেহারা, এলোমেলো চুল, একধরনের তীক্ষ্ণতা আছে তার চেহারায়। মেয়েরা পছন্দ করে তাকে।
তার চেহারা, সম্পত্তি নাকি মেধার কারণে তা অবশ্য সে জানেনা। শুভ্র চিন্তা করে শেষ কবে সে নারীস্পর্শে এসেছে! রিফাত ম্যাডাম, তার বছর পাঁচেক এর সিনিয়র ছিলেন ডিপার্টমেন্ট এ, পরে পি। এইচ। ডি। শেষ করে এসে তাদের ক্লাসও নিতেন।
ভয়াবহ সুন্দরী, শুভ্রকে পছন্দ করতেন তা সবাই জানে। কিন্তু সে যখন ডিপার্টমেন্ট এ জয়েন করলেন তখন ছাত্র-শিক্ষক এর দূরত্ব তেমন একটা ঘোচেঁনি। গতবছর হঠাৎ এক পার্টিতে দেখা। শুভ্র এবং রিফাত ম্যাডাম দু’জনই হালকা ড্রিঙ্ক করছিলেন। পাশাপাশি বসেছিলেন একই সোফায়।
“শুভ্র ক্লাস নিতে কেমন লাগছে?”
“সত্যি বলতে কি জঘন্য। “
“কেন? তুমি তো ভালো ছাত্র ছিলে, রেজাল্টও ব্রিলিয়ান্ট, তোমার তো ভালো লাগার কথা। “
“উমম, আসলে পড়াতে খারাপ লাগছে বলব না। কিন্তু মনে হয় শিক্ষকতা হচ্ছে স্বপ্ন দেখানো পেশা। একদল তরুণ-তরুনী আমার কথা মুগ্ধ হয়ে কথা শুনবে, দেশকে ভালোবাসবে, এগিয়ে যাবে সামনের দিকে, নাহলে আর শিক্ষক হয়ে লাভ কি বলেন।
আমার মনে হয় না আমি তা করছি। নিতান্তই কিছু করতে হয় বলে ক্লাসে যায়, পড়াই। “
“তোমার মতন একজন টিচার আসাতে ডিপার্টমেন্ট এর অনেক লাভ হয়েছে, আমি শিওর ছাত্র-ছাত্রীরাও অনেক এনজয় করছে তোমার ক্লাস, তুমি যাই বলো না কেন? পি। এইচ। ডি করতে কবে যাচ্ছো?”
“জানি না।
চাকরিটাই ছেড়ে দেব বোধহয়। ভালো লাগছেনা। “
“তোমার সেই ছবি আঁকা রাজকন্যার খবর কি? সেই আসক্তি কেটেছে?”
শুভ্র বোঝে আশেপাশে উৎসাহী মানুষের ভীড় বাড়ছে। তার আর রিফাত ম্যাডামের ব্যাপারে এমনিতেই সবার আগ্রহ। তার মধ্যে পাশাপাশি বসে আছে দু’জন, গল্প করছে।
অনেকেই অনেক কিছু জানতে চাইতে পারে। শুভ্র রিফাত ম্যাডাম এর দিকে তাকায়। উগ্র একধরণের সৌন্দর্য আছে ওনার ভেতর, মডেলদের মতন একহারা গড়ন, অদ্ভুত সুন্দর মুখশ্রী আর পোষাকেও একধরণের আমন্ত্রণের জন্য তাকে এড়িয়ে চলা মুশকিল। শুভ্র পার্টি ছেড়ে চলে যাবার প্রস্ততি নিল। গাড়ির কাছে এসে স্টার্ট দিতেই দেখল রিফাত আসছে।
সে রাতে শুভ্র’র আর বাড়ি ফেরা হয়নি। রিফাত এর বাড়ি থেকে সে ফিরেছিল পরের দিন সকালে। এভাবে কতরাত রিফাতের একার ফ্ল্যাট এ কাটিয়েছে গতবছর তা আর এখন মনে করতে পারছেনা। আসলে ভাললাগার আকর্ষণ নিঃসন্দেহে ছিল সেখানে, কিন্তু ভালবাসা ছিল না। থাকার দরকারও নেই।
শুভ্রের বোহেমিয়ান জীবনে কোন নিশ্চিত নারীর আগমন চায় না সে। আজকে রিফাত এর কথা মনে পড়ছে খুব। মনে মনে ভাবল সহসাই আবার থাকবে সে রিফাত এর সাথে। ফোনটা হাতে নিতে গিয়েও নিল না কি মনে করে। আজ কেন যেন ভালো লাগছেনা।
আজ চাঁদ দেখবার দিন। ভরা পূর্ণিমায় গভীর রাতে জ্যোৎস্না দেখবার দিন...
চার
রুপার বিয়ে চারদিন পর। ছেলে ভালো। কম্পিউটার এনজিনিয়ার। বাপের গাড়ি-বাড়ি আছে ঢাকায়, ছেলের কোন ভাই বোন নাই, এবং রুপার শ্বাশুড়িও মারা গেছেন বহু বছর।
তার থেকেও বড় কথা ছেলে অত্যন্ত বেকুব প্রকৃতির। একদিন বাইরে গিয়েছিল তারা একসাথে। হাত-টাত ধরা তো দূরের কথা, ছেলে আলাপ জুড়ে দিলো অলিম্পিকের জিমন্যাস্ট নিয়ে। এর চেয়ে কম্পিউটার নিয়ে আলাপ করলেও ভালো হতো, অলিম্পিকের জিমন্যাস্ট এর চাইতে কম্পিউটার নিয়ে রুপার জ্ঞান অপেক্ষাকৃত ভালো।
“আপনার ফেভারিট অলিম্পিয়ান কে?”
“মানে?”
“না মানে কাকে আপনার বেশি ভালো লাগে? মাইকেল ফেল্পস না উসান বোল্ট?”
“আমি এসব ফালতু জিনিস দেখিনা, আমার ভালো লাগেনা।
কিছু মানুষ অকারণে দৌড়াদৌড়ি করে। তাদের চাইতেও বেশি লাফালাফি করে সারা দুনিয়ার মানুষ আর ফালতু মিডিয়াগুলো – আমার অসহ্য লাগে। ”
রুপা বুঝতে পারে ছেলে ভড়কে গেছে। কিন্তু তার কিছু করার নাই। তার মন ভালো নেই।
হিমুর সাথে সম্পর্কটা যেদিন পুরোপুরি শেষ হলো, সেদিন থেকেই মন খারাপ। তবে এ সম্পর্ক শেষ হবারই কথা ছিলো – যা হবার ভালোই হয়েছে।
রুপা ছেলেকে বলে, “আপনার আগে আমার আরেকটা সম্পর্ক ছিলো, জানেন?”
“নাহ জানি না। “
“ছেলের কাজ কি ছিলো জানেন?”
“নাহ, কি ছিলো?”
“ছেলে রাত বিরাতে হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরে বেড়াত, রাস্তার পাশের দোকানে চা খেত, মানুষের হাত না দেখেই তাদের ভবিষ্যৎ বলে দিত। সে কখনো পায়ে স্যান্ডেল পড়ত না।
”
“ছেলের নাম কি ছিলো?”
“নাম দিয়ে আপনি কি করবেন? হাত দেখাতে যাবেন?”
“রুপা চলুন, আমরা হিমু ভাইয়ের সাথে দেখা করে আসি। ”
বিয়ের আর চারদিন বাকি। রুপা এসেছে স্বাধীনতার সুবাস নিতে। বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতুর ওপর দিয়ে রুপা বাইরে তাকায়, সেখানে নীলের ঘনঘটা। অসময়ের শরতে আসলেই মেঘের ভেলা জমেছে।
এমনকি বিকেলের ঝকঝকে আলোতেও বিশাল বড় একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। রুপা বোঝে আজ পূর্ণিমা। এমন চাঁদের আলোয় গৌতম ঘর ছাড়লেও সাধারণ মানুষ ঘরে ফেরে।
বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষেরা দেখে অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে হু হু করে কাঁদছে। তার চোখের পানি দেখে আশেপাশে কয়েকটি বাচ্চাও কান্না জুড়ে দিয়েছে।
গোধূলীর কনে দেখা আলোয় এমন দৃশ্য দেখে সবার মন উদাস হয়, কান্না আসে।
পাঁচ
আজ পূর্ণিমা এমন কোন তথ্য শুভ্রের কাছে ছিলো না। কিন্তু সে মনে মনে জানতো আজ ঘর ছাড়ার দিন। অনেকদিন পর শুভ্র শেভ করে গোসল করল। আলমিরা থেকে বের করল তার সবচেয়ে সুন্দর পাঞ্জাবিটা।
সবুজ রঙের পাঞ্জাবি, রিফাত দিয়েছিলো।
রিফাতকে সঙ্গে নিয়ে শুভ্র যখন গাজীপুরে পৌঁছুল তখন গভীর রাত। আগামীকাল ঈদ, ঢাকা আর তার আশপাশ যেনো শুণ্যতায় ভরে গিয়েছে। রাস্তায় দু’একটা কাভার্ড ভ্যান। আর কিছু নেই।
চলার পথে গাজীপুরের শালবন, কিছু নিঃসঙ্গ পেঁচার আর্তনাদ আর রাস্তার শরীরে গাড়ির চাকার মৃদু আলাপন – ব্যাস। শুভ্র’র মাঝে আবেগ-অনুভূতি কম। কিন্তু কি যেন হলো, শুভ্র রিফাত এর হাতে হাত রাখে। বাইরে আকাশে বিশালকায় একটা চাঁদ উঠেছে। এত বড় চাঁদ শুভ্র আগে কখনো দেখেনি।
রিফাতও মন্ত্রমুগ্ধের মতন সেদিকে তাকিয়ে থাকে। পথের পাশে কিছুদূরে একটা রাস্তা নেমে গিয়েছে। শুভ্র সেই রাস্তা দিয়ে কেন যেন আনমনেই গাড়ি নামিয়ে দিলো। মাঝে মাঝে কিছু সময় আসে, যখন মানুষকে কিছুই করতে হয়না। কোন একটা অদ্ভুত শক্তি তাকে নিয়ে যায় অজানা গন্তব্যের দিকে।
শুভ্র ভরা পূর্ণিমায় গাড়িটা থামায় রাস্তার পাশে। সামনে বিশাল এক বাগান বাড়ি, গেটের দরজা হা করে খোলা। ওরা হেঁটে ভেতরে ঢুকে পড়ে। বাগানবাড়ির ভেতর অদ্ভুত ঠান্ডা একটা ভাব। নানারকম গাছ-গাছালিতে ভরা।
সবুজ ঘাসগুলো অদ্ভুত সুন্দর করে ছাঁটা। দূরে ছোট ছোট একতলা ঘর দেখা যাচ্ছে, সামনে ছোট বাগান, কিছু পুকুর আর বড় বড় মূর্তি। এত গভীর রাতে অজানা অচেনা জায়গা দিয়ে হেঁটে যেতে শুভ্র’র ভয় লাগছে না। রিফার তার কাছে ঘেঁষে আসে। শুভ’র বড় ভালো লাগে।
মনে হয় এমন করে যদি আকাশের পূর্ণিমা মাথায় নিয়ে সারাজীবন হেঁটে যাওয়া যেতো, তবে বড় ভালো হতো। কিছুদূর যেতেই চাঁদকে ছাড়িয়ে দেখা দেয় এক অপূর্ব নক্ষত্রবীথি। আর ঠিক নীচেই যেন সাজিয়ে রাখা হয়েছে একটি সুন্দর লিঁচু বাগান।
রিফাত ফিসফিস করে বলে, “দেখো দেখো কিছু লোক ওই গাছগুলোর নীচে। ”
শুভ্র অবাক হয়ে দেখে বেশ কিছু ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পড়া মানুষ গান গাইছে লিচু বাগানটায়।
কাছে যেতেই গানের কলিগুলো ওদের কানে আসে।
“ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়
চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়। ”
সামনেই একটা কবর। কবরের আশেপাশে কোন আলো জ্বালানো নেই। জিজ্ঞেস করতেই জানা গেলো এই কবরে যেই মানুষটি শুয়ে আছেন তিনি চাঁদের আলো খুব ভালোবাসতেন।
আরো ভালোবাসতেন ফুল, পাখি, বৃক্ষরাজি। প্রতি পূর্ণিমায় তাকে ভালোবেসে এখানে গানের আসর বসে। গাতকেরা দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বড় আবেগ নিয়ে গান গায়,
“ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়
চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়। ”
রিফাতকে পাশে নিয়ে শুভ্র আনমনে ধবধবে শ্বেতপাথরের কবরের গায়ে লেখা এপিটাফটা পড়ে। সেখানে লেখা,
“চরণ ধরিতে দিয়োগো আমারে
নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে।
“
কেন জানেনা, শুভ্র দেখে রিফাত এর চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছে। রিফাত অবাক হয়ে দেখে শুধু সে না, এখানকার প্রতিটা মানুষের চোখে জল। কবরে শুয়ে থাকা নাম না জানা মানুষটা কি এক অদ্ভুত জাদুতে সবাইকে আপন করে নিয়েছে। ফিরে যাবার সময় তারা দেখে হলুদ পাঞ্জাবি পড়া এক যুবকের হাত শক্ত করে ধরে পুকুর পাড়ে বসে আছে এক তরুণী। তরুণীর পরণে একটা সুতির লাল পাড়ের শাড়ি।
পাশে পেয়ারা গাছ। সব মিলে পূর্ণিমা রাতে দুনিয়াটাকে বড় অলৌকিক মনে হয় শুভ্র’র।
শুভ্র’র কেন যেন মনে হয় তরুণীটির নাম রুপা আর যুবকটির নাম হিমু। কেন মনে হয় সে জানে না। একবার ইচ্ছে হলো গিয়ে জিজ্ঞেস করে; পরক্ষনেই মনে হয় থাক, দুনিয়ার সব রহস্য ভাঙতে নেই।
শুভ্র যখন রিফাত এর হাত ধরে সেই বিশাল বাগানবাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়, হিমু আর রুপা যখন পুকুর এর পাড়ে বসে আনমনে গান শোনে কোন এক নাম জানা সাধকের কথা ভাবতে ভাবতে, ঠিক তখনই দমকা একটা ঝড়ো হাওয়া ছুঁয়ে যায় তাদেরকে। শুভ্র’র মনে হয় কেউ যেন তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
রুপা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে পুকুরের ওপাড়ে পানির ওপর দিয়ে কেউ একজন আনমনে হেঁটে যাচ্ছেন। সাদা পাঞ্জাবি আর হালকা ফ্রেমের চশমা পড়ে সামনে দিকে ঝুঁকে চলা মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। সেই হাসিতে কি অদ্ভুত প্রশান্তি, কি অদ্ভুত মায়া।
রুপার চোখের সামনেই সেই অবয়বহীন ছায়ামানব লিচু বাগানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যায়।
ভর জ্যোৎস্নার আলোয় রুপার কাছে সবই অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত মনে হয়। জ্যোৎস্নার আলোয় বৃষ্টিতে ভিজে ফিরে যেতে যেতে পেছনে শোনা যায় বাঁশির সুরে সাধকের গানে উন্মাতাল প্রকৃতি গাইছে
“ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়
চান্নি পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়। ”
আহারে কি মায়া, কি ভীষণ মায়া!!
(হুমায়ুন আহমেদ এর প্রথম মৃত্যু-মাস আজ – আমার শ্রদ্ধাচারণ)
শামীম আহমেদ
১৯/০৮/২০১২
নিকেতন, ঢাকা।
[]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।