মিথ্যার পতন সন্নিকটে.......... মওদূদীবাদের স্বরূপ সন্ধান
ইঞ্জিনিয়ার আবু রামিন
ইদানিং ‘মওদূদীবাদ’ শব্দটি বিভিন্ন স্থানে উচ্চারিত হচ্ছে। এ শব্দটিকে অনেকেই তুচ্ছার্থে উল্লেখ করছেন। আবার কেউ কেউ এটির পক্ষে বলতে চান। আবার কোন কোন ব্যক্তি বলেন, এটির অস্তিত্বই নেই। তাই, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে।
মওদূদী ভক্তরা মওদূদী সাহেবকে একজন ইসলামী চিন্তাবিদ ও ইসলামী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মনে করেন। সে কারণে অনৈসলামিক আদর্শকে ভিত্তি করে যারা রাজনীতি করেন তাদের সমালোচনাকে মওদূদী ভক্তরা আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে স্বাভাবিক ও অপরিহার্য মনে করেন।
কিন্তু ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসীগণ মওদূদী সাহেবের সমালোচনা করবেন এটিকে মওদূদী ভক্তরা স্বাভাবিক মনে করেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে- ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী মহল থেকেও মওদূদী সাহেবের সমালোচনা হচ্ছে (বরং বেড়ে গেছে)। তাই ইসলামী মানদণ্ডে মওদূদী সাহেবের লেখনীর পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন।
পূর্বোক্ত ‘মওদূদীবাদ’ কথাটি নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। যারা মওদূদীবাদের সমালোচক- তারা বলতে চান, মওদূদী সাহেব ইসলামের বিরুদ্ধে নিজের মত প্রকাশ করেছেন এবং তার অনুসারীরা তার ব্যক্তিগত কথাকে ইসলামবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও মেনে নেন। তাই, তাদের দায়িত্ব হলো জনগণের সামনে তুলে ধরা মওদূদী সাহেব ইসলামের বিরুদ্ধে কি কি ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করেছেন আর তার অনুসারীরা কোন কোন ক্ষেত্রে ইসলাম বাদ দিয়ে মওদূদী সাহেবের মতকে গ্রহণ করেছেন।
যারা মওদূদী সাহেবের সমর্থক তাদের কথা হচ্ছে, মওদূদী সাহেব সমকালীন সময়ে ইসলামী জ্ঞানে অগ্রসরদের মধ্যে অন্যতম। তাই তার দ্বারা মুসলিম উম্মাহ উপকৃত হয়েছে।
তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করেননি বরং ইসলামের অপ ও সংকীর্ণ ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। মওদূদী সাহেবের সমর্থকদের অনেকেই মনে করেন ‘মওদূদীবাদ’ বলে কিছু নেই। মওদূদী সাহেব নিজের মত নিয়ে কোন ‘বাদ’ বা ‘তন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করেননি, করতে বলেননি, করতে উৎসাহও দেননি। তার অনুসারীরাও নীতিগতভাবে মওদূদী সাহেব সহ কারোর ইসলামবিরোধী কথাকে মেনে নেন না।
সে যাই হোক, আলোচনা মূল বিষয় হল মওদূদী সাহেবের লেখনীর মাঝে ইসলামবিরোধী কিছু আছে কিনা? আর থাকলে সেগুলো কি কি?
এ প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখযোগ্য।
সেটি হচ্ছে, অতিভক্তি যেমন অন্যায়, তদ্রূপ অন্ধ-বিরোধিতাও অন্যায়। কেউ যদি মওদূদী সাহেবের সকল কথাকেই বিনা বিচারে গ্রহণযোগ্য মনে করেন তাহলে তা হবে অন্ধভক্তি। আবার কেউ যদি মওদূদী সাহেবের সকল কথার মধ্যেই ইসলামবিরোধিতার গন্ধ পান তাহলে সেটিকে বলা যায় অন্ধ বিরোধিতা। সুতরাং , যে কারো সমালোচনা হওয়া উচিত নিরপেক্ষ, জ্ঞাননির্ভর, বস্তুনিষ্ঠ, যথাযথ, যথামাত্রায় এবং সংশোধনের উদ্দেশ্যে।
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে যারা মওদূদী সাহেবের সমালোচনা করেন তাদের সমালোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, রাজনৈতিক বা অন্য কোন স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে যে সমালোচনা তার তেমন মূল্য নেই। ইসলামী মহল থেকে যারা একেবারে না জেনে, কম জেনে, মুখে শুনে বা পত্রিকায়-লিফলেটে পড়ে সমালোচনা করেন তাদের সমালোচনারও খুব একটা মূল্য নেই। তবে, তাদের সমালোচনার মূল্য অনেক বেশি যারা কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে, আন্তরিক কল্যাণ কামনার জন্যে, সংশোধনের উদ্দেশ্যে, যথেষ্ট পড়াশোনা-জ্ঞানার্জন-যাচাই করে যথাযথভাবে সমালোচনা করেন।
সম্ভবত এ রকম একজন ব্যক্তি, আলেমে দ্বীন, মাওলানা মুহা: হেমায়েত উদ্দীন। তিনি একটি চমৎকার বিষয়ে বই লিখেছেন।
নামটি হল, “ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ”। এ বইয়ের এক স্থানে তিনি “মওদূদী মতবাদ” শিরোনামে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। নিম্নে তার বইয়ে উল্লিখিত মওদূদী সাহেবের সমালোচনা ও সে সম্পর্কিত পর্যালোচনা ধাপে ধাপে উপস্থাপন করা হল:
সমালোচনা:মাওলানা মানযূর নো’মানী সাহেবের বর্ণনা মতে ১৯৩৬/১৯৩৭ সাল পর্যন্ত মওদূদী সাহেব ইংরেজি স্টাইলে চুল রাখতেন এবং দাড়ি সেভ করতেন। তারপর নামকাওয়াস্তে দাড়ি অবস্থায় ছিলেন দীর্ঘ দিন।
পর্যালোচনা:আমলে ক্রটি নেই- এমন লোক এ যুগে পাওয়া যাবে কি? মানুষের জীবনের শেষ বা পরবর্তী অবস্থাটিই কি মুখ্য নয়? আলেম সনদপ্রাপ্ত সকলে কি ১০০% বিশুদ্ধ?
সমালোচনা:উলামায়ে কেরাম উপলব্ধি করলেন যে, মওদূদী সাহেবের মূল লক্ষ্য হল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন করা।
পর্যালোচনা:মানুষের অন্তরের খবর মানুষ জানে না আল্লাহ?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব ধর্মকে রাজনীতি সর্বস্ব করে তোলেন।
পর্যালোচনা:ইসলাম কি রাজনীতি বিহীন? আল্লাহ কি রাজনীতি বুঝেন না?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব বলেন, ‘ইলাহ’ অর্থ শাসক।
পর্যালোচনা:আল্লাহ কি শাসক; না শাসিত?
সমালোচনা:পূর্বে জামায়াত করতেন পরে জামায়াত ছেড়ে দিয়েছেন- এমন লোকের উদ্ধৃতি দ্বারা বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে জামায়াত ইসলামবিরোধী।
পর্যালোচনা:পূর্বে জামায়াত বিরোধী ছিলেন; পরে জামায়াতে যোগ দিয়েছেন এমন লোকের উদ্ধৃতি কোথায়?
সমালোচনা:নবীগণ মানুষের মত পানাহার করতেন এটা তাদের মানুষ প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হল না অধিকন্তু তাঁরা মানুষ-সেটা প্রমাণ করার জন্য তাঁদের দ্বারা পাপ সংঘটিত করা হল!
পর্যালোচনা:গুনাহ আর পদস্খলন কি এক? বিষয়টি কি পদস্খলনের ব্যাপারে নয়? কুরআনে নবীদের ব্যাপারে আল্লাহর বক্তব্য কি অস্বীকার করতে হবে?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব লিখেছেন, “সে পবিত্র সত্তার কাছে কাতর কন্ঠে আবেদন করুন, হে মালিক, এ তেইশ বছরের নববী জীবনে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দানকালে স্বীয় দায়িত্বসমূহ আদায়ের বেলায় যে সকল ক্রুটি-বিচ্যুতি আমার (রাসূল সা.) থেকে সংঘটিত হয়েছে তা ক্ষমা করে দাও।
পর্যালোচনা:বান্দাহ আল্লাহর কাছে নিজেকে পুরোপুরি শুদ্ধ মনে করে দোয়া করাটা আদব কি না? আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে নবীর মর্যাদা কি কমে যায়? মওদূদী সাহেবের মন্তব্য যদি পূর্বযুগের সর্বজন গ্রহণযোগ্য আলেমদের বক্তব্যের অনুরূপ হয়ে থাকে তাহলে সেই আলেমগণের উপরও কি দোষ চাপানো উচিত নয়?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব শুধু সাহাবী নয় নবীদেরও সমালোচনা করেছেন।
পর্যালোচনা:আল্লাহ তাঁর বান্দাহর সমালোচনা করতে পারেন কি? আল্লাহ তাঁর বান্দাহকে নির্দেশ, সংশোধনী বা পরামর্শ দিতে পারেন কি? আল্লাহ প্রদত্ত নিদের্শ, সমালোচনা বা সংশোধনীর উল্লেখ করা অবৈধ না জরুরী? আল্লাহ প্রদত্ত সংশোধনী আলোচনা করা আর নিজ থেকে সমালোচনা করা কি এক?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব বলেছেন, “এটা কেবল (ইউসুফ আ. কর্তৃক) অর্থমন্ত্রীর গদী লাভের দাবি ছিল না, যেমন কোন কোন লোক মনে করে থাকেন। বরং এটা ছিলো ‘ডিক্টেটরশীপ’ লাভের দাবি। এর ফলে ইউসুফ (আ.) যে পজিশন লাভ করেছিলেন তা প্রায় এ ধরনের ছিলো যা ইটালীর মুসোলিনীর রয়েছে। ”
পর্যালোচনা:শাসক যদি যোগ্য মনে করে কাউকে বিশেষ দায়িত্ব দিতে চায় কিন্তু ইসলাম অনুযায়ী পরিচালনার বা কর্মের স্বাধীনতা না দিতে চায় তাহলে সে দায়িত্ব গ্রহণ করা কি গদীর লোভ নয়? শাসক যদি যোগ্য মনে করে কাউকে বিশেষ দায়িত্ব দিতে চায় এবং ইসলাম অনুযায়ী পরিচালনার বা কর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয় তাহলে সে দায়িত্ব গ্রহণ করা কি দোষণীয়? ইউসুফ আ. এর আদর্শ আর মুসোলিনীর আদর্শকে কি এক বলা হয়েছে নাকি কর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা সম্পর্কিত সাদৃশ্যের কথা বলা হয়েছে?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেবের মতে আদম (আ.) ভুল করেছিলেন..।
পর্যালোচনা:আদম (আ.) কর্তৃক নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ এর ঘটনা কি কুরআনের বর্ণনা নয়?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব বলেছেন, অনেক সময় মানবিক দুর্বলতা সাহাবীদেরকেও আচ্ছন্ন করে ফেলত..।
পর্যালোচনা:কুরআন ও হাদীসে সাহাবীদের ভুল করার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা আছে না নেই?
সমালোচনা:আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা হলো সাহাবায়ে কেরাম হক ও সত্যের মাপকাঠি। কিন্তু মওদূদী সাহেব সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি বলে মনে করেন না।
পর্যালোচনা:সাহাবায়ে কেরাম উম্মতের মধ্যে সত্যের সর্বোৎকৃষ্ট ধারক ও বাহক- এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সত্যের মাপকাঠি বলতে যদি উম্মতের মধ্যে সত্যের সর্বোৎকৃষ্ট অনুসারী বুঝায় তাহলে নি:সন্দেহে তাঁরা সত্যের মাপকাঠি। তবে, সত্যের মাপকাঠি বলতে যদি সত্যের অনুসারী বুঝায় তাহলে এ যুগের অনেককেও সত্যের মাপকাঠি মানা লাগতে পারে।
সেক্ষেত্রে এ যুগের লোককেও সত্যের মাপকাঠি মানা যাবে কি? সত্যের মাপকাঠি বলতে কি সত্যে সর্বোচ্চ মান বুঝায় না? সত্যের মাপকাঠি বলতে কি বিনা যাচাইকে মান্য বুঝায় না? সত্যের মাপকাঠি বলতে কি শর্তহীনভাবে অনুসরণের যোগ্য বুঝায় না? কুরআন ও হাদীসে কি এমন কোন কথা আছে যেখানে বলা হয়েছে যে, সাহাবাদের কখনো কোন ভুল হয়নি? ভুল হয়ে থাকলে সেটির উল্লেখ করা যাবে না? ভুল হয়ে থাকলে সেটির অনুসরণ করা যাবে? সাহাবীদের সকল কথা ও কাজ কি কুরআন ও হাদীসের মত নির্ভুল? তাদের সকল কাজ কি বিনা শর্তে মানতে হবে? কুরআন-হাদীসের সাথে মিললেও বা না মিললেও? সূরা আন নিসার ৫৯ নং আয়াতে মতভেদ হলে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরে আসতে বলার দ্বারা কি সত্যের মাপকাঠি হিসেবে কুরআন ও রাসূল (সা.)-কেই বুঝাচ্ছে না? কুরআন-হাদীসের এ সকল শিক্ষাই কি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদা নয়?
সমালোচনাইমাম মাহদী সম্পর্কে) মওদূদী সাহেব বলেছেন, “আমার মতে আগমণকারী ব্যক্তি তার নিজের যুগের একজন আধুনিক ধরনের নেতা হবেন। ”
পর্যালোচনা: ইমাম মাহদী কি নিজ যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাৎপদ, অদক্ষ ও আধুনিক চিন্তা-চেতনা বিবর্জিত হবেন?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব বুঝাতে চেয়েছেন যে, ইমাম মাহদী (আ.) এর বেশভূষা সুফী ও মৌলভীদের আকৃতির মতো হবে না।
পর্যালোচনা: এ ভাষায় মওদূদী সাহেব কোথায় বলেছেন তার সূত্র জানা গেলো কি? সূফী ও মৌলভীদের পোশাক কি সর্বত্র একই রকম? সুফী ও মৌলভীদের পোশাক বলতে বা হালাল ও সুন্নাতী পোষাক বলতে কি নির্দিষ্ট কোনো কাটিং বা স্টাইলকেই এককভাবে বুঝানো হয়েছে?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব বুঝাতে চেয়েছেন, ইমাম মাহদী (আ.) এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নির্ধারিত কোনো চিহ্ন থাকবে না যে, তার ভিত্তিতে তাকে খুজেঁ বের করা হবে। অথচ, বহু সংখ্যক রেওয়ায়েতে তাঁর শারীরিক আকৃতি সম্পর্কে বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে।
পর্যালোচনা: শারীরিক গঠন প্রয়োজনীয় কিন্তু জ্ঞান (ইলম), মযবুত ঈমান, দক্ষতা বা যোগ্যতা এগুলোই কি আসল নয়?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব বুঝাতে চেয়েছেন যে, যুদ্ধ ছাড়া ইমাম মাহদীর বিজয় কারামত, দুআ, তাসবীহ ইত্যাদি ধরনের অন্য কিছুর মাধ্যমে ঘটা ভুল।
অথচ মুসলিম শরীফের রেওয়ায়েতে শুধুমাত্র নারায়ে তাকবীরের ধ্বনি দ্বারাই শহর জয় হয়ে যাওয়ার কথা বর্ণিত আছে।
পর্যালোচনা: কুরআনে যে যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ ও ব্যবহারের নির্দেশ আছে সেটার গুরুত্ব কি কম?
সমালোচনা:লেখক বলেন, ইসলামের ইতিহাসে এমন কোনো মুহূর্ত আসেনি যখন ইসলাম তথা কুরআন-হাদীস সঠিকভাবে বুঝা ও পেশ করার মত ব্যক্তিত্ব ছিল না।
পর্যালোচনা: ইসলামের ইতিহাসে এমন মুহূর্ত কি আসেনি যখন অনেকে ইসলামের বুঝওয়ালা ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত ছিল? একজন মানুষও কখনোই কুরআনকে ভুল বুঝবে না- এমন কথা কুরআন ও হাদীসে আছে কি?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেবের মতে, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত এগুলো মূল ইবাদত নয়, বরং এগুলো হল ট্রেনিং কোর্স। তার মতে এ ইবাদতগুলো মূল উদ্দেশ্য নয় বরং মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা।
পর্যালোচনা: মূল ইবাদত, বুনিয়াদ আর উদ্দেশ্য কি সবসময় একই? সূরা আল বাকারাহর ১৮২ নং আয়াতে “রোযা এজন্য ফরয করা হয়েছে যেন..’’ বলা দ্বারা রোযাকে কি উদ্দেশ্য বুঝায় না (উদ্দেশ্য সাধনের) প্রক্রিয়া বুঝায়? সূরা আল ফাতহ এর ২৮ নং, সূরা আত তাওবাহর ৩৩ নং এবং সূরা আস সফের ৯ নং আয়াত মতে, রাসূল (সা.)-কে এজন্য প্রেরণ করা হয়েছে যেন দ্বীন বিজয়ী হয়।
এভাবে কি বুঝানো হচ্ছে না যে, রাসূল (সা.) প্রেরণের উদ্দেশ্য হল দ্বীনের বিজয়? সূরা বাকারাহর ৩০ নং আয়াত অনুযায়ী উদ্দেশ্য হলো প্রতিনিধিত্ব, সূরা আশ শামস এর ৭-৮ নং এবং সূরা আলে ইমরানের ১১০ নং আয়াত অনুযায়ী উদ্দেশ্য হলো সততা প্রতিষ্ঠা আর অসততা দমন, সূরা বাকারাহর ১৪৩ নং আয়াত অনুযায়ী উদ্দেশ্য হলো আনুগত্য, সূরা আল হজ্জের ৩৭ নং আয়াত অনুযায়ী উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া, সূরা আয যারিয়াতের ৫৬ নং আয়াত অনুযায়ী উদ্দেশ্য হলো ইবাদাত- একথা কি সঠিক নয়? দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজে রাসূল (সা.) এর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর নামায কাযা হয়েছে। কিন্তু নামায পড়তে গিয়ে দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজ বন্ধ হয়েছে কি?
সমালোচনা:লেখক বলেন, কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে হুকুমত বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই হলো নামায, যাকাত.. প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত করা।
পর্যালোচনা: তাহলে হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে নামায লাগে কেন?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব তার লেখনীর বহু স্থানে সুলাহা তথা বুযুর্গানে দ্বীনের লেবাস-পোশাক নিয়ে বিদ্রূপাত্মক ভাষার ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।
পর্যালোচনা: বিদ্রূপাত্মক ভাষা কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে? কাফের মুমিনের পোশাক পরলেই কি মুমিন হবে? মুমিন প্যান্ট-শার্ট-টাই পরলেই কি কাফির হবে? চিন্তার ও চরিত্রের পরিশুদ্ধি কি পোশাকের স্টাইলের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেবের মতে দাড়ি রাসূল (সা.) এর সুন্নাতে হুদা অর্থাৎ এমন কোন সুন্নাত বা আদর্শ নয় যা অনুসরণ করা জরুরী। তদুপরি তার মতে দাড়ি যে কোন পরিমাণ রাখলেই চলে।
পর্যালোচনা: দাড়ি রাখা জরুরী নয় একথা তিনি কোথায় বলেছেন? আল্লাহ ও রাসূল (সা.) দাড়ির পরিমাণ সম্পর্কে সরাসরি কোনো নির্দেশ দিয়েছেন কি?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব তার স্বরচিত তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকায় লিখেছেন- কুরআনের একটি আয়াত পাঠ করার পর যে অর্থ আমার বুঝে আসে এবং যা আমার অন্তরে উদয় হয়, যথা সম্ভব বিশুদ্ধ ভাষায় তাই নিজের ভাষায় বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি।
পর্যালোচনা: প্রখ্যাত মুফাসসিরগণ কিতাব ঘেটে যা বুঝেন ঠিক তার বিপরীত তাফসীর করেন কি? নাকি যা বুঝেন আমানতদারিতার সাথে সে অনুযায়ীই তাফসীর করেন?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব কুরআনের তাফসীরের ক্ষেত্রে এবং হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে পূর্বসূরী মনীষী তথা রিজালুল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।
পর্যালোচনা:মওদূদী সাহেব কুরআনের তাফসীরের ক্ষেত্রে এবং হাদীসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে পূর্বসূরী মনীষী তথা রিজালুল্লাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন- এর উদাহরণ আছে কি?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেবের লেখনীর বহু স্থানে মুক্ত বুদ্ধি প্রয়োগ এবং মুক্ত মনে কুরআন অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রতি যেভাবে সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তাতে তার মতবাদ অনুসারীগণ তাকলীদ তথা ইমামগণের অনুসরণ করার ব্যাপারে বল্গাহীনতার শিকার হয়ে পড়েছেন।
পর্যালোচনা:কুরআন বুঝা ও জ্ঞানার্জন কি ফরয নয়? এ ফরয কি ইমামের অনুসরণের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নয়? কুরআনির ইস্যুতে সকল ইমাম কি একমত নন? মাযহাবগত মতপার্থক্য নিয়ে উম্মতের মধ্যে বিভাজন কাম্য না মতৈক্যের ইস্যুগুলোকে ভিত্তি করে ঐক্য কাম্য?
সমালোচনা:মওদূদী সাহেব রব, ইলাহ, দ্বীন এ শব্দগুলোর অর্থ বিকৃত করেছেন।
পর্যালোচনা:রব মানে কি শুধু পালনকারী? ইলাহ মানে কি শুধু উপাস্য বা মা’বুদ? দ্বীন শব্দটির কি কোন একক অর্থ আছে না এর অর্থ অনেক? প্রকৃতপক্ষে এ শব্দগুলোর তাৎপর্য কি এক এক আয়াতে এক এক রকম নয়?
সমালোচনা:লেখক বলেছেন, সাহাবীরা সমালোচনার উর্ধ্বে।
সাহাবীদের সমালোচনা না করা এবং তাদের প্রতি ভক্তি ও ভালবাসা রাখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের নীতি।
পর্যালোচনা:সাহাবার ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে পারে কি? হয়েছে কি? হয়ে থাকলে তা উল্লেখ করা জায়েয কি? কুরআন-হাদীসে সাহাবার ত্রুটি উল্লেখ করা থাকলে কুরআন-হাদীসের সে শিক্ষা প্রচার করা যাবে কি? কুরআন-হাদীসে সাহাবার ত্রুটি উল্লেখ করা হলে সে অংশের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাহাবাকে নির্ভুল প্রমাণ করার নামে কুরআনের আয়াত বা হাদীসকে অস্বীকার করা কি আরও বড় অন্যায় নয়? আয়াত, হাদীস বা সাহাবীর মতে অন্য সাহাবীর ত্রুটি উল্লেখ করা আর ঐ সাহাবীকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে নিজ সিদ্ধান্তে, বানিয়ে, অযাচিতভাবে মন্তব্য করা কি এক?
সমালোচনা:লেখক বলেন, আহলে হকের অভিমত হলো: সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সকলেই আদিল তথা ন্যায়পরায়ন। অতএব তারা সমালোচনার উর্ধ্বে।
পর্যালোচনা:‘ন্যায়পরায়ন’ আর ‘শর্তহীনভাবে অনুসরণযোগ্য’ কি এক? যদি না হয় তাহলে সাবাবাগণ আদিল হলেও সমালোচনার উর্ধ্বে কিভাবে?
সমালোচনা:মহানবী (সা.) বলেছেন, “..আমার পর তোমরা তাদেরকে (বা সাহাবীদেরকে) সমালোচনার পাত্র বানিও না। ..”
পর্যালোচনা:কারোর ত্রুটির উল্লেখ আর তাকে সমালোচনার পাত্র বানানো কি এক? সাহাবীদের সকলেই জান্নাতী।
তাই, তাদের ত্রুটির চিন্তা না করে নিজের ত্রুটির চিন্তাই কি বেশি করা উচিত নয়? কারোর একটি ত্রুটি থাকলেই কি সে সার্বিকভাবে মন্দ? নবী ছাড়া সব মানুষেরই কি কম-বেশি ত্রুটি নেই?
সমালোচনা:লেখক বলেছেন, তাদেঁর (সাহাবীদের) পরস্পরে দ্বন্দ্ব-লড়াইয়ের বিষয়টি বিশ্লেষণ সাপেক্ষ এবং এ কারণে তাঁদের কাউকে আদালতের সীমানা থেকে সরিয়ে দেয়া যাবে না। .. তারা সকলেই ছিলেন মা’যুর।
পর্যালোচনা:সাহাবাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-লড়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই ছিলেন আন্তরিক। তবে, পরস্পরবিরোধী দুটো ইজতিহাদেই সওয়াব হলেও দুটোই কি সমানভাবে সঠিক?
সমালোচনা:লেখক বলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই, সকল সাহাবীই ঈমান, আমল, আখলাক, আদর্শ সকল ক্ষেত্রেই সত্যের মাপকাঠি ও মিয়ারে হকের দণ্ডে উত্তীর্ণ।
পর্যালোচনা:রাসূল (সা.) কে মানদণ্ড ধরলে সাহাবীগণই উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম বলে প্রমাণিত হন।
তাই- মানুষ হিসেবে মানদণ্ড কি রাসূল (সা.)-ই নন? রাসূলের অনুসরণের ব্যাপারে সাহাবীগণই মাপকাঠি। তারা নিজেরাই যদি সরাসরি মাপকাঠি হন তাহলে তাদের মর্যাদা কি এক্ষেত্রে রাসূলের সমান হয়ে যায় না?
সমালোচনা:সত্যের মাপকাঠি বা মিয়ারে হক কথাটি পূর্বসূরী মনীষীগণের পরিভাষা নয়। এটি জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী সাহেবের সৃষ্ট।
পর্যালোচনা:তাহলে লেখক কেন এ পরিভাষার চর্চা করছেন।
এভাবে সমালোচনা আর পর্যালোচনার ধারা অনেক দীর্ঘ।
পাঠকের কাছে অনুরোধ যেখানে যা প্রচার করা হয় তাতে অন্ধ না হয়ে যাচাই করে দেখুন। ভালোভাবে যাচাই করার পর যেখানে সত্য খুজেঁ পাবেন, নিজের পরকালীন স্বার্থে- সেটাকেই সহযোগিতা করুন। মিথ্যা বা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে নিজেও সোচ্চার হোন; অন্যকেও সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করুন।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সত্য ও সুন্দরের পথে আমরণ টিকে থাকার তাওফীক দিন। আমিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।