আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার প্রিয়তায় রবিঠাকুরের গীতি, নৃত্য ও কাব্যনাট্যের ভালোলাগার কন্যারা

চলে গেলো আরও একটি ২২শে শ্রাবন। কবিগুরুর মৃত্যুদিন বলে কিছু নেই। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন শত কোটী বাঙ্গালীর হৃদয়ে যতদিন তারা বুক ভরে নিশ্বাস নেবে এই পৃথিবীর আলো হাওয়ায়। রবিঠাকুরের গান,কবিতা, গল্প সবই আমাদের হৃদয়ের বলা ও না বলা কথা, দুঃখ বেদনা, ভালোবাসা বা বিরহের এক অমূল্য সঙ্গীত। এত সবকিছুর পরও রবিঠাকুরের কালজয়ী গীতি ও নৃত্যনাট্যরা এক ভিন্ন সুধা বইয়ে যায় আমার হৃদয় জুড়ে।

আমার ভালোলাগা আর ভালোবাসার গীতি ও নৃত্যনাট্যের সেই পাত্র পাত্রীরা খেলে বেড়ায় আমার চোখের সামনে দিয়ে সত্যিকারের আকারে নিরাকারে। আমি বোধ হয় অনেকের মাঝেও খুব সৌভাগ্যবান একজন মানুষ যে এই চরিত্রগুলো শুধু হৃদয়েই লালন করিনি। বিভিন্ন উৎসবে,মঞ্চে নিজের মাঝে ধারণ করতে পেরেছি একদম নিজের মত করে। কিছুক্ষনের জন্য ভুলেছি নিজের নাম ধাম পরিচয়। মিশে গিয়েছি একেবারেই তাদেরই মাঝে।

এমনি আমার অতি প্রিয় একটি গীতি ও নৃত্যনাট্য 'শ্যামা'। ১৩০৬ সালের ২৩ আশ্বিন ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যের পরিশোধ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ জন্ম দিলেন এক নায়িকার। নাম তার শ্যামা। আর তারপর ১৩৪৬ এর ভাদ্র মাসে‘শ্যামা’ চরিত্রটিকে মুখ্য করেই কবি লিখলেন একটি নৃত্যনাট্য। নাম বদলে হল ‘শ্যামা’।

এ গীতি নৃত্যনাট্যের প্রথম দৃশ্যে দেখা যায় বজ্রসেন ও তার বন্ধুকে। বন্ধু! তুমি ইন্দ্রমণির হার এনেছ সুবর্ণ দ্বীপ থেকে-- রাজমহিষীর কানে যে তার খবর দিয়েছে কে। দাও আমায়, রাজবাড়িতে দেব বেচে ইন্দ্রমণির হার-- চিরদিনের মতো তুমি যাবে বেঁচে। বজ্রসেন। না না না বন্ধু, আমি অনেক করেছি বেচাকেনা, অনেক হয়েছে লেনাদেনা-- না না না, এ তো হাটে বিকোবার নয় হার-- না না না, কণ্ঠে দিব আমি তারি যারে বিনা মূল্যে দিতে পারি-- বন্ধু।

জান না কি পিছনে তোমার রয়েছে রাজার চর। বজ্রসেন। জানি জানি, তাই তো আমি চলেছি দেশান্তর। পালাতে চাইলো বজ্রসেন তার বহুদিনের সাধনায় খুজে পাওয়া 'ইন্দ্রমনি' অমূল্য রতনটি নিয়ে যা সে সমর্পন করতে চায় একমাত্র তার ভালোবাসার মানুষটিকে যার দেখা আজও সে পায়নি। কিন্তু নগর কোটালের সন্দেহভাজন দৃষ্টির শিকার হলো সে।

তারা রাজকোষে চুরি যাওয়া মনির সাথে তার এ অমুল্য রতনের মিল খুঁজে পেতে চাইলো। রাজপথে বজ্রসেনের পেছনে নগর কোটাল। বজ্রসেন দৌড়ে পালায়। রাজ কাননে সখী পরিবৃতা নৃত্যারতা শ্যামার চোখে পড়ে সে দৃশ্য। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে শ্যামা তার।

ধরা পড়ে বজ্রসেন রাজকোটালের হাতে। মিথ্যে চুরির অপবাদে ওকে বেঁধে আনে কোটাল। এগিয়ে আসে শ্যামা রক্ষা করতে তাকে। কিন্তু কোটালের রোষানল থেকে রক্ষা করতে পারেনা বজ্রসেনকে। ভেঙ্গে পড়ে শ্যামা।

শ্যামা। তোমাদের এ কী ভ্রান্তি-- কে ওই পুরুষ দেবকান্তি, প্রহরী, মরি মরি। এমন করে কি ওকে বাঁধে। দেখে যে আমার প্রাণ কাঁদে। বন্দী করেছ কোন্‌ দোষে।

কোটাল। চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে, চোর চাই যে করেই হোক। হোক-না সে যেই-কোনো লোক, চোর চাই। নহিলে মোদের যাবে মান! শ্যামা। নির্দোষী বিদেশীর রাখো প্রাণ, দুই দিন মাগিনু সময়।

কোটাল। রাখিব তোমার অনুনয়; দুই দিন কারাগারে রবে, তার পর যা হয় তা হবে। শ্যামা। রাজার প্রহরী ওরা অন্যায় অপবাদে নিরীহের প্রাণ বধিবে ব'লে কারাগারে বাঁধে। ওগো শোনো, ওগো শোনো, ওগো শোনো, আছ কি বীর কোনো, দেবে কি ওরে জড়িয়ে মরিতে অবিচারের ফাঁদে অন্যায় অপবাদে।

এগিয়ে আসে পাগল প্রেমিক উত্তীয়। সে উত্তীয়। এক প্রেমাকাঙ্খী যুবক! শ্যামার জন্য বুঝি সে তার নিজ প্রাণ দিতেও ইচ্ছুক! কিন্তু হায়!! শ্যামা ভ্রুক্ষেপহীন। তার মনে উত্তীয়ের জন্য নেই কোনো স্থান, নেই ভালোবাসা। উত্তীয় দূর থেকেই ভালোবেসে যায় তাকে।

মায়াবন বিহারিনী হরিণী, কেনো তারে ধরিবারে করি পণ অকারণ!! http://www.youtube.com/watch?v=ZSmm-N3Z90I ভীনদেশী বিদেশীর তরে শ্যামার এমন মর্মপীড়া সহ্য হয়না তার। যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে সে চায় শ্যামার মুখের হাসি। আর তায় হাসি মুখে এগিয়ে আসে সে...................... উত্তীয়। ন্যায় অন্যায় জানি নে, জানি নে, জানি নে, শুধু তোমারে জানি ওগো সুন্দরী। চাও কি প্রেমের চরম মূল্য-- দেব আনি, দেব আনি ওগো সুন্দরী।

Click This Link ভালোবাসার চরম মূল্য দেয় উত্তীয়। নিজের কাঁধে তুলে নিতে চায় বজ্রসেনের মিথ্যা অপবাদ। বাঁচিয়ে দিতে চায় সে প্রিয়মানবীর প্রিয় মানুষটিকে। উত্তীয় প্রিয় যে তোমার, বাঁচাবে যারে, নেবে মোর প্রাণঋণ-- তাহারি সঙ্গে তোমারি বক্ষে বাঁধা রব চিরদিন মরণডোরে। কেমনে ছাড়িবে মোরে, ওগো সুন্দরী॥ প্র্রেমোন্মাদ শ্যামা তাতেই রাজী হয়।

উত্তীয় ধরা দেয় রাজকোটালের হাতে । কিছুপরে জ্ঞান ফেরে শ্যামার। বিবেকের দংশনে যখন তাকে বাঁচাতে ছুটে যায় সে তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। উত্তীয় তার নিজের জীবনের বিনিময়ে শ্যামাকে দিয়ে যায় তার শ্রেষ্ঠ উপহার। তার ভালোবাসার দান বজ্রসেনের জীবন।

পরম ভালোবাসার মানুষটি ও তার ভালোবাসা যে তার জীবনের চাইতেও অনেক অনেক বেশী প্রিয়। মুক্তি পেয়ে বজ্রসেন আপ্লুত হয়। দুজনে মিলে পালিয়ে যায় রাজবাড়ি ছেড়ে। খবর পেয়ে পিছে লাগে রাজার চর। পালিয়ে যায় তারা দূর পরবাসে।

গড়ে নতুন জীবন, ভালোবাসর ঘর। বজ্রসেন বার বার জানতে চায়। কোন মূল্যের বিনিময়ে এই দূরহ সাধন করেছে শ্যামা। কোন অর্ঘ্যে বাঁচিয়েছে তাকে। শ্যামা বার বার এড়িয়ে যায় সে কথা।

কিন্তু ক্ষনে ক্ষনে বজ্রসেনের মনে প্রশ্ন জাগে কোন মূল্যে এ অসাধ্য সাধন করেছিলো শ্যামা। শ্যামা নীরব থাকে। বলতে চায়না সে কথা যে তার প্রেমান্ধ এক অবুঝ বালক উত্তীয়ের প্রানের বিনিময়ে পেয়েছে সে তার ভালোবাসর মানুষটিকে। কিন্তু বার বার বজ্রসেনের মিনতিতে একদিন বাধ্য হয় শ্যামা বলতে সে গোপন সত্য। শ্যামা।

তোমা লাগি যা করেছি কঠিন সে কাজ, আরো সুকঠিন আজ তোমারে সে কথা বলা। বালক কিশোর উত্তীয় তার নাম, ব্যর্থ প্রেমে মোর মত্ত অধীর; মোর অনুনয়ে তব চুরি-অপবাদ নিজ-'পরে লয়ে.................. তীব্র ঘৃনায় শিউরে ওঠে বজ্রসেন। মরমে মরে যায় সে। এক পাগল প্রেমিক যুবকের প্রানের বিনিময়ে পেয়েছে সে তার নবজীবন!এ কথা বুঝি কিছুতেই সহ্য হয়না তার। শ্যামা তার প্রেমে পাগল হয়ে হত্যা করেছে একজনের নিস্পাপ ভালোবাসা।

সইতে পারেনা সে। অসহ্য হয়ে ওঠে শ্যামা ও তার প্রেম বজ্রসেনের কাছে। তার হৃদয়ে জাগে না শ্যামার জন্য আর এক ফোটা করুণাও। ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ওঠে বজ্রসেন। বজ্রসেন।

কাঁদিতে হবে রে, রে পাপিষ্ঠা, জীবনে পাবি না শান্তি। ভাঙিবে ভাঙিবে কলুষনীড় বজ্র-আঘাতে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শ্যামা। অনেক অনুনয়েও বুঝাতে ব্যার্থ হয় যে সে যা করেছে তা তার প্রিয়তমের জন্যই। শ্যামা।

ক্ষমা করো নাথ, ক্ষমা করো। এ পাপের যে অভিসম্পাত হোক বিধাতার হাতে নিদারুণতর। তুমি ক্ষমা করো, তুমি ক্ষমা করো। ঘৃনার তীব্রতা কাটেনা বজ্রসেনের তাতেও। সে চায়না একজনের হত্যা পাপের মূল্যে কেনা কারো ভালোবাসার দান।

ব্যাথায় বুক ভেঙ্গে যায় তার সেই অবুঝ অবোধ যুবকের জন্য যে তার ভালোবাসার মূল্য দিয়েছে নিজের জীবন দিয়ে। বজ্রসেন। এ জন্মের লাগি তোর পাপমূল্যে কেনা মহাপাপভাগী এ জীবন করিলি ধিক্‌কৃত। কলঙ্কিনী ধিক্‌ নিশ্বাস মোর তোর কাছে ঋণী। ছেড়ে যায় সে শ্যামাকে।

বিরহে, তীব্র দহনে পুড়ে যায় হৃদয়। তবুও পারেনা ভুলতে এ নিষ্ঠুর রমনীর খেলা। কিছুতেই ক্ষমা পায়না শ্যামা তার প্রিয়তমের কাছে। শত অনুনয় অনুরোধে আর ভালোবাসাতেও বুঝি ক্ষমা হয়না তার অপরাধের। বজ্রসেনের কন্ঠে অনুতাপ ঝরে শেষ বেলায়।

তবুও সে অপারগ। সেই তরুণ বালকের ভালোবাসর কাছে তার জীবন অতি তুচ্ছ পরাজিত বোধ হয়। বিরহের অনলে পুড়িয়ে বুঝি সে তার প্রায়েশ্চিত্য করতে চায়। শেষে এসে তার কন্ঠে ঝরে পড়ে দুঃখ, বিরহ, অনুতাপ ও শ্যামার প্রতি এক করুণাময় ভালোবাসা। শ্যামাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসেছিলো বজ্রসেন কিন্তু বালক উত্তীয়ের আত্মত্যাগ সে ভালোবাসায় কাঁটা হয়ে জেগে থাকে।

উত্তীয়ের ভালোবাসার কাছে বুঝি পরাজয় ঘটে দুনিয়ার তাবৎ প্রেমিকের। কি ব্যাথা বুকে নিয়ে এই চরম আত্মত্যাগ তা বুঝি কিছুতেই অনুধাবনও হয়না তার! বজ্রসেনের জীবন তুচ্ছ কলুষিত মনে হয়। খুঁজে পায়না সে কোনো সমাধান। পরিশেষে দেখা যায় বজ্রসেনের এক বুক ভালোবাসার হাহাকার। শ্যামার জন্য সে প্রার্থনা করে সৃষ্টিকর্তার কাছে।

মুছে দিতে বলে সে অভাগিনীর সকল পাপ তাপ। পাপের কাছে প্রেমের নির্লজ্জ্ব পরাজয়, প্রিয়ার ভালোবাসার মূল্য দেবার অক্ষমতা, বিবেকের দংশন, উত্তীয়ের আত্মাহুতির সকল অপরাধ নিজের কাঁধে নিয়ে সে চায় বিধাতার কাছে তার নিজ পাপের, ক্ষমাহীনতার চরম শাস্তি। Click This Link বজ্রসেন। ক্ষমিতে পারিলাম না যে ক্ষমো হে মম দীনতা, পাপীজনশরণ প্রভু। মরিছে তাপে মরিছে লাজে প্রেমের বলহীনতা-- ক্ষমো হে মম দীনতা, ......................... ক্ষমিবে না, ক্ষমিবে না আমার ক্ষমাহীনতা, পাপীজনশরণ প্রভু॥ সম্পূর্ণ শ্যামা গীতি ও নৃত্যনাট্যের ইউ টিউব লিন্ক- Click This Link রবিঠাকুরের শ্যামা গীতি নৃত্যনাট্যের শ্যামা, উত্তীয় ও বজ্রসেন।

এই তিনজনের জন্যই দর্শক, শ্রোতা ও পাঠক হৃদয়ে জন্মায় এক রাশ দুঃখ বেদনা ও ভালোবাসা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে অপরাধিনী শ্যামার প্রতি আমার এক বিশেষ দূর্বলতা রয়ে গেছে সেই বালিকা বয়স থেকেই। অভাগিনী শ্যামাকে মূল্য দিয়ে হয়েছে অনেকখানিই যার মূল্য হয়তো তার পরজীবনেও শোধ করা হবেনা। তাই শ্যামার দুঃখে সমব্যাথী হয়ে কাঁদে আমার মন আর সে এক প্রিয় নাম হয়ে জেগে থাকে আমার বুকের ভেতর। বিদায় অভিশাপ ।

বৃহস্পতিপুত্র কচ দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কাছে এসেছিলেন সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখবার জন্য। সেখানে হাজার বছর অতিবাহিত করবার পর নৃত্য গীত ও বাদ্যে শিক্ষিত হয়ে কচ যখন দেবলোকে প্রত্যাগমন করতে চাইলেন ও শুক্রাচার্যকন্যা দেবযানী হতে বিদায় নিতে গেলেন। তখন গুরুকন্যা দেবযানীর মন কিছুতেই প্রেমিক কচকে ছেড়ে দিতে চাইছিলো না। সেই বিরহ বিধুর প্রেম, ভালোবাসা আর আত্মহংকারের ক্ষনটিই ফুটে উঠেছে কবিগুরুর বিদায় অভিশাপ কাব্যে। বিদায় ক্ষনে কচ গেলো দেবযানীর কাছে বিদায় চাইতে।

কচ! দেহো আগ্গা, দেবযানী, দেবলোকে দাস করিবে প্রয়ান আজি গুরুগৃহবাস সমাপ্ত আমার। আশীর্বাদ করো মোরে, যে বিদ্যা শিখিনু তাহা চিরদিন ধরে অন্তরে জাজ্জ্বল্যমান থাকে উজ্জল রতন, সুমেরুশিখরশিরে সূর্য্যের মতন - অক্ষয়কিরন!!! দেবযানী! মনোরথ পুরিয়াছে, পেয়েছো দূর্লভ বিদ্যা আচার্য্যের কাছে সহস্রবর্ষের তব দুসাধ্য সাধনা সিদ্ধ আজি আর কিছু নাহি কি কামনা? ভেবে দেখো মনে মনে আর কিছু নাহি??? দেবযানী! ভেবে দেখো মনে মনে আর কিছু নাহি??? কচ! আর কিছু নাহি ভুলেই গেলো বুঝি কচ তিলে তিলে গড়ে ওঠা এতদিনের দেবযানীর প্রেম ভালোবাসা। হায় নিষ্ঠুর পুরুষ হৃদয়। স্বার্থ সিদ্ধির পর নেই কোনো দাম একটি নারী হৃদয়ের বুঝি। তাই তো সে বলে নির্বিকার- কচ।

সুকল্যাণ হাসে প্রসন্ন বিদায় আজি দিতে হবে দাসে। মন মানেনা দেবযানীর। বার বার বেঁধে রাখার নিস্ফল চেষ্টা করে চলে সে। দেবযানী । হায় বন্ধু, এ প্রবাসে আরো কোনো সহচরী ছিল তব পাশে, পরগৃহবাসদুঃখ ভুলাবার তরে যত্ন তার ছিল মনে রাত্রিদিন ধরে— হায় রে দুরাশা ! কচ ।

চিরজীবনের সনে তাঁর নাম গাঁথা হয়ে গেছে। কচ । ঈর্ষাভরে তিনবার দৈত্যগণ মোরে করিয়াছে বধ, তুমি দেবী দয়া করে ফিরায়ে দিয়েছ মোর প্রাণ, সেই কথা হৃদয়ে জাগায়ে রবে চিরকৃতজ্ঞতা। দেবযানী । কৃতজ্ঞতা! ভুলে যেয়ো, কোনো দুঃখ নাই।

উপকার যা করেছি হয়ে যাক ছাই— নাহি চাই দান-প্রতিদান । সুখস্মৃতি নাহি কিছু মনে? যদি আনন্দের গীতি কোনোদিন বেজে থাকে অন্তরে বাহিরে, ....................................... সেই সুখকথা মনে রেখো—দূর হয়ে যাক কৃতজ্ঞতা তবুও যেতেই হবে কচকে ফিরে আর তাই সে বলে- এত হাজার বছর যে সাধনার তরে এসেছিলে সে সাধনা তার আজ পূর্ন হয়েছে। তার কর্তব্য তাকে পূরণ করতে হবে। নিজ স্বার্থে নিজ প্রেমের কারণে সে পারেনা দেবযানীর সাথে থেকে যেতে চিরতরে। কচ।

শুচিস্মিতে, সহস্র বৎসর ধরি এ দৈত্যপুরীতে এরি লাগি করেছি সাধনা ? দেবযানী তা মানেনা সে বলে তার প্রেমও মূল্যহীন নয়- দেবযানী । কেন নহে? বিদ্যারই লাগিয়া শুধু লোকে দুঃখ সহে এ জগতে? করে নি কি রমণীর লাগি কোনো নর মহাতপ? পত্নীবর মাগি করেন নি সম্বরণ তপতীর আশে প্রখর সূর্যের পানে তাকায়ে আকাশে অনাহারে কঠোর সাধনা কত? ............. রমণীর মন সহস্রবর্ষেরই, সখা, সাধনার ধন। কচ মনে করিয়ে দেয় তার প্রতিজ্ঞার কথা। তার ভালোবাসা মিথ্যে নয় তবে তার কর্তব্যও তার উপরে। কচ।

দেবসন্নিধানে শুভে করেছিনু পণ মহাসঞ্জীবনী বিদ্যা করি উপার্জন দেবলোকে ফিরে যাব। এসেছিনু, তাই; সেই পণ মনে মোর জেগেছে সদাই; পূর্ণ সেই প্রতিজ্ঞা আমার, চরিতার্থ এতকাল পরে এ জীবন— কোনো স্বার্থ করি না কামনা আজি। ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দেবযানী। অপমানিত হয় অহংকারিনী। দেবযানী ।

ধিক্‌ মিথ্যাভাষী! শুধু বিদ্যা চেয়েছিলে? গুরুগৃহে আসি শুধু ছাত্ররূপে তুমি আছিলে নির্জনে শাস্ত্রগ্রন্থে রাখি আঁখি রত অধ্যয়নে অহরহ? উদাসীন আর সবা-’পরে? ছাড়ি অধ্যয়নশালা বনে বনান্তরে ফিরিতে পুষ্পের তরে, গাঁথি মাল্যখানি সহাস্য প্রফুল্লমুখে কেন দিতে আনি এ বিদ্যাহীনারে? এই কি কঠোর ব্রত? এই তব ব্যবহার বিদ্যার্থীর মতো? অভিমান ঝরে পড়ে মুঢ় বালিকার তার ভালোবাসার অপমানে। কিন্তু কচ নিরুপায়। যেতেই হবে তাকে ফিরে। সে বার বার বুঝায় সে নিরুপায় তার কর্তব্যের কাছে তবে তার ভালোবাসা মিথ্যে নয়। অভিমানে আপ্লুত হয় সেও দেবযানীর নির্মম বাক্যবাণে।

ক্ষমা চায় সে। কচ । হা অভিমানিনী নারী, সত্য শুনে কী হইবে সুখ। ধর্ম জানে, প্রতারণা করি নাই; ........................................ক্ষমো মোরে, দেবযানী, ক্ষমো অপরাধ। কিন্তু দেবযানী আজ তার নিস্পাপ প্রেমের করুন পরিনতিতে ক্ষিপ্ত, ক্ষুব্ধ ও নির্মম।

সে অপমানিত। কিছুতেই ক্ষমা করা সম্ভব নয় তার এই পাষান প্রেমিককে। দেবযানী । ক্ষমা কোথা মনে মোর। করেছ এ নারীচিত্ত কুলিশকঠোর হে ব্রাহ্মণ।

তুমি চলে ষাবে স্বর্গলোকে সগৌরবে, আপনার কর্তব্যপুলকে সর্ব দুঃখশোক করি দূরপরাহত ; আমার কী আছে কাজ, কী আমার ব্রত। আমার এ প্রতিহত নিষ্ফল জীবনে কী রহিল, কিসের গৌরব? এই বনে বসে রব নতশিরে নিঃসঙ্গ একাকী লক্ষ্যহীনা। যে দিকেই ফিরাইব আঁখি সহস্র স্মৃতির কাঁটা বিঁধিবে নিষ্ঠুর; লুকায়ে বক্ষের তলে লজ্জা অতি ক্রূর বারম্বার করিবে দংশন। ধিক্‌ ধিক্‌ , কোথা হতে এলে তুমি, নির্মম পথিক ...... ক্ষোভ ঝরে পড়ে দেবযানীর কন্ঠে। তার ভালোবাসার অপমান সহ্য না করতে পেরে সে অভিশাপ দেয়................যে বিদ্যার তরে তার ভালোবাসার অবহেলা করেছে কচ সেই বিদ্যা সে প্রয়োগ করতে পারবেনা কখনও।

তোমা-’পরে এই মোর অভিশাপ— যে বিদ্যার তরে মোরে কর অবহেলা, সে বিদ্যা তোমার সম্পূর্ণ হবে না বশ— তুমি শুধু তার ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভোগ; শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ। এতদিনের এত পরিশ্রমে শেখা বিদ্যার উপর গুরু কন্যার এমন অভিশাপে বুঝি হতাশ তখন কচ। শোকে তাপে হৃদয় ভেঙ্গে যায় তবুও তার ভালোবাসা মিথ্যে নয়, নয় প্রতারণা আর তাই সে বলে, কচ। আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে। ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে।

দেবযানীর প্রেমের মূল্য দিতে পারেনি কর্তব্যজ্ঞানে পরিপূর্ণ দেবতা কচ। তবে সহস্র বছরের শেখা বিদ্যায় দেবযানীর অভিশাপের বদলে বর দিয়ে যায় সে যেন তার প্রিয়তমার মনে তার কারণে এতটুকু দুঃখ, ব্যাথা বা গ্লানি না থাকে। সে যেন সবকিছু ভুলে তার দেয়া ভালোবাসার শেকড়টুকুও উপড়ে তুলে ফেলে দিতে পারে। আর সুখী হয় বাকী জীবনে। এই সেই দেবযানী আর তার নিস্পাপ ভালোবাসা, অভিমান বা রাগ বা ক্রোধ মূর্তমান জেগে রয় আমার হৃদয়ে চুপি চুপি সকলের অগোচরে অবিরল।

বিদায় অভিশাপ- সম্পূর্ণ লিন্ক Click This Link চিত্রাঙ্গদা মণিপুর রাজের কন্যা চিত্রাঙ্গদা। মণিপুর রাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে তাঁর বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে। এরপরেও যখন রাজকূলে চিত্রাঙ্গদার জন্ম হল রাজা তাকে পুত্ররূপেই লালন করলেন । রাজকন্যাকে শিখালেন ধনুর্বিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা, রাজদণ্ডনীতি একজন ছেলে সন্তানের মত । অর্জুন বারো বছরের জন্য ব্রহ্মচর্য ব্রত পালন করার কালে ভ্রমণ করতে করতে এলেন মণিপুররাজ্যে।

সেই সময়ে অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার দেখা। প্রথমে তার কূৎসিত কুরুপে অর্জুনের অবহেলার পাত্রে পরিনত হলো সে। এতে অপমানিত হয়ে চিত্রাঙ্গদা প্রেমদেবতার কাছে কিছুদিনের জন্য নারীর সৌন্দর্য্য বর চায় ও অর্জূনের দৃ্ষ্টি আকর্ষন করে। একসময় তার মধ্যে হতাশা জন্মে। সে তার গুনকেই রুপের চাইতে বড় ও সন্মানজনক ভাবে।

নিজের উপর সে হীনমন্যতায় ভোগে অর্জূন ভালোবেসেছে তার রুপকে যা তার নিজের কাছে মূল্যহীন। একসময় অর্জূন জানতে পায় চিত্রাঙ্গদার কথা। সাহস, শক্তি, বু্দ্ধি ও স্নেহে যে সর্বেসর্বা অর্জূন তার দেখা পাবার জন্য অধীর হয়ে ওঠে। এতদিনে বুঝি চিত্রাঙ্গদা খুঁজে পায় নিজ প্রকৃত স্বত্তা। সে আত্মরুপে প্রকাশিত হয় ................... আমি চিত্রাঙ্গদা! আমি রাজেন্দ্র নন্দিনী নহি দেবী নহি সামান্যা নারী।

http://www.youtube.com/watch?v=aQ5M9D0bNV4 সে এক আশ্চর্য্য নারী চিত্রাঙ্গদা। সে চায়নি নারীর সৌন্দর্যে কোনো পুরুষের পূজা। হে সহেনি কোনো পুরুষের অবহেলা। পুরুষের পাশে থেকে একই কাতারে নিজ দাবীতে সে ছিলো অটল। নারী পুরুষের সম অধিকারে সে যেন এক অবিচল দৃষ্টান্ত! তার অহংকার, শক্তি, বিশ্বাস সর্বপরি প্রেমময় মন সে এক আশ্চর্য্য ভালোলাগা।

ইউটিউব লিন্ক- চিত্রাঙ্গদা গীতি নৃত্যনাট্য http://www.youtube.com/watch?v=7oZ_mtwJCXE http://www.youtube.com/watch?v=8yCzKcBNjFY সম্পূর্ন চিত্রাঙ্গদা- Click This Link রবিঠাকুর ছিলেন বলেই হয়তো এই আকাশ ভরা সূর্য্য তারার মাঝে স্থান পেয়ে ধন্য হয়েছি আমি কারণ তিনিই আমাকে বুঝতে ভাবতে আর অনুভব করতে শিখিয়েছেন একটি ছোট্ট প্রজাপতি বা জোনাকীর মাঝেও সৃষ্টিকর্তার মহান সৃ্ষ্টির সৌন্দর্য্যকে । আমার সকল আবেগ অনুভুতি আর প্রেরণার মূলে দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জীবনের শেষ মুহুর্তটি পর্যন্ত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি জানাই কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা! সবশেষে আমার গাওয়া খুব খুব প্রিয় রবিঠাকুরের একটি গান। http://www.mediafire.com/?wj1eqbbd0jizysb  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।