আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অশ্রুপূর্ণ এক জোড়া চোখ, অপলোক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা দুটি শিশু

থানা সদর হাসপাতাল। নিষ্পলোক দুটি অশ্রুপূর্ণ চোখ চেয়ে আছে দু্টি ছেলের দিকে। ছেলে দুটির একটি বয়স ৭/৮ অন্যটির বয়স ১২/১৩। বড় ছেলেটির গায়ের রং, চেহারা, স্বভাব মায়ের মত ফর্সাই বটে। মা আদর করে সবার কাছে বলে, আল্লাহ আমার এই ছেলেকে মেয়ে বানাতে চেয়েছিল, অভাবের সংসারে এত সুন্দর মেয়ে হলে ভাল ঘরে বিয়ে দিতে পারতাম না বলেই ওকে ছেলে করে পাঠিয়েছে।

দ্বিতীয় ছেলেটির গায়ের রং গ্রামের ভাষায় রাঙা ফর্সা, স্বভাব বাবার মত, চেহারাটাও যেন বাবার নকল পেয়েছে। দুটি ছেলে বাবার দু'হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে বাবার দুপাশে। মা শুয়ে শুয়ে দেখছে আর অশ্রু গড়িয়ে পরছে চোখ দিয়ে। কথা বলতে চাইলেও বলার উপায় নেই। নাকের ভেতর দিয়ে নল চলে গেছে পেটের মধ্যে যেখানে জ্বমে আছে এ্যাসিডিটি।

বড় ছেলেটি বসতে চাইছে বেডে কিন্তু বাবা তার বসতে দিচ্ছে না, রোগীদের বেডে বসতে দিলে শেষে ছেলেদুটির না আবার অসুখ করে বসে। বড় ছেলেটি মাকে জিঙ্গেস করে মা বাড়ী যাবে কবে। মা শুধু চেয়ে থাকে, আর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে। মা হাত ধরে ছেলেকে কাছে বসায়, পরম আদরে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছেলেটি মায়ের খুবই ভক্ত, মা ছাড়া জীবনে এই দুটি রাত তারা ঘুমিয়েছে।

মায়ের আদরে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। মা চোখের জল মুছে দিয়ে ইশারায় জিঙ্গেস করে ভাত খেয়েছে কিনা, ছেলেটি আবারও কেঁদে বলে ভাতের ভেতর চুল পেয়েছে তাই ভাত খেতে পারে নাই। মা হাত বুলিয়ে দেয় ছেলের মাথায়। ছোট ছেলে বলে মা তোমার কি হয়েছে, নাকের ভেতর ঢোকানো নল ধরে টান দিতে চায়, ডাক্টারকে মার দিতে চায়, নার্সকে বলেছে ঘুসি দিবে যদি নল না খুলে দেয়। সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসার মান অত্যন্ত নিম্নমানের হলেও ছেলেদুটির বাবার কিছুটা পরিচিত নার্স থাকার ফলে ডাক্টারেরা চিকিৎসা দিচ্ছে নিয়মিতই।

নার্স বলে দিয়েছে বাঁচার সম্ভবনা খুব কম, পেটের মধ্যে আলসার নামক ঘা হয়েছে। এখানকার ডাক্টারেরা অষুধ বলতে দিয়ে যাচ্ছে ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল আর এ্যাসিডিটির জন্য এন্টারসিড। রেনিটিডিন বাজারে আসে নাই বা এখানে তার নাম কেও শোনে নাই। উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে হবে রাজশাহী অথবা ঢাকাতে। কিন্তু এই সামান্য চাকুরী বলতে একটি সরকারী ব্যাংকের পিয়ন হিসেবে মাসিক ৫৬০/= বেতনের চাকুরী করে ছেলে সংসার নিয়ে কোন মতে চলে যায় সেখানে চিকিৎসার অর্থ যোগার হবে কিভাবে সেটি নিয়েই চিন্তিত।

মাও বেশ চিন্তিত মারা যেতে পারে কথাটি শোনার পর থেকে। কথাটি অন্যান্য বড় হাসপাতালে হলে রোগীকে না বলে উৎসাহ দেয়া হলেও থানা সদর বা সরকারী হাসপাতালে সেগুলো রোগীকে বলে কিছুটা বিশ্রী ভাবেই। হয়তো নার্স ডাক্টারেরা প্রতিনিয়ত মানুষের কষ্টমুহুর্তগুলো দেখতে দেখতে খুবই স্বাভাবিক হয়ে গেছে তাদের কাছে। মা ছোট ছেলেকে কাছে নিয়ে জড়িয়ে ধরে, ভাবে যদি মারা যায় এই ছেলে দুটির কে দেখবে, কে খাওয়াবে, কে গোসল করাবে পরম আদরে, গ্রামের বাড়ীতে কখনও কখনও পা না ধুয়েই ঘুমিয়ে পরে, তখন কে গামলায় পানি নিয়ে পা ধুইয়ে দিবে, ঘুমন্ত ছেলেদের কে খাওয়াবে। মারা গেলে নানী দাদী কিছু দিন খবর নেবে, বাবাও হয়তো বিয়ে করবে ছেলেদুটির দেখাশুনার আশায়, হয়তো বা নিজের প্রয়োজনেই।

নতুন মা'ও হয়তো দেখবে যতদিন না তার ঘরে নতুন কোন অতিথি আসবে, তারপর! তারপর ছেলে দুটির কি হবে ভেবে দুচোখ গড়িয়ে পানি বেয়ে পরে, ছোট ছেলে মায়ের চোখের পানি মুছে দেয়, বলে তোমার কিছু হবে না। মা হাত বুলিয়ে দেয়, ছোট ছেলে মায়ের চুলেহাত বুলিয়ে দেয়, গলা জরিয়ে ধরতে চায় কিন্তু পারে না মা শুয়ে আছে বলে। ইশারায় জিঙ্গেস করে স্কুলে গিয়েছিল না, দুজনাই বলে গিয়েছিল। স্কুল ড্রেস ময়লা হয়েছে ধুতে হবে। এরই মধ্যে নার্স এসে বলে যায় ডাক্টার আসবে সবাইকে বের হতে হবে।

বাবা নিথর দাঁড়িয়ে ছিল, এবার বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে ছেলে দুটির হাত ধরে, বাসায় পৌছে দিয়ে অফিসে চলে যায়। মা একা শুয়ে থাকে হাসপাতালের বেডে। ছেলে দুটি স্কুলে যায়, স্কুল থেকে ফিরে হাঁস মুরগীর খাবার দেয়, ছাগলদের ঘাস নিয়ে এসে খেতে দেয়। তারাও যেন কারো অনুপস্থিতি বুঝে বেশীই ডাকা ডাকি করছে। সংসারে তাদের লেখাপড়ার খরচ চলে এগুলির উপর ভর করে, এমনকি স্কুল ড্রেস, সাবান, মাঝে মাঝে ওদের দুধও কেনা হয় এখান থেকেই।

বাড়ীতে আছে নানী, সন্ধ্যেয় ভাত রান্না হয়, খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরে তারা। মা বাড়ীতে নেই তাই পড়া লেখাও নেই। বাবা রাতে ফিরে ঘুমিয়ে পরে। নানী থাকতে চেয়েছিল হাসপাতালে কিন্তু ওখানে পরিচিত নার্সেরা আছে আর বাড়ীতে ওদের দেখাশুনারও লোক দরকার তাই তিনি বাসায় আছেন। দেখতে দেখতে আরো তিনটে দিন কেটে যায়, ছেলেদুটির কান্না কাটির কথা ভেবে বাবা আর নিয়ে যায় নাই তাদের।

মা ফিরে আসে বাড়ীতে, ডাক্টার অষুধ হিসেবে দিছে শুধু এ্যান্টারসিড ট্যাবলেট আর লিখে দিয়েছে এ্যান্টারসিড সিরাপ, কিছু পথ্য আর চিকিৎসার জন্য দ্রুত ঢাকা অথবা রাজশাহী নিতে বলেছে, তা না হলে বাঁচানো যাবে না। মা বাসায় ফিরেই টাকা কিভাবে যোগার করা যায় সেই চিন্তা করতে থাকে। তাকে বাঁচতে হবে তার ছেলেদুটির জন্য, ওদের ভবিষ্যতের জন্য। পরিচিত সবার কাছে টাকা ধারের জন্য হাত পাতে, কেও একটু সাহানুভূতির তাত বাড়ায় না। এভাবে প্রায় ১মাস কেটে গেলে টাকা আর যোগার হয় না।

অবশেষে উপায়ন্ত না দেখে গর্ভবর্তী ছাগটি বিক্রি করে ৩৫০টাকায়। ভেবেছিল কারো কাছ থেকে টাকা ধার করতে পারলে ঐ ছাগলের বাচ্চা হলে বিক্রি করে টাকা শোধ করে দেবে। কিন্তু অভাবের সংসারে কেও ধার দিতে চায় না। কিন্তু এই সামান্য টাকায় চিকিৎসা করা সম্ভব না। পরিচিত একজন বলে তুমি যশোর অথবা ফরিদপুর মিশোনারী হাসপাতালে দেখাও, তারা অধুষ দেবে স্বল্প মূল্যে আর চিকিৎসা সেবাও ভাল।

কিন্তু সেখানে গিয়ে থাকবে কোথায় সেখানেও তো কেও নাই। আর যে টাকা তাতে ঢাকা তো দুরে থাক রাজশাহীতেও দেখানো সম্ভব না। শেষে উপায়ন্ত না দেখে সিন্ধান্ত নেয় রাতের ট্রেনে যাবে আবার সন্ধ্যার ট্রেনে ফিরে আসবে। একদিন ট্রেনে যশোর মিশোনারী হাসপাতালে যায়, সকালে ডাক্টার দেখায়, ডাক্টার দেখে শুনে বুঝতে পারে এটি আর কিছু না, অভাবের সংসারে কোন দিন অর্ধপেট আর কখনও না খেয়ে থাকতে থাকতে তার এই অবস্থা। ডাক্টার জিঙ্গেস করে কেন তিন খান না, নিজে মারা গেলে কে দেখবে তাদের ছেলেদের, মা হেসে বলে ওরা তো বেঁচে থাকবে।

আমি ওদের মধ্যেই বেঁচে থাকব। ডাক্টার আশ্বাস দেয় তার কিছু হবে না অধুষ গুলো নিয়মিত খেলে আর নিয়ম মেনে চললে। মা ফিরে আসে রাতের ট্রেনে, ঘুমন্ত ছেলেদের বুকে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পরে। সংসার ফিরে পায় নতুন প্রাণ, আবার নেমে পড়ে জীবন যুদ্ধে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।