চারপাশে আত্মমুগ্ধ আদিমতাবোধ, আর গ্রন্থিবদ্ধ চিন্তা; সেখান থেকে মুক্তির পথ খুঁজি... ভ্যাবলা তারেক ছিল আমাদের স্কুলের সহপাঠি, বন্ধু। তারেকের নামের আগে ‘ভ্যাবলা’ বিশেষণটি আমাদের মধ্যেই কেউ দিয়েছিলাম, এখন ঠিক মনে নেই সেই ব্যক্তিটি আমি কি না।
আমরা যখন স্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছি মাত্র। সে সময় শুভর সাথে আমাদের বন্ধুত্বের দহরম-মহরম। শুভর বাবা স্থানীয় নেতা হওয়ার ফলে, আবেশী চুম্বকের মতো আমরাও ধীরে ধীরে প্রভাবশালী হয়ে উঠছিলাম।
প্রভাবশালীর আরেক অর্থ ক্ষমতাশালী। আপনারা দেখবেন উঠতি তারুণ্যের ক্ষমতা ষাঁড়ের শিঙ গজানোর মতো ব্যপার। যেখানে সেখানে গুতোগুতি করতে বেশ আনন্দ লাগতো। আমরা এটার একটা নাম দিয়েছিলাম ‘ফাঁপর দেয়া’।
একদিন আমাদের ফাঁপরে আক্রান্ত হলো ভ্যাবলা তারেক।
সেদিন আমরা পাড়ার রকে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমনি সময় তারেক যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে, বাঁ হাতের পলিব্যাগে কয়েকটি আপেল আর ডান হাতে আরেকটি নিয়ে খেতে খেতে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে বাবুর লোল পড়ছিল সম্ভবত; সে হঠাৎ ডাক দিলো,
‘ঐ তারেইক্কা, শুইন্যা যা’
তারেক আমাদের ডাক শুনে একটু থমকে দাঁড়ায়, তারপর এগিয়ে আসে। জিজ্ঞাসা করে, ‘কি রে?’
তখনই ফাঁপরটা দেই, ‘কি রে! কি রে কি?’ চোখ নাচিয়ে বলে উঠি ‘বড় ভাইগো লগে ক্যামনে কথা কইতে হয় জানস্ না?’
তারেক অবাক হয়। চোখ বড় বড় করে বলে, ‘তগো মনে নাই! আমরা প্রাইমারী স্কুল থাইকা এক লগে পড়ছি?’
‘হ পড়ছি, তো কি হইসে?’ সুমন বলে ওঠে।
এবার ও উত্তর দেয়, ‘তাইলে তরা আমার সিনিয়র হস ক্যামনে?’
‘আরে ব্যাটা আমার দাদাও তো আমার লগে প্রাইমারীর বই পড়ছে, এর লাইগা কি দাদা আর আমি সমান?’
‘না’
‘এই জন্যেই আমরা তর বড় ভাই। বুচ্ছস?’
‘হ’ তারেক মাথা নাড়ে।
বাবু জিজ্ঞেস করে, ‘আপেল পাইছোস কই?’
‘কিনছি। ’
‘দেহি মিষ্টি নাকি?’ পলিব্যাগটি তারেকের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় সে।
তারেক মৃদু প্রতিবাদ করে, ‘খাইছ না, মায়ে বকবো?’
‘তর মায়ে কি প্রতিদিন বকে?’
‘হ’
‘তাইলে এইটা আর নতুন কি?’ বাবু একটা আপেলে কামড় দিয়ে বলে, ‘আমাগো লাইগা আজকা এট্টু বেশি শুনবি’।
‘কিন্তু, দোস্ত...’ তারেক কিছু এটা বলতে যায়।
‘দোস্ত! কিয়ের দোস্ত? বড় ভাই ক ব্যাটা’ শুভ ধমকে ওঠে।
তারেক এবার ভ্যাবাচ্যাকা খায়। ওর মুখখানি একটু যেন ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। বলে, ‘বড় ভাই’।
‘আবার ক’ শুভ বলে।
‘বড় ভাই’
‘বাহ! লক্ষী সোনা। অহন থাইক্যা বড় ভাই কইয়া ডাকবি, ঠিক আছে?’
‘হ’ জবাব দেয় তারেক।
‘এখন বাসায় যা। মায়ে কিছু জিগাইলে কইবি বড় ভাইরা আপেল খায়া ফালাইছে।
ঠিকাছে?’
‘হ’
‘হ কিরে ব্যাটা, ক জী। ’
‘জী’ তারেক বলে।
‘আর শোন তগো বাসার তিন তালায় বিথীরা থাহে না?’
‘জী’
শুভর কথার ওজনে তারেক কিছুই অস্বীকার করে না। ওর চোখে চোখ রেখেই শুভ পেছন পকেট থেকে নিজের মানিব্যাগটা বেড় করে। সেখান থেকে ভাঁজ করা একটি কাগজ নেয় সে।
তারপর তারেকের হাতে দিয়ে বলে,
‘এই চিঠিটা বিথীরে দিবি, আর কইবি শুভ ভাই দিছে। ঠিকাছে?’
‘জী’ তারেক চিঠিটা হাতে নেয়।
‘ওক্কে, এইবার যা’ শুভ তারেককে বিদায় করে দেয়।
আমাদের হেব্বি আনন্দ হচ্ছিল তারেককে এমন ফাঁপর দেয়ার পর। কিন্তু তারেক যে একদিন আমাদের, এর চেয়েও বড় ফাঁপর দিবে সেদিন সেটা আন্দাজ করতে পারিনি।
আমাদের মধ্যে শুভর বাতিক ছিল চিঠি লেখার, মহল্লার সুন্দরী মেয়ে চোখে পড়লেই একটা চিঠি সে লিখে ফেলতো। শুধু তাই-ই নয়, ওর মানিব্যাগের ভেতর দু একটা রেডিমেট চিঠিও থাকতো। সেদিন তারেকের হাতে বিথীকে যে চিঠিটা দিয়েছিল সপ্তাহ শেষেও তার কোন জবাব না পেয়ে সে একদিন তারেককে ধরলো,
‘কি রে তারেইক্কা, বিথীরে কি চিঠি দিছস?’
‘জী’ তারেক জবাব দেয়।
‘সে কি কিছু কইছে?’
‘নাহ! কিচ্ছু কয় নাই’
‘বাদ দে, ব্যপার না। এই নে আর একখান।
এইটা বিথীর ছোট বোন রে দিবি; বুচ্ছস?’ শুভ তারেকের হাতে নতুন আরও একটি চিঠি ধরিয়ে দেয়।
‘জী’
‘কি য্যেন নাম মাইয়াডার?’
‘তিথী’
‘হ। তিথী; খুব সুন্দর নাম। ’ শুভ মন্তব্য করে।
এই ঘটনার পর তিথী-বিথী দুই বোন মিলে শুভকে যে জবাবটা দিয়েছিলো সেটা নিশ্চই সিরিয়াস একটা কিছু।
যা হোক শুভ যেহেতু চেপে গেছে আমরাও আর বেশি ঘাঁটাঘাটি করি নাই।
এইসব ঘটনার কয়েক বছর পরের কথা। তারেকের সাথে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ কম হতে থাকে, প্রায় দেখিই না বলা চলে। কে যেন বলেছিল, ও কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এমনই একদিন; এক বিষ্ময়কর সংবাদে আমরা একাট্টা হলাম।
মহল্লার শিমুল গাছের তলায় বসে আমাদের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হলো। শুভ অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল, বাবু মাথায় হাতদিয়ে বসে আছে। কেউ কেউ গালাগালি করে তারেকের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছিলাম। কারণ কি? কারণ তারেক আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সেনাবাহিনীর অফিসার পদে যোগদিয়েছে। শুধু তাই নয় সে ইতোমধ্যেই দীর্ঘকালিন প্রশিক্ষণে যোগ দিতে চলে গেছে।
আমরা ঈর্ষার আগুনে পুড়তে লাগলাম। শুভ বললো, ‘ব্যাটারে চোখে চোখে রাখা উচিত ছিল, দেখছোস তো আমাগো ফাঁকি দিয়া কেমনে লেফটেনেন্ট জেনারেল হইয়া গেল’।
আমরা সবাই একমত হলাম। ‘আসলেই চোখে চোখে রাখলে ভ্যাবলার এতো উন্নতি হইতো না। এখনতো গা জ্বালানি সহ্য হইতাছে না’।
সেদিন রাতেই স্বপ্ন দেখলাম। মঞ্চের সামনের অংশ আলোকিত। উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তুমুল দামামার তালে তালে পেছনের আলো-আঁধারি থেকে এক লেফটেনেন্ট জেনারেল এগিয়ে আসছেন। তিনি এসে আলোর বন্যায় দাঁড়ালেন।
কিন্তু একি আশ্চর্য এ যে আমাদের ভ্যাবলা তারেক!
মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে দেখলাম, ঘেমে নেয়ে উঠেছি। ও দিকে শুভও নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে কত, তার কোন ইয়ত্তা নেই। এভাবেই কেটে যেতে লাগলো দিনের পর দিন, আমাদের ঈর্ষাগুলোও বিরক্ত হয়ে উঠলো। শেষে শুভ তার চিরাচরিত মুদ্রাদোষে হাত নাড়িয়ে বললো, ‘বাদ দে, ব্যপার না’।
কিন্তু ব্যপার ঘটলো পরে, যখন তারেক এলো।
ঈদের ছুটিতে সে এলো। আমরা মহল্লার স্কুলের মাঠে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমনি সময় এক নওজোয়ান এসে দাড়ালো আমাদের সামনে। চুলগুলো এতো ছোট করে ছাঁটা যে মাথার চামড়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে এসে বললো, ‘স্লামালেকুম বড় ভাই, ভাল আছেন?’
শুভ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, সেই সাথে প্রায় সমস্বরে আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘আরে তারেক না?’
‘জী’ তারেক জবাব দেয়।
‘আরে তুই আমাগো আপনে আপনে করতাছস ক্যান?’ শুভ বলে ‘তুই আমাগো বন্ধু না, এক লগে পড়ালেহা করছি না বেটা?’
তারেক হাসে, সে হাসির আড়ালে এক মধুর প্রতিশোধ লুকিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করি,
‘তোর পদমর্যাদা কি রে?’
সে বলে, ‘সেকেন্ড লেফটেনেন্ট’
‘লেফটেনেন্ট জেনারেল কবে হইবি?’
তারেক এর কোন জবাব না দিয়ে শুধু হাসতেই থাকে। আমরাও আর এ জন্য চেপে ধরি না। সেনাবাহিনী ওকে কবে প্রমোশন দেবে জানি না, কিন্তু আমাদের কাছে সে আজীবন লেফটেনেন্ট জেনারেল ভ্যাবলা তারেক হয়েই থাকবে।
সমাপ্ত ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।