আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বাধীনতা-উত্তর শব্দ বিনির্মাণ আশির দশকের কবিতা

স্বাধীনতা-উত্তর শব্দ বিনির্মাণ আশির দশকের কবিতা এমরান হাসান স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতার বিনির্মাণ এবং বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপট নিরীক্ষণের পূর্বে স্বীকার করতেই হয় ত্রিশের দশকের বাংলা কবিতার বাঁক পরিবর্তনের বিষয়টিকে। কেননা জীবনানন্দের সমসাময়িক কবিরাই শুধু নন পরবর্তীকালে অধিকাংশ কবিই জীবনানন্দিক বোধকে লালন করে নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন তাদের কবিতার চারণভূমি। বাংলাদেশের কবিতার বিবর্তনের কাল কোন সময়টি? কোন সময়কেই বা কেন্দ্র করে বাংলাদেশের কবিরা শুরু করেছিলেন তাদের পরিবর্তিত কবিতার সপক্ষে পথ চলা? এ প্রশ্ন বর্তমান সময়ে যতটা মুখ্য তার চেয়ে মুখ্য বিষয় বাংলাদেশের কবিতার সঠিক সড়ক নির্মাণ। জীবনানন্দিক চেতনাকে ঊধর্ে্ব রেখেই স্বাধীনতাপূর্ব কালপর্বের অর্থাৎ ষাটের কবিরা নির্মাণ করে গেছেন তাদের কবিতা। যদিও ষাটের কবিতা প্রবল করাঘাত করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের আকুতি এবং প্রাপ্তির তীব্র ইচ্ছা।

পরবর্তী সময়ে সত্তরের কবিরা তাদের কবিতায় নতুন স্বদেশ প্রাপ্তির উৎসব এবং স্বাধীনতার প্রজ্জ্বলিত লাভায় উদ্দীপ্ত হয়ে তাদের কবিতা নির্মাণ করেছেন। কবিতায় পোস্ট মর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতার সূত্রপাত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন আশির কবিতা। সত্তরের কবিরা সাবলীলতার মঞ্চনির্মাণে যখন ব্যস্ত ঠিক সেই সময়ে আশির কালপর্বের অধিকাংশ কবি সত্যিকার অর্থেই উত্তরাধুনিকতার মুখোশ পরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বাংলা কবিতাকে। তাদের চিন্তা-চেতনা মতাদর্শের প্রায় পুরোটা জুড়েই উত্তরাধুনিকতার ধূসর মায়াবী হাতছানি। পাশ্চাত্য চিন্তা অর্থাৎ ডবংঃৎধহ ঃযড়ঁমযঃ কে বিশ্লেষণের ছাচে ফেলতে গিয়েই মধ্য সত্তরের পর বাংলা কবিতা প্রবেশ করতে শুরু করে অন্ধ গলিতে।

যেখানে শব্দের নেপথ্যে নির্মাণের প্রয়াস চলেছিল পাশ্চাত্য চেতনার। বরং দেশীয় পুরান, কাহিনী সরসী সঙ্গীত আর অপরূপ প্রকৃতিকে এক প্রকার পাশ কাটিয়েই চলেছিলেন আশির কালপর্বের কবিরা। আধুনিকতার সঠিক এবং সমর্থিত সংজ্ঞা বাংলাদেশের কবিতায় খুঁজে পাওয়া সত্যিকার অর্থে দুরূহ নয় কিন্তু উত্তরাধুনিকতা! কবিতাই শুধু নয় কথাসাহিত্য সঙ্গীত এবং নাট্যকলাতেও এই শব্দটি বোধকরি কখনোই উপযুক্ত নয়, কারণ সত্যিকার অর্থেই অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের পর আর কোনো কালকেই চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। নিজস্ব চিন্তা চেতনার সুস্পষ্ট ফসল কবিতা এবং অন্যান্য সাহিত্য। অতীন্দ্রিয় বিষয়াদি সত্যিকার অর্থেই সার্থক কবিতায় স্থান পায় কী? জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এরকম বহু উপমা স্থান পেলেও লক্ষ্য করলে বোঝা যায় পরবর্তী সময়ে আবার তিনি একই কবিতায় গতিপথ পরিবর্তন করেছিলেন তার চিরায়ত বোধের দিকেই।

সুধীন্দ্র নাথ দত্তের কবিতায়ও এরকমটি লক্ষ্যণীয় হয়। তারপরও জীবনানন্দ কিংবা সুধীন্দ্র নাথের কবিতায় বারংবার মুখ্য হয়েছিল বাঙালিয়ানা। প্রাধান্য পেয়েছিল বাংলার চিরায়ত মরমী আবেগ। ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশের কবিতায় সত্তরের কবিরা যথাসম্ভব বেগবান করেছিলেন বাঙালিয়ানার সার্থক প্রকাশের গতিপথকে। আশির কবিরা উত্তরাধুনিকতার ছাচে ফেলতে পুরোপুরি সক্ষম হননি বাংলা কবিতাকে বোধকরি, তাাদের কাছে দুর্বোধ্যই রয়ে গেছে আধুনিকতা আর উত্তরাধুনিকতার ব্যবধান।

তবুও এ দশকের বেশ কিছু কবিতায় নির্মিত হয়েছে নিজস্ব স্বপ্নের, কাঙ্ক্ষার। যার আবরণে তৈরি হয়েছে সত্যিকারের চিরায়ত সুন্দর কিছু স্তবক আর অসম্ভব দ্যুতিময় কিছু পঙ্ক্তি- ক. অজস্র স্বাক্ষর শেষে মৃত্যুকে যথার্থ মনে হয় গ্লাস বোতলের পাশে ছাইদানি, একা মোমবাতি উৎসব শেষ হলে সবকিছু ক্লান্তিকর লাগে জলেরও আকাশ আছে পাতালের অযুক্তি আবেগ -(জলজ পাথর/খালেদ হোসাইন) খ. পাখি, এক উড্ডীন গতিশীল গল্পের নাম বৃক্ষ, নিঃশ্বাসের সাঁকো-পথে হৃদি-পড়শি নদী, সঞ্চারণশীল আদি উৎসের ধ্বনি ফসল, অঙ্কুরিত প্রাণকোষের মুখরিত সস্নোক মানুষ, যে যার রহস্যের বৃত্তে নিখোঁজ -(কয়েকটি শাদা পঙ্ক্তি/শরীফ শাহরিয়ার) মানুষের সংজ্ঞা মুখ্য না হলেও জীবনের প্রয়োজনেই মানুষ আত্মকেন্দ্রিক। আশির দশকের কবিতার রাজকোষে এই আত্মকেন্দ্রিক ঘরানার কবিতার ভা-ার যৎসামান্য হলেও প্রচ- শক্তিশালী। বলা যায়, এই সুন্দর গতিপথকে অনেকটাই রহিত করে দিয়েছে উত্তরাধুনিক কবি'বৃন্দ। সত্যিকার অর্থে তাদের কবিতা কেবল শব্দের পাশে শব্দ বসিয়ে বাক্য সৃষ্টির নামান্তর মাত্র।

এ দশকের শামসেত তাবরেজী, জুয়েল মাজহার, ওয়ালি কিরন, তারিক সুজাত প্রমুখের কবিতায় বিষয় বস্তুর তীব্রতা থাকলেও প্রকাশ ভঙ্গিমার সীমাবদ্ধতা লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশের কবিতার নিজস্ব যে শরীর অর্থাৎ গঠনশৈলী সেটি থেকে উপরোক্ত কবিরা বের হয়ে যেতে চেয়েছেন। অভাবনীয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের কবিতায় দীর্ঘদিন চলে আসা যে স্রোত আজকের একবিংশ শতাব্দীতে সর্বজন বিদিত, আশির কালপর্বের অধিকাংশ কবিই এই মতাদর্শ এবং পথকে অস্বীকার করে তাদের কবিতা নির্মাণে ব্রতী হয়েছেন। যদিও জীবনানন্দিক উক্তির 'কবিতা অনেক রকম' স্বপক্ষে তারা হেঁটেছেন বারবার তবুও কবিতার জন্য পরিমার্জিত প্রকাশ ভঙিমা জরুরি। আশির কালপর্বের অনেক কবিই কবিতায় তুলে এনেছেন স্বেচ্ছাচারীতার নামে অসংজ্ঞায়িত কিছু চিন্তাধারা যাকে কবিতা নামে আখ্যায়িত করলে বোধ করি অত্যুক্তিই হয়ে ওঠে।

আবার ঠিক পাশাপাশিই আশির কবিতায় উঠে আসতে থাকে জীবন জীবিকার মারাত্মক দর্শন যা কিনা সময় আর চেতনার চাহিদাকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে। কবিতার নামে প্রহসন সৃষ্টি নয় বরং কবিতার সার্থক কাঠামো নির্মাণে এসব কবিতায় উঠে আসে অপরূপ জীবনের আড়ালে নিজস্ব অভিব্যক্তি- এখন আমার কালো রঙের মুখ এখন আমার একলা থাকার সুখ সঙ্গে যাওয়ার সঙ্গীরা কেউ নেই এখন আমার একলা টানার খেই একা একাই মাঠ ছাড়াবো আমি একা একাই হবো বিপথগামী জাপটে ধরে কালো সাপের লেজ একা একাই ভাঙবো রোধের তেজ। -(এখন আমার/শ্যামল সেন) আশির দশকের কবিতার একটি মারাত্মক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যোগাযোগমুখী চিন্তাধারা। অর্থাৎ পুরো সময়টাতেই প্রত্যেক কবিই আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের চিন্তাকে পেঁৗছে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন মানুষের দরোজায়। বাংলা কবিতার অন্য কোন দশকের কবিরা এই কাজটি সার্থক ভাবে সম্পন্ন করতে পারেননি।

অপর বৈশিষ্টটি হচ্ছে সব ধ্যান-ধারণাকে অস্বীকার করা। সত্যিকার অর্থেই আশির কবিরা এই বিষয়টিতে পুরোপুরি সফল হতে পারেননি কারণ চর্যাগীতিকার আবিষ্কারের সময় হতে ত্রিশের দশক পার হয়ে চলি্লশের কবিরা চেষ্টা করেছিলেন নতুনত্বের জয়গান গাইতে। পুরনোকে অস্বীকার করে তারা সফলতার কাছে পেঁৗছতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশের কবিতায় বিশেষত, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ এই তিন কবি কবিতাকে পেঁৗছে দিয়েছেন বাঙালি অস্তিত্ববাদ; আর মরমীবাদের চরম এক অবস্থানে যে স্থান থেকে কোনোক্রমেই বাংলা কবিতা চলে যেতে পরেনি অন্য কোনো পথে। ষাটের কবিরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক এক চরম সময় অতিবাহিত করেছেন যা কবিতার জন্য দুর্লভ রসদ হিসেবে কাজ করেছিল।

লক্ষ্যণীয় যে ষাটের দশকেই জীবনানন্দিক ঘরানা অর্থাৎ মাপজোক করে কবিতা নির্মাণের বিষয়টি আবার ব্যাপক আকার ধারণ করে আবু কায়সার, আবুল হাসান, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, অরুনাভ সরকার, শাহনুর খান, অসীম সাহা প্রমুখের কবিতার ভেতরে। বাঙালি সত্তার মরমীবাদ আর অস্তিত্ববাদের সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট ব্যবহার ষাটের কবিরা করেছেন তাদের সময়টিতে। তবুও ষাটের কবিতায় ঘটনা এবং বিবৃতির প্রাধান্যের কারণে কবিতা অনেকটা গাল্পিক স্ট্রাকচারে নির্মিত হয়েছে। সত্তরের কবিতা মূলত অন্তর্ভেদী এবং সামগ্রিক বিষয়াদিতে নির্মিত মনে হলেও সে সময়ের কবিতায় মখ্য বিষয় ছিল নতুন স্বদেশকে ঢেলে সাজানো আর মানুষের সামগ্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে বেগবান করা। সত্তরের রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবিদ আজাদ, ত্রিদিব দস্তিদার, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, নাসির আহমেদ, আবু হাসান শাহরিয়ার প্রমুখ এ আন্দোলনের অগ্রপথিক ছিলেন।

পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ সত্তরের দশকের শেষদিক থেকে শুরু করে আশির পুরোটা সময়জুড়েই বাংলাদেশের স্বৈরশাসন, অত্যাচার নিপীড়নের বিষয়গুলোকে নথিভুক্ত করতে শুরু করেন আশির কবিরা কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে তাদের কবিতায় ঢুকে যায় পোস্টমর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতার যার অন্যতম প্রধান কারণ লিটল ম্যাগাজিন চর্চা। অস্বীকার করার পথ নেই বাংলাদেশের কবিতার প্রথম আধুনিকতার সূচনালগ্নে লিটল ম্যাগাজিনের চর্চা বলবৎ ছিল এবং যার কারণে বাংলা কবিতা ক্রমাগত উৎকর্ষের পথে হেঁটেছে কিন্তু উত্তরাধুনিকতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতি আর সেই ঘরানার কবিতা চর্চা আশির দশকে পুরোপুরি শুরু হয়ে যায়। তারপরও আশির দশকে সৃষ্টি হয়েছে আলোড়িত করার সপক্ষে অসংখ্য সত্যিকার অর্থেই সুন্দর আর নান্দনিক পঙ্ক্তিমালা। সময়ের প্রয়োজনেই আশির দশকের এ কবিতাগুলো চির সুন্দর দ্যোতনায় বারংবার দুত্যিময়। ক. এতদিন সকল জাগরণে জ্বলন্ত খুঁড়ি মাটি ও পাথর নিচে তার বয়ে যায় আজো ফনাবিদ্ধ আগ্নেয় সাগর একটু শুইতে পারলে উঠবো, না পারলে এই শেষ চুমু নাও ক্ষমাশীল মৃত্তিকা-মহাদেশ সামনে ক্রন্দনশীলা পথ এবার তো প্রস্তুত রথ ওঠো জয়দ্রথ।

(দুঃখ ধরার ভরা স্রোতে/সুনীল সাইফুল্লাহ) খ. আমি কোনো মৃত্যু, কোনো জীবন বুঝি না। উৎসবের পূর্বে এই করতলে কেঁপে ওঠে চিতার আগুন হাতের চামড়া আর রোমকূপ পুড়ে পুড়ে তৈরি হয় রণাঙ্গন, আমি অজস্র অশোক পুষ্প ছুড়ে দিতে থাকি বিপক্ষের কংক্রিট তোরণে, তারপর কী রকমভাবে যেন পড়ে থাকি নিহত মানুষ (আত্মযুদ্ধ/ফরিদ কবির) অগণিত কবির অপরূপ গতিশীল ভঙ্গিমা এবং বাংলা কবিতার দীর্ঘ পথ পরিক্রমার ফসল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কবিতা। এই সময়ের অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তর কবিতার মঞ্চে সত্তরের কবিরা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন নিজস্ব আঙিনা। কতটুকু সফল তারা? বোধ করি ব্যর্থতার আর সফলতার পাল্লা সমান। কবিতার সহজ সাবলীল চিন্তা চেতনা আমৃত্যু আরাধ্য হওয়া উচিত সত্যিকার কবিদের।

প্রভাব ছাড়া কোনো সাহিত্যই সৃষ্টি হতে পারেনি আজ অবধি। সুতরাং প্রভাবের দায় স্বীকার করতেই হয়, তার অর্থ এই নয় নিজস্ব চিন্তাধারাকে হত্যা করে, নিজস্ব সংস্কৃতি পরিপন্থী কোনোকিছু সৃষ্টি করা। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আশির দশকের কবিরাই এ কাজটি খুব সচেতন ভাবে সম্পাদন করতে বারবার সচেষ্ট হয়েছেন। এ দশকের রেজাউদ্দিন স্টালিন, মারুফ রায়হান, সরকার মাসুদ, সৈয়দ তারিক, ফরিদ কবির, তারিক সুজাত, মজিদ মাহমুদ, আহমেদ মুজিব, মাসুদ খান, ওমর কায়সার, চিনু কবির প্রমুখের কবিতা উক্ত মন্তব্যের সপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। কবিতার ভাষা আর প্রকাশ ভঙ্গিমার ব্যবধানের কারণে সত্যিকারের কবিতার ঘরানা থেকে প্রায় অনেকটাই সরে এসেছেন উপরোক্ত কবিরা।

এ দশকের কবিদের কবিতায় নতুনকে স্বাগত জানাবার সফল চেষ্টা ধরা পড়ে। উঠে আসে বিক্ষিপ্ত চিন্তার ফসিল আর চেতনার ঝাপসা অনুরণন। আশির দশকের রাজনৈতিক, সামাজিক তদুপরি সামগ্রিক পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই বিপরীত মেরুতে থাকলেও কবিতায় তার প্রভাব অনেকাংশেই বিকৃত ঢঙে উঠে এসেছে। লিটল ম্যাগাজিন চর্চার দীপ্ততায় নয় বরং সভ্যতার অনুজ্জ্বল শিখার মতো নিশ্চুপ অথচ বর্ণাঢ্য আশির দশকের কবিতার পা-ুলিপি। কবিতার বিনির্মাণ বিপর্যয়ের পেছনে যে কারণগুলো চিহ্নিত করা যায় তার অন্যতম বোধকরি পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি দুর্বলতা এবং যত্রতত্র ব্যবহার।

কবিতা আত্মকেন্দ্রিকতার সুস্পষ্ট দলিল- এ উক্তির যথার্থ ব্যবহার করতে গিয়েও আশির দশকের কবিরা সফলতার দেখা পাননি শেষাবধি। কবিতা নয় কোন মৌন চুক্তিপত্র জীবনযাত্রার, মেধা আর মননের। কবিতা জীবনের কসাই খানায় ছোট্ট জলন্ত পিদিম। ভয়ার্ত অথচ চিত্তাকর্ষক এক অদ্ভুত পরিবেশ। আশির দশকের কবিদের মেধা, মননের কোনটিতেই এই বাক্যের সঠিক এবং সার্থক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়নি।

বাংলাদেশের কবিতার মনোমুগ্ধকর উদ্যানে সময়ের প্রয়োজনেই আশির কালপর্বের কবিরা জেগে উঠেছিলেন কলমের সপক্ষে। কবিতার পঙ্ক্তিতে প্রাধান্য পেয়েছিল স্বেচ্ছাচারিতা, স্বরচিত মতবাদের সপক্ষে সস্নোগান। প্রকাশ ভঙ্গিমাতে ছিল অপরিসীম সাহসিকতার পরিচয়। সীমাবদ্ধতা ছিল গতিময়তা আর শেকড় ও ঐতিহ্য সন্ধানী কবিতা সৃষ্টির বিষয়টিতে। এ দশকের খালেদ হামিদী, খালেদ হোসাইন, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, কামার ফরিদ, গোলাম কিবরিয়া পিনু শেকড় সন্ধানী কবি হিসেবে ব্যতিক্রমী।

তাদের কবিতার ঠাস বুনট, উপমার সঠিক ব্যবহার এবং শব্দের পর শব্দ সাজাবার নিখুঁত কারুকাজ পুরো সময়টাকে চিহ্নিত করেছিল আলোকোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে। আশির দশকের কবিতার রুদ্র উচ্চারণের ঘরানাই পরবর্তী দশকের কবিতাকে একদিকে যেমন বেগবান করেছিল তেমনি অপরদিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। এই দশকে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ চর্যাগীতিকার সর্বাধুনিক বাংলা অনুবাদ করে বাংলাদেশের কবিতাকে আরো উঁচু আসনে পেঁৗছে দিয়েছেন। এরকম জরুরি কাজ সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনতা পরবর্তী কবিতার ইতিহাসে বিরল। বাংলা কবিতার রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য বিধৌত ইতিহাস।

চর্যাগীতিকা থেকে শুরু করে গত শতাব্দীতে সৃষ্টি হওয়া কবিতা এবং ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশ তথা বাংলা সংস্কৃতির মিশেলে যে সব কবিতা সৃষ্টি হয়েছে সেটি সত্যিকার অর্থেই উল্লেখযোগ্য ভা-ার। স্বাধীনতা-উত্তর সত্তর কালপর্ব পরবর্তী আশির দশকের কবিতায় ঐতিহ্যিক দ্যোতনা খুব বেশি সৃষ্টি না হলেও উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু কবিতা চিহ্নিত করা সম্ভব। উত্তরাধুনিকতা নাম্নী অদৃশ্য মোহ নয় বাংলাদেশের কবিতায় প্রাধান্য বিস্তার করুক লোকজ ঐতিহ্য আর সময়ের শ্রেষ্ঠ সংলাপ। যায় যায় দিন ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।