আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানুষই শাহবাগকে পথ দেখিয়েছে: ইমরান

ঠিক এক বছর আগের এই দিনে শাহবাগে ওই অবস্থানের উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন ইমরান এইচ সরকার, আন্দোলনের গতিপথই যাকে করে তোলে মুখপাত্র।

শাহবাগ আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই মোড়ে অবস্থান, মানুষের সম্পৃক্ততা, আন্দোলন পরিচালনা, সরকারের অবস্থান, হেফাজতে ইসলামের উত্থান, আন্দোলনের লক্ষ্য, পরবর্তী পরিকল্পনা নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।

প্রশ্ন:  প্রায় এক বছর ধরে আপনাদের এ আন্দোলন চলছে। আন্দোলনের শুরুতে কি ভেবেছিলেন এটি এত দীর্ঘ হবে?

ইমরান: আন্দোলন একটি চলমান প্রক্রিয়া। আন্দোলনের নানান রকম পর্যায় থাকে।

দীর্ঘদিন তো আন্দোলন করছি, ৫ ফেব্রুয়ারির আগেও তো আন্দোলন করেছি। মানুষের পাশে বিভিন্ন সময় দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন ইস্যুতে রাস্তায় দাঁড়ানো এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ সব জায়গায় যে প্রচারণা, সেটা অবশ্য অন্য ধরনের আন্দোলন ছিলো। নতুন একটা পর্যায়, এ পর্যায়ে যে এতোদিন ধরে রাস্তায় থেকে আন্দোলন করতে হবে আসলে ৫ তারিখে এরকম কোনো চিন্তা ছিল না।

একটা রাজনৈতিক আন্দোলনকে যে এতদিন চালিয়ে যেতে হবে, তাতে অবশ্য নতুন একটা অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন: গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের পরে আপনারা আন্দোলনে নামেন। সেই আন্দোলনের শুরুটা কিভাবে হয়েছিল?

ইমরান: এই যে আন্দোলন শুরুটা, আগেই আমি বলেছি নানান পর্যায়ে এ আন্দোলন চলছে। মূলত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ কার্যক্রম চলছে। প্রথমে যখন ছাত্র ছিলাম, তখনও মূল ফোকাসটা ছিল জামায়াত বিরোধিতা। এরা যুদ্ধাপরাধী সংগঠন, এরা যে একটা খারাপ সংগঠন দেশবিরোধী এটা জানতাম।

সবচেয়ে কাছ থেকে দেখতাম শিবিরকে। শিবিরকে সব সময় আমরা মনে করতাম একটি সন্ত্রাসী সংগঠন।

তো আমি যখন একদমই ছাত্র ছিলাম, তখন আমাদের মধ্যে এই জামায়াত-শিবির বিরোধী একটা তৎপরতা ছিল, শিবিরবিরোধী একটা জোট ছিল। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে কাজ করতাম আমরা। এটি ছিল অ্যান্টি শিবির অ্যালায়েন্স।

সেখান থেকে আরো ধীরে ধীরে আন্দোলন চলতে থাকে আমাদের। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল যখন শিবির ক্ষমতায় ছিল তাদের যে তাণ্ডব, তাদের যে দাপট ক্যাম্পাসগুলোতে আমরা দেখেছি। সাধারণ ছাত্রদের ওপরে তারা যে নির্যাতন করেছে- বিভিন্ন স্থানে বম্বিং, অস্ত্র দিয়ে মানুষ হত্যা, সেগুলোর বিরুদ্ধে কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের একটি অবস্থান ছিল। সেগুলো একভাবে করতাম। আরো পরে আমরা একটি সংগঠন তৈরি করি ওয়াইপিডি নামে, ইয়ুথ ফর পিস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি।

রায়ের পর কাদের মোল্লার উদ্ধত ভঙ্গী

এই সংগঠনের কাজ একটু আলাদা ছিল- একটি সেক্যুলার ইয়ুথ ফোর্স তৈরি করা যারা পলিটিক্যালি কনশাস হবে, রাজনৈতিকভাবে সচেতন হবে। সে ভিশন নিয়ে আমরা কাজ করতাম এবং সারা দেশব্যাপী আমাদের ইয়ুথ গ্রুপ ছিল, তাদের বেশিরভাগই ছিল স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সদস্যদের সর্বোচ্চ বয়স ছিল ৩৫।

ওয়াইপিডিতে কাজ করতে গিয়ে একটি বড় নেটওয়ার্ক তৈরি হয়ে যায়। প্রায় ৫০ হাজারের একটি নেটওয়ার্ক, যারা নানাভাবে এর সাথে জড়িত ছিল।

তখন আমরা দেখতাম যে আমাদের বেশিরভাগ কর্মীই সোশাল মিডিয়ায় সক্রিয় ছিল, ব্লগ লিখে বা নানাভাবে ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে কানেকটেড। তথন আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ওয়াইপিডির সদস্যদের জন্য যেহেতু আমাদের রিসোর্স লিমিটেড ছিলো সহজে এদের প্রশিক্ষিত করা, আমাদের যে আদর্শ সেটা তাদের মধ্যে ছড়িযে দেয়া, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ছড়ানোর সহজ মাধ্যম হলো একটি ব্লগ তৈরি করা। কারো যদি একটি ব্লগ থাকে তাহলে সে অনুযায়ী সেখানে রিসোর্স প্রোভাইড করতে পারবো। তখনো অনেক ব্লগ ছিল, কিন্তু সমস্যাটা ছিল সেখানে  মুক্তিযুদ্ধবিরোধী নানা লেথা, বিতর্কিত অনেক লেখা আসতো।

আবার সেখানে নো-মডারেশনের কারণে নানা ধরনের ভাষাগত সমস্যা ছিল, আজে বাজে অনেক লেখা সেখানে চলে আসতো।

তো আমরা ভাবলাম, এরকম একটি ব্লগ তৈরি করি একটি ট্রেনিং মডিউলের মতো যেখানে মুক্তিযুদ্ধের মতো মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক করতে দেয়া হবে না। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, ধর্মীয় রাজনীতি বা জঙ্গিবাদী যে কার্যক্রম সে জাতীয় মানসিকতা সমর্থন করে সেরকম কিছু সেখানে থাকবে না। অসাম্প্রদায়িক মানসকাঠামো তৈরির জন্য যে কন্টেন্ট দরকার সেটি থাকবে।

প্রজন্ম ব্লগ অনেক ক্লিন হওয়ার কারণে খুব দ্রুত একটি ভাবমূর্তি তৈরি করে। আরো যে প্রগতিশীল ব্লগগুলো আছে সেগুলো নিয়ে আমরা একসঙ্গে সম্পৃক্ত করি।

এই ব্লগটি ছিল তরুণদের ব্লগ। আবার আমাদের ব্লগারদের মধ্যে একটি বড় অংশ ছিল যারা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন। আমরা এ ব্লগটি তৈরি করতে গিয়ে দেখলাম যে, একটি বড় অংশের ব্লগার এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তৈরি হয়েছে, যাদের বয়স ওয়াইপিডিতে কাজ করার জন্য সমর্থন করে না।

আমরা দেখলাম, বিভিন্ন ব্লগে অনেকে কাজ করে। প্রজন্ম ব্লগেও সবাইকে আনা সম্ভব না।

তথন আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, এই ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের নিয়ে একটি সংগঠন তৈরি করবো। এর প্রেক্ষিতেই ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক (বোয়ান) গড়ে তুলি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে অপপ্রচারগুলা চালানো হয় সেগুলোর বিরুদ্ধে আমরা ফাইট করার চেষ্টা করি। ওয়াইপিডি আর বোয়ান খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে থাকে। যেহেতু দুটো খুবই কাছাকাছি সংগঠন তাই তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও এক।

এরমধ্যে আপনারা দেখেছেন, বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে যেমন রাজা ত্রিদিব রায়ের লাশ এদেশে আনার চেষ্টা করা হয়েছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট গুল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে যখন নাক গলিয়েছে কিংবা বাংলাদেশের ক্রিকেট দলকে যখন পাকিস্তান পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তখনো কিন্তু আমরা এই শাহবাগেই প্রতিবাদ করেছি। আমরা যা-ই করছিলাম আমাদের ফোকাসের জায়গা ছিল একটিই- সেক্যুলার সোসাইটি তৈরি করা।  

প্রশ্ন: ৫ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের শুরুটা কিভাবে?

ইমরান: ১০ বছরে আমরা যে বিভিন্ন আন্দোলন করেছি তার প্রধান দাবিই ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার রায় দেয়া হল, খুবই অপ্রত্যাশিত রায়। আমরা কেউ এটা আশা করিনি যে, এমন একটা রায় হবে।

কারণ তার অপরাধ সম্পর্কে এদেশের প্রতিটি মানুষই ওয়াকিবহাল, যে সে কী করেছে এবং তার অপরাধের মাত্রাটা কী। তো তার যে অপরাধের মাত্রা সে অনুসারে কিন্তু আমরা আশা করতে পারি যে, এতগুলো হত্যাকাণ্ডের যে নায়ক-৩৪৪ জনকে হত্যার অভিযোগ যেখানে ট্রাইব্যুনালেই প্রমাণিত হয়েছে। তারপরেও যে রায় হলো সেটি কিন্তু এদেশের মানুষ মেনে নেয়নি। তাই রায় শোনার পরে কোনো সময় নেয়া হয়নি।

৫ ফেব্রুয়ারি বিকালে শাহবাগের চিত্র

রায় হলো ১২টার মধ্যে।

এরপরেই ১২টা ১৭ মিনিটে আমি ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিই- শাহবাগে একটা সমাবেশ ও গণমিছিল হবে, শাহবাগ মোড়ে। ৩টা ৩০ মিনিটে এ হওয়ার কথা ছিল। বোয়ানের সবার সঙ্গে এরমধ্যে কথা বলে, ব্লগার যারা আছেন সবার সঙ্গে কথা বলে আমরা বোয়ান থেকে অফিসিয়ালি আবার একথাটা জানিয়ে দিই ১২টা ২৩ মিনিটে।

এরপরেই আমি বাসা থেকে বের হয়ে যাই, বাঁধন (মাহমুদুল হক মুন্সী) আমার প্রতিবেশী, তাকে সঙ্গে নিয়ে যাকে যাকে পথে পেয়েছি তোলা শুরু করছি। বাসা থেকে নেমেই ফোন দেয়া শুরু করেছি।

মারুফ রসুল, আরিফ জেবতিক, অনিমেষ রহমান, আমি বাঙালসহ একদম প্রথম যারা ব্লগার এবং ওয়াইপিডির যারা সদস্য তারা সবাই আসা শুরু করি।

সবাইকে বলেছি শাহবাগে চলে আসতে। আমি আর বাঁধন সিএনজি নিয়ে রওয়ানা হলাম, পথে সবাক পাখির (ব্লগার) বাসা। তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে আমরা ফার্মগেট আসি। সেখানে একটি ব্যানারের দোকানে নামি।

সবাক পাখিকে নেয়ার উদ্দেশ্য হল, ও আবার খুব ভালো ডিজাইন করতে পারে। তাকে দিয়ে ব্যানার ডিজাইন করালাম যেটা আপনারা ৫ ফেব্রুয়ারিতে দেখেছেন। দুটো ব্যানার হয়েছিল একদম শুরুতে।

আমি ব্যানার নিয়ে যখন শাহবাগে পৌঁছাই ততক্ষণে শাহবাগে অন্তত শ’খানেক মানুষ জমা হয়েছে। সবাই বিশৃঙ্খলভাবে জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

আমি এসেই সবাইকে লাইন ধরাতে চেষ্টা করি। আর মারুফ ও আরিফ জেবতিক দেখি সাইনপেন দিয়ে পোস্টার লিখছে। বুয়েটের দ্বীপ, যে ছেলেটাকে মেরে ফেলল, ও ছিল। পোস্টার লিখছিল।

সবাইকে অর্গানাইজ করতে জাদুঘরের সামনের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিই।

এ কারণে অনেকে এটাকে ভুল করে মানববন্ধন ভেবেছে। আসলে মানববন্ধন আমাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না এবং জাদুঘরের সামনেও কোনো কর্মসূচি ছিলো না। কর্মসূচি ছিল শাহবাগ মোড়েই। ওই ফেসবুক স্ট্যাটাসটা দেখলে বুঝতে পারবেন।

মানুষ ভর্তি হয়ে যাচ্ছিলো- এ সময় আমরা একটা মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড়ে চলে গেলাম।

আনুমানিক ৪টা বাজে তখন। মূল মোড়ে অবস্থান নিই। মাইকের জন্য লোক পাঠানো হয়। অন্যান্য জিনিস ম্যানেজ করা। এরপর থেকেই কিন্তু প্রতি মিনিটে লোক বাড়তে খাকে।

সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনগুলো আসা শুরু করে। সবার প্রথমে আসে প্রগতিশীল ছাত্রজোট, মশাল মিছিল নিয়ে। এরপর ধীরে ধীরে আরো অনেকে আসা শুরু করে। রাত ৮টা বা ৯টার পরে ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী, জাসদ-ছাত্রলীগসহ আরো অনেকে আসলো।

সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল, তখন আমরা মোমবাতি কিনলাম পাশের একটি দোকান থেকে।

মোমবাতি জ্বালিয়ে পুরো এলাকাটা ঘিরে দেয়া হল। এরমধ্যে ঢাক-ঢোল চলে আসলো। কোথা থেকে আসলো আমরা কিন্তু জানি না। স্লোগানও তৈরি হয়ে গেছে। কেউ কিন্তু এমন নয় যে আগে থেকে স্লোগান দেয়।

সাধারণ মানুষই স্লোগান দিচ্ছে, স্লোগান তৈরি হয়ে গেল। এভাবেই চলতে থাকল, রাত অবধি মানুষ আসতে থাকল। চিন্তা করিনি রাতে মানুষ থাকবে। আমাদের কারোরই এক্সপেরিয়েন্স ছিলো না। ব্লগাররা যারা আন্দোলন কো-অরডিনেট করছিল এরা সবাই নির্দলীয় মানুষ।

ঠিক বুঝতেছিলাম না, কী করবো। রাতে থাকবো কি না- এটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলছিল।

প্রশ্ন: তবুও তো দেখা গেল রাতে অবস্থান করলেন.......

ইমরান: রাতে থাকা নিয়ে নানা মত ছিল। কেউ বলছিল রাতে থাকি, আবার কেউ বলছিল সকাল থেকে আবার আসি। সহযোদ্ধারা এমনই মত দিচ্ছিলেন।

এ অবস্থায় সিদ্ধান্ত হলো যে, না আমরা রাতে থেকেই যাবো। কারণ অনেকেই রাতে থাকার প্রিপারেশন নিয়েই এসেছিল। তো আমরা কেউ আর চলে গেলাম না। রাতে প্রচুর মানুষ থাকল, অতটা আশা করিনি।

প্রশ্ন: পরদিন অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি শুরুটা কিভাবে হল?

ইমরান: পরদিন সকালে যখন আলো ফোটা শুরু করে মানুষের ঢল নামা শুরু করল।

১০টা বাজতে বাজতেই কয়েক হাজার মানুষ। চারদিক থেকে শুধু মানুষ আসছে। যেদিকে দেখি খালি মানুষ আসছে। এভাবে ৬ তারিখের কর্মসূচি চলছে, অবস্থান চলছে। আরো বিভিন্ন সংগঠন যারা প্রথমদিন আসতে পারেনি তারাও আসা শুরু করল।

তখন একটু চেষ্টা করা হলো যাতে সাংস্কৃতিক দলগুলো একটার পরে একটা পারফর্ম করতে পারে। চত্বরের বাইরেও বিভিন্ন স্থানে অনেকে এসে বসা শুরু করল।

আমরা বোয়ান সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কোনোভাবেই এটাকে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবো না। যেহেতু গণআন্দোলন, যে যেভাবে যা করতে চায়, যেখানে বসতে চায় আমরা কোনো বাধা দেবো না। বরং আমরা তাদের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করতাম যে, কে বসেছে বা কোন সংগঠন বা কী তাদের পরিচয়।

এটা জাস্ট জানার চেষ্টা করতাম, কিন্তু কখনো গাইড করার চেষ্টা করতাম না। এভাবে চলতে থাকল।

গণমাধ্যম এ সময় পরবর্তী কর্মসূচি জিজ্ঞেস করা শুরু করল। এত বড় আন্দোলন চালানোর অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল না। তাই কী কর্মসূচি হবে সেটাও বুঝতে পরছিলাম না।

সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সময় লাগছিল, যে প্রাথমিকভাবে কী কর্মসূচি দেব। যখনই একটু সুযোগ পাচ্ছিলাম, সহযোদ্ধারা কথা বলে নিচ্ছিলাম। সবাই মত দিচ্ছিল। ফাইনালি মিডিয়া যেহেতু বারবার জানতে চাচ্ছে, তখন প্রেস মিট করে ৮ তারিখে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিলাম।

প্রশ্ন: ৮ ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নিলেন কিভাবে?

ইমরান: কীভাবে সমাবেশ করবো, কীভাবে হবে, কারা কথা বলবে কোনো কিছুই প্রথমে ঠিক করা হয়নি।

আমরা ভাবলাম যে, ৮ তারিখ যেহেতু শুক্রবার, আর হাতেও দুদিন আছে তাই পরিকল্পনা করার সুযোগ পাওয়া যাবে। পরে ৭ তারিখে আলোচনা হল বোয়ান অ্যাক্টিভিস্টদের সাথে, যারা আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্য যে সংগঠনগুলো এসেছিলো তাদের সঙ্গেও কথা বলার দায়িত্ব দেয়া হল। আমাকেই দায়িত্ব দেয়া হলো যেন তাদের সাথে কথা বলি।

৮ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে মহাসমাবেশ

তখন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে প্রথমে কথা বলা শুরু করলাম।

সন্ধ্যায় গ্রুপ ধরে কথা বলা শুরু করলাম। শুরু থেকেই আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল যে, কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকে রাজনৈতিক পরিচয়ে বক্তব্য দিতে দেবো না। আমরা এটা বার বার মাইকেও বলেছি। সাধারণ মানুষও এটাকে খুব এনকারেজ করেছে। ছাত্র সংগঠনগুলোকেও এ বিষয়ে আমরা কনভিন্সড করতে পারি।

যেহেতু ছাত্র নেতারা অভিজ্ঞ সেহেতু আমরা বললাম যে তারা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার জন্য আমাদের সঙ্গে থাকুক। তারাও সম্মত হলেন।

৮ তারিখের সমাবেশে সিভিল সোসাইটিকে আমরা বক্তব্য দিতে দিই। আমাদের কাছে যাদের মনে হয়েছে রাজনৈতিক পরিচয় নেই তাদের ডাকা হয়। গণ্যমাণ্য অনেকেই ছিলেন, অন্তত হাজার খানেক ছিলেন যারা মঞ্চে কথা বলতে পারেন।

কিন্তু সবাইকে তো মঞ্চে তোলা সম্ভব ছিল না, তাই এদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে আমরা মঞ্চে আহ্বান করি।

বোয়ান আন্দোলনের ডাক দিলেও ৫ তারিখের পরে কিন্তু এটা গণমানুষের আন্দোলন হয়ে যায়। ৮ তারিখ পর্যন্ত এভাবেই চলে। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে বিভিন্ন সময় আমরা বক্তব্য দিয়েছি এটি কিসের ভিত্তিতে দিতাম। এখানে যখন সবাই জড়ো হল তখন কখনো কাউকে বলতে হয়নি।

মানুষই আমাদের খুঁজে নিয়েছে, তারা কিছু বলতে হলে আমাদের বলতো।

সমাবেশের আগে কিন্তু আমি মুখপাত্র হইনি। ওই সমাবেশে আমাকে সভাপতি করা হয়েছিল। আমি হতে চাইনি, গণ্যমান্য অনেকেই ছিলেন। আমার কোনো প্রিপারেশন ছিল না।

কিন্তু যারা এসেছিলেন তারা বলেন যে, না এটা তরুণদের আন্দোলন তোমাকেই সভাপতিত্ব করতে হবে। পরিচালনাও আমি করেছিলাম।

অনেকে কথা বললেন, শপথ পাঠ করানো হল। বোয়ানের অফিসিয়াল যে বক্তব্য সেটা প্রথমবার সমাবেশে পড়া হল। যেহেতু তখনো গণজাগরণ মঞ্চ হয়নি, তাই বোয়ানের নামেই সব হল।

এর মধ্যে প্রায় সব সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে, একটা প্ল্যাটফর্ম বা নাম দেয়া যেতে পারে। একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তৈরি করা যেন আন্দোলনের সিদ্ধান্তগুলোতে সবার অংশগ্রহণ থাকে। তবে এটা আনুষ্ঠানিক কোনো কাঠামো ছিল না।

তখন আন্দোলনের নাম গণজাগরণ মঞ্চ দেয়া হয়। অনেকে শাহবাগকে তাহরির স্কয়ারের সঙ্গে মিলিয়ে শাহবাগ স্কয়ার বা অন্য কোনো নাম দিচ্ছিল, আমরা ভাবলাম এটারও একটা নাম দেয়া যায়।

অন্য কোনো আন্দোলন যেমন তাহরির স্কয়ার বা ওয়াল স্ট্রিটের সঙ্গে কিন্তু শাহবাগের আন্দোলনের অনেক পার্থক্য ছিল। শাহবাগ একটি আদর্শিক আন্দোলন। এ ধরনের নাম দেয়ায় বিভিন্ন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছিল। বিদেশি পত্রিকাগুলোও আন্দোলনকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করছিল। এজন্য প্রজন্ম চত্বর নাম দেয়া হয়, যেহেতু ওয়াইপিডির ব্লগের নামও ছিল প্রজন্ম ব্লগ, এটার সঙ্গে মিলিয়েই নাম দেয়া হয়।

নামের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে ৮ ফেব্রুয়ারির সমাবেশে। সমাবেশ শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী আন্দোলনের নাম গণজাগরণ মঞ্চ এবং ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী শাহবাগের নাম প্রজন্ম চত্বর প্রস্তাব করেন। সবাই সেটা গ্রহণও করল।

প্রশ্ন: সরকারের চাপ, হেফাজতে ইসলামের উত্থান বা অন্য যে সব বাধা এসেছিল সেগুলো কিভাবে সামলালেন?

ইমরান: এ আন্দোলনের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল রাজনীতিকীরণ না হওয়া। এটি অনেক দুরূহ কাজ ছিল, যেহতু আমরা সবাই সাধারণ মানুষ।

সমর্থনের সবচেয়ে বড় জায়গা ছিল জনগণ। তারাই পথ দেখিয়েছে। যখনই এটাকে রাজনীতিকীরণের চেষ্টা হয়েছে বা কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া হয়েছে সাধারণ মানুষই এর প্রতিবাদ করেছে। তারা নো নো বলে কিন্তু জানিয়ে দিয়েছে। এটিই অনেক বড় শক্তি ছিল।

এটা ধারণ করেই কিন্তু আন্দোলন চলছে।

রাজনীতিবিদরা কিন্তু সমাজের বাইরের কেউ নন, আর এটা একটা উন্মুক্ত আন্দোলন। বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনগুলো থাকার কারণে এবং তাদের রাজনৈতিক পরিচিতির কারণে মানুষের মধ্যে অনেক সময় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বিরোধী পক্ষও একে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। বারবার আমরা বলার চেষ্টা করেছি, এখানে সবাই আসতে পারে তবে এটা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের আন্দোলন না।

বিপত্তি আরো তৈরি হয়েছে আমাদের ছয় দফা দাবি নিয়ে, এগুলো নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আন্দোলন করে আসছে। অনেকের সঙ্গেই আমাদের দাবি মিলে গেছে। একই দাবি দেখেও অনেকের মনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে যে আসলে এরা কি এক কি না।

দাবি বিবেচনায় নিয়েই বড় বড় দলগুলো জোরালো সমর্থনের কথা বলেছে। এমনকি সংসদেও কিন্তু আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দৃঢ়ভাবে আমাদের দাবি সমর্থন করেন।

এজন্যই অনেকের মনে শঙ্কা তৈরি হয় যে, কোনো একটি রাজনৈতিক দল আন্দোলন দখল করে নিল কি না। অনেকেই প্রশ্ন করেছে এ বিষয়ে।

এটা এমন হতে পারে যে, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যে অবস্থান নিয়েছিল তখন সেটা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ঠিক ছিল। রাজনৈতিক দলের গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তারা যেটা করেছে, আন্দোলনকে সমর্থন করে এটা সরকার সমর্থিত তা ছড়িয়ে আন্দোলনকে তাদের দিকে নিতে চেষ্টা করেছে।

তারা এক্ষেত্রে কিছুটা সফল হয়েছে, মানুষ কিছুটা বিভ্রান্তও হয়েছে কিন্তু। কৌশল থেকে এমনটা করে থাকতে পারে।

‘করে থাকতে পারে’ এজন্যই বলছি যে, প্রধানমন্ত্রীর সে সময়ের যে বক্তব্য তার কোনো প্রতিফলন কিন্তু আমরা পরে দেখিনি। তিনি বলেছিলেন, ছয় দফায় তার সমর্থন রয়েছে এবং তিনি এটার বাস্তবায়ন করবেন। এর কিন্তু এখনো পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দেখিনি।

যেমন ধরেন, আমাদের প্রধান দাবি জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, এটা নিয়ে কিন্তু আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বলছেন, জামায়াত রাজনৈতিক দল, আবার অনেক মন্ত্রী ইসলামী ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন করেছেন। এগুলো ছয় দফা পরিপন্থী। এখন কিন্তু বিষয়গুলো পরিস্কার হয়েছে।

সরকার আন্দোলনকে বাধা দেয়ারও চেষ্টা করেছে। যেমন হেফাজতে ইসলাম নামে একটি উগ্রবাদী সংগঠনের উত্থানকে কেন্দ্র করে শাহবাগে মঞ্চ ভেঙে দেয়া হয়েছে।

এটা কিন্তু সরকারের প্রাথমিক অবস্থানের সঙ্গে যায় না। কোনোভাবেই গণজাগরণ মঞ্চের অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে হেফাজতের আন্দোলনকে মেলানো ঠিক নয়।

সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতারও কিন্তু জায়গা আছে। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে, আইন সংশোধন করেছে- এ জায়গায় আমাদের কৃতজ্ঞতাও রয়েছে। আমরা সাধুবাদও জানাই।

প্রশ্ন: আন্দোলনের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে?

ইমরান: আমাদের প্রধান ইস্যু যুদ্ধাপরাধীদের রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ছয় দফার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনোভাবেই রাজপথ থেকে সরে যাচ্ছি না। আমরা যখনই দেখবো কোনো শঙ্কা তৈরি হয়েছে, কোনোভাবে যদি বিচার বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হয় তখনই আমরা কঠোর অবস্থানে চলে যাব। অবস্থান যদি আবারো নিতে হয়, তাহলে আবার অবস্থান নেব।

প্রশ্ন: কিছুদিন আগেই দুটি রোডমার্চ শেষ করে ফিরলেন।

 ৫ ফেব্রুয়ারি, গণজাগরন মঞ্চের এক বছর পূর্তি, সব কিছু মিলিয়ে অনেক ব্যস্ত যাচ্ছে। আমরা জানি অনেক চাপ আপনার উপর, কেমন আছেন?

ইমরান: লাগাতার প্রোগ্রাম চলছে, একটার পরে একটা- ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে রোডমার্চ গেল দুটো, আবার এখন ৫ ফেব্রুয়ারি। একদিকে ভিতরে অনেক আনন্দ অনুভব করছি, অন্যদিকে যেহেতু প্রায় পুরোটা সময়ই রাজপথে আর আমাকেই কথা বলতে হয় সব সময় সেকারণে এ গণআন্দোলনের পক্ষ থেকে মূলত আমার খারাপ থাকার কোনো সুযোগ কখনো তৈরি হয়নি। আছি ভালই।

প্রশ্ন: বাড়তি চাপ অনুভব করছেন?

ইমরান: বড় একটি ঘটনা শেষ রোডমার্চ, সেখান থেকে একটা অনুপ্রেরণা আমাদের মধ্যে কাজ করে যে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি।

এর একটা ভালো অনুভূতি আমাদের মধ্যে কাজ করছে। একটু চাপ আছে, ৫, ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি তিন দিনের কর্মসূচি আছে।

আরেকটা বড় চাপ হচ্ছে, দায়বদ্ধতার জায়গা। এক বছর পার করে এতোগুলো কাজ, এতো সময়, এতো দীর্ঘ আন্দোলন- মনে হয় অনেক দায়িত্ব বেড়ে গেছে, দায়বদ্ধতার জায়গা তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন: এর আগে একবার শাহবাগ তৃণমূলে গিয়েছিল, এবার রোডমার্চে গেলো।

এই দুটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য চোখে পড়েছে?

ইমরান: শাহবাগের আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল যে বাইরে যাবো। চট্রগ্রাম ও ময়মনসিংহে সমাবেশের আয়োজন করা হলেও আমরা যেতে পারিনি। মূলত আমাদের প্রতিনিধি দল বিভিন্ন জেলায় গিয়েছে। সেখানে মঞ্চের আঞ্চলিক প্রতিনিধিরাই থেকেছে, এজন্য আসলে মূল্যায়নের সুযোগ হয়নি।

রোডমার্চে আমরা সবাই গিয়েছি।

দুটো রোডমার্চেই আমাদের প্রায় ৫০টি পথসভা ও সমাবেশ হয়েছে। প্রতিটিতে হাজার থেকে লাখো মানুষের উপস্থিতি কিন্তু ছিল। সাধারণ মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে। সুতরাং সারা দেশে মানুষের যে সমর্থন ছিল এতো প্রোপাগান্ডা আর অপপ্রচারের পরেও মানুষের অবস্থান আগের জায়গাতেই আছে। যেহেতু শাহবাগে অবস্থান এখন আর নেই, লাখো মানুষের উপস্থিতিও শাহবাগে নেই, কিন্তু এ শাহবাগ সব গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে।

এর প্রতিফলন আমরা দেখে এসেছি।


সোর্স: http://bangla.bdnews24.com     দেখা হয়েছে বার     বুকমার্ক হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.