......... গল্প শুরুর আগেঃ
এ গল্পটি পড়ে অনেকের মনে হতে পারে এটি তীব্র বর্ণবাদী মনোভাব থেকে লেখা হয়েছে। বিভিন্ন রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনগুলো দেখলে কেন যেন মনে হয় আমরা এখনও কঠিন বর্ণবাদী সমাজে বসবাস করছি। এ গল্পটি হয়ত সে সমাজেরই।
যাক প্যাঁচাল বাদ দেই। গল্পে আসি...
১।
সবুজ কালারের হাফ শার্টটা গায়ে দিয়ে বাইরে বেরুল মারুফ জাবের। আকাশে কটমটে রোদ। চোখ খুলতে কষ্ট হয় এমন অবস্থা। একটা সানগ্লাস কিনতে হবে। বিড়ালের মত চোখ করে চারপাশে তাকায় সে।
ভার্সিটি এলাকায় দাঁড়িয়ে এখন, আশেপাশে সুন্দরী মেয়েদের দেখা যাচ্ছে। সব মেয়েরা খুব সুন্দর করে ছাতা নিয়ে হাঁটছে। মারুফ জাবের তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
চায়ের তৃষ্ণা পায় তার। রাস্তা পেরিয়ে রতন মামার চায়ের দোকানে যায় সে।
চায়ের সাথে বেনসন ধরালো একটা। বাইরের গরম, চায়ের গরম আর সিগারেটের ধোঁয়ায় মাথার ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগছে তার। অদ্ভুত এক মাদকতা চলে আসছে মনে। নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বসে পড়ল ফুটপাথের পাশের রেলিংটিতে।
আপনি ওখানে বসলেন কে? খুব তীক্ষ্ণ গলায় বলল কেউ একজন।
মারুফ জাবের ঘাড় ঘুরাল। দেখল একমেয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হেঁটে আসছে ওর বসার জায়গাটার দিকে। মেয়েটার কী সুন্দর চোখ, কী ফর্সা গায়ের রঙ, সবচেয়ে বড় কথা কী সুন্দর ফিগার!
আপনি আমার জায়গায় বসলেন কেন? কী সমস্যা আপনার? আমি কাগজ বিছিয়ে জায়গা রেখে গেলাম, তাও যে সে কাগজ না, আমার ক্লাসনোট, এই যে কী হল উঠেন না কেন, কী সমস্যা আপনার?
হাঁটুর কাছে গরম অনুভূতি হল মারুফ জাবেরের। কী সর্বনাশ! চা পড়ে গিয়ে প্যান্টটা নষ্ট হয়ে গেছে। কোন কথা না বলে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল মারুফ জাবের।
মেয়েটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হেঁটে দূরে সরে যাচ্ছে সে।
আউ করে শব্দ হল একটা। সাথে সাথেই মেয়েটার হাসির শব্দ পাওয়া গেল। মারুফ জাবের উঁচু ফুটপাথ থেকে উল্টে পড়ে গেছে। চা দিয়ে মাখামাখি সারা শরীর।
সিগারেটের আগুন আঙ্গুলে লেগে ভীষণ জ্বালা করা শুরু করেছে।
লজ্জায় নত মারুফ জাবের উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ তার কেমন শীত শীত লাগা শুরু করেছে। কেমন একটা শিরশির করা অনুভূতি। তার মনে হতে লাগল সে এই মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেছে।
সে অন্ধের মত মেয়েটার কাছে গেল, খুব স্বাভাবিক গলায় বলে ফেলল আমি তোমার জন্য প্রতিদিন গায়ে চা মেখে বসে থাকতে রাজী আছি, তুমি কি আমাকে সে সুযোগটা দিবে?
মেয়েটা কিছু না বলে মিষ্টি করে হেসে ফেলল। হাসি হাসি মুখ করে বলল আমার নাম শিলা। তোমার নাম কী?
মারুফ জাবের অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে নিজের নাম বলতে পারছে না। তার হাত কাঁপছে, প্রচন্ড পানি খেতে ইচ্ছে করছে তার।
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল সে।
কী হল, সুন্দরী মেয়ে দেখে নিজের নাম ভুলে গেলেন নাকি? ওরকম ড্যাবড্যাব করে কী দেখছেন? আর বুকের দিকে একটু পরপর তাকাবেন না, নজর ঠিক করেন।
কোমল কন্ঠে কড়া বকা খেয়ে ঘোর কাটল মারুফ জাবেরের। সে আবার জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল আমার নাম মারুফ জাবের, আপনার ফোন নাম্বারটা দেওয়া যাবে?
না দেওয়া যাবে না। তবে আপনার ফোন নাম্বার নিতে পারি, যেদিন খুব মেঘ থাকবে আকাশে সেদিন আপনাকে হঠাৎ ফোন দিয়ে বলব চলুন না চা খাই একসাথে।
শিলা ফোন নাম্বার নিয়ে চলে গেল। মারুফ জাবেরের মনটা খুশিতে ভরে উঠল। তার কেমন ভেসে যেতে ইচ্ছে করছে। রাস্তায় জোরে জোরে চিৎকার করে গান গেয়ে গেয়ে কাপড় খুলে নাচতে ইচ্ছে করছে।
মারুফ জাবের গুনগুন করে গান গেয়ে বাসায় ফিরছে।
সে জানতেও পারল না শিলা এখন পাপন নামের এক ছেলের সাথে রিক্সায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনে যাচ্ছে।
২।
মেঘের অপেক্ষায় দিন কাটে মারুফ জাবেরের। কবে মেঘে ছেয়ে যাবে আকাশ, কবে পাবে সেই চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ।
মারুফ জাবের ফেসবুকে খুঁজে বেড়ায় শিলাকে।
শিলা নামে সার্চ দিতেই হাজারটা মেয়ের ছবি চলে আসে। মারুফ জাবের দেখতে থাকে। আসল শিলাকে পায় না। তবে খোলামেলা পোশাকের নকল শিলাদেরও সে দেখে, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে দেখে। দেখে চোখকে শান্ত করে।
হাসিতে ভরে উঠে তার মুখ।
এভাবেই কেটে যেতে থাকে একেকটি দিন।
এক রাতের ঘটনা। এক মেয়ে মারুফ জাবেরকে নক করে ফেসবুকে। মেয়ের নাম নীলা।
মারুফ জাবের খুশি হয়ে উঠে। শিলা নীলা কী মিল! আচ্ছা এমনও তো হতে পারে এটা শিলারই প্রোফাইল। এমনও তো হতে পারে সেদিন শিলা তার আসল নাম বলেনি, তার আসল নাম নীলা। মারুফ জাবের নীলার ছবি দেখে। দেখেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।
নাহ এটা শিলা না। নীলা কেমন শ্যামলা করে, দেখতেও ভাল লাগছে না। মারুফ জাবের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। তারপর নীলার সাথে চ্যাট করতে থাকে। হাজার হোক নীলাও তো মেয়ে, চ্যাট করতে আনন্দই লাগতে থাকে মারুফ জাবেরের।
এভাবে প্রায় প্রতিদিনই নীলার সাথে চ্যাট হতে থাকে মারুফ জাবেরের। নীলা কখন খায়, কী দিয়ে খায়, কখন বাইরে যায়, বাথরুমে যায় সব খবরই রাখতে শুরু করে সে। মারুফ জাবেরকেও আস্তে আস্তে নীলার ভাল লাগতে শুরু করে।
সেদিন রাতে তুমুল বর্ষণ। মারুফ জাবের চা খেতে খেতে নীলার সাথে চ্যাট করছে।
নীলা জিজ্ঞেস করে
কী সুন্দর বর্ষা দেখেছেন?
হুম দেখছি।
কী করেন এখন?
চা খাই।
বৃষ্টির শব্দে হঠাৎ নীলার খুব কান্না পেয়ে গেল। সে খুব আবেগ নিয়ে লিখল,
আচ্ছা, আমি আপনাকে প্রতিদিন নিজ হাতে চা বানিয়ে খাওয়াতে চাই, জানেন আমি অনেক সুন্দর চা বানাই। আপনি কি দিবেন আমাকে সে সুযোগটা?
মারুফ জাবের মনে মনে হেসে ফেলল।
এহ, শখ কত! যে না একখান চেহারা আবার আসছেন আমারে সারাজীবন চা বানায়া খাওয়াইতে। আমার শিলা তোর চেয়ে কত্ত সুন্দর, শিলা আমারে চা বানায়া খাওয়াবে, তুই ক্যান। আয়নায় নিজেরে একবার দেখসিশ। ছেলে দেখলেই খালি লাইন মারতে ইচ্ছা করে। তোর মত মেয়ের হাতের চা আমি খাই না!
মারুফ জাবের যখন এসব কথা ভাবছে তখন সে জানতেও পারল না, নীলার পাশে তারই বোন শিলা পাপনের সাথে গুটুর গুটুর করে কথা বলছে, আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনে যাচ্ছে।
মারুফ জাবের কিছু না বলে অফলাইন হয়ে গেল।
৩।
আপা এবার কিন্তু তুই আমাকে বুফে খাওয়াবি, তোর এত ভাল রেজাল্ট হল। খুশিতে গলাটা ধরে আসছে নীলার।
শিলা বলে, যাহ, আমি এত টাকা পাব কই।
আগে চাকরী করি তারপর হবে।
নীলা নাছোড়বান্দা, আপাকে সে ছাড়বেই না।
শিলার তখন মারুফ জাবের নামের ভ্যাবলামার্কা ছেলেটার কথা মনে পড়ল। সে ফোন করল মারুফ জাবেরকে।
হ্যালো, আমি শিলা।
আপনি, এতদিন পর! এতদিন কত বৃষ্টি গেল, অথচ আপনার ফোন নেই। মারুফ জাবের আদুরে কন্ঠে নালিশ করছে।
আসলে আমার ফোনে টাকা থাকে না।
আপনি বলবেন না সে কথা, আচ্ছা এখন থেকে প্রতিদিন আমি টাকা ভরে দিব নে।
সে হবে নে, আমার বুঝলেন খুব বুফে খেতে ইচ্ছে করছে।
আপনার খাওয়াতে হবে কিন্তু। কাল কি পারবেন?
হ্যাঁ পারব। পারতেই হবে।
আমার সাথে কিন্তু আমার বোন থাকবে।
হ্যাঁ হ্যাঁ কোন সমস্যা নাই।
বোন থাকুক, আপনার জামাই থাকুক, না না না আপনার জামাইকে রাখা যাবে না।
মজার মানুষ তো আপনি, আচ্ছা দেখা হবে কালকে।
ফোন রেখেই শিলা বলে, নীলা, কালকে সন্ধ্যায় রেডি থাকিস, জম্পেশ বুফে হবে।
নীলা খুশি হল, বুঝতেও পারল না কালকে তার জন্য কত বড় একটা চমক অপেক্ষা করছে।
ফোন রেখে মারুফ জাবের খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে।
মনে মনে ভাবে বোনকে নিয়ে আসছে। তার মানে একবারে ফ্যামিলি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে ব্যাপারটা। গর্বে ভরে উঠে তার বুক। নীলার কথা মনে পড়ে তার। ইশ কত মেয়ে তাকে পছন্দ করে।
কিন্তু সব মেয়েকে তো আর সময় দেয়া যাবে না, লাই দেয়া যাবে না। নীলাকে ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে রিমুভ করতে হবে, শিলা দেখে রাগ করতে পারে। উফ, কালকে যে কী হবে।
৪।
নীলা আর শিলা সেজেগুজে বসে আছে রেস্টুরেন্টে।
মারুফ জাবেরের স্টাইল করতে করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। বন্ধুর গাড়িটা ধার করেছে সে, শিলা আর তার বোনকে বাসায় নামিয়ে দেওয়া যাবে । নীল কালারের শার্ট, সাথে কালো প্যান্ট। বডি স্প্রে দিয়েছে সারা শরীরে। দেওয়ার সময় এক্সের এডভার্টাইজগুলোর কথা মনে পড়েছে বারবার।
কল্পনায় এক্সের মেয়ে গুলোর জায়গায় সে দেখতে পায় শিলা আর তার বোনকে। শালীকে নিয়ে বাজে চিন্তা চলে আসায় মনে মনে একটু লজ্জিত হয় সে। শালীর জায়গায় মনে পড়ে নীলাকে, না ধুর এই মেয়ে দেখতে মোটেও সুন্দর না।
মারুফ জাবের রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই তাকে দেখে ফেলে শিলা। সে নীলাকে বলে ঐ যে আসছেন বেকুব সাহেব।
নীলা গেটের দিকে তাকায়। আরে এ তো তার মারুফ জাবের, ওকে কতই না পছন্দ হয়েছিল, কতই না স্বপ্ন বুনেছিল ওকে নিয়ে। ও আসছে, তার মানে মারুফ আপুকে পছন্দ করে। আপু বলতেই ও আপুকে বুফে খাওয়াতে ছুটে আসছে।
বুক ফেটে কান্না আসছে নীলার।
আস্তে করে আপুর সামনে থেকে উঠে যায় সে। ওয়াশ রুমে চলে আসে টুপ করে। আয়নার সামনে দাঁড়ায় ও। তাকায় নিজের দিকে। আয়নাতে যাকে দেখতে পাচ্ছে তাকে কেউ চায় না, এমনকি ও নিজেও না।
দ্বিতীয় পর্ব...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।