আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইতিহাসের কথা- নুরজাহান

নুরজাহান মোঘল ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ইতিহাসে মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এর পত্নী হিসেবেই তিনি পরিচিত। কিন্তু এই পরিচয় এর আড়ালেও কাহিনি রয়েছে। নুরজাহান বা জগতের আল হচ্ছে সম্রাট জাহাঙ্গীর এর দেয়া নাম। তার আসল নাম ছিল মেহেরুন্নিসা।

মেহেরের বাবা ছিল গিয়াস বেগ। তার বাবা গিয়াস বেগ ও মা যখন তেহেরান থেকে ভাগ্যের সন্ধানে হিন্দুস্তান আসছিলেন তখন পথের মধ্যেই নির্জন মরু প্রান্তে এক বাবলা গাছের তলায় জন্ম হয় মেহেরুন্নিসার। গল্প আছে যে এই সময় গিয়াস বেগ ও তার পত্নী এমন দুর্দশায় পরেছিলেন যে মেয়ে কে বাঁচাবার কোন উপায় না পেয়ে তারা পথের মাঝেই কচি মেয়েকে শুইয়ে রেখে রউনা হন। আশা ছিল কোন সহৃদয় ব্যক্তি যদি তাকে পায় নিয়ে আশ্রয় দিবে। কিন্তু বাপ মায়ের মন।

কিছুদুর যাবার পর ই শিশু কন্যার কান্না শুনে তারা আর থাকতে পারলেন না। ফিরে এসে দেখেন সর্বনাশ! ছোট মেহেরের মাথার উপর একটা বিরাট কেউটে সাপ তার ফনা মেলে দুলছে। গিয়াসের চিৎকার এ সাপ টা আস্তে আস্তে চলে গেলো, কিন্তু মেহেরের বিন্দু মাত্র ক্ষতি করলো না। মেয়েকে বুকে চেপে নিঃসহায় , নিঃসম্বল গিয়াস বেগ এসে পৌঁছালেন লাহোরে। এবার তার ভাগ্য পরিবর্তন হল।

আকবর বাদশার সুনজরে পরলেন তিনি, আর ছোট মেয়ে মেহেরের স্থান হল হেরেমে। সেখানেই সে শিখল নাচ, গান, লেখা পড়া, তরবারি যুদ্ধ, আরও নানান বিদ্যা। মেহেরের বয়স যতই বারতে লাগলো তার রূপ ও ততই ফেটে পড়তে লাগলো। তার মত সুন্দরি তখন নাকি কেউ ছিল না মোঘল সাম্রাজ্যে। এবার মেহেরের বিয়ে ঠিক হল তুর্কিস্তানের খানদানি বংশের আলি কুলি বেগ এর সঙ্গে।

আলি কুলি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, নির্ভীক ও সচ্চরিত্র যুবক। একলা খালি হাতে বাঘ মারার জন্য তার নাম হয় শের আফগান। শোনা যায় মেহের একবার যুবরাজ সেলিমের নজরে পড়ে জান। সেলিম ও অমনি খেপে উঠলো মেহের কে বিয়ে করার জন্য। বাদশাহ আকবর এর কাছে আর্জি পউছে গেলো তার বিয়ের।

কিন্তু নিজের বংশ মর্যাদার কথা ভেবে সেলিমকে নিষেধ করে আলি কুলির সঙ্গে মেহেরের বিয়ে দেন। মেহেরের বয়স তখন ষোল। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে চলে যান বর্ধমান। এবার ইতিহাসের পট পরিবর্তন হল। আকবরের মৃত্যুর পর যুবরাজ সেলিম বসলেন সিংহাসন এ।

নাম নিলেন জাহাঙ্গীর। সম্রাট হয়েও জাহাঙ্গীর মেহের কে ভুলতে পারলেন না। জাহাঙ্গীর ভেবে চিন্তে দেখলেন আলি কুলি কে যদি হত্যা করা যায় তবেই সে মেহের কে বিয়ে করতে পারবে। তবে আলি কুলি কে হত্যা করা সহজ কাজ ছিল না। সম্রাট কৌশলের আশ্রয় নিলেন।

শিকারে যাবার আমন্ত্রন দিলেন আলি কুলি কে। সরল মনে আলি কুলি চললেন সম্রাট এর সাথে বাঘ শিকারে। ধূর্ত সম্রাট তাকে আদেশ দিলেন একটা ক্ষিপ্ত বাঘ মারবার জন্য। কিন্তু সম্রাট তাজ্জব বনে গেলেন। আলি কুলি খালি হাতে বাঘ টাকে গলা টিপে হত্যা করলো।

এবার সম্রাট তাকে একটা পাগলা হাতির সামনে ফেলে দিলো। কিন্তু এবার ও আলি কুলি তার তলোয়ারের এক কোপে হাতির শুর দু ভাগ করে ফেলল। আলি বুঝতে পারলো তাকে মারার ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি ফিরে গেলেন বর্ধমানে। জাহাঙ্গীর মরিয়া হয়ে বাংলার সুবেদার কুতুব কে নিরদেশ দিলেন আলি কুলি কে হত্যা করবার জন্য।

কুতুব তার অনুচর দের নিয়ে হত্যা করতে গিয়ে নিজের মারা পড়লো। হতভাজ্ঞ আলি কুলি প্রান হারাল অনুচর দের গুলিতে। শেরের মৃত্যুর পর মেহের কে আগ্রা তে নিয়ে আসা হয়। তখন মেহেরের বয়স তেত্রিশ। ওই বয়স এও তিনি অপূর্ব রূপসী ছিলেন।

মোঘল হেরেমে থেকেও দীর্ঘ চার বছর সম্রাট কে দেখেন নি। তারপর আর পারলেন না সম্রাট কে ফেরাতে। সাইত্রিশ বছর বয়স এ বিয়ে করেন জাহাঙ্গীর কে। জাহাঙ্গীর তার নাম দিলেন নুরজাহান বা জগতের আলো। ইংরেজ দুত টমাস রো লিখে গেছেন মেহের আসলে দেশ শাসন করত।

জাহাঙ্গীর ছিল নাম কা ওয়াস্তে সম্রাট। সেই সময়কার মুদ্রাতে জাহাঙ্গীর এর সঙ্গে নুরজাহানের ছবিও ছাপা হত। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রাজ্য পরিচালনা করতেন। জাহাঙ্গীর এর রাজত্তের শেষ দিকে যখন তার ছেলে খুররম ও সেনাপতি মহাব্বত খা বিদ্রোহ করেন তখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন নুরজাহান। নুরজাহানের শেষ জীবন সুখের হয় নি।

তার বিরাট উচ্চাকাঙ্খা ছিল তার জন্য দায়ী। জাহাঙ্গীর এর মৃত্যুর পর নুরজাহান ও লাহোরেই থেকে যান শেষ পর্যন্ত। অবশেষে বাহাত্তর বছর বয়স এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ওই লাহোরেই। নুরজাহান নিজে ছিলেন কবি। তার কবরের গাঁয়ে তার রচিত দুটি লাইন দেখতে পাওয়া যায়।

ফরাসিতে লেখা। কবি সত্ত্যন্দ্র নাথ দত্ত বাংলায় অনুবাদ করেনঃ “ গরীব গোরে দ্বীপ জেলো না, ফুল দিও না কেউ ভুলে, শ্যামা পোকার না পোড়ে পাখ, দাগা না পায় বুলবুলে। “  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।