পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয় ,,,,,পথের পাশেই আছে মোর দেবালয়
রামোজী ফ্লিম সিটির বিখ্যাত ট্রেড মার্ক রামোজী লেখা এই গেট
২০ দিনের ছুটিতে কলকাতা গিয়ে ভাবনায় পড়লাম কই যাবো? বোম্বে না হায়দ্রাবাদ ! বোম্বের ট্রেনের টিকেট পেতে দেরী হবে তাছাড়া যেতেও সময় লাগবে অনেক, শেষে হায়দ্রাবাদই ঠিক হলো। হাওড়া জংশন থেকে সকাল ১১টায় ইষ্টকোষ্ট এক্সপ্রেসে রেলে পরদিন সন্ধ্যায় ভারতের অন্যতম বৃহত্তম প্রদেশ অন্ধ্রের রাজধানী পুরোনো নবাবী স্মৃতির গন্ধে ভরপুর, ভারতের স্বাধীনতার পরও স্বাধীন রাজ্য নিজামদের গৌরব সেই হায়দ্রাবাদ এসে নামলাম।
হায়দ্রাবাদ স্টেশন
স্টেশন এলাকাটির নাম নামপালী। আমাদের মত সাধারন ট্যুরিষ্টরা বেশিরভাগই এই নামপালী আর আবিদে উঠে। বড়লোকরা উঠে বানজারা হিলসে।
যেখানে আজহারউদ্দিনের মত স্টার ক্রিকেটার ছাড়াও বড় বড় ফ্লিমস্টাররা থাকে। যাক আমরা উঠলাম নামপালীর হর্ষ হোটেলে। এসি রুম ইন্ডিয়ান ২০০০ হাজার রুপি ভাড়া।
হোটেলের সামনে রাস্তার দুপাশে সারি সারি ট্যুর এজেন্টের অফিস। তাছাড়া আসেপাশে প্রচুর রেস্টুরেন্ট যা একটা ট্যুরিস্টের প্রথম বিবেচনার বিষয়।
হোটেলে লাগেজ রেখেই বের হোলাম খেতে। রাস্তার উল্টোদিকেই অনেক বছরের পুরোনো রেস্টুরেন্ট আজিজিয়াতে ঢুকলাম। প্রথমেই ভাবলাম হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত বিরিয়ানী দিয়ে যাত্রা শুরু হোক। সেই প্রথম সেই শেষ।
হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত বিরিয়ানী
সেই শুকনা শুকনা বিস্বাদ বিরিয়ানী খেয়ে বের হয়ে একটা মিষ্টি মশলা দেয়া পান চিবাতে চিবাতে ফুটপাথ দিয়ে হাটছি।
আর আমার স্বামীর একই কথা 'বুঝলা আমাদের দেশের কালিজিরা চাল ছাড়া রান্না করা পোলাও বিরানী সব থার্ডক্লাস টেষ্ট',আর বাসমতী চালের গন্ধ নাকি তার কাছে তেলাপোকার গন্ধের মত লাগে। যা কিনা রান্না করা হয়েছিল সেই আজিজিয়ায়।
আমাদের হোটেলের পাশেই দেখলাম রয়েল ট্যুর এজেন্ট, গেলাম। তিন চার জন স্টাফ বসা। জিজ্ঞেস করলাম কি কি ট্যুর প্যাকেজ আছে? তারা সমস্বরে বলে উঠলো, 'রামোজী ফিল্ম সিটি।
আমরা চমকে গেলাম শুনে । কি বলে ! আমি অনেক আগেই হায়দ্রাবাদ দেখেছি। কত কিছু দেখার আছে, আর এরা কি বলছে!! চারমিনার, নিজামের প্যালেস, সালার জং মিউজিয়াম, গোলকোন্ডা ফোর্ট। এসবের কি হলো ! কোথায় গেল তারা !
যাক আমরা বল্লাম আগামী কাল আমরা সিটি ট্যুর করবো তার পর আরো চারদিন আছি দেখা যাক কই যাই। সিটি ট্যুরের রিসিট কাটার পরদিন সকাল আটটা তিরিশে আমাদের আসতে বল্লো কাউন্টারে।
যেহেতু আমরা পাশেই হোটেলে থাকি। সকাল বেলা সেজেগুজে এসে বসলাম ।
বাসের অপেক্ষা করছি।
কর্মচারীগুলো চা এনে খাচ্ছে
একজোড়া নববিবাহিত দম্পতি আমার পাশে এসে বসলো। সামান্য আলাপে জানলাম তারা রামোজী যাচ্ছে।
একটু পরই শুনতে পেলাম 'বাস আগেয়া, আইয়ে আইয়ে'।
আমরা চেয়ার থেকে উঠতে গেলাম বল্লো 'বৈঠিয়ে ইয়ে বাস আপকো নেহি, ইয়ে রামোজীকে লিয়ে'।
মেজাজটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে , সব কিছুই মনে হচ্ছে রামোজীকে ঘিরে। চেয়ে দেখলাম লাল রংয়ের একটা বাস, সবুজ রংয়ের ছাদটা দোচালা টিনের চালের মত ডিজাইন। বাস ভর্তি লোক।
ওরা বল্লো এই বাসের নাম চায়না টাউন আর এটা শুধু রামোজী যাবার জন্য স্পেশালী তৈরী।
হায়দ্রাবাদ শহর ঘুরতে ঘুরতে দুজনে সিদ্ধান্ত নিলাম যত হাস্যকরই হোক এই রামোজীতে আমাদের যেতেই হবে।
ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যায় হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত হুসেন সাগরের তীরে দাড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম রামোজী আমাদের যেতেই হবে
সিটি ট্যুর থেকে রাতে ফিরেই আমরা রামোজী ফিল্ম সিটিতে যাবার জন্য একদিন পরের টিকেট কিনলাম আর শর্ত দিলাম একদম সামনের সিটটা আমাদের জন্য রিজার্ভ রাখতে হবে। তারা বল্লো, 'ওক্কে ডরাইয়ে মাত' ওটা আপনাদের জন্যই থাকবে। সামনের সিটে বসলে অনেক দুর পর্যন্ত দেখা যায় যা আমার খুব প্রিয় সিট।
সামনের সিটে আমরা
একদিন পর সকাল সাড়ে আটটায় কাউন্টারের সামনে এসে দাড়ালাম। একটু পরেই আমার প্রতীক্ষিত বাস এসে দাড়ালো। সামনের সিটটা আমাদের জন্য রাখা। পুরো বাস ভর্তি ট্যুরিষ্ট।
রওনা দিলাম ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের রাজধানী হায়দ্রাবাদ থেকে ৩০ কিলোমিটার দুরে হায়াতনগরের দিকে।
যেখানে গিনসের মতে বিশ্বের বৃহত্তম ফিল্ম সিটি রামোজী।
টিকেট কাউন্টারের অদুরে রামোজীর বিখ্যাত গেট
১৯৯৬ সালে রামোজী রাও হায়দ্রাবাদের ৩০ কিমি দুরে পাহাড়ের কোলে ১৬৬৬ একর জায়গা নিয়ে রামোজী ফিল্ম প্রতিষ্ঠা করেন। পাহাড়ের খাজে খাজে বিভিন্ন তরু শ্রেনী মাথা উচু করে আছে, বিশেষ করে তাল গাছের সারি। বন জংগলে ঘেরা, নীল স্বচ্ছ পানির লেক,অসাধারন সব দৃষ্টি নন্দন নির্মান শৈলীতে ভরপুর পুরো এলাকা।
বর্তমানে এটা রামোজী গ্রপের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফিল্ম সিটি হিসেবে রামোজী গিনিস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড সার্টিফিকেট পাওয়া। এই সিটিতে সিনেমা/ সিরিয়াল সব কিছু তৈরীর সবরকম অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে।
বলা হয়ে থেকে কোন সিনেমার নির্মাতা শুধু স্ক্রিপ্ট নিয়ে এখানে এসে ফিল্ম নিয়ে বের হয়ে যেতে পারবে। একটা সিনেমা তৈরী করতে যা কিছু প্রয়োজনীয় তা সবই মজুদ সেখানে। বিভিন্ন রকম হিন্দী, তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম, কানাড়া, গুজরাটি, বাংলা, উড়িয়া, ভোজপুরি, ইংরাজী ম্যুভি ছাড়া টিভি সিরিয়ালও এ্যড তৈরী হয় প্রতিনিয়ত।
এছাড়াও ভারতের বিখ্যাত টিভি চ্যানেল ইটিভির হেড কোয়ার্টারও এখানে।
হায়াতনগরে যাবার পথের ধারে
পৌনে নটায় রওনা হোলাম। পুরোনো শহর হায়দ্রাবাদকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ৯ নং জাতীয় সড়ক ধরে। শহর পেরিয়ে শহরতলী ছাড়িয়ে রুক্ষ পাহাড়ী এলাকার মাঝে চলতে চলতে অবশেষে ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে রামোজী ফিল্ম সিটির কাছে এসে হাজির হোলাম। আস্তে আস্তে বাস এসে থামলো মেইন রোডের কাছে টিকেট কাউন্টারের সামনে।
ট্যুরিষ্ট কোম্পানীর বাস ভাড়া ১৫০ রুপি ছাড়াও এখানে বড়দের জন্য প্রবেশ ফি মাথাপিছু ৬০০ রুপি। বাচ্চাদের জন্য ৫০০।
টিকেট কাউন্টারের সামনে আমি
বাস আমাদের টিকেট কাউন্টারের নামিয়ে দিয়ে পেছন দিকে চলে গেল। আমরা টিকেট কেটে লাইন ধরে ভেতরে ঢুকলাম। সেখানে আমাদের টিকেট চেকিং, হ্যান্ড ব্যাগ আর দেহ তল্লাশীর পর ঐপারে আসলাম।
কোন বাইরের খাবার, পোষা প্রানী,এলকোহোল, ড্রাগ, তামাকজাত দ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ,বিস্ফোরক নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ। অনেকে খাবার নিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো ওদের স্টোরে রেখে আসার জন্য বলা হলো। আমার স্বামী যথারীতি সিগারেট নিয়ে ধরা খেয়ে স্টোরে জমা রাখলো টোকেন নিয়ে। যাবার সময় ফিরিয়ে দেবে।
এপারে এসে দেখলাম আমাদের বাস দাড়ানো।
আমাদের বিখ্যাত চায়না টাউন বাসে আমি
আবার বাসে উঠে শুরু হলো আমাদের চলার পালা। গেট থেকেও প্রায় কয়েক কিলোমিটার দুরে রামোজী। অপুর্ব সৌন্দর্য্যমন্ডিত সেই প্রাকৃতিক দৃশ্য যার দুপাশে বুনো জংগল আর ঝোপঝাড়ে ঢাকা পাহাড় ছড়িয়ে আছে। তার মাঝ দিয়ে একেবেকে চলছে আমাদের চায়না টাউন বাস। দুরে সারি সারি আমার প্রিয় তালগাছ।
মেইন গেট পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা গন্তব্যে
গেট দিয়ে ঢোকার পর শুরু হলো মানুষের তৈরী সেই অপরূপ পথ যার দুপাশে কিনা সারি সারি ভাস্কর্য আর গাছের বিথীকা ! কোনটা রেখে কোনটা দেখবো আমরা ! ওসব পেরিয়ে আমাদের বাস গিয়ে থামলো একবারে শেষ মাথায় যেখানে ট্যুরিষ্ট কোম্পানীর বাসগুলো দাড়ানোর জন্য নির্ধারিত।
গাছ না ভাস্কর্য কে কার চেয়ে সুন্দর
সারাদিনের প্রোগ্রাম। গাইড আমাদের বলে দিল এই রাস্তা দিয়ে সোজা আমরা যেন চলে যাই সেন্ট্রাল কোর্টে। সেখান হেল্প ডেস্ক থেকে আমাদের সব বলে দেয়া হবে। বিকাল সাড়ে ৫টার মধ্যে যদি ফেরত না আসি তাহলে বাস ছেড়ে দেবে আর আমাদের নিজে নিজে হায়দ্রাবাদ যাবার ব্যাবস্থা করতে হবে।
আমাদের ড্রাইভার কাম গাইডের বানী মাথায় নিয়ে আমরা তার দেখানো পথে হাজির হোলাম সেন্ট্রাল কোর্টে যেখানে মেয়েগুলো বসে আছে আমাদের সাহায্য করার জন্য।
হেল্প ডেস্কের চটপটে মেয়েগুলো দুঃখ করলো দেরী করে যাবার জন্য । কারন অসাধারণ সুন্দর ওপেনিং সিরিমনিটা ততক্ষনে শেষ হয়ে গেছে। ওরা আমাদের একটা ব্রোশিওর ধরিয়ে দিয়ে বল্লো এটাতে সারাদিনের প্রোগ্রাম আর কোথায় কি কি দর্শনীয় আছে, কখন কি শুরু হবে তার বিস্তারিত বর্ননা। তারপরও সমস্যা হলে ওরাতো আছেই।
আমার পেছনে সেন্ট্রাল কোর্ট যেখানে ওপেনিং এবং ক্লোসিং শো হয়।
ব্রোশিওরে অনেকগুলো প্রোগ্রামের কথা লেখা ,বিভিন্ন ধরনের রেস্টুরেন্টের নাম, কেনাকাটার জন্য কিছু দোকান আছে সেসবের নাম সব লেখা। প্রধান আকর্ষন হলো এ্যকশন থিয়েটার, ফিল্মি দুনিয়া, রামোজী টাওয়ার, বোরাসুরা যাদুকরের কারখানা, স্যুটিংএর জন্য তৈরী বিভিন্ন সেট, কত রকমের বাগান ফোয়ারা ছাড়াও বিভিন্ন রাইড। কিন্ত প্রথমেই ওরা ওদের নিজস্ব বাসে পুরো সিটিটা ঘুরে দেখার জন্য এডভাইস করলো। এই বিশাল এলাকাতো আর হেটে দেখা সম্ভব নয় কারো পক্ষে।
ফ্লিম সিটির ভেতরে রাস্তায়
আমরা এসে সারি বেধে দাড়ালাম বাস কাউন্টারে। অনেকেই এসেছে বিভিন্ন ট্যুর কোম্পানীর মাধ্যমে। এখানে কে কোন কোম্পানী থেকে এসেছে তা কোন ব্যাপার না ,লাইনে দাড়াও বাসে উঠো।
কাউন্টারে দাড়ানো রামোজীর বাস ।
শুরু হলো আমাদের ট্যুর পুরো ফ্লিম সিটি জুড়ে।
সাথে গাইডের বর্ননা।
চলবে ...
বিরিয়ানীর ছবি ছাড়া আর সব আমাদের ক্যামেরায় তোলা। সবার সামনে খাবারের ছবি তুলতে আন ইজি লাগে তাই ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।