ভোর ৫ টা বাজে, ঘুম আসছে না। এটা আমার জন্য খুব নতুন কিংবা অবাক করা কোন বিষয় নয়। আমি যখন ক্লাস এইট এ পড়ি তখন আমার আব্বা আমাকে একজন ডাক্তার এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, রাতে কেন আমার ঘুম হয় না তার অনুসন্ধান করতে। তো সেই ডাক্তারকে আমি বলতাম নাসির আংকেল, তিনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, প্রাইভেট প্র্যাক্টিসও করতেন। নাসির আংকেল আব্বুকে বলেছিলেন, “স্যার জিতু যদি ঘুমের অভ্যাস পরিবর্তন না করে তাহলে ভবিষ্যত জীবনে বিপদে পড়বে।
” আমি ঘুম নিয়ে পরবর্তী জীবনে বিপদে পড়েছি সন্দেহ নেই। ২০০৭ এ পড়ালেখা শেষ করে যখন ব্র্যাক এ জয়েন করি তখনও আমার ঘুম সংক্রান্ত জটিলতা কাটেনি। মাস শেষে বেতনের টাকার একটা বড় অংশ দেরি করে অফিসে যাবার কারণেই চলে যাবার কথা, কিন্তু মান্নান ভাই'র দয়া আর ভালোবাসার কারণে বেঁচে যেতাম। যাই হোক নানারকম ডাক্তার-এনজিনিয়ার, ব্যয়াম-বিয়ে কোন কিছু করেই আমার ঘুমের সমস্যার কোন সুরাহা হয়নি। সমস্যা ঠিক হলো ২০১০ এ এসে আমার মেয়ের জন্য।
মেয়ের যাতে ঘুম নষ্ট না হয় তাই তাড়াতাড়ি বিছানায় যাই এখন, যদিও ঘুমাতে ঘুমাতে নিদেনপক্ষে রাত ১টা।
তবে এখনও মেয়ের স্কুল না থাকলে, কিংবা মা-মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলে আমি গভীর রাত জেগে থাকি, চিন্তা করি, লিখি। আজকের ঘুম না আসাটা অন্যরকম, অন্যকারণে। একটা কারণ হতে পারে গতকাল মাত্র লন্ডন থেকে ফিরেছি, এখনও জেট-ল্যাগড। আজকে সকালে ৯ টায় উঠেও আবার ১১ টায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সেই ঘুম ভাংলো সন্ধ্যা ৬ টায়।
সারাদিন আর বাইরে যাওয়া হয়নি। টি। ভি দেখছিলাম আনমনে। মনটা অস্থির ছিলো গতকাল থেকেই – কারণ বাংলাদেশের কিংবদন্তীর কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ এর শারীরিক অবস্থার অবনতি। গতকাল থেকেই মনে হচ্ছিল হুমায়ুন বোধহয় আর ফিরবেন না আমাদের মাঝে।
রাতের দিকে ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাসও দিয়েছিলাম – “আমার সাবেক পররাষ্ট্রসচিব চাচা মহিউদ্দিন আহমেদ ১৯৯০ সালে আমাদের সব কাজিনদের ৫০০ টাকা করে দিয়েছিলেন বই মেলা থেকে বই কিনবার জন্য। তিনি সাথে করে আমাদের নিয়েও গিয়েছিলেন, তবে তার একটাই শর্ত ছিলো হুমায়ুন আহমেদ এর বই কেনা যাবেনা। আমি সর্বমোট ৩৭০ টাকার বই কিনতে পেরেছিলাম। তখন বইয়ের দাম কম ছিলো, তবু হুমায়ুন আহমেদ এর বই ছাড়া ৫০০ টাকার বই কিনতে পারিনি। আমার চাচার মতন সব বুদ্ধিজীবিদের হিংসা, বিদ্বেষ এড়িয়ে হুমায়ুন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা লেখক।
তিনি জীবনে অনেক যুদ্ধ জয় করেছেন - আশা করি এবারও করবেন। যদি নাও পারেন, ক্ষতি নেই; যুদ্ধের কোন শেষ নেই, শুধু যুদ্ধক্ষেত্রটা পরিবর্তন হয়। হুমায়ুন আহমেদ এর জন্য শুভ কামনা। ”
আজ রাতে হঠাত দেখা গেলো তার অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে, তার কিছুক্ষন পরেই জানা গেলো তিনি আর নেই। ইন্নানিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
আমার সারা সন্ধ্যা রাতটাই ভীষন খারাপ গেছে। আমার বাবার পরে যে মানুষটি আমাকে স্পষ্টবাদী হতে শিখিয়েছিলেন, অন্যায়ের সাথে আপোষ না করতে শিখিয়েছিলেন তিনি হুমায়ুন আহমেদ। সমাজের এতসব পংকিলতার মাঝে কিছু সময় আপোষ করতে বাধ্য হতে হয়, কিন্তু তিনি শিখিয়েছেন মাথা তুলে সত্য বলতে - সেটাই করে যাব, তাতে ব্যক্তিস্বার্থ বাধাগ্রস্থ হয় হোক। আনমনে ভাবছিলাম হুমায়ুন আহমেদ এর সাথে আমার সম্পর্ক কবে থেকে? আমার ক্লাস ৫ পর্যন্ত জীবন কেটেছে খুলনায় - বাবার সরকারি চাকরির সূত্রে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনেক খারাপ।
খুলনা থেকে প্রথমে বাসে কিংবা ট্রেনে চড়ে ঢাকায় আসতে হতো, সেখান থেকে গ্রামের বাড়ি ফেনী। কিন্তু মনে আছে হঠাত করে সরকার একটা ট্রেনের ব্যবস্থা করলেন খুলনা থেকে ফেনী পর্যন্ত। মাঝে অবশ্য পদ্মা নদীর জন্য ফেরি পার হয়ে নতুন ট্রেনে চাপতে হতো। সব মিলিয়ে খুলনা থেকে ফেনী যেতে লেগে যেতো প্রায় ১৮-২০ ঘন্টা, তবুও আমরা খুশী। সেই ট্রেন ভ্রমণেই হুমায়ুন আহমেদ এর সাথে আমার প্রথম পরিচয়।
মনে আছে আমরা ট্রেনে উঠবার আগে বাবা বই কিনে দিতেন। আমি কিনতাম কিরিটি রায়ের রহস্যের বইগুলো। ঘুটঁঘুটে অন্ধকারের মধ্যে টিমটিমে বাতিতে ট্রেন চলত আর আমি কিরিটি রায়ের রহস্য উদ্ঘাটনের অভিযানে মজে যেতাম। এতবড় চলার পথে কিরিটি রায়ের ২/৩ টা বই শেষ, কিন্তু আমার বই পড়ার তৃষ্ণা তো আর শেষ হবার নয়। আমার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে এক ভদ্রলোক পড়ছিলেন অন্য একটা বই।
ওনার নিজের বই পড়া শেষ হলে আমার কাছে এসে বললেন, “তুমি আমার বই পড়, আমি তোমার বই পড়ি। ” আমি খুবই বিরক্ত হলাম। কোথায় নিহাররঞ্জন রায়ের কিরিটি রায়ের বই আর কোথায় তার কি এক লম্বা চওড়া পুস্তক! কিন্তু যেহেতু আমার বই পড়া শেষ, কোন অজুহাতেই তা আর আটকে রাখতে পারলাম না। তবে আমি ওনার বইটা নিতে চাইলাম না, উনি জোর করেই গছিয়ে দিলেন। বললেন, “পড়ে দেখো, খুবই ভালো বই।
” আমি বিরক্ত হয়ে বইটা পাশে রেখে দিলাম। কিন্তু খানিকক্ষন পর কিছু করার নেই দেখে বইটা উলটে-পালটে দেখলাম। বইয়ের নাম ‘মন্দ্রসপ্তক’, লেখকের নাম হুমায়ুন আহমেদ। বইটির নামের অর্থ তখন বুঝিনি, পরে জানলেও আজও মনে রাখতে পারিনা। তবে বইয়ের ভেতরটা ভারি মজার।
বইয়ের মূল চরিত্র পাগলা কিসিমের একজন মানুষ। সে অন্যের ব্রাশ দিয়ে নিজের দাঁত দিব্যি মেজে ফেলে; অথবা বইয়ের আরেক চরিত্র তার স্ত্রীকে নগ্ন হয়ে তার জন্য পানি আনতে বলছেন যেই বউ কিনা তাকে দেখতে পারে না – আমার কাছে অন্যরকম লাগলো, ভালো তো বটেই। বইটির চরিত্রগুলো খুব অন্যরকম, পরিচিত। তাদের মাঝে পাগলামি আছে, ভাল ছাত্র আছে, সুন্দরী আছে, রাগি বাবা আছে, পাড়ার মাস্তান আছে, দারিদ্র আছে – আমার জীবনে যা যা আছে তার সবই ওই বইতেও আছে। আমি যতক্ষনে বইটি পড়ে মজা পেতে শুরু করেছি, ততক্ষনে রেলস্টেশন সন্নিকটে, আমার আর বইটি পড়া শেষ হলো না।
বইটির নামও এত কঠিন ছিলো যে বহুদিন আর তা মনে করতে পারিনি। বইটি যখন আবার হাতে পেলাম, তার মাঝে বেশ কিছু বছর কেটে গেছে এবং আমিও ততদিনে পুরোদস্তুর হুমায়ুন আহমেদ এর ভক্ত, পাঠক!
হুমায়ুন আহমেদ এর সাথে নব্বই দশকের শুরুতে সেই যে আমার পরিচয়, তার আর ইতি ঘটেনি। হুমায়ুন আহমেদ এর সব বই আমি পড়েছি – সব!হুমায়ুন আহমেদ জীবনের শেষভাগে এসে আমাদের ব্যাচ-মেট শাওনকে বিয়ে করেছিলেন। আমার জানামতে বিয়ে একটা বৈধ বিষয় এবং এই বৈধ কাজ করে তিনি ফেঁসে গেলেন, জনপ্রিয়তাও কমে গেলো। উনি যদি অন্যান্য কিছু প্রথিতযশা ব্যক্তিদের মতন বিবাহ-বহির্ভূত ভালোবাসা করতেন, তাহলে ফাসঁতেন না।
হুমায়ুন আহমেদ মারা গেছেন। ইন্নানিল্লাহ হে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। দরজার ওপাশে রওয়ানা হওয়া এই অসাধারণ সাহিত্যিকের জন্য শুভ কামনা। বড় জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, "স্যার ওই জগতটা কেমন? দু'কলম লিখে গেলে হতো না?"
আজ থেকে ১ বছর পর ১৯ জুলাই ২০১৩ - হুমায়ুন আহমেদ এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ততদিনে হয়ত আমি থাকব না, আপনি থাকবেন না, আমার কোন প্রিয় মানুষ থাকবেন না - কিন্তু হুমায়ন আহমেদ থাকবেন, সবাই তাকে নিয়ে আলোচনা করবেন।
আজ থেকে ৫ বছর পর ১৯ জুলাই ২০১৭ - হুমায়ুন আহমেদ এর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। ততদিনে হয়ত আমি থাকব না, আপনি থাকবেন না, আমার কোন প্রিয় মানুষ থাকবেন না - আমাদের নিয়ে কোন আলোচনাও হবে না। কিন্তু হুমায়ন আহমেদ থাকবেন, সবাই তাকে নিয়ে আলোচনা করবেন...
শামীম আহমেদ
নিকেতন, ঢাকা
২০ জুলাই, ২০১২
হুমায়ুন আহমেদ স্যার এর মন্দ্রসপ্তক এবং আমিঃ স্মৃতিচারণ ১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।