আমি আমার "বাস্তব" কর্মব্যস্ত জীবনের ফাকে একটু বিনোদনের আশায় সুধু মাত্র ফান/মজা/টাইম পাশ/বন্ধুত্ব/দুষ্টামি করার জন্যেই আমার " "ভার্চুয়াল লাইফ" ব্যাবহার করি। আমার কোনো কমেন্টে বা পোস্টে কেউ যদি আঘাত পান, তাহলে সরাসরি জানাবেন, আমি“প্রকাশ্য সরি” বলে দিব।
:মামা, মামা
ফরিদপুর থেকে ঢাকা আসার পথে গোয়ালন্দ মোড়ের আগের স্টপিস। ঠিক বাস স্টপিস নয়, এমনি সাধারন একটি মোড়। চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম, তখনি একটি বাচ্চা “মামা” বলে সন্মধোন করল।
বিরক্তি নিয়ে বাচ্চার দিকে তাকালাম, বয়স আনুমানিক চার বছর বা একটু বেশি হবে।
বাচ্চাটা আবারো ডাকল
:মামা, মামা।
প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল, এমনিতেই গাড়ি নস্ট হওয়াতে মেজাজ ফোরটি নাইন হয়ে আছে, তার উপর এই উপদ্রপ। পকেটে হাত বাড়ালাম, মানিব্যাগ বেড় করতে গিয়ে ছেলেটার দিকে আবার তাকালাম।
গায়ে ছিড়া স্যান্ডু গেঞ্জি ঠিকই আছে, কিন্তু ছেলেটার পায়ে স্যান্ডেল, নরমাল পন্স।
নাহ! ফকির বা ভিক্ষুক বলে মনে হচ্ছে না।
ভিক্ষা করতে আসলে কেউ সেন্ডেল পরে আসত না।
বাচ্চা’টা হটাত আমার হাত ধরল, আর বলে
:মামা। মামা, আম্মায় ডাকে।
প্রচন্ড অবাক হলাম, এই অপরিচিত হাইওয়ের মাঝে আমাকে আবার ডাকে কে?
বাচ্চার হাতের নির্দিশিত জায়গায় তাকালাম, দেখি একটি হাল্কা পাতলা গড়নের বোরখা পড়া একজন দারিয়ে আছে, মুখমণ্ডল পুরোটা ঢাকা।
কৌতুল বসত বাচ্চার হাত ধরে মহিলার কাছে যাই।
:ভাইজান আমারে চিনছেন??
আমি কথা বলি না, শুধু মাথা নাড়িয়ে “না”সুচক বুঝালাম।
মেয়েটি তার বোরখার নেকাব’টি খুলল,
:ভাইজান আমি জ্যোৎস্না। এবার চিনছেন?
:উমমম, নাহ।
তাও আমি চিনতে পারলাম না।
সত্যি কথাটাই বললাম।
মেয়েটি কিছুটা মর্মাহত হল,
:ভাইজান, আফনে আমারে বিয়া দিছিলেন, আমার বিয়াতে আফনে আব্বার লগে আইছিলেন, আমার বিয়াডা আপনের লাইগাই হইছিল.........
:হ্যা হ্যা মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। ওহ!! তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ, মানে অনেক বদলিয়ে গিয়েছ। এটা তোমার বাচ্চা??!!?? মাসাআল্লহ।
:জ্বে ভাইজান, আফনেগোর দোয়ায়।
:তোমার বাবা-মা কেমন আছে??
:জ্বে, আব্বায় ভালা আছে। মা’য়ে নাই ।
:ওওও।
:ভাইজান আফনেরে দেখোনের লাইগা অনেক ইচ্ছা করে। আল্লাহর কাছে অনেক কইছি যেন মরনের আগে আফনের লগে একবার দেহা করাইয়া দেয়।
আইজ আল্লাহ আমার কথা শুনছে।
মেয়েটি এবার ফুপিয়ে কান্না শুরু করল।
আমি অপস্তুত হয়ে যাই, বললামঃ আআ ইয়ে আমাদের গাড়ি নস্ট হয়ে গেছে, একটু পরে ঠিক হয়ে যাবে। তোমরা ভাল আছ এটা শুনে ভাল লাগল। তাহলে আমি আজ আসি।
মেয়েটি হটাত কান্না থামিয়ে, চোখা মুছতে মুছতে বলেঃ আফনে কই যাইবেন, আপনে আমাগো বাড়িত যাইবেন। আফনেরে অনেক দিন পরে দেহা পাইছি, আফনেরে আইজ বাড়িত লইয়া যাব।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাচ্চা ছেলেটি হাত ধরে টানাটানি করা শুরু করে, আর বলতে থাকেঃ মামা বাড়িত লন, বাড়িত লন,।
আমি পড়লাম মহা সমস্যায়, একদিকে আমার সাথে আছে “কেতা দুরস্থা” অর্থাৎ সুটেড বুটেড দুইজন “কর্পোরেট রোবট” আর একজন “পটের বিবি”, যারা মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে আর উদ্ভট দৃস্টি দিয়ে আমাদের পর্যাপেক্ষন করছে।
আর একদিকে আছে এই “গ্রাম্য ইনসেন্ট” পরিবার, যাদের এই কান্না বা আবদার উপেক্ষা করা আমার জন্যে বড়ই কঠিন।
আমি মাইক্রোবাসের কাছে গেলাম, বিভিন্ন প্রশ্ন উত্তরের পরে তাদের বুঝাতে সক্ষম হলাম যে, আমি এই গ্রাম্য পরিবারটির সাথে যাচ্ছি এবং আমার আসার আগেই যদি গাড়ির মিস্ত্রি চলে আসে বা গাড়ি ঠিক হয়ে তাহলে তারা যেন আমাকে রিং করে নতুবা যদি আমার আসতে দেরি হয় তাহলে তারা চাইলে চলে যেতে পারে।
আমার কথায় তারা অবাক হল, “পটের বিবি” তার অগ্নি দৃস্টি দিয়ে আমাকে “ছাই ভস্ম” করার চেস্টা করল। পাত্তা দিলাম না।
..............................
গ্রাম্য রাস্তায় হাটছি, আমার হাত ধরা “সদ্য পরিচয়” হওয়া ভাগ্নে, সামনে মেয়েটি। কিছুদুর পাকা রাস্তা, পরে পায়ে হাটা পথ।
মামা-ভাগ্নে হাটছি, পিচ্চির নির্ভয়ে হাটার স্টাইল দেখে আমার মনে হচ্ছে, এত দিন পরে “মামা ভাগ্নে যেখানে-আপদ নাই সেখানে” কথাটির মর্মার্থ্য বুঝতে শিখলাম।
আমি হাটছি, পড়ন্ত বিকেলে হাটছি। সোনালী রোদে নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করছি আর ভাবছি আজ থেকে পাঁচ বা ছয় বছর আগে এমনি এক বিকেলে ঠিক এমনি করে এক বৃদ্ধ লোক ভিক্ষা করছে গোয়ালন্দ ফেরি ঘাটে। গাড়ির লম্বা জ্যাম পড়েছে, অনেকেই নেমে চা খাচ্ছে, বাচ্চা’রা গাড়ির জানাল দিয়ে হাত বাড়িয়ে এটা সেটা কিনছে। এই বৃদ্ধ লোক’টি গাড়ীতে উঠে ভিক্ষা করছে, কাল তার মেয়ের বিয়ে, কিন্তু বিয়ের খরচপাতি সে যোগার করতে পারে নাই।
বাবা হিসেবে এটা তার অক্ষমতা, তাই সে ভিক্ষা করছে।
কেউ সাহায্য দিচ্ছে, কেউ “আহারে বেচারা” বলছে, কেউ আবার পাত্তাই দিচ্ছে না।
আমিও পাত্তা না দেয়ারই দলে। যদিও আমার কাছে টাকা আছে, পায়ের মুজার ভিতরে অনেক টাকা। আমাকে আমার আব্বাজান “ব্যাড বয়”উপাধি দিয়েছেন।
এই ব্যাডবয় খেতাপ থেকে বাচতে আব্বুর কথা ইদানিং অক্ষরে অক্ষরে পালন করি, যেটা সব ভবঘুরে বেকার ছেলেরই করতে হয়। আব্বাজানের কথা মত গ্রামের রাইস মিল বিক্রির বায়নার টাকা নিয়ে ঢাকা আসতেছি। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে কাউকে ভিক্ষা দেওয়া আমার সাজে না।
আমি গাড়ি থেকে নেমে পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে চা নিলাম। ভিক্ষুক’টি গাড়ি থেকে নেমে পাসের গাছের নিচে দাড়িয়ে টাকা গুনছে।
ভাল ভাবে লক্ষ করে দেখি উনি উনার কান্না লুকানোর চেস্টা করছে এবং সেটা কঠিন ভাবে। অবাক হলাম!! কারন প্রফেশনাল ভিক্ষুক’রা কান্না লুকানোর চেস্টা করে না, বরং দেখিয়ে দেখিয়ে কাঁদে। আমি ভিক্ষুক’কে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ও চা খাই।
কিছুক্ষণ পরে খেয়াল করি বৃদ্ধ লোকটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে কি যেন বলছে। উনি কি গাছের সাথে কথা বলছে, নাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর সাথে কথা বলছে সেটা বুঝতে না পারলাম না।
হয়ত আল্লাহ কেন উনাকে এই বিপদে ফেলছেন? বা আল্লাহ কেন উনাকে সাহায্য করছেন না? সেটা নিয়েই আল্লাহর সাথে হয়ত ঝগড়া করছেন। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে এটা বুঝতে পারলাম আমার গুডবয় হওয়া আর হইল না, আমি ব্যাডবয়, ব্যাডবয়ই রইব। ।
.................................।
সন্ধ্যার সময় সেই বৃদ্ধ লোকটির সাথে আজকের এই রাস্তা দিয়েই এই গ্রামেই সেদিন এসেছিলাম। দেখেছি ১৩ কি ১৪ বছরের একটি কিশোরী হাতে মেহেদি দিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে যাচ্ছে। আমি যেতে দিলাম না, আমি উঠোনের মধ্যে কাঠের চৌকি পেতে “ষ্টেজ”বানিয়ে সেখানেই তার গায়ে হলুদ করতে বললাম।
আমি সবাইকে ডাকলাম এই বিয়ের আয়োজনে। খবর পাঠালাম কার বাড়ীতে ছাগল আছে? কার খেতে লাউ কুমড়া আছে? কার খোয়াড়ে মুরগি আছে? কোন দোকানে তেল নুন আছে?
আমার ডাকে মধ্যরাতে সাড়া দিল গ্রামের মেম্বার/মহিলা মেম্বার/স্কুল শিক্ষক সহ আরো অনেকেই।
ছোট ছোট বাচ্চারা মাইক ওয়ালাকে ডেকে আনল। চলল বিয়ের গান- বাজনা ও “হ্যাজাক বাতি” জ্বালিয়ে বিয়ের রান্নার কাজ।
......................................................
আজ পাঁচ বা ছয় বছর পরে আবারো সেই গ্রামে আমার ভাগ্য আমাকে নিয়ে এসেছে। আজ এ এক অন্য পরিবেশ। আমাকে দেখতে এসেছে সেদিনের সেই সব মা-খালারা।
কারো হাতে “ডাব” কারো হাতে আধা পাকা “আতা ফল/আম”।
সে দিনের সেই বিয়ের “কিশোরী কন্যা” আজ আমার জন্যে নিজ হাতে রান্না করছে মুরগি, মাছ, তরকারি। আমি খাচ্ছি, পেট পুরে খাচ্ছি। কোনো সঙ্কোচ নাই। কেউ তাকিয়ে দেখবে না আমি কি ভাবে খাই, আমার হাতের কতটুক ভিজে।
এখনে নেই কোনো তথাকথিত ভদ্র সমাজের কার্টেসি /ফর্মালেটিজ মেন্টেইনের যন্ত্রণা।
কেউ জিজ্ঞাসা করল না, আমি কি করি? কে আমি?? কি আমার জাত? আমি কি হিন্দু নাকি মুসলমান? নাস্তিক না আস্তিক?
এখানে কোনো প্রশ্ন নয়, সুধুই ভালবাসা। সৃস্টির সেরা জীব একজন আদম সন্তান হিসেবে আর একজন আদম সন্তানের জন্য ভালবাসা।
আমি খাচ্ছি, বিনা সঙ্কোচেই “এই সন্ধ্যের সময়” পেট পুরে খাচ্ছি।
_______________________________________
_______________________________________
আমরা কিছু করি না, কিছু করার সাধ্য আমাদের নাই, সব ঐ উপরওলার নির্দেশে হয়।
উনিই প্রত্যেকের সহায়, প্রত্যেকের তরে। উনিই আমাদের পরিচালিত করেন।
ঐ সৃস্টিকর্তা চাইলে যে কাউকে ব্যাডবয় করেন, আবার যে কেউকে গুডবয় হিসেবে সৃস্টি করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।