অরুণালোক তৈয়ব খান: গত ১০ জুলাই ২০১২ তারিখে লিটল ম্যাগাজিন নহলী’র আয়োজনে পাবলিক লাইব্রেরি’র মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো কবি আহসান হাবীব’র ২৭তম মৃত্যু বার্ষিকী স্মরণে আলোচনা সভা ও আবৃত্তি সন্ধ্যা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নহলী একটি মধ্যযুগীয় বাংলা শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে সতেজ, নতুন। যার যাত্রা শুরু হয়েছে ২০০৬ সালের অক্টোবরে। নহলী তার যাত্রা পথে দেশ বরেণ্য এসব কবি সাহিত্যিকদের জীবন চরিত ও সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যাচ্ছে।
যাতে করে নতুন প্রজন্ম তাদের অগ্রজদের সম্পর্কে জানতে পারে। এ অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কবি ইকবাল আজিজ, কবি কাজী রোজী, ভাষা সংগ্রামী ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি মহাদেব সাহা। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নহলী’র সহযোগী সম্পাদক মিলন আশরাফ। তাঁর মূল্যবান বক্তব্য শেষে কবি আহসান হাবীবের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন মাহিদুল ইসলাম। তাঁর ভরাট কণ্ঠে আহসান হাবীবের কবিতা পুরো হল জুড়ে পিনপতন নীরবতা এনে দেয়।
পরে কবি আহসান হাবিবের স্মৃতিচারণ করেন কবি মহাদেব সাহা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কবি আহসান হাবিব যদিও তাঁর কবিতায় বলেন, “আমি কোন আগন্তুক নই” কিন্তু তাঁর চালচলন ও কথাবার্তায় মনে হতো যেন এ দুনিয়ার জমিনে তিনি একজন আগন্তুক মাত্র। ” এরপরে স্মৃতিচারণ করেন কবি ইকবাল আজিজ, কবি কাজী রোজী। কাজী রোজী বলেন, “কবি আহসান হাবীবের কথা মনে হলে নিজের কাছেই এক ধরনের অপরাধ বোধ জমে। কেননা, বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের বিপরীতে আমরা তাঁর জন্য তেমন কিছুই করতে পারি নি।
” এরপর স্মৃতিচারণ করেন, কবি আহমদ রফিক। উল্লেখ্য যে, কবি আহমদ রফিক কবি আহসান হাবীবের রচনা সার্থক সম্পাদনা করেন। তিনি বলেন, বাংলা সাহিত্য কবি আহসান হাবীবের কাছে দারুণ রকম ঋণী। কেননা, তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য অনেকটা তিমির রাত্রি অতিক্রম করেছে। এরপর নির্মলেন্দু তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমার সাথে কবি আহসান হাবীবের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো।
তিনি আমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তাঁর (আহসান হাবীব) মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমি কবি’র সাথে হাসপাতালে ছিলাম। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে বিশেষত কবিতায় তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, তাতে নতুন প্রজন্ম অনেক উপকৃত হবে। একটি কর্মময় ও সার্থক জীবন ছিলো তাঁর। ” কবি নির্মলেন্দু গুণের স্মৃতিচারণের পর বক্তব্য রাখেন, জাতীয় গ্রন্থাগারের মহাপরিচালক ছড়াকার আলম তালুকদার।
জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি ও ছড়াকার আসলাম সানী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন, নহলী’র সম্পাদক তরুণ লেখক আহমদ ফয়েজ এবং সার্থক সঞ্চালক হিসেবে নহলী’র সহযোগী সম্পাদক এহ্সান মাহমুদ যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। অনুষ্ঠানে কবি পরিবারের মধ্য থেকে তাঁর পুত্রবধু ও নাতী আহসান সাজিদ উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য যে, কবি কাজী নজরুলের পরবর্তী সময়ে বাংলা কবিতা যখন ¤øান হতে চলেছিল, ঠিক তখন বাংলা সাহিত্যে কবি ফররুখ আহমদ উজ্জ্বল হয়ে উঠেন। কিন্তু তাঁর সময়ে তিনি নজরুল চেতনায় উজ্জীবিত ছিলেন।
এ সময় সমসাময়িকদের কেউ কেউ আলাদা কাব্যিক বলয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হন; এদেরই অন্যতম ছিলেন আহসান হাবীব। আহসান হাবীবের কবি প্রতিভা নিয়ে মন্তব্য করার দায়ভার অনেক। তাঁর সম্পর্কে যতোটুকু জানা যায়, কবি আহসান হাবীব ছিলেন একজন মৃদুভাষী কবি। কিন্তু তাঁর ভাবনার জগতটা ছিলো বিশাল। তিনি যেসব সহকর্মীর সঙ্গে ঢাকার সাহিত্য নির্মাণে কাজ শুরু করেছিলেন, তারা ঠিক পরবর্তীকালের কবিতার ওপর আহসানের মতো ধারাবাহিক প্রভাব বিস্তার করতে পারেন নি।
কবি আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালে পিরোজপুরের শংকরপাশায়। তাঁর বাবা কবি’র নাম রেখেছিলেন হাবীবুর রহমান। কিন্তু কবি তাঁর পিতৃপ্রদত্ত¡ নাম মোটেও পছন্দ করেন নি। তাই নিজের নাম নিজেই পাল্টে রেখেছিলেন আহসান হাবীব। কবি হওয়ার স্বপ্ন তাঁর চোখে ছেলেবেলাতেই খেলা করতো।
তাই ১৯৩৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে বাবার অমতে কলকাতায় পালিয়ে যান। তাঁর চোখে তখন অনেক বড় লেখক হওয়ার স্বপ্ন। প্রচলিত কর্মজীবনের প্রতি তাঁর কোন টান ছিলো না বলেই জানতে পারা যায়। কিন্তু ফাঁকা পকেটে শুধুমাত্র জেদ সম্বল করেই তিনি টিকে গেছেন সাহিত্যের সোনালী জগতে। তিনি হার মানেননি দারিদ্র্যের কাছে, তাই মাত্র ২০ বছর বয়সেই কাজ শুরু করেন তকবীর, বুলবুল ও সওগাতের মতো পত্রিকায়।
১৯৪৩-৪৮ সালে কাজ করেছেন আকাশবাণী কলকাতায়। ১৯৪৭-এ ভারত বিভক্তির পর তিনি পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেন এবং এ বছর বিয়ে করেন। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এ বছরই কবির প্রথম কবিতার বই 'রাত্রিশেষ' প্রকাশিত হয়। এরপর কিছুদিন কাজ করেছেন ফ্রাংকলিনে। পরে ১৯৬৪ সালে তিনি বর্তমান দৈনিক বাংলায় (তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানে) যোগ দেন।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এ পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতা কবি আহসান হাবীব দীর্ঘ বিশ বছর সম্পাদনা করেন। এবং এ সময়ই তাঁর হাত ধরে কবিতার জগতে বর্তমানের অনেক বিখ্যাত কবিই কাব্য জগতে নিজেদের নাম লেখাতে সমর্থ হন। কর্মক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলেই জানা যায়। শুধু নিজ কর্মক্ষেত্রই নয়, বরং আধুনিকতা, ব্যক্তিত্ব ও রুচির ক্ষেত্রেও আহসান হাবীব দুই বাংলাতেই হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়।
তিনি মানুষের ভেতরের গুণের প্রাধান্য দিয়েছেন।
কবি আহসান হাবীবের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা আট। ছায়াহরিণ, সারা দুপুর, আশায় বসতি, মেঘ বলে চৈত্রে যাবো, দুই হাতে দুই আদিম পাথর, প্রেমের কবিতা ও বিদীর্ণ দর্পণে মুখ। ছোটদের জন্য তাঁর লেখা রানী সাঁকোর খাল, ছুটির দিন দুপুরে, জোছনা রাতের গল্প ইত্যাদি উল্লেখ করার মতো। কবি আহসান হাবীব তাঁর সাহিত্য কর্মের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদকসহ বাংলাদেশের সব উল্লেখযোগ্য পুরস্কার লাভ করেন।
কালজয়ী এ কবি ১৯৮৫ সালের ১০ জুলাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।