ঃ কবীর শেখ ঃ www.banglatolet.com ডিজিটাল দুনিয়া রওশন আরা খানম | তারিখ: ২৭-০৬-২০১২
উৎস - প্রথম আলো
স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশের মাতৃমৃত্যুর কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে তিনটি বিলম্বকে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথম বিলম্বটি হয় বাড়িতে অর্থাৎ চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি। দ্বিতীয়টি সেবাকেন্দ্রে পৌঁছাতে বিলম্ব এবং তৃতীয়টি পৌঁছানোর পর সেবা পেতে বিলম্ব।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের পরিবারে এবং সমাজে নারীর স্থান খুব উঁচুতে থাকে না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও তাদের হাতে থাকে না।
তাই গর্ভবতী মহিলারা যখন বিপজ্জনক অবস্থায় উপনীত হন, তখনো তাঁদের পরিবারের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়। পরিণতিতে শিশুর মৃত্যু, মাতৃমৃত্যু বা মায়ের স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদি জটিলতায় চোখের পানি ফেলা ছাড়া তেমন কিছুই করার থাকে না। এ গল্প সবারই জানা। আজ একজন প্রতিবাদী নারীর কথা বলতে চাইছি।
ওই নারী ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন, লেখাপড়া জানেন না, বয়স ৩২ বছর।
১৮ বছরের বিবাহিত জীবন, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। সন্তান নিতে চাইছেন তিন বছর ধরে, কিন্তু না হওয়ায় তিনি চিকিৎসার জন্য এসেছেন।
এত দিন পর তিনি চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হলেন কেন, জানতে চাইলাম। তিনি জানালেন, বিয়ের ১৫ বছর পর তাঁর গর্ভে একটি সন্তান এসেছিল। নিয়মিত গর্ভকালীন চেকআপের কোনো সুযোগ তিনি পাননি।
পরিবার থেকে বাড়তি কোনো যত্নও পাননি। প্রসব ব্যথা শুরু হওয়ার পর তিনি তাঁর স্বামীকে অনেক অনুরোধ করেছিলেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য, যেন তাঁর এত দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সন্তানের কোনো ক্ষতি না হয়। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁর কথা কানেই তোলেনি। স্বামী একজন ধাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এলেন আর তাঁকে থাকতে হলো বাড়িতেই। অনেক ব্যথা-কষ্টের পর তিনি একটি মৃত পুত্রসন্তান প্রসব করলেন।
পরিবারের লোকজন সন্তান না হওয়া, মৃত সন্তান প্রসব করা নিয়ে নানা কথা বলল। স্বামী চুপ করে রইলেন। সন্তান হারানোর বেদনা ধীরে ধীরে তাঁকে প্রতিবাদী করে তুলল। মনে মনে তিনি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেললেন।
সুস্থ হওয়ার পরই তিনি আদালতের দ্বারস্থ হলেন এবং আদালতের মাধ্যমে স্বামীকে তালাক দিলেন।
তাঁর ভাষ্যমতে, ‘সারাটা জীবন তাঁর সংসারে খাটলাম আর আমার বা আমার সন্তানের জন্য তাঁর কোনো দায়িত্ব নাই, কোনো চিন্তা নাই। এ রকম স্বামী দিয়া কী করুম?’
এ নারীকে সেদিন কেউ সহযোগিতা করেনি। এমনকি তাঁর মা-বাবাও না। তবুও তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। বিবাহবিচ্ছেদের পর অনেক হুমকি-ধমকি সহ্য করে অবশেষে এক বছর আগে তিনি আবার বিয়ে করেছেন নিজের পছন্দে এবং বর্তমান স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন চিকিৎসার জন্য।
যখন জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ইনিও যদি আগের মতো করেন?’
ওই নারীর সরাসরি উত্তর, ‘আগের ঘরে আমার কোনো মর্যাদা ছিল না। আমার কথার কোনো দাম ছিল না, তাই চিকিৎসাও পাই নাই। বর্তমান স্বামী আমাকে অনেক সম্মান ও গুরুত্ব দেয়। না হইলে কি আর চিকিৎসার জন্য আনত। ’ আমি খুবই বিস্মিত হলাম তাঁর জীবনবোধ এবং বাংলাদেশের নারীর অবস্থান সম্পর্কে এত স্পষ্ট ধারণা দেখে।
আরও অবাক হলাম তাঁর সাহস দেখে।
তিনি চিকিৎসা নিয়ে চলে গেলে আমি তাঁর গমন পথের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, একই কাহিনি নিয়ে আগেও অনেকে এসেছেন, সন্তানের শোকে তাঁদের ঝর ঝর করে কাঁদতে দেখেছি। নিজের স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় ভুগতে দেখেছি কিন্তু এমন প্রতিবাদ করতে এই প্রথম দেখলাম এবং বলা যায় মুগ্ধ হলাম।
আমার মাঝেমধ্যে মায়েদের এই কান্না দেখে মনে হয় এমন যদি হতো, একটি মেয়ে যখন পরিবারের সিদ্ধান্তহীনতা অথবা অবহেলার জন্য সন্তান হারায় অথবা নিজের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ, সেসব ক্ষেত্রে যিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন অথবা যাঁর সিদ্ধান্তের কারণে অথবা অবহেলায় এই জীবনহরণ, তাঁকে যদি আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করার সুযোগ থাকত, প্রতিটি ক্ষেত্রে আর তা নিশ্চিত করা যেত, তবে হয়তো এ দেশে মা এবং শিশুর মৃত্যুর হার দ্রুত কমে আসত। আর নারীরাও যদি তাঁদের অধিকারের জন্য প্রতিবাদ করতে পারতেন, তাহলে হয়তো অবস্থার পরিবর্তন ত্বরান্বিত হতো।
অধিকার বলতে গর্ভকালীন সেবা পাওয়ার অধিকার, সুস্থ শিশু জন্মদানের ব্যবস্থাপনা পাওয়ার অধিকার, মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করার অধিকার বোঝানো হচ্ছে।
প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত এবং সামাজিক চাপ প্রয়োগের ব্যবস্থা করার জন্য এ ধরনের প্রতিবাদী, সাহসী নারীরা হতে পারেন অবহেলিত, দুর্বল নারীদের সাহস জোগানোর সহায়ক শক্তি এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার অগ্রদূত। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।