আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চরম ঝুঁকির মধ্যেই চলছে রক্ত পরিসঞ্চালন কার্যক্রম

আতাউর রহমান কাবুল ‘Every blood donor is a hero ‘প্রত্যেক স্বেচ্ছায় রক্তদাতা এক একজন বীর’—এই স্লোগান ধারণ করে গত ১৪ জুন পালিত হলো ‘বিশ্ব রক্তদাতা দিবস-২০১২’। বাংলাদেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দিবসটি পালিত হলেও বাংলাদেশের রক্ত পরিসঞ্চালন কার্যক্রমের বাস্তবে কী অবস্থা, তা জানতে সরেজমিন ঘুরে পাওয়া গেছে ভয়াবহ তথ্য। ঢাকা মেডিকেলের ১৭ নম্বর গাইনি ওয়ার্ড। সিজারিয়ান সেকশন অপারেশনের জন্য চিকিত্সকের দেয়া রিকুইজিশন নিয়ে আছমা বেগমের স্বামী চানখাঁরপুল এলাকার একটি ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত আনতে গিয়ে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলেন প্রয়োজনীয় রক্ত নিয়ে। আছমা বেগমের শরীরে প্রয়োগ করার ১০ মিনিটের মধ্যেই তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হলো।

সেবিকারা কর্তব্যরত চিকিত্সকদের জানালে এভিল, ওরাডেক্সন কিংবা ফেনারগ্যান ইনজেকশন পুশ করে রক্ত দেয়া বন্ধ করতে বললেন। ফলে তাকে আর রক্ত দেয়া সম্ভব হলো না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ওয়ার্ডের এক সেবিকা এই প্রতিবেদককে জানান, স্ক্রিনিং টেস্ট করতে হলেও আধাঘণ্টার বেশি সময় দরকার ছিল, অথচ তাড়াতাড়িই রক্ত ওয়ার্ডে চলে আসল। তিনি জানলেন, অধিকাংশ রক্তই রি-অ্যাকশন (তীব্র প্রতিক্রিয়া) করে, অনেক সময় রক্ত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রোগী অস্থির হয়ে পড়ে। মারাত্মক কিছু লক্ষণ দেখা দেয়।

এতে অধিকাংশ রোগীকে আর রক্ত দেয়াই সম্ভব হয় না। আর এই রক্তে যদি ঘাতক ব্যাধিগুলোর অস্তিত্ব থাকে তবে তো জীবনটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। মাঝখানে অর্থের অপচয় তো নস্যি। শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজেই নয়, যত্রতত্র গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতালসহ সারাদেশে একই চিত্র। সারা দেশে চরম ঝুঁকির মধ্যেই চলছে রক্ত পরিসঞ্চালন কার্যক্রম।

বছরে দরকার প্রায় ৬ লাখ ব্যাগ রক্ত বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ ব্যাগ রক্ত দরকার হয়, যার মাত্র ৩০ ভাগ রক্ত সংগৃহীত হয় স্বেচ্ছায় রক্তদাতার মাধ্যমে। স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা গত দশ বছরে শতকরা ১০ ভাগ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ ভাগে দাঁড়ালেও ১৬ কোটি লোকসংখ্যার এ দেশে এ সংখ্যা নিতান্তই কম। বাকি ৭০ ভাগ রক্তের জন্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা পেশাদার ব্লাড ব্যাংকে যেতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দুই শ্রেণীর রক্তই বিপজ্জনক। কেননা আত্মীয়ের রক্ত ভালো মনে করে অনেকে স্ক্রিনিং ছাড়াই দিতে চান আর পেশাদার রক্ত মানে তো ঘাতক ব্যাধিকে ডেকে আনা।

পেশাদার রক্তদাতা হয় মূলত নেশাসক্তরা। এদের রক্তে পর্যাপ্ত হিমোগ্লোবিন থাকে না; বরং বেশি তাকে নানা ধরনের রোগজীবাণু। এদের অনেকেই সুচের মাধ্যমে ড্রাগ নেয়। অর্থাত্ প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ রক্তই মূলত নানান ধরনের রোগের অন্যতম উত্স। এই রোগগুলো ছড়াচ্ছে মানুষ থেকে মানুষে রক্তের মাধ্যমে।

তবে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার রক্তই সবচেয়ে নিরাপদ হিসেবে ধরা হয়। কেননা তাদের রক্ত নেয়ার পর স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে ৫টি ঘাতকব্যাধির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অবাক ব্যাপার হলো, একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশেই পেশাদারদের রক্ত বেচাকেনা হয় না বলে জানা গেছে। পরিসংখ্যানে জানা গেছে, বাংলাদেশে যে পরিমাণ রক্ত বিভিন্ন চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়, তার মধ্যে জেনারেল সার্জারি ২৩ শতাংশ, জেনারেল মেডিকেল ১৫ শতাংশ, কার্ডিওথোরাসিক ১৩ শতাংশ, অর্থোপেডিকস ১১ শতাংশ, হেমাটোলজি ৯ শতাংশ, দুর্ঘটনা ও জরুরি প্রয়োজনে ৮ শতাংশ, কিডনি, নবজাতক ও শিশু সার্জারিতে ৬ শতাংশ, ইনটেনসিভ কেয়ার (আইসিইউ) ৪ শতাংশ, অবসট্রেটিক ও গাইনোকোলজি ৩.৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ৭.৫ শতাংশ রক্ত প্রয়োগ করা হয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষ প্রয়োজনে রক্ত পায় না ব্লাড ব্যাংক না থাকার কারণে।

এজন্য হঠাত্ রক্তের প্রয়োজনে তাদের ‘হার্টসল’ নামে বিশেষ স্যালাইন দেয়া হয় রক্তের পরিবর্তে। এটাতে সাময়িক চিকিত্সা সম্ভব হলেও রক্ত কিন্তু লাগবেই। দেশে অনুমতিপ্রাপ্ত ব্ল্যাড ব্যাংক মাত্র ৫৪টি স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. মো. মোমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া সূত্রে অবাক করার মতো যে সংবাদ জানা গেল তা হলো, সারাদেশে এখন পর্যন্ত সরকারি অনুমতিপ্রাপ্ত বেসরকারী ব্লাড ব্যাংক রয়েছে মাত্র ৫৪টি। এর মধ্যে ঢাকায় প্রায় সবগুলো। ঢাকার বাইরে সারাদেশে নিবন্ধিত ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা ৫/৭টি।

অথচ ঢাকা শহরেই অলিগলিতে অনেক ব্লাড ব্যাংক বছরের পর পর বছর রক্ত পরিসঞ্চালন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে এর সংখ্যা প্রচুর। অবৈধ এসব ব্লাড ব্যাংকের অধিকাংশেই প্রশিক্ষিত ডাক্তার কিংবা টেকনিশিয়ান নেই। স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমেও রয়েছে ভ্রান্তি স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমের সঙ্গে যেসব সংগঠন কাজ করছে, তাদের ক্ষেত্রেও নানা ভ্রান্তি রয়েছে। প্রথমত তারা স্ক্রিনিং টেস্টের জন্য ভ্রাম্যমাণ রক্তদান ক্যাম্পগুলোতে কোনো অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান রাখেন না।

অনেক বিশেষজ্ঞের মত হচ্ছে, মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী ‘স্ক্রিনিং’ করতে পারে না। কিন্তু স্ক্রিনিং পরীক্ষাটা প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান দিয়ে করানোর কথা থাকলেও মেডিকেল কলেজ পড়ুয়া স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীরাই এ কাজগুলো করছে। এ দৃশ্য অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। নানা কারণে মনিটরিং হচ্ছে না বিভিন্ন সূত্রে জানা গেল, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই চলছে শতকরা ৮১ ভাগ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র (ব্লম্লাড ব্যাংক)। দেশে যদি মাত্র ৫৪টি নিবন্ধিত ব্লাড ব্যাংক থাকলে সারাদেশে পরিচালিত অন্যান্য রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলো অবৈধ।

লাইসেন্স করা ব্লাড ব্যাংকগুলোর নিয়মিত মনিটরিং হচ্ছেনা। জানা গেছে, বেশিরভাগ সময় মন্ত্রণালয়ে মিটিং থাকে বিধায় মনিটরিংয়ের জন্য সংশ্লিষ্টরা পর্যাপ্ত সময় পান না। সারা দেশে কতগুলো ব্লাড ব্যাংক রয়েছে এ প্রশ্নের উত্তরে ডা. মো. মোমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া জানালেন, কতগুলো অবৈধ ব্লাড ব্যাংক রয়েছে তা বলতে পারব না। কেননা বাড়ী বাড়ী গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার মত লোকবল তাদের নেই। এ কাজটা হয়তো সিটি কর্পোরেশন করতে পারে।

তিনি জানালেন পত্র পত্রিকার মাধ্যমে সংবাদ পেলে অভিযান হয় এবং তখন তারা ধরা খায়। তিনি আরো জানালেন, পর্যাপ্ত যানবাহন ও লোকবলের অভাবে মনিটরিং করা সেভাবে সম্ভব হচ্ছে না। স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম হুমকির মুখে সাধারণত তিন শ্রেণীর রক্তদাতা পাওয়া যায়— ১. স্বেচ্ছায় রক্তদাতা যার পরিমাণ ৩০ ভাগ, ২. রিপ্লেসমেন্ট বা বিনিময় রক্তদাতা যার পরিমাণ ৬০ ভাগের মতো, ৩. প্রফেশনাল বা পেশাদার রক্তদাতা যার পরিমাণ ১০ বা তার নিচে। ১৯৭২ সালের ১০ মে তত্কালীন তরুণ চিকিত্সক বর্তমান জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম নিজে রক্তদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমের সূচনা করেন। স্বেচ্ছা রক্তদাতা আন্দোলনে যারা অবদান রেখে চলেছে তারা হলো— কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, সন্ধানী, রেড ক্রিসেন্ট, অরকা, বাঁধন প্রভৃতি।

স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না সাধারণত মোটা সুচের ভয়, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, পরিবারের সদস্যদের বাধা, উদ্বুদ্ধকরণের অভাব, নিজেদের প্রয়োজনে রক্ত না পাওয়া, ডোনার কার্ড না পাওয়া, সামাজিক স্বীকৃতির অভাব ইত্যাদি কারণে এদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না সেভাবে। অথচ ১৮ থেকে ৬০ বছরের প্রত্যেক নারী-পুরুষ রক্তদানের মাধ্যমে এই তাত্পর্যপূর্ণ ও সামাজিক আন্দোলন এগিয়ে নিতে পারেন। নিয়মিত রক্ত দান করলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের মতো জটিল রোগের হাত থেকে রেহাইসহ সুস্থ ও প্রাণবন্ত জীবনযাপন করা যায়। বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান আন্দোলন পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রেড ক্রিসেন্ট, অ্যাসোসিয়েশন অব ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স কিছুদিন আগে এক জরিপে জানায়, বাংলাদেশে প্রতি হাজারে মাত্র ০.৪ শতাংশ লোক স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়। আশা করা যাচ্ছে, এই সংখ্যা মাত্র ১ বা ২ ভাগে উন্নীত করতে পারলেই বাংলাদেশের মোট রক্তের চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে।

বড় হাসপাতালগুলোতেও ব্লাড ব্যাংক নেই ঢাকা শহরের বড় হাসপাতালগুলোর অনেকগুলোতেই ব্লাড ব্যাংক নেই। অথচ সেখানে ডেঙ্গু, নিউরোসার্জারির মতো রোগেরও চিকিত্সা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে যা পাওয়া গেছে, তা হলো ব্লাড ব্যাংক করার বিষয়টিতে লাভবান হওয়ার মতো বিষয় নেই বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এতে তেমন আগ্রহী নয়। অথচ আইসিইউ (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট), সিটি স্ক্যানের মতো ব্যয়বহুল খাতে তারা বিনিয়োগ করছে। কিন্তু একজন ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট দরকার হলে তাকে কোথায় পাঠাবে কিংবা কীভাবে তা ম্যানেজ করবে, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলেনি সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে।

কেননা প্লাটিলেট তৈরি হতে সময় লাগে ৬-৭ ঘণ্টা। প্লাটিলেট অবশ্যই পাঁচ দিনের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে, সেটাইবা মানা হচ্ছে কতটুকু? সংগ্রহ করা রক্ত ২ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কতদিন রাখা যায়, তা নির্ভর করে তাপমাত্রা ও ব্যবহৃত কেমিক্যালের ওপর। তবে যে কোনো রক্ত ফ্রিজ থেকে সরবরাহের আধাঘণ্টার মধ্যে রোগীর দেহে প্রয়োগ করার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হয় না। আইন মানছে না বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকগুলো বেসরকারি পর্যায়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত ব্লাড ব্যাংকগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সরকার ২০০২ সালে ‘নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন আইন-২০০২’ নামে একটি আইন পাস করে। কিন্তু এ আইন মানছে না বেসরকারি এবং অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলো।

অসংখ্য অনুমোদনহীন ব্লাড ব্যাংক অনিয়ন্ত্রিত ও বিপজ্জনক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। নিরাপদ রক্ত বলতে বোঝায়, যে রক্ত ১২ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে এবং ট্রান্সফিউশনের পর তা যত তাড়াতাড়ি দেয়া যায় তত ভালো। কয়েকদিন জমা করা রক্তের চেয়ে ফ্রেশ ব্লাড অবশ্যই ভালো। আবার স্ক্রিনিং কিটস্ সঙ্কটের কারণেও দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর ব্লাড ব্যাংকগুলোতে মাঝে মাঝেই স্ক্রিনিং ছাড়াই রক্ত সঞ্চালন হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গুটিকয়েক হাসপাতালে সিফিলিস ও হেপাটাইটিস-বি টেস্ট করা হলেও অন্যান্য পরীক্ষা করানো হয় না।

অনিরাপদ রক্তের হারও কম নয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ‘রক্ত সঞ্চালন বিভাগ’ সূত্রে জানা যায়, এখানে গড়ে প্রতিদিন ২০০ ব্যাগের মতো রক্ত রোগীরা বিভিন্ন প্রয়োজনে নেয়। তাদের মধ্যে স্ক্রিনিং করে প্রতিদিন ৫-৬ ব্যাগ অনিরাপদ রক্ত পাওয়া যায়। এ হার আশঙ্কাজনক বলে জানালেন ওই বিভাগে কর্তব্যরতরা। আবার রাজধানীর মিরপুর, কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ প্রভৃতি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত কিনে হাতুড়ে ডাক্তাররা ফার্মেসি কিংবা বিভিন্ন স্থানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এসব এলাকার বিভিন্ন ফার্মেসিতে কিংবা ডাক্তারদের চেম্বারেই রোগীর শরীরে রক্ত দিচ্ছে। এখানে স্ক্রিনিং কিংবা ক্রস ম্যাচিং করার কোনো সুযোগ থাকছে না।

ঢাকার বিভিন্ন স্থানসহ সারাদেশেই ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য ব্লাড ব্যাংক। এসব ব্লাড ব্যাংক থেকে দূষিত রক্ত কিনতে হচ্ছে বরং উচ্চমূল্যে। নিরাপদ রক্তের জন্য পাঁচটি পরীক্ষা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর ব্লাড ট্রান্সমিশনের সংজ্ঞা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু’র নির্দেশ মতে, নিরাপদ রক্তের জন্য একজন রক্তদাতাকে কমপক্ষে ভয়াবহ পাঁচটি রক্তবাহিত ঘাতক রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিতে হয়। এগুলো হলো : হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভি (হিউমেন ইমিউনোডিফিসিয়েন্সি ভাইরাস) বা এইডস, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিসের মতো কঠিন রোগ। সাধারণত সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন ছাড়া রক্ত পরিসঞ্চালন করা ঠিক নয়।

আবার ক্রস ম্যাচ ও স্ক্রিনিং রিপোর্ট ছাড়া রক্ত পরিসঞ্চালন করা যাবে না। ২০০২ সালে বাংলাদেশে ‘নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন’ চালু হয়। ২০০৮ সাল থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিধিমালা ২০০৮’ প্রণীত হয়েছে। অথচ ২০০৮ সালের আগে লাইসেন্সের কোনো বালাই ছিল না। তখন কীভাবে চলত এ কার্যক্রম, এর কোনো সদুত্তর মেলেনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীলদের কাছে।

পরীক্ষা হয় না বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকগুলোতে সরকারি ও বেসরকারি কয়েকটি ব্লাড ব্যাংকে সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, অধিকাংশ বেসরকারি ব্লাড ব্যাংকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার নেই। এসব ব্লাড ব্যাংকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত পাঁচটি ঘাতক ব্যাধির পরীক্ষা করা হয় না এবং তারা যথেষ্ট স্টেরিলিটি (সংক্রমণ রোধকারী ব্যবস্থা) মেনে চলে না। তারা রক্তদাতা নির্বাচনের পূর্বশর্তও মানেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অসুস্থ, নেশাসক্ত কিংবা পেশাদার রক্তদাতাদের কাছ থেকে রক্ত কিনে নেয়া হয়। এখানে নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, নেই পোস্ট ডোনেশন রুম, পরিবেশও নোংরা।

সরবরাহ করা রক্ত দেখতে অনেকটা ঘোলা পানির মতো। এসব ব্লাড ব্যাংক প্রদত্ত রক্তে সঠিক মাত্রায় রক্তের উপাদান এবং পর্যাপ্ত সেল থাকে না বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। ডাক্তার নামে যারা থাকেন, তারা ক্রস ম্যাচিংয়ের ফরমে স্বাক্ষর করে রাখেন আগে থেকেই। মোটকথা, স্ক্রিনিং ও ক্রসম্যাচিং ছাড়াই রক্ত দেয়া হচ্ছে এসব ব্লাড ব্যাংকে। ব্লাড ব্যাংকগুলোতে প্রয়োজনীয় লোকবল নেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনের দ্বিতীয় ভাগে ‘বেসরকারি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা’র ধারা-২-এ বলা আছে, ‘প্রত্যেক রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের ল্যাবরেটরিতে একটি কিংবা দুটি ফার্মাসিউটিক্যাল রেফ্রিজারেটর, ব্লাড ব্যাংক ফ্রিজ, ডিপ ফ্রিজ, রক্তের স্যাম্পল সংগ্রহের জন্য ডমেস্টিক ফ্রিজ, কম্পাউন্ট মাইক্রোসকোপ, সেন্ট্রিফিউজ মেশিন, ওয়াটার বাথ, ইনকিউবেটর, ভিউ বক্স, ডিস্টিল ওয়াটার প্লান্ট, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল কিটস্ ও রি-এজেন্ট থাকতে হবে।

এবং বিধিমালা ৯(২)(ঘ)-তে বলা আছে, রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার/মেডিকেল অফিসার, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, টেকনিক্যাল সুপারভাইজার, রেজিস্টার্ড নার্স, ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট প্রভৃতি থাকতে হবে। অথচ অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলোতে থাকে মালিক, কয়েকজন দালাল, একজন মার্কেটিং ম্যানেজার ও অফিস কর্মচারী। তাছাড়া অবৈধ ব্লাড ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগ গড়ে উঠেছে অপরিচ্ছন্ন জায়গায়। মোটকথা, চরম ঝুঁকির মাঝেই চলছে সারাদেশের রক্ত সঞ্চালন কার্যক্রম। আর এতে মারাত্মক হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য।

বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিপাত না দিলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। লেখক : বিভাগীয় সম্পাদক, আমার স্বাস্থ্য+তথ্যপ্রযুক্তি, দৈনিক আমার দেশ সূত্র : Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।