অরুণালোক ফলকন্যাদের বাল্যবিবাহ না দিয়া উপায় নাই। বলা যায় না কখন কী হইয়া যায়! চতুর্দিকে হরেক প্রকারের পশুপক্ষী বিচরণ করিতেছে। কাক, বুলবুলি, বাদুর প্রভৃতির মধ্য হইতে কখন কে আসিয়া ঠোক্কর মারিবে না, ইন্দুর-বান্দর-কাঠবিড়ালীরা আসিয়া জোরপূর্বক ফলকন্যাদের সতীত্ব হরণ করিবে না, ইহার কি কোন গ্যারান্টি আছে? শরিয়ত মোতাবেক পর্দায় (জাল দিয়া জড়াইয়া) রাখিয়াও শ্রীমতি লিচু কুমারী চক্রবর্তীকে বাদুরের চুম্বন হইতে রক্ষা করা যায় নাই। বহু পাহারা দিবার পরও আনারসী, কদলী, পেঁপে বানুকে শূকর ও বাদুরের ছিনতাই’র হাত হইতে রক্ষায় ব্যর্থ হইতে হইয়াছে। এত ঝামেলা কে সহে? মোসাম্মৎ আম্র আক্তারকে বৃক্ষেই পরিপক্ষ হইয়া পূর্ণবতীর রূপ-যৌবন লাভের সুযোগ দিলে পক্ষীকূল ধর্ষণ করিবার সুযোগ পাইবে।
উহারা সুবাসিত পক্ক আমের সিন্দুর রাঙা চেহারাকে চঞ্চু দিয়া নিষ্ঠুরের মত চুম্বন করিবে, নখর দিয়া ক্ষত বিক্ষত করিবে, আঁচড়াইবে, কামড়াইবে। বান্দরের ভয় তো রহিয়াছেই। ইহা কোনক্রমেই সহিবার নহে। কাঁঠালকে গাছেই পরিপূর্ণ যৌবন লাভের সুযোগ দেওয়া যাইবে না। কেননা, যৌবনবতী পক্ক কাঁঠাল এতটাই মোহনীয় সুগন্ধ বিতরণ করিতে থাকে যে, শৃগাল মহাশয়গণ কাঁঠালের প্রেমে মাতোয়ারা হইয়া যান।
ফলকন্যাদের বৃক্ষেই সাবালিকা হইয়া পরিপুষ্ট, সুস্বাদু হইবার সুযোগ দিলে, মৃত্তিকার পরকীয়া প্রেমের টান এড়াইতে না পরিয়া প্রাণনাথ বলিয়া উহার বুকে লুটাইয়া পড়ে। মাটির টান এড়ানো বড় কঠিন এবং পৃথিবীর শক্তিশালী প্রেম যে পরকীয়া, উহা কৃষক পিতাগণ উপলব্ধি করিয়া শঙ্কিত। ভুমি যুবকের যদি মধ্যাকর্ষণের ভাষায় যুবতী ফলকন্যাদের চিঠি লিখিবার সুযোগ পায়, তবে আর রক্ষা নাই। জাত-মান-কূল সকলই যাইবে। উজবুক ভূমির হাত হইতে ফলকন্যাদের রক্ষা করার দুশ্চিন্তায় কৃষক পিতাদের মুখে আহার রুচে না, উহাদের নিশিথের শান্তির নিদ্রা সেই কবে হইতে পালাইয়াছে উহার খবর তো কেহ লয় নাই!
নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেদেরই করিতে হইবে।
তাই বহু কাঠ-খড় পুড়াইয়া, বহু ক্লেশ করিয়া কৃষকপিতারা একত্রিত হইয়াছে। উহারা মিটিং-এ বসিয়াছে এবং সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হইয়াছে, ফলকন্যাদের বাল্যবিবাহ দিতে হইবে। কিন্তু সমস্যা হইল, বিবাহ তো এমনি এমনি দেওয়া যাইবে না, একটা মাধ্যম দরকার। কন্যার পিতারা তো আর বাড়ি বাড়ি গিয়া বর তালাশ করিতে পারে না। তাই একজন ছুটিয়া গিয়া ঘটক (ফলের ব্যবসায়ী) ডাকিয়া আনিল।
সভায় চোগলখোরও একজন ছিলো। সে বিড়ি খাইবার ছলে বাড়ি বাড়ি গিয়া অন্দর মহলের রমণীকূলের নিকট সভার গৃহীত সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র করিয়া আসিল।
পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবার অধিকার নাই। নারী তো শুধু সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ভিন্ন অতিরিক্ত কিছু নহে। ইহা সমগ্র নারীকূল জ্ঞাত থাকিলেও ফলকন্যাদের বাল্যবিবাহে ঘোর আপত্তি করিল এবং নারীর অধিকার রক্ষায় সকলে একত্রিত হইয়া সভাস্থলে আসিয়া উপস্থিত হইল।
উদ্দেশ্য, পুরুষদের এই একক এবং সর্বনাশা সিদ্ধান্তের সর্বান্তকরণে বাধা দান। কেননা, উহারা মনুষ্যনারী। নারী অর্থাৎ প্রকৃতি। তাই বৃক্ষনারীদের অধিকার খর্ব করিবার ষড়যন্ত্র রোধ কল্পে তীব্র প্রতিবাদ করিতে, অন্দর মহলের দাসীপনা আপাতত মুলতবি রাখিয়া প্রকৃতিতে একাত্ম হইতে পারিয়াছে। উহারা কৃষকমাতা।
একমাতা হইয়া আরেক মাতার ব্যথার সমব্যথী হইবে না, ইহা কেমন করিয়া হয়? তাহারা আসিয়া কৃষকপিতাদের কাছে কৈফিয়ত দাবী করিল।
সভায় তুমুল বিতর্ক উপস্থিত। কেহ কাহাকেও ছাড়িয়া কথা কহিতেছে না। কৃষকপিতারা কৃষকমাতাদের প্রবল চাপের মুখে সমস্যাগুলি খুলিয়া বলিতে বাধ্য হইল এবং এই বলিয়া বক্তব্যের উপসংহার টানিল, বৃক্ষমাতার বুকেই যদি লালিত পালিত হইয়া ফলকন্যারা নারীত্বের পরিপূর্ণতা লাভের সুযোগ পায়; তবে পশুপক্ষী, ভূমি যুবার প্রেম এবং মনুষ্য তস্কর হইতে উহাদের রক্ষা করা কঠিন। কিন্তু কৃষাণমাতাদের পক্ষ হইতে আপত্তি আসিল, সন্তানসন্ততির বাল্যবিবাহ দিলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।
বয়োঃপ্রাপ্ত না হাওয়া কোন নারী সংসার জীবনে প্রবেশ করিলে নিপীড়িত হইতে হয়। কেননা, তখন দেহ-মন পরিপুষ্ট থাকে না। বাল্যবিবাহের ফলে অল্প বয়সেই সন্তান ধারণে বাধ্য হইতে হয়। অপরিপুষ্ট দেহে সন্তান ধারণ করিলে এবং সন্তান প্রসবের চূড়ান্ত সময়ের অনেক আগেই অস্ত্রপচারের মাধ্যমে সন্তান ভূমিষ্ঠ করানোর বন্দোবস্ত হইলে প্রকৃতিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়িতে বাধ্য। কেননা তাহাদের বেশ জানা আছে, সাতমাসেই যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, সে সন্তান সাধারণত অতিশয় ক্ষীণদেহী, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধারণের অযোগ্য এবং প্রায়শয়ই খিটখিটে মেজাজের হইয়া থাকে।
আর বছর বছর পোয়াতি হইতে গিয়া মায়েদেরও স্বাস্থ্যহানীর ভয় কম নহে। ফলের ক্ষেত্রেও তাহাই, ইহাতে আর ভিন্নতা কি? অপরিপক্ক ফলকন্যারা রূপে-রসে-স্বাদে-গন্ধে পূর্ণতা লাভ করে নাই। এইরূপ অবস্থায় বিবাহ দিতে গেলে কখনোই ভাল বর (ক্রেতা) পাওয়া যাইবে না। কেননা, রং-রূপ-রস ইত্যাদি যথার্থ না হইলে ভাল বর জুটিবে কীসের জোরে? কৃষাণমাতারা বৃক্ষমাতাদের প্রতি এইরূপ পক্ষপাতিত্ব করিয়া কথা বলিবে, ইহা কৃষাণপিতারা ভাবে নাই। নারীকূলের যুক্তি শুনিয়া তাহারা খানিকটা হতোদ্যাম হইয়া আড় চোখে ঘটকের দিকে তাকাইয়া দেখিল কোন জাদু মন্ত্রে একজন ঘটকের জায়গায় দুইজন হইয়া গিয়াছে।
কৃষকমাতা-পিতাগণের আড়চক্ষুর দৃষ্টি লক্ষ্য করিয়া প্রথম ঘটক (ফলের ব্যবসায়ী) লাজুক হাস্যে উঠিয়া দাঁড়াইল। অতঃপর দুই হাতের তালু খানিকক্ষণ কচলাইয়া দ্বিতীয় ঘটকের পরিচয় করাইয়া দিল- ‘উনি আমার উস্তাদ ঘটক (ফলের আড়তদার)। আপনাদের মূল্যবান তর্কবিতর্ক বোধগম্য না হওয়ায় খানিকক্ষণ আগে মোবাইল মেসেজ পাঠাইয়া রাজধানীর ফলপট্টি হইতে উস্তাদকে ডাকাইয়া আনিয়াছি। উস্তাদ আমার ধনে-মানে-জ্ঞানে সকলের সেরা এবং একজন পাক্কা ব্যবসায়ী। উনার নেটওয়ার্ক বিশাল, আত্মীয়তার সূত্রে দেশের সমস্ত অধিদপ্তর, আমলা, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, পাতিমন্ত্রী, এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, সমাজসেবী মায় প্রশাসনের সকলেই বাঁধা পড়িয়াছে।
সম্পর্কে উহারা সকলেই আমার উস্তাদের শ্যালক হন। এই শ্যালকেরা উস্তাদের অর্থের কাছে নিজেদের বিবেক বিকাইয়া দিতে কার্পণ্য করেন নাই বরং ধন্য হইয়াছেন। উস্তাদ উল্লেখিত সকলকেই বুঝাইতে সক্ষম হইয়াছেন, বিবেক থাকিলে লাভ করা যায় না। তাই বিবেককে বিসর্জন দিয়া পাক্কা ব্যবসায়ী হও এবং লাভ কর। আমিও এই মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া, কী করিয়া অধিক লাভ করা যায়, তাহা উস্তাদের নিকট হইতে বহু পূর্বেই সবক লইয়াছি এবং লাভ করিতেছি।
এখন আপনাদের জ্ঞাতার্থে আমার প্রাণপ্রিয় ব্যবসায়ী উস্তাদ কী করিলে অতি অল্প সময়ে অধিক লাভ করা যায়, উহা উত্তমরূপে ব্যাখ্যা দান করিতেছেন। সাগরেদ ঘটকের ঘোষণা শেষ হইলে কৃষকপিতাদের সকলেই করতালি দিয়া স্বাগত জানাইল। কিন্তু কৃষকমাতারা শোরগোল শুরু করিল।
নারী কণ্ঠের চিক্কন চিৎকার সহিয়া অনেক কষ্টে কান পাতিয়া যে কথাগুলি উদ্ধার করা গেল তাহা এইরূপঃ- এইরূপ লাভ করাটা ইংরেজিতে হইলে ভাল হইত। বাংলায় ব্যবসায়িক লাভ করিলে ফলকন্যাদের ভাগ্যে কেবল বিড়ম্বনাকেই ডাকিয়া আনা হইবে।
পক্ষান্তরে ইংরেজিতে লাভ (LOVE) করিলে উহাদের প্রতি যথার্থ অভিভাবকত্বের পরিচয় পাওয়া যাইবে। কারণ, ইংরেজিতে লাভের মধ্যে মানবতা আছে, ধর্ম আছে, সততা আছে, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ আছে, দেশপ্রেম আছে এবং সর্বোপরি বরপক্ষকে (ক্রেতা) ঠকাইবার হীন মনসিকতা নাই।
অনেক কষ্টে নারীকূলের উচ্চকণ্ঠকে নিবৃত্ত করা গেল। সাগরেদ ঘটকের পূণঃ আহ্বানে উস্তাদ ঘটক উঠিয়া দাঁড়াইয়া গলা খাকারি দিয়া কণ্ঠকে কথা বলিবার মত উপযোগী করিয়া লইলেন। অতঃপর ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া গাম্ভির্যতা অর্জন করিয়া বক্তব্য শুরু করিলেন-, “প্রিয় ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ, আপনারা আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন।
ইতোপূর্বে আমি আপনাদের দুইপক্ষের বিতর্ক শ্রবণ করিয়া একদিকে যেমন প্রীত হইয়াছি, অন্যদিকে মর্মাহতও হইয়াছি। প্রীত হইয়াছি এই কারণে, কৃষকপিতারা বিলম্বে হইলেও হৃদয়াঙ্গম করিয়াছেন যে, সমাজে ভালভাবে বাঁচিয়া থাকিতে হইলে ব্যবসার বিকল্প নাই। কেননা, সমাজ এখন বিত্তবানদের দখলে, চিত্তবানের স্থান এখন কোথাও নাই। বর্তমান জামানায় বিত্তবান হইতে গেলে মনে প্রাণে ব্যবসায়ী হইতে হইবে। এক টাকায় পণ্য কিনিয়া দুই টাকা লাভ করিতে না পারিলে কখনোই ধনবান হওয়া যাইবে না, বিলাসবহুল ইমারত নির্মাণ করা যাইবে না, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি ক্রয় করা যাইবে না, সন্তানকে বহুব্যয় করিয়া বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কিংবা বিদেশে পাঠাইয়া উচ্চ শিক্ষা দেওয়া যাইবে না।
এসি, ফ্রিজ, রঙ্গীন দূরদর্শন, বাহারী পোশাক, ঠাঁট-বাট , রিচফুড ক্রয় করিতে গেলে অতিরিক্ত অর্থ দরকার পড়ে। এই অতিরিক্ত অর্থ যোগান দিতে পারে কেবল ব্যবসা, পেশাগত জীবনে অনৈতিক কাজ। অবশ্য আরও একটি রাস্তা আছে, তাহা হইতেছে কর্মজীবনে কঠোর পরিশ্রম। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করা বাঙালী ভুলিয়া গিয়াছে এবং বিনা পরিশ্রমে কীভাবে ধনী হওয়া যায় তাহাই গবেষণা করিতেছে। বাঙালী এখন বাবুয়ানা করিতে শিখিয়াছে।
বাবুয়ানা করিবার অর্থের যোগান দিতে হইলে দুর্নীতির বিকল্প নাই। এখন আপনারাই ভাবিয়া দেখেন, কৃষকপিতারা যে তাহাদের ফলকন্যাদের বাল্যবিবাহের সিদ্ধান্ত নিয়াছে, তাহা কতখানি সঠিক সিদ্ধান্ত। আমি তাহাদের সাধুবাদ জানাই। ”
বক্তব্যের এই পর্যায়ে খানিক বিরতি দিয়া উস্তাদ ঘটক ইতিউতি তাকাইলেন। উনার তেষ্টা পাইয়াছে বুঝিয়া মাতৃমনা নারীকূলের কেউ একজন ছুটিয়া গিয়া রাস্তার মোড়ের দোকান হইতে ঠাণ্ডা এক বোতল তরল পানীয় লইয়া আসিল।
সাগরেদ ঘটক উহা দেখিয়া ভীষণ আশ্বস্ত হইল। অতিথি সৎকারের ত্রুটি হয় নাই ভাবিয়া বঙ্গনারীদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিল। মনে মনে তাহাদের বাহ্বা দিল। কেননা, এখন আর কেহ উহাদের গেঁয়ো-মুর্খ মহিলা বলিয়া অপবাদ দিতে পারিবে না। কারণ তাহারা বুঝিতে পারিয়াছে, নলকূপের ঠাণ্ডা জলে আখের গুড়ের সাথে পাতিলেবুর কিংবা বেলের শরবত ইদানিং সভ্য সমাজে অচল।
ডাব আনিয়া দিলেও জল ছিটিয়া পরিধেয় বস্ত্র নষ্ট হইবার ভয় আছে। তাই অতিথি সৎকার করতে গ্রামেও বোতলজাত তরল পানীয়ের প্রতি তাহাদের আস্থা দেখিয়া ভীষণ প্রীত হইল। এইদিকে উস্তাদ ঘটক স্মিত হাস্যে দাত্রীর নিকট হইতে মেজবানী গ্রহণ করিয়া ধীরেসুস্থে ক্যাপ হইতে সেলোফিনের কাগজ ছিঁড়িয়া বোতলের মুখ খুলিলেন। তাহাতে ফু-উ-স করিয়া নাতিদীর্ঘ একটা আওয়াজ হইল। আওয়াজটা এতটাই মোহনীয় যে, উপস্থিত সাগরেদ ঘটকের মনে ঐরূপ তরল পান করিবার সুপ্ত ইচ্ছা জাগিল।
সে বোতলজাত তরলের খানিকটা তলানী পাইবার আশায় উস্তাদের দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু উস্তাদ ঘটক সেইদিকে দৃকপাত না করিয়া ঢকঢক শব্দ তুলিয়া বোতলজাত রঙ্গীন তরলটুকু গলধঃকরণ করিলেন, একফোটাও বাকী রহিল না। তেষ্টা নিবৃত্ত হইলে উনি একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলিয়া সাগরেদের দিকে চাহিয়া হাসি ফিরাইয়া দিলেন। সেই হাসিতে সাগরেদ ঘটক মূল্যবান আরেকটি সবক শিখিল, ভোগ্যবস্তুর ভাগ সকলকে দিতে নাই। ভোগ করিতে চাহিলে একাকী করাই বাঞ্ছনীয়।
তাই উস্তাদের মারফতী শিক্ষাটাকে নিজের জীবনে মানিয়া চলিবে বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিল। উস্তাদ ঘটক পূণঃ বক্তব্য শুরু করিয়াছেন- “হ্যাঁ, কেন আমি মর্মাহত হইয়াছি, তাহা শুনুন-, বাঙালী রমণীকূল অদ্যাবধি ইংরেজপ্রীতি ছাড়িতে পারিল না। তাহারা ইংরেজী ভাষার ‘লাভ’ শব্দটির প্রতি বুঝাইয়া দিল, এখনও ইংরেজরা তাহাদের হৃদয়ে লালিত হইতেছে। অবশ্য তাহাদেরই বা দোষ কি? ফর্সা ত্বকের প্রতি সকলেরই একটু আধটু দুর্বলতা থাকে। কিন্তু তাহাদের ইহা বোঝা উচিত- ইংরেজদের ইংরেজি খড়াব শুধু মুখে মুখেই ছিল।
বস্তুত তাহারা নবাব আলীবর্দী খানের নিকট হইতে লবণ ব্যবসায়ের পারমিট পাইয়া বাংলাতেও কম লাভ করে নাই। উহারা আমাদের দুই প্রকার লাভই শিখাইয়া গিয়াছে। আমরা তাহাদের শিখানো বাংলাতে লাভটাকে বাছিয়া লইলে দোষের কিছু হইবে না। আর যাহারা ফলকন্যাদের বাল্যবিবাহে এত আপত্তি তুলিতেছে তাহারা সম্ভবত সেই আদিম যুগেই বসবাস করে। কেননা, বর্তমান বিশ্বে অন্যান্য টেকনোলজির সাথে কৃষিজ সেক্টরেও যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হইয়াছে।
উন্নতমানের কীটনাশকের মাধ্যমে আমরা এখন ফলকন্যাদের যৌবনের স্থায়ীত্ব দিতে পারিতেছি। বিভিন্ন দেশ হইতে আমদানীকৃত বিদেশী ফলকন্যাদের আমরা ফরমালিন দিয়া গোছল করাইয়া দিতেছি। বাজারের মিস আপেল, মিস আঙ্গুর ইত্যাদির দিকে তাকাইলেই বুঝিতে পারিবেন, দিনের পর দিন তাহারা তাহাদের কমনীয়তা ধরিয়া রাখিতে পারিতেছে। প্রখর রৌদ্রে পুড়িতেছে, বৃষ্টিতে ভিজিতেজে কিন্তু চেহারার লাবণ্য অটুট রহিয়াছে। আমাদের দেশী অপরিপক্ক ফলকন্যাদেরও আমরা কার্বাইড মাখাইয়া পরিপূর্ণ যুবতীর চেহারা আনিয়া দিব।
উহা দেখিয়া বরপক্ষ বুঝিতেই পারিবে না যে একদা এই ফলকন্যাদের কাঁচা অবস্থায় মাতৃবৃন্তচ্যুত করা হইয়াছিল এবং এখন বাল্যবিবাহ দেওয়া হইতেছে। ফর্মালিন মাখাইয়া আমরা ফলকন্যাদের যৌবন ধরিয়া রাখিবার ব্যবস্থা করিয়াছি। রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারের সকল তত্ত্ব তো আপনারা জানেন না। এইসব ফলকন্যারা আমাদের আড়তের বিউটিপার্লারের দক্ষ বিউটিশিয়ানদের দ্বারা যখন পটাশিয়াম কার্বাইড, কপার সালফাইড, পটাশের তরল দ্রবণ, কার্বনের ধোঁয়া ও ইথারেল দিয়া শ্যাম্পু¯œান, নানারকম উপটান, ফ্যাসিয়াল এবং ¯েœা-পাউডার মাখিয়া বাহিরে আসিবে তখন তাহাদের গতরের উজ্জ্বল্য দেখিয়ে আশি বছরের বরও ভীমরি খাইয়া যাইবে। ক্ষুদে বালিকা বলিয়া বিবাহ করিবে না, এমনতর জঘন্য কথা তাহারা কল্পনাতেও আনিবে না।
আমাদের আড়তের বিউটিশিয়ানরা এইসব অপরিপক্ক ফলকন্যাদের গায়ে গতরে কেমিকেল দিয়া এমন মেনিকিউর-পেডিকিউর করিয়া দিবে যে, উহাদের রূপ দেখিয়া বরপক্ষের চোখের পলক পড়িবে না। ঝলমলে চেহারা, অটুট যৌবন দেখিতে কার না ভাল লাগে! আমরা যৌবন অক্ষুণ্ণ রাখার কৌশল আবিষ্কার করিয়াছি। সেই কৌশল প্রয়োগে আমাদের দেশীয় ফলকন্যারা একেকজন মিশরের পিড়ামিডের ভিতর থাকা মমি’র মত হইয়া যাইবে, তবু রূপের হেরফের হইবে না। আরেকটি বিষয় না বলিলেই নহে, সেটি হইতেছে-, আমাদের বিউটিপার্লার হইতে যে সমস্ত ফলকন্যারা সাজিয়াগুজিয়া বাহির হইবে তাহাদের নিয়া পরকীয়া প্রেমের ভয়ও পাইতে হইবে না। কেননা, যে সমস্ত দুষ্ট মক্ষীরা ফলকন্যাদের ললাটে ও গ-দেশে সুযোগ পাইলেই সন্ত্রাসী কায়দায় চুম্বন করে, উহারা আর কখনোই ধারে কাছে ঘেঁষিবে না।
সন্ত্রাসী গুণ্ডা মক্ষীরা উহাদের গাত্রে বসিবা মাত্রই মৃত্যুবরণ করিবে। নারীত্বের পূর্ণ মর্যাদা রক্ষার্থে আমাদের টেকনোলজি একেবারে ধন্যন্তরী। উপরন্তু, বিবাহের উপযুক্ত মৌসুমের আগেই যদি আমরা এই কন্যাদিগকে বিবাহের উপযোগী করিতে পারি তবে আমাদের কতো টাকা পণ এবং দেনমোহরনা আসিবে সেইটি আপনারা কল্পনাও করিতে পারিবেন না। কন্যার পিতা হইয়া শুধু আরব দেশের পিতাগণই দেন-মোহরনা আর পণ আদায় করিবেন, ইহা হয় না। একই পৃথিবীতে দুই রকম আইন মানিয়া লওয়া যায় না।
সুতরাং সম্মানিত কৃষকমাতাগণ, আপনারা অকারণ চিন্তা বর্জন করুন এবং আমাদের টেকনোলজির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করুন, যেইরূপ কৃষক পিতারা করিতে চাহিতেছেন। ”
উস্তাদ ঘটকের এইরূপ কথায় কৃষকমাতাগণ দুনোমুনো করিতে লাগিল। তাহাদের মধ্যেও দুইটি ভাগ হইয়া গেল। একভাগ কৃষকমাতা ঘটকের মোহনীয় কথায় মুগ্ধ হইল। তাহারা অনেক ভাবিয়া দেখিল, কেমিকেলের গুণে যদি বাল্যরেখা ঘুচিয়া যায় এবং দ্বিগুণ লাভ ঘরে আসে, তবে মন্দ কি? নগদ প্রাপ্তিতে কার না ভাল লাগে! কিন্তু সমস্যা হইল দ্বিতীয় ভাগের কৃষকমাতাদের লইয়া।
তাহারা কিছুতেই এইরূপ হইতে দিতে রাজী নহে। তাহাদের পক্ষ হইতে কড়া আপত্তি উঠিল, অল্পবয়সে বৃক্ষমাতার বুক হইতে যেইসব ফলকন্যাদের কেমিকেল মাখাইয়া অকালপক্ক করার ব্যবস্থা হইতেছে, ইহা কখনোই সুখের হইবে না। কেননা অকালপক্ক এইসব কন্যারা স্বামীর সংসারে (ভুক্তার উদরে) গিয়া অশান্তি সৃষ্টি করিবে। তাহাদের অবচেতন মনে বাল্যের চাঞ্চল্য থাকিয়াই যাইবে। ফলে গ্যাস্ট্রিক, আলসার, পাকস্থলী ও অন্ত্রনালীর প্রদাহ, অরুচি, ক্ষুধামন্দা, লিভার সেরোসিস, কিডনি বিকল এমনকি লিভার ক্যান্সারের মত মারাত্মক ঝগড়াও বাঁধাইয়া বসিবে।
তখন কী উপায় হইবে? ঐসব কৃত্রিম পরিপক্ক ফলকন্যাদের অত্যাচারে স্বামী বেচারাদের কী হাল হইবে- বলিয়া দ্বিতীয় ভাগের কৃষকমাতারা গোল করিতে লাগিল।
দক্ষিণ হস্ত ঊর্ধ্বে তুলিয়া করিয়া উস্তাদ ঘটক তাহাদের থামাইয়া দিয়া কহিলেন, “বিবাহের পরে কন্যাগণের সংসারের খবরাখবর কেবল বোকারাই লয়। কেহ যদি ইচ্ছা করিয়া বোকামী করিতে চাহে, তবে তাহাদের উদ্দেশ্যে বলিতেছি-, এইরূপ সমস্যা দেখা দিলে বরপক্ষ ইচ্ছা করিলে উকিলের (চিকিৎসক) শরণাপন্ন হইবেন। উহাতে উকিল বাবুরাও কিছুটা কামাইয়া লইতে পারিবেন। কেননা, উহারাও ব্যবসায়ী।
এখন ভাবিয়া দেখুন, স্বজাতিদের প্রতি আমাদের কেমন টান! আমরা শুধু নিজেরাই ব্যবসা করিব না, উপরন্তু অন্যদেরও ব্যবসা করিবার পথ সুগম করিয়া দিব। তবে, একটি কথা না বলিলেই নয়, সেটি হইল- ‘পাকস্থলী’ শব্দটাকে আর ব্যবহার না করাই ভাল। কেননা, উহাতে পাক পাক অর্থাৎ পাকিস্তান গন্ধ পাওয়া যায়। দেশ স্বাধীন হইয়াছে কিন্তু আমরা এখনও পাক পাক করিয়া পাঁকে পানি ঘোলা করিতেছি, ইহা দেশপ্রেমিকের আদর্শ নহে। তৎপরিবর্তে শব্দটির প্রথমাংশ বদলাইয়া বঙ্গস্থলী বলাই সমীচীন”।
এই বলিয়া খানিকটা গোস্যা হইয়াই উস্তাদ ঘটক বক্তব্য শেষ করিলেন। উস্তাদ ঘটকের বক্তব্যকে উপস্থিত বেশীরভাগ লোক সমর্থন করিলেও কেহ কেহ মানিল না। যাহারা মানিল না তাহারা সেকেলে, গেঁয়ো, নিবুর্দ্ধি প্রভৃতি গঞ্জনা গায়ে মাখিয়া স্থান ত্যাগ করিল। আর বাকীদের লইয়া ঘটকেরা ফলকন্যাদের সাজাইয়া গুজাইয়া বিবাহ উপযোগী করিয়া তুলিল।
কৃষকপিতারা এখন ব্যবসায়ীদের সাথে হাত মিলাইয়াছে, তাই বেশ চলিতেছে।
ফলকন্যারা বেশ ভরাট দেহ, কমনীয় চেহারা, চটুল চক্ষুর উদ্দীপক চাহনী লইয়া বরবাজারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। উহাদের কলার অন্ত নাই। ষোলকলা উহাদের আগেই ছিলো। বিউটি পার্লার হইতে এখন আঠারকলা শিখিয়া বর আকৃষ্ট করিতে- নিতম্ব নাচাইয়া, বক্ষ দোলাইয়া, বিভিন্ন প্রকারের অঙ্গভঙ্গী করিতেছে, চক্ষু টিপিতেছে, খিলখিল করিয়া হাসিতেছে, গীত গাহিতেছে, নৃত্য করিতেছে। ফলকন্যাদের যৌবনের এইরূপ খোলতাই দেখিয়া পাশ ফিরিয়া চলিয়া যাইবে, এমন বর বাংলাদেশে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না।
ফলস্বরূপ, সকলেই উহাদের বিবাহ করিতেছে। কিন্তু বাসর করিতে (খাইতে) যাইয়া বোঝা যাইতেছে, রূপ-রং দেখিয়া যাহাদের ঘরে আনা হইতেছে, তাহারা রসে বিস্বাদ, গন্ধে বিটকেলে এবং মারাত্মক রকমের ঝগড়াটে। সংসারটাকে উহারা ছারখার করিয়া দিতেছে। ফলকন্যাদের এইরূপ চরিত্র সম্পর্কে ঘটক সাহেব আগাম কিছু বলিয়া দেয় নাই, দিলে হয়তো বিবাহের সময় বুদ্ধি-বিবেচনা করিবার একটা সুযোগ থাকিত। এখন আর কিছুই করিবার নাই, বাহিরের সুন্দর দেখিয়া অনেক টাকার দেন-মোহরনা দিয়া ফলকন্যাদের বিবাহ করা হইয়াছে।
ঘটকের প্রতারণা, ফলকন্যাদের বিরূপ আচরণ উহাদের মনে বৈরাগ্য দেখা দিতেছে। মনে বৈরাগ্য আসিতে থাকিলে মানুষ দার্শনিক ও ভাববাদী হইয়া উঠে। উহারা তকদিরের উপরই বেশী ভরসা করে, তাই তকদিরের লেখা মানিয়া নিয়া বরেরা সান্ত¡না খুঁজিলেও মনের কোণে একটি বিষয় উহাদের নিয়মিত ঘা মারিয়া যাইতেছে। তাহা হইল- বেহেস্তে হাওয়া বিবিকে লোভ দেখাইয়া শয়তান গন্ধম খাওয়াইয়াছিল, হাওয়ার প্ররোচনায় আদমও বাদ যায় নাই। কিন্তু দুনিয়াতে উভয়েই কেন গন্ধম খাইতেছে, উহার কারণ তালাশ করিতে হইবে।
তারিখ: ১০ জুন, ২০১২
পরিচিতি: কবি, লেখক ও সাংবাদিক
এবং
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
পাক্ষিক সময়ের বিবর্তন
৩২/২ সেনপাড়া পর্বতা
সেকশন ১০, মিরপুর
ঢাকা- ১২১৬
ফোন : ৮২৫৪৫৯৫
মোবাইল: ০১৯৪২-৮৪৭২০৭, ০১১৯১-১৫৬৮৭৬
ইমেল:
http://www.somewhereinblog.net/blog/TAYAUBKHAN
http://www.somoyerbibortan.com ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।