আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৎসবৃদ্ধ অথবা মুখোশের গল্প

আমিই সেই জন, যাকে খুঁজিয়াছ অকারন... ***১ রঙটা ঠিক কালো না। সবুজাভ কালো। কোন রঙটা? লোকটার আলখাল্লার রঙ। কোন লোকটা? যাকে অফিসের সামনে প্রতিদিন দেখা যায়। জারুল বা অন্য কোন গাছের নিচে বসে থাকে।

তার পরনে থাকে একটা আলখাল্লা যেটার রঙ পুরোপুরি কালো না; সবুজ আর কালোর মেশামেশি। আর যা কিনা ময়লা আর জীর্ন। আর তার মতই বার্ধক্যাক্রান্ত। প্রতিদিন অফিসে ঢোকার আগে তাকে দেখি। লোকটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

হয়ত সে স্বাভাবিক দৃষ্টিই ছুঁড়ে। এবং তা স্বাভাবিকভাবেই অস্বাভাবিক অথবা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। বৃদ্ধ বসে থাকে ধ্যানস্থ বুদ্ধের মত। কখনো তার চোখের পলক পড়তে দেখি নি। লোকটা হয়ত একটা বোয়াল মাছ যার কিনা 'চোখের পাতি' নেই।

এসময় তার পাশে একটা বাক্স দেখা যায়। বাক্সের রঙ নীল। নীল রঙের কাঠের বাক্সটাও বয়সের ছাপ বহন করে। এর ভেতরে কি আছে তা আন্দাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিকেলে অফিস শেষে কখনো তাকে দেখা যায় না।

বা আমি দেখি না। সেদিন গিয়ে ধরলাম বৃদ্ধকে। সেদিনও সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। অদ্ভুত এবং পলকহীন। তার পাশে গিয়ে বসলাম।

লক্ষ করলাম তার দৃষ্টি শুধু অদ্ভুত আর পলকহীন না; সেইসাথে ছানিপড়াও। বেনসনটার শেষধোঁয়াটুকু গিলে ছুঁড়ে ফেললাম। দূরে; একটা রিকশার চাকা এইম করে। ধুরো শালা, লাগলোনা। 'প্রতিদিন এইখানে কি করেন?' 'বেচাবিক্রী করি।

' বৃদ্ধের কন্ঠস্বর শ্লেষামিশ্রিত, ভাঙ্গা ভাঙ্গা। মনে হয় সুগভীর কোন কূয়া থেকে উঠে আসছে হামাগুড়ি দিয়ে। 'কি বেচাবিক্রী করেন?' 'মুখোশ বেচি। ' 'এইখানে কেন? এখানে কে কিনবে মুখোশ?' 'মুখোশের বেচাকিনা সবতেই জমজমাট। ' 'তাই নাকি? বাহ।

ভালোতো। ' দ্বিতীয় সিগারেটে আগুন স্পর্শ করাই। আরম্ভ হয় শেষের। এই অবসরে বৃদ্ধ বিশাম নেয় না। খকখক করে কাশে।

থু করে কিছু কফ ছুড়ে ফেলে; যথাসম্ভব দূরত্বে। 'আপনে কিনবেন?' শ্লেষা যেন আরো জড়িয়ে ধরেছে শব্দগুলো। 'আমি? আমি মুখোশ দিয়ে কি করব?' ব্যাটা পাগল নাকি? মনের ভেতরের উশখুশগুলো উশখুশিয়ে ওঠে। 'আপনের মুখোশ দরকার। বেশিই দরকার।

' মুচকি হাসি আঁকিত হয় বৃদ্ধের শতভাঁজের গালটাতে। এখন মনে হয় হাসিটা মুচকির চেও বেশি কিছু ছিল। তারপর ছানিপড়া মৎসদৃষ্টি বৃদ্ধ ভাঙ্গা ভাঙ্গা কফজড়ানো কন্ঠে মুখোশের বৃত্তান্ত শোনায়। বলতে বলতে তার চোখ চকচক করে। একসময় আবিষ্কার করি সেই চকচকানি আমার চোখে।

পারদের মত শুষ্ক চকচকে চোখ নিয়ে ঘন্টার্ধেক পর উঠে দাঁড়াই। হাতে ব্রাউন পেপারে মোড়ানো ছয়টা মুখোশ। মৎসবৃদ্ধ কাঁপা হাতে কাঠের বাক্সের ডালা বন্ধ করতে করতে হাসে। 'লাগলে আবার আইসেন। ' আমিও ফিরতি হাসি দেই।

আসব। 'দামটা?' আসল কথায় আসি। অফিসের লেট হওয়ার আশঙ্কা চোখে ঘড়ি দেখি। 'ওটা পরে চেয়ে নিব। আরোতো নিবেন।

একসাথে দিয়েন। ' ব্যাটার মাথায় যে ছিট আছে তা নিয়ে আর কোন সংশয় থাকে না আমার। ***২.১ 'বাবা, আমার ফাইলটা?' পাকাচুল বৃদ্ধার কন্ঠ অসহায়ত্বের আকুতিতে জবজব করে। তার দিকে না তাকিয়ে সামনের পুরোনো এবং বাতিল একটা ফাইলে দৃষ্টি মাখি। বিরক্তিতে ভ্রু দু'টা কুঁচকে আছে অনুমতি ছাড়াই।

বুড়ি আড়াই মাস ধরেই আসছে। অক্কা পাওয়া স্বামীর পেনশনের বন্দোবস্ত করতে। আরে ভাই, তোর স্বামীর পেনশন; তুইতো নিবি। আমি নেব নাকি? কিন্তু কিভাবে ছাড়ি ফাইলটা? কিছু দাও না টেবিলের নিচ দিয়ে। আমিও খুশি; পেনশনটাও গিললি।

'শালার বুড়ি'। কিছু ছাড়লেই ঝামেলা চুকেই যায় না শুধু; বুকেও যায়। 'শালার কিপ্টা বুড়ি। ' সব কথা কি খোলাসার দাবী রাখে? আর বৃদ্ধার কাছে কথাটা সরাসরি পাড়তেও কেমন জানি লাগে। ভেবেছিলাম নিজেই বুঝবে।

হতাশ হই বৃদ্ধার হাবভাবে। মনে হয় এইমাত্র ভূমিষ্ঠ হয়েই আমার কাছে চলে এসেছে। নাহ। এভাবে আর হচ্ছে না; হবে না। পায়ের কাছের ড্রয়ারটার দিকে হাত বাড়াই।

ব্রাউন পেপার খুলে মুখোশটা বের করি। প্রতিটা মুখোশের গায়েই আলাদা আলাদা নাম দেয়া। আমি 'আমি অসৎ' মুখোশটা পড়ে নিলাম। ***২.২ নিউমার্কেটের ভীড়ে দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। বুকে অক্সিজেন জমিয়ে কোনভাবে টিকে থাকা।

এই ভীড় শুধু মানুষের ভীড় বলে যে কারোই ভুল হতে পারে। এই ভীড় গন্ধেরও। সস্তা পারফিউমের গন্ধ থেকে শুরু করে দামী ব্র্যান্ডের বডি স্প্রের স্মেল, স্নো-পাউডার থেকে কড়া মেকাপের ঝাঝালো গন্ধ রীতিমত প্রতিযোগিতায় নামে আমার ঘ্রানেন্দ্রিয়র দখল নিতে। আশেপাশে 'কাঁচা মাংস' থাকলে ভীড়বাট্টা কম উপভোগ্য হয় না সাগর সৈকতে এলিয়ে পড়ে থাকার চে। দুর্ভাগ্যের বিষয় আশেপাশে নারীদেহ সহজলভ্য না।

যারা আছে হয় তাদের গার্ড আছে নতুবা ফোর্থ বা ফিফথ ক্লাস। হঠাৎ নিরাশার রাডারে একটা পাখি ধরা পড়ল। একটু সামনেই একটা 'পাকা কবুতর' এগুচ্ছে; ভীড়ের সাথে সাথে। হাতের স্নায়ুগুলো নিশপিশ করে ওঠে। উফফ...জিনিস একটা।

বিকেলের আলো কমতির দিকে। আলোক স্বল্পতায় ম্যাচ জমবে বলে মনে হয়। চারিদিকে একবার নজর বোলালাম। ভীড়ের আরো তিনজনের লক্ষ্যও সেইম। তারা মুখোশ পড়ে ফেলেছে।

আমি ভীড়ের খোঁচা গ্রাহ্যে না এনে দ্রুতহাতে সাইড ব্যাগ হাতড়াই। ব্রাউন পেপার থেকে একটা মুখোশ বের হয়। আগেরটা না। মুখোশ পড়তে পড়তে ভীড়ের মধ্যেই দ্রুত হলাম। নাকে সব গন্ধ ছাপিয়ে অন্য একটা গন্ধ পেতে শুরু করেছি।

হয়ত শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় কয়েক ডিগ্রী ফারেনহাইট। অঙ্গবিশেষে সেটা আরো কয়েক ডিগ্রী বেশি হতে পারে। ***২.৩ খুব বেশিদিনের পরিচয় না হলেও সারাকে বেশ ভাল পাই। আমার স্ত্রী ফারজানার মতো লুতুপুতু মেয়ে না। একধরনের আফসোস অনুভব করি কেন আরো আগে মেয়েটার সাথে পরিচয় হয় নি।

সারার খিলখিল হাসি শুনলেই অন্যরকম একটা কাঁপুনি জাগে। সারার ফ্ল্যাটটা বেশ টিপটপ; সাজানো-গোছানো। কেমন জানি শান্তি শান্তি গন্ধ। মনে হয় আমি হাজার বছরের ক্লান্ত পথিক। দু'চোখ একটু আশ্রয় চায় অন্ধকারের।

বার বার হাই ওঠে। মাথার অক্সিজেনস্বল্পতায় বা ঘুমসংক্রান্ত জটিলতায়। সমস্যা হল- আমি এই ছোট ঘুম নগরীতে ঘুমাতে আসি না। এখানকার প্রতিটা সেকেন্ড তারিয়ে তারিয়ে অনুভবের উদ্দেশ্যই আমাকে জাগিয়ে রাখে। সারা হাসছে।

এই অঞ্চলে আগে আগেই মধ্যরাতের নির্জনতারা রাস্তায় রাস্তায় টহলে বের হয়। নীরবতার প্রাচুর্য্যের কারনেই হয়তবা সারার হাসি ঠিক পার্থিব মনে হয় না। সেলফোনের দিকে তাকালাম। ডিসপ্লে স্ক্রীন দিয়ে যেন ফারজানা চেয়ে আছে; রাগহীন, ক্ষোভহীন আর দুঃখহীন চোখে। মেয়েটার চোখে একটা অসহায় অভিমানের পর্দা ঝোলে।

ডান থেকে বামে। তারপর আবার ডান থেকে বামে। ফোনের সুইচ অফ করে দিলাম। যদিও 'জানা'কে বলা আছে অফিসের কাজে খুলনা যাচ্ছি। তবুও অস্বস্তি কাটাতেই ফোন অফ করলাম।

লাভ হল না কোন। ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে বউটা এক চোখ অভিমান নিয়ে। হঠাৎ মনে হল বাসায় চলে যাই। গিয়ে বলি 'খুলনা যাওয়া ক্যান্সেল হয়ে গেল। এই ক্ষতি পোষাবো কিভাবে বলতো।

' নাহ। মুখোশটা পড়ে নিলাম। ফারজানা যেন কোন অদৃশ্যলোকে চলে গেল। আমি সারার পেছন পেছন বেডরুমের দিকে এগুলাম। ***২.৪ এভাবে হয় নাকি? এত অল্প মুখোশ নিয়ে টেকার চে ডেড সী তে ডুবে মরা ঢের সহজ।

আমার মুখোশ চাই। আরো মুখোশ চাই। রিকসাওয়ালাকে চড়িয়ে পৌরষত্ব ঝালিয়ে নিতে মুখোশ চাই; আর বস মাদারচোদকে তেলানোর জন্যও একটা তৈলাক্ত মুখোশের বেশ দরকারিতা অনুভব করি ইদানীং। মুখোশের চাহিদার শেষসীমা বলতে কিছু নাই। এমনকি মুখোশ ছাড়া মহিলা সিটগুলোতে পর্যন্ত এলিয়ে বসা যায় না।

জারুল বা অন্য কোন গাছের নিচে বসে থাকা বৃদ্ধের সাথে দেখা করার জন্য সময় দাবী জানায়। প্রায় বিশটা মুখোশে আর হচ্ছে না। বৃদ্ধ এখনো প্রতিদিন মাছের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সাথে একটুখানি হাসিও ঝুলতে থাকে ভাঙ্গা চোয়াল ধরে। হাসিটা এক-আধটু কেমন যেন।

***৩ 'আমার আরো কিছু মুখোশ দরকার। ' বৃদ্ধ হাসে। সেই হাসিতে ভাল করে লক্ষ্য করলে দুই চামচ তৃপ্তি আর এক চামচ তাচ্ছিল্য উঁকি দেয়। 'আমার আরো মুখোশ দরকার। ' 'এত মুখোশ দিয়া কি করবেন?' 'যা খুশি।

মুখোশ দেন। ' 'আগের দামইতো দেন নাই। ' 'দিচ্ছি। দাম বলেন। ' 'আপনের আত্নাটা।

' শুদ্ধ উচ্চারনে 'আত্না' শব্দটা শুনে মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে এই টার্মের ব্যবহার মৎসবৃদ্ধের এই প্রথম না। পাগলাবুড়ার শখ দেখে হাসব নাকি কাঁদব বুঝি না। এই ব্যাটা বলে কি!! আত্না কেউ বিক্রি করে নাকি। হো হো করে হেসে উঠতে গিয়েও বৃদ্ধের ছানিপড়া বরফ-চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে যেতে হয়। সস্তা সন্ধ্যা রুগ্ন পৃথিবীর মাটি ছুঁই ছুঁই করছে।

ব্রাউন পেপারে মোড়ানো কিছুএকটা নিয়ে জীর্ন এবং ভরহীন একজন মানুষ ক্লান্ত এবং অলস পায়ে হেঁটে যায়। মানুষটা আমি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.