আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডলুরাময় সীমান্ত হাট (বর্ডার মার্কেট)। ছবি সহ।

অতি ক্ষুদ্র পতঙ্গেরও অপূর্ব জীবন। নুরুল ইসলাম ভাইয়ের দোকানের সামনে বসে কোল্ড ড্রিংকস খেতে খেতে কাজিন সুমন বলল “আজ মঙ্গলবার, ডলুরায় (নারায়নতলা, সুনামগঞ্জ) সীমান্ত হাট (Border Market)। চল ঘুড়ে আসি। আর সুযোগ পাব কিনা সন্দেহ। দুইদিন পর তুই চলে যাবি ঢাকায়, আমিও চলে যাব সিলেট।

ব্যস ছুটি শেষ”! আমি সাথে সাথে রাজি। ফোন দিলাম আরেক কাজিন জাকিরকে “আধা ঘণ্টার ভিতর নুরুল ইসলাম ভাই এর দোকানের সামনে আয়। আমরা রেডি হয়ে আসছি। বাসায় যেয়ে তাড়াতাড়ি গোসল সেরে হালকা খাওয়া দাওয়া করে বের হয়ে পরলাম। তিনজন মিলে দোকান থেকে সিএনজি করে প্রথমে গেলাম ষোলঘর (১৫ টাকা)।

সেইখান থেকে অটোরিকশায় করে ধারাগাও (৩০ টাকা)। সামনে এবার সিলেট-সুনামগঞ্জের প্রাণ সুরমা নদী। নদীর ওই পারের নাম হালুয়ারঘাট। নদী পার হওয়ার জন্য ইঞ্জিন চালিত নৌকার ব্যবস্থা আছে। ভাড়া ৬ টাকা।

হালুয়ারঘাট থেকে সরাসরি ডলুরা যাওয়ার একমাত্র বাহন হল মোটরসাইকেল। আপনি নৌকা থেকে নামার সাথে সাথেই দুই তিনজন মোটরসাইকেল ড্রাইভার এসে আপনাকে অনবরত জিজ্ঞেস করতে থাকবে “বর্ডার মার্কেট যাইতাইন নি বা”? আমরা তিনজন যাওয়ার জন্য ১৫০ টাকায় একটা মোটরসাইকেল ঠিক করলাম। সাথে ড্রাইভার। প্রায় আধা ঘণ্টা মোটর সাইকেল চালিয়ে মোটামুটি একটু খালি জায়গায় আসার পরই ঘটল বিপত্তি। চাকায় একটা পিন ঢুকে চাকা লিক হয়ে গেছে।

ড্রাইভার ছেলেটা আমাদের বয়সী। বলল “আফনেরা এট্টু বইন, আমি ২০ মিনিটের ভিতরে মোটরসাইকেল ঠিক খইরা লইয়া আইত্রাম”। এইদিকটা খালি মোটর সাইকেল পাওয়াটা দুষ্কর। প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করার পর একটা খালি মোটরসাইকেল এসে আমাদের পাশে থামল। ড্রাইভার বলল, “সাইফুল ভাই পাঠাইসে, উঠে পরেন”।

আরও প্রায় ২৫ মিনিট চলার পর আমরা ডলুরা সীমান্ত হাটের সামনে এসে পৌছালাম। প্রত্যেক মঙ্গলবার বসে এই হাট। চলে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত। জায়গাটা বাংলাদেশ ভারতের জিরপয়েন্ট। জির পয়েন্টের ওই পাড়ে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া আর এই পাশটায় উদার উন্মুক্ত বাংলা।

মধ্যের এই জায়গাটাও চারিদিক থেকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। হাটে প্রবেশ করার দুইটি গেইট। একটি বাংলাদেশীদের অন্যটি ভারতীয়দের। হাটের বাংলাদেশের দিকের অংশটা বাংলাদেশী দোকানীদের আর ভারতের পাশের অংশটা ভারতীয় দোকানীদের। মার্কেটের ঠিক পাশেই দেখলাম বিএসএফ এর ৩-৪ টি গাড়ি দাঁড়ানো।

ভারত থেকে যারা আসছে তারা পাস কার্ড দেখিয়ে মার্কেটে ঢুকছে, আবার পাস কার্ড দেখিয়েই ভারতে প্রবেশ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের দিকে এই রকম কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। আর ভারতীয় গেইটে ওদের কাস্টমসের লোক থাকলেও বাংলাদেশের গেইটে আসলে কেউই নেই! মার্কেটে ঢুকেই ওইখানকার স্থানীয় এক পরিচিত বন্ধুকে খুজে বের করলাম। গিয়ে দেখি ও সমানে ভারতীয় একটা মেয়ে দোকানীর সাথে আড্ডা দিচ্ছে। বলে রাখা ভাল সুনামগঞ্জের পাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্য অবস্থিত, যেখানে গারোদের বসবাস।

ওদের পারিবারিক ব্যবস্থা মাতৃতান্ত্রিক। এই কারনেই মনে হয় প্রায় সবগুলো ভারতীয় দোকানই মেয়েদের চালাতে দেখলাম। এরা আবার বাংলা, হিন্দি ইংরেজি তিন ভাষাই কম বেশী বুঝে। আবার বাংলাদেশী দোকানীরাও মোটামুটি হিন্দি বুঝে। চা কফি খাওয়ার জন্য আলাদা দোকান আছে।

তবে ভারতীয় বেশ কয়েকটি দোকানেই দেখলাম ওরা নিজেরা খাওয়ার জন্য চা কফি রাখে। আমরা আমাদের ওই বন্ধুর পাশে বসার পরই ওই দোকানী মেয়েটি আমাদেরকে চা খেতে দিল। যখন দোকানের পাশে খালি জায়গায় বসে চা খাচ্ছিলাম তখনই খেয়াল করলাম আমাদের পাশেই ১০ থেকে ১২ জন বিভিন্ন বয়সের মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছে। বন্ধুর কাছে জিজ্ঞেস করে যা জানলাম তা হল এইখানে ভারতীয় ও বাংলাদেশী পরস্পরের আত্মীয় দুইটি পরিবারের সদস্যরা একত্রে বসে গল্প করছে। ১২ জনের মধ্যে ৪ জনই মধ্যবয়সী মহিলা।

দুইটি উঠতি বয়সী ও একটি পিচ্ছি মেয়ে। আর বাকি ৪-৫ জন পুরুষ সদস্য। এইখানের একটা মেয়েকে নিয়ে আবার আরেকটা ভাল গল্প করার মত অনেক কিছুই ঘটেছে সেটা পরে বলব। পুরো হাটে প্রায় শখানেক দোকান। প্রত্যেক দোকানের ভাঁড়া ১৬০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত।

তবে দুই তিন জন দোকানী মিলে একটা দোকান ভাড়া নেয়ার ব্যবস্থা ও আছে। আমরা আবার ভারতীয় দোকান গুলোই বেশী খেয়াল করেছি। ওদের প্রত্যেক দোকানে ৩-৪ জন করে লোক বসা। হাটের মাঝখানে মোটামুটি আয়তনের কিছু উন্মুক্ত জায়গায় প্রায় ৫০-৬০ বস্তা তেজপাতা আছে। দাম জিজ্ঞেস করি নি।

তবে ভারত থেকে আসা এই জিনিসটাই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। এর পরেই বিক্রি হচ্ছে জিরা। এখানে প্রতি কেজি জিরার দাম বাংলাদেশী টাকায় ২৩০ টাকা, কিন্তু ভারতীয় রুপিতে ১৪০ রুপি। প্রথম ধাক্কাটা লাগল এই খানেই। এই খানে কেনাকাটায় যেই কারেন্সি রেট অনুসরণ করা হয় তা মোটামুটি এই রকম...... ১০০ রুপি=১৭০ টাকা।

অথচ যা হওয়ার কথা ছিল ১০০ রুপি= ১৩২ টাকা। অন্যান্য যেইসব ভারতীয় জিনিস বিক্রি হচ্ছে তা হল প্রায় সব ধরণের কসমেটিক্স (বডিস্প্রে থেকে শুরু করে জন্ম নিরোধক), চকলেট, বিস্কুট, দারুচিনি, এলাচি, ইলেক্ট্রনিকস। তবে এইসব ইলেক্ট্রনিকসের জিনিস গুলোকে চৈনিক মাল বলেই হল, আর দাম ও যে কম তা না। ভাল বিক্রি হচ্ছে এমন জিনিস গুলোর মধ্যে আছে পেঁয়াজ, রসুন, কার্পেট, আলু, শাড়ি, গামছা ইত্যাদি। তবে সব জিনিসের কেনাবেচাতেই ওরা ১ রুপি=১.৭০ টাকা থিওরিটা ব্যবহার করছে।

যেমন, একটা জিনিসের গায়ের দাম ২০০ রুপি। এই জিনিসটা রুপিতে কিনতে গেলে আপনার ২০০ রুপিই লাগবে, কিন্তু টাকায় কিনতে গেলে আপনাকে ৩৪০ টাকা দিতে হবে। বাংলাদেশী দোকানগুলোতে তুলনামূলক ভাবে ভাল মানের জিনিসই বিক্রি হচ্ছে। যেমন, মেলামাইনের বাসন কোসন, বিভিন্ন ধরণের কাপড়চোপড়, প্লাস্টিকের আসবাব পত্র। মার্কেটের পাশেই বিভিন্ন ধরণের খাবার দোকান।

এই খানে আপনারা যা খেতে পারেন তা হল ভুনা খিচুড়ি, ডিম, পোলাও, সাদা ভাত, মোরগের মাংস, মাছ, ডাল, ছোলা, পিঠা, সন্দেশ, মিষ্টি, মুড়ি, বাদাম ইত্যাদি। বেশিরভাগ খাবারি গ্রাম্য মেলার স্টাইলে তৈরি। মানে অত ফর্মালিটি নেই, পরিবেষণও নেই। তবে আমি আপনাদের এই নিশ্চয়তা দিতে পারি ঢাকা ও অন্যান্য শহরের মোটামুটি মানের হোটেল রেস্টুরেন্টের চেয়ে এইখানকার খাবার অনেক ভাল এবং কৃত্তিম স্বাদহীন। আমরা একটা দোকানে বসে তিন জন মিলে ১২ টি মিষ্টি গিলেছিলাম।

প্রতিটি ৫ টাকা। দারুন ছিল খেতে। হাট শেষ হয় বিকাল ৫ টায়। বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে এর পূর্বেই হাট থেকে বের হওয়ার সংকেত দেয়া হয়। আমরা ৫ টা বাজার ৫-৬ মিনিট আগে বের হয়ে আসলাম।

ফেরার আগে একবার ডলুরা স্মৃতিসৌধ ঘুরে আসলাম। এর প্রবেশ পথেই রয়েছে স্মৃতিসৌধ এ সমাহিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, পরিচয়। প্রত্যেকেরই কবরে রয়েছে আলাদা আলাদা নাম ফলক। স্মৃতিসৌধ এর পাশেই রয়েছে ভারতের পাহাড় ঘেঁষে বয়ে চলা বর্ষাকালীন নদী। কারণ শুষ্ক মৌসুমে এইখানে শুধু বালির চরই থাকে।

কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার ভিতরে থাকা সত্ত্বেও বিএসএফ কারণে নদী ও পাহাড়ের পাশেই বিস্তীর্ণ জায়গাটুকু আপনি স্বাধীন ভাবে ঘুরানোর সুযোগ নাও পেতে পারেন। তবে স্মৃতিসৌধ এর পাশের পুরো এলাকাটা সত্যিই দেখার মত। এখানের আশপাশে বাংলাদেশী মালিকানাধীন বেশ কিছু ছোটছোট টিলাও আছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.