আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গুম থেকে ফিরে ভয়াল অভিজ্ঞতার বর্ণনা

সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহ পাকেরই প্রাপ্য,যার হিসাব অত্যান্ত সুক্ষ্য এবং সম্পূর্ন নির্ভুল। "আমাকে বলা হল তৈরি হয়ে নিন। এরপর শুধু আল্লাহকে স্মরণ করেছি। সুরা আর কলমা পড়েছি। ’" রাজপথ থেকে তুলে নিয়ে মাথায় চোখমুখ ঢাকা জমটুপি, দুই হাতে হ্যান্ডকাপ ও পায়ে শিকল লাগিয়ে তিনদিন আটক রাখার পর অবশেষে মুক্তি মিলেছে এক পরিবহন শ্রমিক নেতার।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে গুলিস্তান থেকে তুলে নিয়ে তিনদিন আটক রাখা হয় তাকে। তিনদিনের মধ্যে দুইদিনই একাধিক মাইক্রোবাস ও জিপে করে মাইলের পর মাইল রাস্তা অতিক্রম শেষে একটি অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা হয়। সেখানে আরো কয়েকটি ঘরে বেশ কয়েকজন আটক ছিলেন। প্রায় একদিন ঐ ঘরে আটক রাখার পর তাকে আরেকটি গাড়িতে তোলা হয়। ঐ গাড়িতে করে বিভিন্ন স্থানে নেয়ার পর রাজধানীর কাফরুল থানায় এনে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

পরে তার পরিচিত লোকজন থানায় গিয়ে পুলিশের কাছ থেকে নিজেদের জিম্মায় নেন। গুম থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে আসা এই ব্যক্তির নাম সেলিম চৌধুরী (৫০)। তিনি ঢাকা জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা। ঢাকা মহানগর শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি। ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালের ধামরাই রোড কমিটির সভাপতি।

গত ২২ জানুয়ারি সাদা পোশাক পরা অজ্ঞাত ব্যক্তিদের হাতে অপহূত এবং শেষমেষ মুক্তি পাওয়ায় এই ব্যক্তি গতকাল এ প্রতিবেদকের কাছে তার গুম হওয়া ও ফিরে আসার বিস্তারিত বিবরণ দেন। অপহরণের পর তিনটি দিন তার ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তা মনে হলে শিউরে ওঠেন তিনি। তার চোখমুখে ফুটে ওঠে আতঙ্কের ছাপ। একবার বললেন, ‘ভাই এই অপহরণের বর্ণনা ছাপা হলে আবার ওরা ধরে নিয়ে যাবে নাতো? ঠিক আছে, জানতে যখন চাচ্ছেন তাহলে বলি সেই মৃত্যুপুরী থেকে বেঁচে আসার কাহিনী। হয়তো আমিই ফিরে এলাম, যেখান থেকে কেউ ফিরে আসেনি।

সাদা পোশাকের লোকজন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আমাকে তুলে নেয়ার পর হয়তো আমি হারিয়ে যেতাম। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি ফিরে এসেছি। অন্য কোন কারণ আছে কিনা জানি না। সেলিম চৌধুরী পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন জুরাইন এলাকায়। অন্যদিনের মতো ২২ জানুয়ারি রবিবার বেলা সাড়ে ১০টায় বাসযোগে পৌঁছেন গুলিস্তানের মুরগিটোলায়।

এরপর পায়ে হেঁটেই ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে রওনা দেন। তখনই প্রথমে একব্যক্তি পেছন থেকে ডেকে বলেন, এই যে ভাই, আপনাকে স্যার ডাকে। সেলিম বলেন, কোন্ স্যার, আমাকে কেনো ডাকবে? একথা বলেই আবার সামনের দিকে হাঁটতে থাকেন। যাওয়ামাত্র ৬-৭ জন সাদা পোশাকধারী লোক চারদিক ঘেরাও করে তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। মাইক্রোবাসে তোলার পর একটু সামনে এগুতেই তার মাথায় চোখমুখ ঢাকা একটি কালো টুপি পরিয়ে দেয়া হয়।

আরেকটু এগিয়ে যেতেই দুই হাতে লাগানো হয় হ্যান্ডকাপ। এরপর পায়ে শিকল। মাইক্রোবাস চলছে মাইলের পর মাইল। তিনি বলেন, এরপর তাকে কয়েকজনের নাম জিজ্ঞাসা করা হয়। জবাবে তিনি জানান, ‘আমি ৩-৪ জনকে চিনি।

ইতিপূর্বে একসঙ্গে পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এখন ওরা অন্য নেতৃত্বের সঙ্গে। এখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। ’ ২-৩ জনের নাম জিজ্ঞাসা করায় বলেছি, ‘নাম শুনেছি। তবে তাদের সঙ্গে পরিচয় নেই।

আর কোন প্রশ্নও করেনি। জানতে চাইলাম, আমার কী অপরাধ, কীজন্য নিয়ে যাচ্ছেন। কোন জবাব মেলেনি। একজন বলে ওঠেন, চুপ থাকেন। কোন কথা বলবেন না।

তিন-চার ঘণ্টা ভালো রাস্তা দিয়ে চলার পর ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে উঁচু-নীচু ঢালু পথে চলছে মাইক্রোবাস। এর মধ্যে তার মুখের কাপড় ওপরে তুলে দিয়ে একজন বলেন, আপেলটা খেয়ে নেন। বেলা সাড়ে ১০টায় চলতে শুরু করে মাইক্রোবাসটি, সারাদিন চলতে চলতে মধ্যরাতের দিকে নির্জন একটি স্থানে গিয়ে থামলো। আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় নামানো হয়। আমাকে ছোট একটি কক্ষে আটক রেখে সবাই চলে যায়।

কোন সাড়াশব্দ নেই। প্রায় তিন ঘণ্টা পর আযান হলো। বুঝতে পারলাম ফজরের আযান। এরপর আবার আমাকে একটি গাড়িতে তোলা হয়। এবারের গাড়িটি খুব আরামদায়ক।

সম্ভবত পাজেরো জীপ হবে। শীতের সময় হলেও গাড়ির ভিতরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালু ছিল। গাড়ি সারাদিন চলছে আবার কখনো থেমে থাকছে। মাঝে-মধ্যেই এক ব্যক্তি তার মুখে ফল দিচ্ছে। তবে পানি খেতে দেয়া হয়নি।

রাতে আরেক স্থানে থামলো। তিনি বার বার কলেমা পড়ছেন। চোখমুখ টুপি দিয়ে ঢাকা ছিল বলে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। গাড়ির পাশের সিটে বসা একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্যার আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’ এরপর কিছু সময় সাড়া-শব্দ নেই। কানের কাছে একজন এসে বলল, ‘তৈরি হয়ে নেন’।

সেলিম চৌধুরী বললেন, ‘এরপর কি ঘটতে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু আল্লাহকে স্মরণ করছি। সুরা আর কলেমা পড়ছি। ’ দীর্ঘশ্বাস টেনে সেলিম জানান, আরেকটি স্থানে এনে রাখা হলো। অন্ধকার ঘর।

এখানে চোখমুখ ঢাকা টুপি খুলে চোখ বেঁধে দেয়া হলো। ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়ার পর তিনি ধারণা করলেন যে, সামনেও কয়েকটি এরকম ঘর আছে। পায়ে শিকল রয়েছে বলে শব্দ হতেই কানে ভেসে আসল, ‘নতুন ভাই নাকি। ভাই এখানে কোথা থেকে এলে?’ একজন বলে উঠলেন, ‘আমি ১৬ দিন ধরে আছি। তবে বুঝতে পারছি না ১৬ দিন গেলো কিনা।

’ আরেকজন বলেন, ‘তিন মাস হবে হয়তো। অন্ধকারে জমটুপির কারণে কতদিন যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। ’ এর মধ্যে একজন টর্চলাইট জ্বালিয়ে অন্ধকার কক্ষের বাইরে থেকে একটি খাবারের প্লেট ঠেলে দেয়। তখন তিনি বুঝতে পারেন যে কক্ষে প্রবেশের দরজায় গ্রিল লাগানো। এই অংশ দিয়েই খাবার ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

খাবার ঠেলে দিয়ে বলা হল, ‘খেয়ে নেন’। অন্ধকারে প্লেটে হাত রেখে সেলিম বুঝলেন ভাতের সঙ্গে ভাজি ও এক টুকরা মাছ দেয়া হয়েছে। তিনি শুধু ভাজি দিয়ে অল্প ভাত খেয়ে নিলেন। এভাবে প্রায় ৮/৯ ঘণ্টা পার হওয়ার পর আবার তোলা হলো গাড়িতে। এই গাড়ির পেছনে বেঞ্চের মতো সিট ছিল।

গাড়ি চলার কিছু সময় পর যানবাহন চলাচলের শব্দ ও গাড়ির হর্ন কানে আসছিল। তার মনে হল, ঢাকার কোন রাস্তায় গাড়ি চলছে। প্রায় ২০ মিনিট পর একটি বাজারে এসে গাড়ি থামলো। সেখানে লোকজনের কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। গাড়ি থেকে এক ব্যক্তি তাকে বললেন, ‘এ যাত্রায় মনে হয় বেঁচে গেলেন!’ এ কথা বলার খানিক পর প্রথমে খোলা হলো তার হ্যান্ডকাপ।

কিছুক্ষণ পর পায়ের শিকল খুলে দেয়া হল। গাড়ি থেকে ধরে তাকে নামানো হল। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানো হল দোতলায়। একটি ঘরে নিয়ে তার চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হল। তিনদিন পর চোখে আলো দেখতে পেলেন।

প্রথমে সবকিছু ঘোলা দেখাচ্ছিল। চোখ কচলে তিনি সামনের টেবিলে একজন পুলিশ অফিসারকে দেখতে পান। যারা তার চোখ খুলে দিয়েছেন তারা ছিলেন সাদা পোশাকে। সাদা পোশাকের এক ব্যক্তি পুলিশ অফিসারকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি আসামি নিয়ে নেন। ’ একটা কাগজে পুলিশ অফিসার কি যেন লিখে নিলেন।

সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা চলে যাওয়ার পর ঐ পুলিশ অফিসার একটু আশ্চর্য হয়ে গেলেন বলে সেলিমের মনে হল। বললেন,‘ভাই আপনাকে নিয়েই তো পরিবহন ধর্মঘট চলছে। আপনি বসেন। ওরা আপনাকে টর্চার করেনি তো?’ এসব প্রশ্নের উত্তরে সেলিম চৌধুরী জানান, ‘তারা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তারা কারা আমি বুঝতে পারছি না।

’ পুলিশও কোন উত্তর না দিয়ে তিনি মোবাইল ফোনে পরিবহন নেতাদের বিষয়টি জানালেন। রাত ১২টার দিকে পরিবহন নেতারা থানায় এসে তাকে নিয়ে যান। এক্ষেত্রে তার ব্যাপারে কোন মামলাও হয়নি। সেদিন ছিলো মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি রাত প্রায় ১২টা। সেলিম আবারো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, কারা আমাকে ধরে নিয়ে গেলো? কী কারণে নিলো তাও বুঝতে পারছি না।

আমার বিরুদ্ধে কোন মামলা বা জিডি পর্যন্ত নেই। তবে তিনি ঐ সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের কৃতজ্ঞতা জানান। একপর্যায়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা তাকে মুক্ত করার জন্য গুলিস্তান ও ফুলবাড়িয়াসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু করে। আল্লাহর রহমতে তারাই তার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করেছেন।

সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক (০৫/০৬/১২ইং)  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।