কাজ-কাজ আর কাজ। ক্ষমতার আগ্রাসন হতে মুক্তি। ঝাপসা চোখে এখনও হাতড়ে বেড়ান অমরসূর। সেই স্মৃতি হয়তো সময়ের ফেরে ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু চাইলেই কী মুছে ফেলা যায়।
আর তাই এখনও আবেগাল্পুত হয়ে পড়েন তিনি। মাঝে মাঝে স্মৃতির ভেলা ভাসিয়ে নিয়ে যায় অমরসূরকে। গর্বে বুক ভরে ওঠতে চায় তার। নিজেকে স্বাধীন দেশের একজন ভাবতে পেরে গর্বিত হন তিনি। কিন্তু স্বজনহারা কষ্ট বুকের মাঝপথে আচানক আটকে যায় যেন কোন কোন মূহুর্তে।
দেখতে দেখতে সময় ও গড়িয়ে গেছে অনেকখানি।
এই তো সেদিনের কথা! মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত রাজপথ। এরপরও মোটের ওপর চলে যাচ্ছিল সময়গুলো। কিন্তু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পরপরই সম্পূর্ণ পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ঘরে ঘরে ওড়তে থাকে স্বাধীন বাংলার পতাকা।
অচল হয়ে পড়ে যেন পাকিস্তানী শাসন। দেশও চলতে থাকে বাঙালিদের ইচ্ছোনুযায়ী। ২৫ মার্চ রাত ১২ টা। অর্তকিতে হামলা চালানো হয় ঢাকায়। আক্রমণের ল্যবস্তু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস,কলেজ, সংখ্যালঘু প্রধান এলাকা ও বস্তি।
যার মধ্যে বাদ যায় নি শাখারিবাজারও। বাসা-বাড়িতে ধরিয়ে দিয়েছিল আগুন। যাকেই হাতের নাগালে পেয়েছিল তাকেই হত্যা করেছিল ওরা। এর মধ্যে হয়তো কেউ কেউ ভাগ্য ফেরে জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিল। এমনকি পাক হানাদারদের হিংস্র ছোবল থেকে রেহাই পায়নি কোলের শিশুটিও।
কতই বা বয়স আমার। আমি তখন এসএসসি পরিার্থী। পাঁচ ভাই আর তিন বোনের সুখের সংসার ছিল আমাদের। শুধু বড় ভাই-ই থাকত কলকাতায় পিসির কাছে। ভাইবোন সবাই ছিল আমার ছোট।
বাবা চাঁনবধন সূর ছিলেন শাঁখা কারিগর। এর সাথে শাঁখার ব্যবসাও দেখতেন তিনি। তাই বাবার পে সবকিছু একা সামাল দেয়া ছিল বেশ কঠিন। সেজন্যই কাজের সুবিধার্থে আরো কয়েকজন কারিগর রেখেছিলেন তিনি। এরপরও সময় পেলেই যন্ত্রপাতি সঙ্গে নিয়ে লেগে পড়তেন শাঁখার কাজে।
আর কী ঐকান্তিক মন নিয়েই না বাহারি নকশা এঁকে যেতেন একেকটি শাঁখায়। এর সাথে বিকিকিনির কাজটাও করে যেতেন হাসিমুখ নিয়েই। আর এই ব্যবসায়িকসূত্র ধরেই প্রশাসন থেকে শুরু করে অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে পরিচয় গড়ে ওঠে বাবার। পরিচয়ের এই বদৌলতে অনেকেই আসা-যাওয়া করতেন আমাদের এখানে। তাই বাবার ধারণার মধ্যেই ছিল না পাকসেনাদের রোষানলের শিকার হতে হবে আমাদেরকে।
এদিকে ৪ এপ্রিল ঘোষণা করা হয়েছে এসএসসি পরীা। কিন্তু দেশের পরিস্থিতির জন্য পরীা পিছানো হয়েছে ২০ এপ্রিল। আর বেশীদিন নেই পরীার। প্রস্তুতি নিতেই ব্যস্ত সারাদিন। পড়ার টেবিল থেকে ওঠার সময়টুকুও হয়ে ওঠে না আমার।
ইতোমধ্যে ঈশাণকোণ ছেয়ে গেছে রাজ্যের যত মেঘ। অগ্নিমূর্তি নিয়ে ধেয়ে আসল যেন কালবৈশাখি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হিংস্র নখরের আঁচড় দিয়ে বসল এই চরাচরে। আর মূহুর্তেই লন্ডভন্ড হয়ে গেল সবকিছু। ২৬ মার্চ বিকাল সাড়ে তিনটা।
সারাদেশে জারি করা হল কারফিউ। থমথমে ও নিস্তব্ধ হয়ে আছে চারপাশ। হঠাৎ জানা গেল বিশাল লটবহর নিয়ে শাখারিবাজারের পশ্চিমপাশে জড়ো হয়েছে পাকবাহিনী। সাথে জুটেছে এদেশীয় কয়েকজন মুসলিমলীগের পান্ডাও। মুসলিমলীগ নেতা খাজা খায়রুদ্দিন পাকসেনাদের হাতেই তুলে দেয় এখানকার বাসাবাড়ির ঠিকানা ও সবার নামের তালিকা।
এদিকে পাকিস্তানী মিলিটারিরা ঢুকেই শুরু করেছে গুলিবষর্ণ। আমাদের কারোই জানার মধ্যে ছিল না কী ঘটতে চলেছে সবার ভাগ্যে। কান পেতে বাইরের পরিবেশটা বোঝার চেষ্টা করছি আমরা সবাই। জানা গেল, ৫২ নং হোল্ডিংয়ের লোহার গেইট ভেঙ্গে ঢুকে পড়েছে ওরা। ঢুকতে গিয়ে হাতের কাছে পেয়ে যায় আমার বন্ধু সুভাষকে।
অমনি পাকড়াও করে ছাদের ওপরে উঠিয়ে নিয়ে আসে ওকে। শুনলাম ছাদ থেকে সুভাষ আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। চিৎকার করে ও বলছে “ ভয় পাবার কিছু নেই অমর। তোমাদের কারোই কিছু হবে না। নির্ভয়ে তোমরা সবাই বেরিয়ে আসো”।
বাবা কেন জানি কিছুতেই বের হতে দিলেন না আমাদের। আমাদের সবাইকে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসলেন তিনি। পাচিল টপকিয়ে পার করিয়ে দিলেন পাশের বাড়ির ওপারে। বাবার কোলে ছিল আমার মাসতুতো ভাই বুদ্ধদেব। কাজেই বাচ্চা কোলে নিয়ে পাচিল টপকাতে পারলেন না বাবা।
মৃত্যুদূত যেন ওৎপেতেই ছিল সুযোগের সন্ধানে। মিলিটারিরা ৫২ নং বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে নামলেন আমাদের ৫১ নং বাড়ির ছাদে। ছাদ দিয়ে নীচে নেমে আসলেন ওরা। বাবা ভেবেছিলেন আর যাই হোক না কেন অন্তত কোলে থাকা বুদ্ধকে কিছু করবে না ওরা। কিন্তু ওদের হিংস্রতায় হার মেনেছিল দুধের শিশুও।
ধরে নিয়ে গেল বাবাকে। সাথে রেহাই দিল না কোলে থাকা ছোট ভাই বুদ্ধকে। শুধু বাবাই নয় আরো অনেককেই এভাবে আশে-পাশের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে ৫২ নং বাড়িতে জড়ো করল ওরা। মূহুর্তেই হায়েনার ভয়াল থাবা ছিন্নভিন্ন করে দিল সাবইকে। লাশ হল বাবাসহ অনেকে।
বেঁচে থাকার ভাগ্যটা ছিল বলেই হয়তো বেঁচে গেলাম আমরা ক’জন। খোলা কাঁচা পায়খানাঘরের ছোট্ট খুপরিই বাঁচিয়ে দিল আমাদের। আর পায়খানার দূর্গন্ধের জন্যই বোধ হয় ঢোকার চিন্তা বাতিল করেছিল ওরা। দূর্গন্ধে ভুড় ভুড় করছে আশপাশ। কিন্তু সেই অনুভূতিও ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল আমাদের।
পার হতে চাচ্ছিল না এক একটি সময়। পিঠে-পিঠ ঠেকিয়ে কোনোভাবে মাথাগুঁজে দাঁড়িয়ে আছি আমরা ক’জন। একে-অপরের নিঃশ্বাসের শব্দেও আতংক ফুটে উঠছিল আমাদের সবার চোখেমুখে। আকাশের দিকে চোখ মেলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম বেলা গড়িয়ে কতটা হল।
২৭ মার্চ সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
নিস্তব্ধ ও নিসাড় পুরো এলাকা। আস্তে আস্তে দু’একটি পরিচিত অনুসন্ধানী চোখকে উঁকি দিয়ে বাইরের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করতে দেখলাম। বুকে সাহস ফিরে পেলাম যেন। কিন্তু কথা বলার ভাষাটুকু হারিয়ে ফেললাম তৎণাৎ। মাঝে মাঝে ফিসফিসানির মতো কিছু শব্দ ঢেউয়ের মতো এসে বারি খাচ্ছিল কানে।
মনে হল আপাতত ভয়ের কিছুই নেই। কেননা গলি-ঘুপচির জন্য এখানকার পথ খুঁজে বের করা ওদের জন্য ছিল বেশ কঠিন। সেজন্যই বোধ হয় ওদের যত আক্রমণ শুরু হত আলো থাকা অবস্থায়। সবখানেই ওরা তান্ডবের চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছে। প্রায়ই ঘরের দরজা-জানালা ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে আছে।
আধপোড়া ঘরগুলো থেকে খসে পড়েছে ইট ও টিনের চালা। আগুন পোড়া গন্ধ বাতাস থেকে মিলে যায় নি এখনও। এর মধ্যে আমাদের মতো আরো ক’জনও খুঁজতে বেরিয়েছে স্বজনদের।
কাউকে ওরা বাঁচিয়ে রাখে নি। কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে হত্যা করেছে আমার বন্ধু সুভাষকে।
আর বীভৎসতার সাী রাখতে মায়ের সামনে সন্তানকে বলি দিতেও কুণ্ঠা করে নি ওরা। সন্তানহারা মায়ের আর্তচিৎকারে খান খান হয়েছে শাঁখারিবাজারের অলি-গলি। কিন্তু একমূর্হুতের জন্যও এই কণ্ঠধ্বনি সেই নরপিচাশদের কর্ণকুহুরে গিয়ে পৌঁছাতে সম হয় নি। ৫২ নং বাড়ির এক রুমে ঠাসাঠাসি করে মেরে রেখে গেছে একইসাথে ১২ জনকে। উল্টিয়ে যাচ্ছি একেকটি লাশ।
কিন্তু কোথায় আমার বাবা! খুঁজেই চলেছি এ ঘর থেকে ও ঘরে। হঠাৎ চোখ আটকে গেল উঠোনের কোণে। দেখলাম বেয়নেট খুঁচিয়ে হত্যা করা বাবা ও ছোট ভাইয়ের লাশ। লাশ দু’টি রুমের ভিতরে ঢুকালে যদি কোনোভাবে ওদের মনে সন্দেহ দানা বাধে, তাই এই অবস্থায় বাবাকে ফেলে রেখে চলে আসলাম আমি। প্রকৃতি যেন এই কয়েকদিনে পাল্টে দিল আমাদের।
বাবার মৃত্যুতে চোখ বেয়ে এক ফোঁটা পানি ও গড়িয়ে গেল না কারো। যেন কাঁদতেও ভুলে গেছি আমরা। এদিকে জোয়ান পুরুষদের বাড়িতে রাখাটা সমীচিন মনে করলেন না কেউই। পথে-ঘাটে, বাড়িতে যেখনেই আমাদের মতো জোয়ানদের দেখা পাচেছ সেখানেই নাকি হত্যা করছে ওরা। ধরেও নিয়ে গেছে অনেককে।
কিন্তু যাদের নিয়ে গেছে তাদের অনেকেই আর ফিরে আসতে পারে নি। তাই এখানে আমাদের থাকাটা নিরাপদ মনে করলেন না মা। কেরাণীগঞ্জের বাগনা পিসতুতো ভাই হিরন্ময়ের বেশ পরিচিত। ওখানেই ছোট ভাই দিলীপ, বিভাসসহ আমাদের তিনজনকে পাঠিয়ে দেয়ার সিন্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করে ফেললেন সবাই। কিন্তু এই বিপদের মুখে মা-বোনকে ফেলে রেখে কিভাবে যাই আমরা! ওরা তো আর মানুষের পর্যায়ে নেই।
নরমাংসের স্বাদ পেয়ে বসেছে ওদের। হিংস্র নেকড়ের মতো নির্বিচারে ঝাপিয়ে পড়ছে ওরা সাধারণ নিরস্ত্র মানুষের ওপর। কাজেই মরতে হলে সবাই একসাথেই মরব। আমার কথার সাথে পেরে ওঠতে না পেরে হাল ছেড়ে দিলেন মা।
এদিকে আলো বাড়ছে একটু একটু করে।
বিকট শব্দ করে থামল এক জীপ গাড়ি। বেশ কয়েকজোড়া বুট ধুপধাপ শব্দে দৌড়ে গেল শাঁখরিবাজারের পূর্বদিকে। চিৎকার আর হৈ-হুল্লোড়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠল চারপাশ। ওরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ১৬ নং বাড়িতে। সাপের হিংস্র ফণার মতো আগুনের লেলিহান শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠল পুরো বাড়ি।
সজোরে লাথি দিয়ে ভাঙ্গল ৩৫ নং বাড়ির দোর। ঢুকেই বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে হত্যা করল নিশিহরিনাগসহ আরো ছয় জনকে। আর এভাবেই একটানা ২৮ মার্চ পর্যন্ত চলল নরপিচাশদের এই হোলি খেলা। ২৯ মার্চ পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত। এলাকা ছেড়ে দেওয়া শুরু করল সবাই।
দেখতে দেখতে শূণ্য হয়ে গেল পুরো শাঁখারিবাজার। বারবার মনে হচ্ছিল বাবকে এভাবে ফেলে রেখে চলে যাবো আমরা। কিন্তু সৎকার করার মতো অবস্থাতো নেই এখানে। বাবার লাশ যেখানে পড়ে আছে ফিরে গেলাম সেখানে। কিসে যেন খুবলে খেয়েছে বাবার শরীরের কিছু অংশ।
আর বেশীণ তাকিয়ে থাকার মতো ছিল না পরিবেশটা। উঠোন থেকে লাশ দুটোকে সরিয়ে রুমের ভিতর থাকা বাকি লাশের উপরে চড়িয়ে দিয়ে বের হয়ে আসলাম আমরা। আর এভাবেই হয়ে গেল আমার বাবা ও ছোট ভাইসহ অন্যান্যদের সৎকার।
প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। সাথে আছে মা, আমার ছোট দুই বোন সাগরিকা ও সুনীতা, ছোট ভাই অমিত, দিলীপ, বিভাস আর অন্তসত্ত্বা মাসি।
জানি না ভাগ্যে কি আছে আমাদের! যদিও নিরাপদ আশ্রয় বলতে হিরন্ময়ের সেই গ্রামটি মাথায় গেঁথে আছে। কিন্তু বাগনায় আমরা আদৌ পৌঁছতে পারবো তো! ভাগ্যের ওপরই ছেড়ে দিলাম সবকিছু। শুধু এটুকু জানলাম নদীর ওপারে গেলে বাঁচানো যাবে নিজেদের। এলাকা থেকে বের হয়েই মনে হল শুধু আমরা নই ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে চলেছে মানুষ। ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে ঢাকা।
অনেকেই হয়তো জানে না কোথায় তাদের গন্তব্য। যেখানে- সেখানে পড়ে আছে লাশ। কোন কোন লাশ এরই মধ্যে ফুলে ফেঁপেও ওঠেছে। দৃষ্টিশূণ্য হয়ে গেল আমার। আর কিছুটা পথ পেরোলেই বুড়িগঙ্গা।
শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিল সুনীতা। হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ওর। এরপরও ওর প্রতিবন্ধী শরীর বেঁচে থাকার তাগিদ নিয়ে ছুটে চলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সার সার নৌকা দাঁড়িয়ে আছে ঘাটজুড়ে। নৌকায় করে চলেছি আমরা।
সবার ল্য যদি একটু আশ্র্রয় মেলে কোথাও। এ যেন এক অনিশ্চিত পথ চলা। সামনের সময়গুলোতে আমাদের জন্য কী অপো করছে আমরা কেউ জানি না। বিপদগামী এই পথ পেরিয়ে যদি কোনোভাবে সীমান্তের ওপারে পা দেয়া যায় তাহলে হয়তো মুক্তির স্বাদ মিলবে আমাদের। সবাই আমরা একই পথের যাত্রী।
এর মাঝে কারো কারো যাওয়ার মত নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য ছিল না। আমরা বাগনা যাচ্ছি শুনে আমাদের সঙ্গী হয়ে গেল ওরাও।
লোকে লোকারন্য পুরো বাগনা। কিন্তু যমদূত কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না আমাদের। নদী পাড় হয়ে পাকবাহিনী ঢুকে পড়েছে গ্রামে।
যে যেভাবে পাড়ছে আশ্রয়স্থল ছেড়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। হঠাৎ কান বির্দীণ করা চিৎকার কিছুণের জন্য থমকে দিল আমাকে। এক পলকের জন্য দেখতে পেলাম আমার অন্তসত্ত্বা মাসির বুক চিরে গুলি পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেল। ছটফট করতে করতে সেখানেই চিরনিদ্রা দিলেন মাসি ভাগ্যরাণী সূর। গুলির ল্য ভেদ করে গেল আমার ছোট বোন সাগরিকার বেলায়ও।
ওর ঘাড় দিয়ে গুলি ঢুকে বুকের মাঝপথে চোরাকাঁটার মতো বিঁধে গেল শরীরের সাথে। ওখানেই ছিটকে গেল সাগরিকা। শুধু দেখলাম অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছে ওর শরীর বেয়ে। আর বেশীণ তাকিয়ে থাকার মতো অবস্থা ছিল না আমার। ঐ অবস্থায় সাগরিকাকে রেখে দৌড়ে চলেছি আমরা।
বার বার ভাবনায় এসে বারি খাচ্ছিল, বেঁচে আছে তো সাগরিকা! নাকি মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতে মারা গেছে ও।
দিগভ্রান্তের মতো ছুটছি আমরা। এভাবে ঠিক কত মাইল পথ পার হয়ে চলে আসলাম আন্দাজ করতে পারছিলাম না। রাস্তার সাইনবোর্ড দেখে জায়গাটির নাম বোঝার চেষ্টা করলাম। ধলেশ্বরী পাড় হয়ে নবাবগঞ্জ থানায় আমরা।
সেখানকারই আগলা-র টিগরপুর গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় মিলল আমাদের। আমার হাত ধরে আছে সুনীতা ও বিভাস আর মার কোলে আমার ছোট ভাই অমিত। শুধু নেই আমার আদরের ছোট বোন সাগরিকা। এরই মাঝে খবর আসল বেঁচে আছে সাগরিকা। জানলাম কেরানীগঞ্জের বাগুই গ্রামের এক ডাক্তারের বাড়ীতে আছে ও।
ভদ্রলোকের নাম নূর মোহাম্মদ। সবাই যখন ছুটে পালাচ্ছিল তখন রাস্তার পাশে এক মেয়েকে কোঁকাতে দেখে ছুটে যান তিনি। কোনোভাবে নিয়ে আসেন তার বাড়িতে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ায় মৃত্যুর দোড়গড়া থেকে ফিরে আসে ও।
তবে প্রারম্ভিক ধকলটা সামলানো গেলেও ঝুঁকিটা থেকেই যায় শরীরে।
কেননা বুকের মধ্যে বিঁধে যাওয়া গুলিটা বের করা হয় নি ওর শরীর থেকে। আর এজন্য প্রয়োজন অপারেশন। না হলে কিছুতেই বাঁচানো যাবে না ওকে। এই পরিস্থিতিতে শ্বপাদসংকুল পথ বেয়ে নূর মোহাম্মদ নদীর ওপার থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে সাগরিকাকে। ভর্তি করিয়ে দেন মিটফোর্ডে।
কিন্তু অপারেশনের জন্য যে লাগবে টাকা! দূর্যোগের এই দিনে এত টাকা কোথায় মিলবে! ব্যাংকে আমার কিছু জমানো টাকা ছিল। বিপদের সময়ে এই সম্বলটুকুই আশার আলো দেখালে আমাদের। কিন্তু এই দিয়ে আর যাই হোক অপারেশন তো আর হবে না। এই সময়ই পরামত্মীয়ের মতো পাশে দাঁড়ালেন নূর মোহাম্মদ। “আমি থাকতে এত ভরকে যাচ্ছেন কেন! এতদূর যেহেতু আসতে পেরেছি।
দেখবেন সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সাগরিকাকে নিয়ে একেবারেই চিন্তা করবেন না। ও আমার ছোট বোনের মতো। সুস্থ হয়ে উঠলে আমি নিজেই ওকে পৌঁছে দিয়ে আসব। ” কিন্তু আমাদের যে কোন নিদির্ষ্ট গন্তব্য নেই।
তাছাড়া ঘর-বাড়ি রেখে চলে গেছে অনেকেই। কে কোথায় গেছে তাও জানি না। মাথাও কাজ করছিল না ঠিক মতো। আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিল বোধ হয় নূর মোহাম্মদ। “ থাকার ব্যবস্থা নিয়ে ভাববেন না।
ব্যবস্থা যদি নাও হয় আমার বাড়িতেই থাকবে ও। ”দেবতুল্য এই লোকটি যদি আমাদের পাশে এসে না দাঁড়াতেন তাহলে হয়তো বাঁচানোই যেত না সাগরিকাকে। হঠাৎই পিসসুতো ভাই জ্যোর্তিময়ের কথা মনে পড়ল। ওদের শ্রীনগরের ষোলঘর গ্রামের বাড়ি ঠিকানাটা দিলাম ওকে। “আপনাকে কী বলব আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
আপনার মাথার ওপর বোঝাটা আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিলাম আমি। জানি না দেখা হবে কিনা। তবে আপনার এই রূণ কখনই শোধ হবার নয়। ” আর বেশীণ থাকতে পারছিলাম না আমি। চলে আসলাম হাসপাতাল থেকে।
টিগরপুর ও নিরাপদ ছিল না আমাদের জন্য। জানা গেল যখন তখন চলে আসতে পারে পাকবাহিনী। শুনলাম গোয়ালন্দকে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। কাজেই গোয়ালন্দে যাওয়াই মঙ্গলজনক বলে মনে করল সবাই। নবাবগঞ্জের শেষ সীমানা জয়পাড়া গ্রাম।
বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ ছূটে চলেছে এখান থেকে ওখানে। আর এজন্য নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় বুক বেঁধে নদী ঘাটে এসেছে আমাদের মতো অনেক পরিবার। নৌকা ধেয়ে চলেছে গোয়ালন্দ ঘাটে। কিন্তু গোয়ালন্দের মাটিতে পা রাখা হল না আমাদের। কেন জানি মুক্তিযোদ্ধারা নদীর পাড় থেকে ঘাটে ওঠতে দিলেন না কাউকে।
এদিকে পাড়ে থাকা মানুষগুলো ঘাটে ওঠার জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে গেল। আর এ নিয়ে দু’পরে মধ্যে চলল তুমুল বাকবিতণ্ডা। একপর্যায়ে ওরা আমাদের আশ্বস্ত করল অস্থির হওয়ার কিছুই নেই। ওদের জীপ গাড়িটা কিছূ সময়ের জন্য গ্রামের বাইরে গেছে, আজকের মধ্যে ফিরে আসলেই নিজ দায়িত্বে ওরা রাজবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে আমাদের। ওখান থেকে ট্রেনে ঈশ্বরদী যেতে পারলেই ওপারেই ভারতের সীমান্ত।
কাজেই ওদের কথাই মেনে নিল সবাই। আর নদীর পাড়ে আমাদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে দু’জন আর্মড মুক্তিযোদ্ধা দিলেন ওরা।
২০ এপ্রিল সন্ধ্যায় মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। কিছুণ পরই শুরু হল বৃষ্টি। বিরামহীন এই বৃষ্টি পড়া থামতেই চাইছিল না যেন।
এক অজানা আশংকা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল আমাদের। এদিকে ঘাটের ধারে কাছেও নেই সেই আমর্ড মুক্তিযোদ্ধা দু’জন। ভোররাতে হঠাৎ শুরু হল মিলিটারিদের অতর্কিত আক্রমণ। সারারাতে বৃষ্টিতে পিছল রাস্তা ও ঘাটের পাড়। আছড়ে-পিছড়ে কোনভাবে রাস্তার ওপর ওঠে পড়লাম আমরা।
কিন্তু অনেকেই পাড় থেকে উঠে আসতে পারল না রাস্তায়। রেললাইনের পাশে বেশ নিচুতে মৃত্যু-ক’পের মতো হা হয়ে আছে পদ্মা নদী। পা হড়কে গেলেই নিশ্চিত মৃত্যু। চরম এই সত্যটা জেনেও দৌড়ে চলেছি আমরা। দেখলাম আমাদের কিছু দূরে বাচ্চা কোলে থাকা অবস্থায় এক মহিলা নিজেকে সামাল দিতে না পেরে মূহুর্তের মধ্যে পড়ে গেল নদীতে।
অমনি এক ঝাঁক গুলি এসে ঝাঁঝড়া করে দিল ওদের। রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল নদীর পানি। আর এভাবে কতজন মানুষের যে মৃত্যু হয়েছে, তার কি ঠিক আছে! রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল সুনীতার। সুনিতাকে কাঁধে নিয়ে দিগভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছি আমি। একবারের জন্যও পিছনে ফিরে তাকাবার সাহস হচ্ছিল না কারো।
হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে আমার। শুধু আমি নই আমার সাথে আছে সুনীতা। প্রাণপণে দৌড়ে চলেছি আমি। সমস্ত শক্তি জড়ো হল যেন আমার দুটি পায়ে। হঠাৎ অনুভব করলাম ঘাড় বেয়ে কিসে যেন ভিজে যাচ্ছে আমার পুরো শরীর।
পরণই বুঝতে পারলাম, এটা পানি নয় অন্য কিছু। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি বেঁচে নেই সুনীতা। গুলিতে উড়ে গেছে ওর মাথার একপাশ। ওর এই ঝড়ে পড়া রক্ত নিমিষেই একাত্মা হয়ে মিশে গেল যেন আমার শরীরের সাথে। আট বছরের সুনীতার নিথর শরীর নিয়ে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি।
সবকিছু হারিয়ে এক উদভ্রান্ত কিশোর আমি। স্বজন বলতে এখন আমার আর কেউ নেই। দৌড়ে পালাতে গিয়ে কে কোথায় ছিটকে গেছে মনে করতে পারছি না আর।
দেখলাম একা নই আমি। আমার সাথে আছে আরো অনেকে।
অপরিচিত মুখগুলোকে দূরের মনে হচ্ছিল না আর। শ্বাপদসংকুল মূহুর্তগুলো আত্মীয়তার বন্ধনে বেঁধে ফেলল যেন আমাদের সবাইকে। সুনীতা এখন আমার একার বোন নয়। নিজের বোনের মতোই সুনীতাকে বুকে তুলে নিল সবাই। সবার সহযোগীতায় রামদিয়া ট্রেন লাইনের পাশের গ্রাম বালিয়ডাঙ্গিতে চিরকালের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আসলাম আমার সুনীতাকে।
এই বিশ্বচড়াচড়ে খুবই অসহায় আর একা মনে হচ্ছিল নিজেকে। আমাকে ছেড়ে চলে গেল সুনীতা। হারিয়ে ফেলেছি মাকে। আদৌ সে বেঁচে আছে কিনা জানি না। মিডর্ফোডের বেডে শুয়ে থাকা সাগরিকাই বা আছে কেমন।
কিছুই ভাবতে পারছিলাম না আমি।
১০-১২ দিন পর দেখি আলুথালু অবস্থায় এক মহিলা হেঁটে চলেছে গ্রামের পথ দিয়ে। হঠাৎ বুকের ভিতরটা মোচর দিয়ে ওঠল। খুবই পরিচিত লাগল সেই মুখের আদল। যেন আগেও দেখেছি কোথাও।
সামলাতে পারলাম না নিজেকে। দৌড়ে গেলাম উদভ্রান্ত সেই মহিলার কাছে। হোঁচট খেলাম কিছুণের জন্য। এ যে আমার জন্মদাত্রী মা! এই কয়েকদিনে কী বেহাল দশাই না হয়েছে মার। আমাকে দেখতে পেয়ে মায়ের সে কী আহাজারী কান্না।
হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে। গুমোট পরিবেশে ভারী হয়ে ওঠল সেই মুহূর্তটি। “ অমর, আমি অমিতকে হারিয়ে ফেলেছি। পুরো গ্রাম খুঁজে বেড়িয়েছি, কিন্তু কোথাও অমিতকে খুঁজে পেলাম না। পথে যাকে পেয়েছি তাকেই শুধিয়েছি।
কিন্তু আমার অমিতের খোঁজ তো কেউ দিতে পারল না। ” সন্তান হারানোর চাপা কষ্ট পাথরের মতো আটকে গিয়েছিল মার বুকে। আর তাই আরেক সন্তাকে খুঁজে পাওয়ার মধ্য দিয়ে চোখের জল হয়ে নিঃসরিত হচ্ছিল যেন সেই রক্তরণ। ভেবে পাচ্ছিলাম না এই য়িষ্ণু মন কী পারবে আরো কিছু কষ্টের ভার বহন করতে? বাধ্য হয়েই চেপে গেলাম সুনীতার মৃত্যসংবাদটি। অমিতকে ফেলে রেখে গোয়ালন্দের মাটি ছাড়তে চাইলেন না মা।
এরই মধ্যে মিটফোর্ড থেকে ছেড়ে দিয়েছে সাগরিকাকে। গ্রামে আসা একজন খবর দিল, শ্রীনগরের ষোলঘরে জ্যোর্তিময়ের বাড়িতে আছে ও। কাজেই সাগরিকার এই সংবাদ মার সম্বিত ফিরিয়ে নিয়ে আসল। অন্য সন্তানদের মাঝে বেঁচে থাকার আকুতি শান্ত করে ফেলল মাকে। কিন্তু সময় এরই মধ্যে তাকে বদলে দিয়েছে অনেকটুকু।
মৃত্যু ঘটেছে আগের সেই আবেগানুভূতিরও। একবারের জন্যও জানতে চাইলেন না সুনীতার কথা। এ যেন নিজের মত করে বুঝে নেয়া কোন ব্যাপার।
গোয়ালন্দ থেকে ফের হাঁটা ধরলাম আবার সেই আগলা-র টিগরপুরে। আগের মতো নেই টিগপুর।
শুনশান ফাঁকা হয়ে আছে পুরো গ্রাম। অনেক বাড়িঘর জনমানবশূণ্য হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ভাবতেই অবাক লাগছিল এই কয়েকদিন আগেও রাস্তা ধরে ছুটে গিয়েছিল অগুণিত মানুষ। নিজের কাছেই বেশ অপরিচিত মনে হচ্ছিল এই জনপদটি। কোথায় গিয়ে উঠব আমরা? মনে হচ্ছিল, আরো কিছু বাড়িতে মানুষের অস্তিত্ব আছে এখনো।
অবশেষে কপালজোড়ে আশ্রয় হল আমাদের। বাড়ির কর্তা ধর্মে হিন্দু ছিলেন। আমাদের দেখেই বলে বসলেন, “ এখনো নিরাপদ নয় এই এলাকাটি। মনে হয়, বেশিদিন থাকতে পারবেন না আপনারা। যেকোন সময়ই আক্রমণ হতে পারে এখানে।
কোনভাবে ধরে প্রাণ নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। মনে হচ্ছে দিন ঘনিয়ে আসছে আমাদেরও। কিন্তু ঘরে অসুস্থ মাকে রেখে কিভাবে যাই বলুন?” পরে শুনেছি আমরা চলে আসার ২-৩ দিন পরই আক্রমণের শিকার হয় সেই বাড়িটি। পুরো বাড়িজুড়ে ওরা এঁকে দিয়ে যায় হিংস্রতার চিহ্ন। আর বেশীদূর নয় মুন্সিগঞ্জ।
সেখানকারই শেখেরনগর স্কুলে গিয়ে উঠলাম আমরা। আমাদের মতো অনেকেই এসে ওঠেছে স্কুলে। ওখানাকারই একজনকে জ্যোর্তিময়ের কথা বলায় স্কুল থেকে ষোলঘরে নিয়ে গেল আমাদের।
আমাদের আসার খবরটা বোধ হয় সাগরিকার কানে পৌঁছে গিয়েছিল। দেখলাম দশ বছর বয়সী সাগরিকা বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো ছুটে আসছে আমাদের দিকে।
ঠিক আগের সেই আদল আর সেই ছোট্ট শরীর। এখনো সেই মূহুর্তগুলো দৃশ্যমান হয়ে আছে যেন আমার চোখে। কী দূরন্তই না ছিল সাগরিকা! এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ছুটোছুটি করে বেড়াতো সারাদিন। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি লেগে থাকতো সব সময়ই। কিন্তু এই ক’দিনের ব্যবধানে সময় যেন ওর বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক।
আমাকে আর মাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে নিচ্ছিল ও। যেন সেই স্পর্শ ও গন্ধকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। সুনীতা ও অমিতকে হারিয়েছি ঠিকই। কিন্তু সাগরিকাকে তো পেয়েছি আমাদের মাঝে। কাজেই একে-অপরকে আঁকড়ে ধরার ইচ্ছেটা যেন চেপে বসল নিজেদের মধ্যে।
যদিও এখানেই শেষ নয়। যুদ্ধের তো শুরু হল মাত্র। এরই মধ্যে অমিতকে যদি আমাদের মাঝে ফিরে পেতাম, তাহলে চাওয়া-পাওয়ার হয়তো পূর্ণতা পেত। জানি এ শুধুই আশায় গুড়ে বালি। কাজেই সব আশা-আকাক্সার জলাঞ্জলী দিয়ে বিক্রমপুর থেকে ট্রলারে উঠে পড়লাম আমরা।
সীমান্তে যাবো শুনে ট্রলারেরই একজন বলল, ‘এই ট্রলারে করেই আপনারা রামচন্দ্রপুর হয়ে কুমিল্লা পযর্ন্ত যেতে পারবেন। আর ওখান থেকে আগরতলা যাওয়ার রাস্তাটা ও বেশ সহজ। ’ ট্রলারেই সহযাত্রী হিসেবে পেয়ে গেলাম আমাদের মতো আরো অনেককে। অনেক গ্রাম হয়ে দীর্ঘ শ্বাপদসংকুল পথ পেরিয়ে আসলাম আমরা। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, অবশেষে সীমান্তে এসে পৌঁছেছি সবাই।
কাঁটাতাঁরের ওপ্রান্তে হাজার হাজার মানুষে গিজগিজ করছে শরণার্থী শিবির। জানি না একে মুক্ত বিহঙ্গ বলে কিনা। তবুও মোটের ওপর স্বস্তির নিঃশ্বাস তো পাওয়া গেল। প্রাণের তাগিদই তো এতদূর ছুটে চলে এসেছি আমরা। হয়তো গুলির আওয়াজে প্রকম্পিত হচ্ছে না এখানকার পথ-প্রান্তর।
প্রাণের দায়ে দিকবিদিক ছুটে বেড়াতেও হচ্ছে না আমাদের মতো অনেককে। কিন্তু অনিশ্চিত চলার পথ তো আর থমকে দাঁড়ায়নি। বরঞ্চ প্রতিটি অসহায় মুখায়বেই খেলা করে যাচ্ছে একই জিজ্ঞাসু ভাবনা। স্বপ্নের সেই স্বাধীন ভূমিটি আবার আমাদের হবে তো! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।