“First rule of business, protect your investment.” পারলে একবার কেওকারাডং ঘুরে আসবেন-১
যেখানে মাত্র দশমাসে একজন মানবশিশু পয়দা হতে পারে, সেইজায়গায় এই লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব নাজিল হতে সময় লেগেছে দুবছর। মানেটা সহজ, আমি সিরিয়াস কোন লেখক নই, অন্যের লেখা পড়তে আমার আলসেমি নেই, কিন্তু নিজে লিখতে গেলেই যত বিপত্তি।
আবার এই শিরোনামে এখন কিছু লেখা খুবই লজ্জার এবং বিপদজনক। কারন দুইটা।
এক, যদি লিখতে পারতাম 'পরশু সময় থাকলে একটু এভারেস্ট ঘুরে আসবেন' তাহলেও যুগোপযোগী হত।
লোকজন যেখানে অ্যামাজন জঙ্গলে ভ্য়-ডরহীন ঘুরাঘুরি করছে সেই জায়গায় আমি যদি বলি ' চলেন আসেন বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাই, বুঝবেন জঙ্গল কি জিনিষ' লোকজন নির্ঘাৎ বলবে 'বেটা ব্লগও পাইছ আর তুমিও প্রসব করতাছ'।
দুই নম্বর বিপদটা হল যে জায়গায় যাবার আব্দার আমি করছি সে স্থানের বর্ণনা কয়েককোটি গুণ ভাল করে অনেকেই দিয়েছেন। তাদের দেওয়া ছবিগুলোও অসাধারণ, দামি এস. এল. আর. ক্যামেরা তারা কাধেঁ ঝুলিয়ে রাখেন আর তাদের হাতে ধরা থাকে আধুনিক জি.পি.এস. সিস্টেম। তারা সিরিয়াস টাইপ এডভেঞ্চারার, আসলে তারা বুঝেনও ভাল। সে তুলনায় আমি হলাম কোন জাতের না।
এইসব এডভেঞ্চার করার কোন যন্ত্রপাতি আমার নাই। আমি মোবাইলে ছবি তুলি আর পারলে শার্ট-প্যান্ট ইন করে ট্র্যাকিং করি।
এতকিছুর পরও কেন লিখলাম? কারন সহজ ও সরল- আমারও মাঝেমাঝে গল্প বলতে ইচ্ছে করে, একটু লিখিনা কেন?
যাই হোক, আমাদের গাইড আলমগীরকে নিয়ে রওনা হলাম রুমাবাজার থেকে বগালেকের উদ্দ্যেশ্যে। আলমগীর লুঙ্গি পরা। সে লুঙ্গির গিঁট খুলে আবার দিল।
বুজলাম সে যে প্রস্তুত এটা তার সংকেত। আমরা আমাদের ব্যাগ-প্যাক কমিয়ে ফেললাম। সাথে নিলাম শুধু একটা ব্যাগ, দুইটা পানির বোতল, ২-৩ প্যাকেট এনার্জি বিস্কুট এবং আমরা সাতজন। ব্যাগটা বন্ধু গিয়াসের কাধেঁ তুলে দিয়া আমরা বাকিরা নিশ্চিত হলাম। কিন্তু সে নিশ্চিত হতে পারলনা, আশ্যস্ত করে বললাম 'পর্যায়ক্রমে আমরাও নিমু'।
যে পথে হাটছি, আরো অনেকে আসা যাওয়া করছে, তাদের প্রাত্যহিক রুমাবাজার যাতায়তের রাস্তা। কেউ জিনিষপত্র নিয়ে আসছেন আবার কেউ ফিরে যাচ্ছেন। বাজারটাই সব। ৩০-৪০ কিলোমিটারের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন মোবাইল নেটওয়ার্ক রুমাবাজার ছাড়া কোথাও ছিলনা।
কেউ কেউ ১০-২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে রুমাবাজার এসেছেন মোবাইল থেকে একটা ফোন করার জন্য। তাদের ছেলেমেয়েরা হয়ত ঢাকা বা চট্টগ্রামের কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। একটা মেয়েকে দেখলাম, বাড়ী ফিরছে, কাঁধেব্যাগ, মনে হল কোন কলেজে পড়ে। গাইড জানাল এভাবে বহুদুর পাড়ি দিয়ে এরকম আরো অনেকে স্কুল-কলেজে পড়ালেখা করে।
আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশের কাব্যিক বর্ণনা এধরনের লেখায় একটি অবশ্য করনীয় কাজ।
ব্যাপারটা আমার জন্য অনেক কঠিন। সহজে বলতে গেলে, চারপাশে ঝোঁপ-ঝাড়, একটু দূরে বড় বড় গাছপালা, উঁচু উঁচু পাহাড়, একটি আঁকাবাঁকা পাহাড়ি নদী, অমসৃণ মেঠো পথ উঠছে আর নামছে। তবে যতই এগুচ্ছি ততই নাগরিক ভাঁওতাবাজি কমে আসছে, মনে হচ্ছে আমরা ক্রমাগত অধিকতর কোন শুদ্ধ সমাজ-প্রকৃতির কাছাকাছি আসছি।
অনেকটা পথ হেঁটে আসার পর মুনলাই পাড়া। অনেকক্ষণ পর একটা জনবসতি, পাড়ার মানুষগুলো খ্রীস্টান, ঘরগুলোর সামনে সাজানো ফুলের বাগান, মেয়েদের আচঁড়ানো পরিপাটি চুলের মত টান টান ঝাঁড় দেওয়া উঠোন, আর শুকোতে দেওয়া কাপড়।
এইখানে একটু জিরিয়ে আবার রওনা হলাম।
মুগ্ধ হবার মত ব্যাপারটা ঘটল একটু পরেই। মনে হল পাহাড় বেয়ে বেয়ে সত্যই আকাশে উঠে এলাম। গাইড আলমগীর বলল 'ভাইয়া দেখেন মেঘ'।
কুয়াশার মত ধোঁয়াগুলোই মেঘ, একটু দূরেই কিছু আর দেখা যায়না।
দারুন এক অনুভূতি আমাদের সকলকে নির্বাক করে দিল। আসলেইতো হেঁটে হেঁটে অনেক উপরে উঠে এসেছি আমরা, শক্ত জমাট মেঘ না হোক, অন্তত মেঘের শৈশবকে ছুঁয়ে দেখা যাচ্ছে।
একজায়গায় বসে সাথে আনা খাবারগুলো খেয়ে নিলাম। বিশ্রামের পর আবার চলতে শুরু করলাম। দিনের আলো কমে আসছে, একসময় সন্ধা নেমে আসল।
প্রচন্ড ক্লান্ত আমরা অন্ধকারেই হাঁটছি। বারবার জিগ্যেস করছি 'আলমগীর আর কতদূর?' আলমগীরের একটাই উত্তর- 'এইতো সামনে'। শালার সামনের কোন শেষ আছে। কান্না আসছে আমাদের। ষেইসাথে প্রচন্ড ঝড়ো-বাতাস।
এসে পড়লাম একদম খাঁড়া উঠে যাওয়া পাহাড়ের সামনে, আর সমতল পথটি চলে গেছে বগালেক এ। গাইড জানাল বগালেকে ঢুকার আগে পাহাড়ে উঠে সেনাক্যাম্পে আমাদের আসার খবর জানাতে হবে। মুখ দিয়ে জানা সব গালি বেরিয়ে এল, এই পাহাড়ে উঠার চেয়ে মৃত্যু অনেক সহজ হবে আমি নিশ্চিত। ক্যাম্পে নাম লিখিয়ে আমরা বগালেকে প্রবেশ করলাম। আমাদের আর একপাও এগোনোর শক্তি নেই।
আলমগীর একটা কটেজে থাকার ব্যাবস্থা করল। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। কটেজগুলো করা হয়েছে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জন্য। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম খেয়ে দেয়ে ঘুমানোর পর কাল সকালে আবার রুমাবাজারের পথ ধরব। কাজ নেই আর কেওকারাডং জয় করে।
পাহাড়ী পথে হাঁটা এত কষ্ট জানলে বান্দরবান নামটাই আর মুখে আনতামনা।
রাতের খাবার খেলাম লারমের হোটেলে। মিষ্টি কুমড়া, ডিমভাজি, ডাল আর লাল চালের ভাত। মনে হল এর থেকে ভাল কোন মেন্যুই হতে পারেনা। খাবার পর রং চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিল এক বাঙালি ভদ্রলোকের সাথে।
এন.জি.ও তে কাজ করেন, এইসব পাহাড়ি পাড়াগুলোতে সোলার প্যানেল বসান। তিনি বললেন হেঁটে এই পর্যন্ত আসার পর প্রায় সকলেই কেওকারাডং যাবার প্ল্যানটা বাতিল করে দেয়। খাইছেন এবার ভাল করে একটা ঘুম দেন। নিজের ব্যাগ থেকে বের করে সবাইকে ক্লোফেনাক খেতে দিলেন বললেন কালকে সকালেই দেখবেন অনেক ফ্রেশ হয়ে গেছেন। আমরা বুঝলাম কতটা অপ্রস্তুতভাবে আমরা ট্র্যাকিং করতে এসেছি।
সত্যি সত্যি পরদিন সকালে অনেক তরতাজা লাগল। চা খেয়েই আলমগীরকে বললাম 'চল কেওকারাডং পাহাড়ে উঠা যাক'। ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। বগালেক থেকে কেওকারাডং প্রায় ৭-৮ কি:মি: দূরে।
অনেক সকালেই চলতে শুরু করলাম আমরা।
পাহাড়ী ঝরণা, অমসৃন উঁচু নিচু পাথুরে পথ, খুব কষ্ট হচ্ছিল হাটঁতে। গাইড জানাল এই রাস্তাগুলো দিয়েই শুকনো মৌসুমে গাড়ি চলে। বলে কি? মানুষ হাঁটা দায়, তার উপর গাড়ি। ছবিটি দেখুন- এই হল গাড়ি চলার রাস্তা।
এটা ছিল চমৎকার রৌদ্রউজ্জ্বল দিন।
সবুজ পাহাড় আর মাঝে মাঝে সোনালী আভা। বহুদূরে পাহাড়ী খাদে একটি খুঁড়ে ঘর। কে থাকে কে জানে?
অনেকটা পথ হেঁটে এসে পৌছলাম দার্জিলিং পাড়ায়। এখানথেকে কেওকারাডং এর চূড়াটি দেখা যায়। একটা চায়ের দোকানে ঝিরিয়ে নিলাম।
দয়া করে শহর বা গ্রামে দেখা কোন হোটেলের ছবি মনে মনে কল্পনা করবেন না। এই হোটেলগুলোই তাদের থাকার ঘর। পাশে একটি শেল্প বানিয়ে কিছু বিস্কুটের প্যাকেট রাখা। তাহাই হোটেল। কিছু ছবি তুললাম আমরা পাড়ার বাচ্চাদের সাথে, সেই সাথে হোটেলের মালিক তরুনীটির সাথেও।
আবারও এগুতে থাকলাম আমরা। দার্জিলিং পাড়া থেকে ৪০-৫০ মিনিটের মত লাগে চূড়ায় উঠতে। চূড়ায় উঠার সুবিধার্তে পাকা সিঁড়ি করে দেওয়া।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই পোঁছে গেলাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গে।
এভারেস্টের চুঁড়ার মত এখানে কোন বৌদ্ধমূর্তি নেই যেটা নিয়ে ছবি তুললে প্রমান হবে আপনি এভারেস্টে উঠেছেন।
এখানে আছে একটি পাথরের ফলক। আর তাতে লেখা 'কেওকারাডং-এ স্বাগতম'
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।