নিজের ভাবনা অন্যকে জানাতে ভালো লাগে। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে চার বাঙ্গালী এভারেস্ট জয় করলো। এ-যেন বিখ্যাত হবার উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যক মানুষেরই কিছু শখ কিংবা আকাক্সা থাকে। এই আকাঙ্ক্ষাগুলো মোটেও শ্রেণী নিরপে নয়।
দেশের বেশির ভাগ মানুষ স্বপ্ন দেখে দুইবেলা পেট ভরে ভাত খাবার, ওয়াসফিয়া নাজরীনদের মতো নারীদের স্বপ্ন বিশ্বের উঁচু পর্বত আরোহন করা। আমরা তার আকাক্সাকে শ্রদ্ধা করি। তবে বিস্মিত হয়, যখন বুর্জোয়া পত্রিকাগুলো বড় লাল হরফে হেডিং দিয়ে, কোন নারীর এভারেস্ট জয়কে সামগ্রীক বাঙ্গালী নারীর অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াসি হন। কিংবা কারো ব্যক্তিগত সফলতাকে সমগ্র জাতির সফলতা হিসেবে চিহ্নিত করার উদ্যোগি হন। মনে রাখতে হবে ওয়াসফিয়া নাজরীন সহ এখন পর্যন্ত যে চারজন বাঙ্গালী এভারেস্ট জয় করেছে তারা কেউ এদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া পরিবারে জন্ম নেয়নি।
এভারেস্ট জয়ের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে একজন মানুষকে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয় সেটা এদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পে জোগাড় করতে নিদেন পে ৫/৭ জনম লেগে যাবে। তা হলে সাধারণ একটা ঘটনাকে নিয়ে আমাদের দেশের বুর্জোয়া মিড়িয়াগুলোর এমন ভাড়াবাড়ি রকমের প্রচারণার কারণ কী? বিষয়টা নিয়ে একটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে। বুর্জোয়া মিড়িয়ার এই এক ভয়ঙ্কর কূটকৌশল। সমাজের বিদ্যমান বঞ্চনাকে আড়াল করে মিথ্যা অগ্রগতির চিত্র সামনে আনা। বঞ্চিত মানুষকে একটা মিথ্যা জাতীয়তা বোধের সম্মোহনে ফেলে আসল সংকট থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখা।
ওয়াসফিয়ার এভারেস্ট বিজয় নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোর রিপোটে লিখা হয়েছে, এই পর্যন্ত যে চারজন বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করেছেন তাদের মধ্যে দুইজন পুরুষ এবং দুইজন নারী। নারী-পুরুষ সমতা সংখ্যা একটা বড় অর্জন। ব্যাপারটা যেন এমন যে এভারেস্ট জয়ের সমতার ফলে দেশ থেকে লিঙ্গ বৈষম্য দূর হয়ে যাবে। আবার একইদিন ওই পত্রিকায় দুইটা আতকে উঠার মতো খবরও ছাপা হয়েছে। খবরদুইটা হলো ফেনীর এক পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী ধর্ষণের শিকার, বাঘেরহাটের ১৫ বছরের এক স্কুলছাত্রী বখাটেদের উৎপাতে আত্মহত্যা করেছে।
অথচ সংবাদ দুটি এমনভাবে ছাপা হযেছে যেন এসব কোন খবরই না। অবশ্যই একথাও সত্য যে এই ঘটনাগুলো আমরা প্রতিমুহূর্তে শুনতে শুনতে আমাদের একধরণের গা-সোয়া ব্যাপার হয়ে গেছে। যুব সমাজের নৈতিক অবয় আজ সমগ্র জাতির উপর বিষফোঁড়ার মতো চেপে বসেছে। এর সামাজিক কারণ এই পুঁজিবাদী সমাজের ভোগবাদিতা আর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদিতা। সমস্ত মানুষ আজ পুঁজি আর মুনাফার ক্রীড়ানক।
বুর্জোয়া মিড়িয়া আমাদের সামনে একেকজন তারকা তৈরি করে, আর সকলকে এই তারকাদের দৃষ্টান্ত স্থাপনের উসকানি দেয়। সমগ্র যুব সমাজের সামনে এই যেন এক উদ্ভট খেলা, সারাজীবন ছুটে যাবে কিন্তু কখনো লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। ছুঁতে পারি আর না পারি স্বপ্নেতো বিভোর থাকি। প্রসঙ্গক্রমে আমার মনে পড়ছে দামিনি লাফিও-এর জগৎ বিখ্যাত উপন্যাস দ্য সিটি অব জয় এর কথা। পড়েছিলাম একবারে কিশোর বয়সে অন্ততপে ২দশক আগে।
তাই চরিত্রগুলোর নাম এখন আর মনে পড়ছে না। তবে যে ঘটনাটা আমার মনে আজও দাগ কেটে আছে, ভারত যখন প্রথম আনবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালায়, সেই সংবাদ শুনে আনন্দনগর বস্তির এক হতদরিদ্র তরুণী খুশিতে আত্মহারা হয়ে মুহূর্তে ভুলে যায় তার উপোস থাকার কথা, খুশিতে ছুঁটে এসে মার্কিন নাগরিক ইহুদি ডাক্তারকে বলে, জানেন এখন আমরা আপনাদের সমান, আমাদেরও এটম বোমা আছে। যতদূর মনে পড়ে ডাক্তার শুধু একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়েছিল। এভারেস্ট জয়ের এই হিড়িকে আমাদেরও তাচ্ছিল্যের হাসি দেওয়া ছাড়া আপাদতে কিবা করার আছে! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।