একটা মেয়ের একটু কথা।
“বদ্ধ একটা ঘরে আমি বসে আছি। পড়ার টেবিলে একটি মাত্র বই। একটা কবিতার বই। বইটার আবার সব পৃষ্ঠা সাদা।
অবাক হলাম না মোটেও। মনে হচ্ছে এটাই স্বাভাবিক। ঘরটার কাঁচের জানালার ওপাশে একটা হলুদের উপর সাদা ছিট ওয়ালা বড় প্রজাপতি বসে আছে। ওটা যেন ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আচমকা একজন লোক কি করে যেন ঘরে চলে এলো।
বুকের ভিতর ধ্বক করে উঠলো। লোকটার সাড়াশির মতো আঙ্গুল ডান হাতের বাহুতে চেপে বসে গেল। আমি নড়তে পারছি না। ছুটে পালানোর চেষ্টা করতেই হাতের আঙ্গুল গুলো আরো জোরে চেপে বসে গেল। যেন মাংস কেটে বসে যাবে।
আমি অসহায়ের মতো ঘামছি। চিৎকার করার বৃথা চেষ্টা করলাম! গলা যেন কেউ চেপে ধরেছে আমার। বুঝতে পারছি এটা দুঃস্বপ্ন। শত চেষ্টা করেও ঘুম ভাঙ্গতে পারছি না। একটি বার চোখ তুলে তাকালাম লোকটির দিকে।
তার ফর্সা কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সুন্দর চেহারাটিতে আশ্চর্য কাঠিন্য, নাসিকা স্ফীতপ্রায়, চোখ দুটোর শিরা লাল হয়ে ফুলে আছে। চোখের মণি একবার বড়ো হচ্ছে একবার ছোট হচ্ছে। গা থেকে ভুরভুর করে সিগারের গন্ধ আসছে। ”
ছটফট করতে করতে ঘুম থেকে উঠলাম।
আমি ঘুমেই বুঝতে পারি দুঃস্বপ্ন দেখছি। এই একটাই জিনিশ দেখছি একমাস ধরে। প্রতিবারই একই রকম অনুভুতি হয়। আসলে কি কিছু অনুভুতি কখনো ভোঁতা হয় না। আর ঘুম হবে না।
রাতের বাকি অংশটুকু কি করবো বুঝতে পারছি না। ছাদে গিয়ে হেটে আসা যায়। কিন্তু কেন জানি ইচ্ছা করছে না। আজকাল কোন কিছু না করার ইচ্ছা প্রবল হচ্ছে আমার। অতুল বড় বিরক্ত হয়।
আশ্চর্য আমার সব ভাবনাতেই কেন জানি অতুল এসে পড়ে আজকাল। গ্রীক দেবতাদের মতো চেহারা, সুদর্শন এক যুবক। গভীর বাদামী চোখে মায়ার প্রাবল্য আছে। চোখের কারণেই কিনা তার চেহারায় একটা মেয়েলী ভাব চলে আসতে চায়। তবে মুখের কাঠিন্যের কারণে যেটা আসতে গিয়ে আসে নি।
এত সুদর্শন এক যুবককে আমার অসহ্য লাগে। কেন জানি মোটেই সহ্য হয় না তাকে। তবে সেটা ভিতরে ভিতরে। বাইরে প্রকাশ খুব কমই করতে পারি। তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
শত হলেও হবু স্বামীর সাথে ভদ্র ভাষায় কথা বলতে হয়! বাকি রাতটা বাথটাবে শুয়ে কাটিয়ে দিলাম!
পরদিন অফিস থেকে বের হওয়ার আগ মুহুর্তে অতুল এসে হাজির।
- আজকে একটু দেরী করে বাসায় গেলে হয় না?
- কেন বলো তো?
- একটু ঘুরে আসতাম!
- ঠিকাছে।
অতুল সামান্য অবাক হয়। কি ভেবে রাজি হয়ে গেলাম জানি। আসলে আজকে নির্লিপ্ততা ঘিরে আছে কেন জানি!
অতুল রিকশা নিল।
ভ্যাপসা গরম পড়েছে। প্রচন্ড বিরক্তি থাকা স্বত্ত্বেও রিকশায় উঠলাম। অতুলকে প্রচন্ড রকম অপমান করতে ইচ্ছা হচ্ছে।
- হুড কি তুলে দেবো?
- দিতেই পারো আর না দিলেও সমস্যা নাই।
- আচ্ছা নাই দিলাম।
ফ্রি হয়ে বসো।
- ফ্রি হয়েই তো বসেছি। তুমি নড়াচড়া করো না। আর হাতটা ইচ্ছা করলে আমার হাঁটুতে রাখতেও পারো। আমি তোমাকে থাপ্পড় দিবো না।
- এসব কি বলছো?
- কেন ভুল বলছি নাকি?
- আচ্ছা আমি অন্য রিকশায় যাচ্ছি।
- তোমার ইচ্ছা।
অতুল রিকশা থেকে নেমে অন্য রিকশা নিলো। অপমানে তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। এখুনি যেন কেঁদে দিবে।
আমি বিমলানন্দ লাভ করলাম। সপ্তাহান্তে যে নারী তার স্ত্রী হতে যাচ্ছে তার কাছে অপমানিত হওয়াটা সে আশাও করে নি। কিন্তু সমস্যা হলো লোকটা আমাকে পছ্ন্দ করে। আঘাত পেয়েও বারবার ফিরে আসে। আমি যা ত্যাগ করতে চাই সেটাই কেন জানি না আমাকে খুব করে আঁকড়ে ধরতে চায়।
- আরে নওরীন তুই এত্ত বড় হয়ে গেলি কখন?
অন্তু ভাইয়া এসেছেন গতরাতে। সকালে উঠেই হাকডাক শুরু করে দিলেন। আমি মৃদু হাসি দিলাম শুধু। অনেক দিন পর দেশে আসলেন। শুধু আমার বিয়ে উপলক্ষ্যে।
- এই পিচ্চি মেয়ে তো বর দেখতে কেমন বল আমার চেয়ে বেশী হ্যান্ডসাম হলে আমার তীব্র আপত্তি আছে।
উত্তর দিলো পিপলু।
- আরে ভাইয়া দুলাভাই তোমার চেয়ে ম্যালা হ্যান্ডসাম।
পিপলু অন্তু ভাই সহ বাসার প্রায় সবাই রাজ্যের আলাপ জুড়ে দিলো। অন্তু ভাই আগের মতোই রয়ে গেছেন।
একটার পর একটা সিগার টেনে যাচ্ছেন। আম্মা সানন্দে পুরো ডিটেইলস বলে যাচ্ছেন।
- জামাইর নাম অতুল। রাজপুত্রের মতো দেখতে। ফ্যামিলিও তেমন ভালো।
আমাদের নওরীনের কলিগই ছিলো। নওরীনের সাথে প্রায়ই কথাবার্তা বলতো। হঠাৎ একদিন পুরো পরিবার নিয়ে হাজির। সাথে ডায়মন্ডের রিং। আমি তো আরো ভাবলাম.......
অসহ্য লাগছে আম্মার কথা।
আমি চলে আসি আমার রুমে। সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিই। অফিস থেকে ছুটি আরো পরে নিলেই ভালো হত। কিশোরী বেলায় জানালার কাঁচ তুলে দিয়ে পড়ার টেবিলে উঠে বসে থাকতাম। পাশেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ।
বসন্ত এলে গাছটা পাগল হয়ে যেত। লাল রং এর স্টুপিড টাইপ একটা ফুল দিয়ে নিজেকে সাজিয়ে নিতো। এই স্টুপিড টাইপ ফুলটাই আমার এত্ত ভালো লাগে! কেউ আশে পাশে না থাকলে জানালা গলে গাছটায় উঠে পড়তাম। এখন চাইলেও তা সম্ভব না। আমার মতোই গাছটা অনেক বড় হয়েছে।
ডালগুলো উপরের দিকে। মাথা খারাপ করে দেয়া লাল রং এর কৃষ্ণচূড়া দেখতে এখন ছাঁদে বা বাগানে যেতে হয়। কৃষ্ণচূড়া! এর চূড়া তো লাল হয়ে থাকে। তাহলে কৃষ্ণচূড়া কেন নাম? এই প্রশ্ন আমি করেছিলাম অন্তু ভাইয়াকে। তিনি বলেছিলেন “ খাইছে রে তুই এত্ত কঠিন প্রশ্ন করা শুরু করলি ক্যান? বয়স আরো বাড়ুক তোর প্রশ্নের উত্তর তখন দিবো।
” বলেই বেণী টেনে দিয়েছিলেন। উত্তর আমি পাই নি কখনো। আর জিজ্ঞাসাই করি নি!
ফোনটা হাতে নিয়ে অতুলের নাম্বারটা ডায়াল করলাম। প্রশ্নটার উত্তর পেতে ইচ্ছা করছে কেন জানি!
- নওরীন!
- হ্যাঁ। আচ্ছা কৃষ্ণচূড়ার চূড়া তো লাল ফুলে ছেয়ে থাকে তো এর নাম কৃষ্ণচূড়া কেন?
- উত্তরটা আমি জানি।
তোমাকে বলবো আমাদের বিয়ের দিন। একমুহুর্ত অপেক্ষা করে বলে সে।
- ঠিকাছে। রাখি তবে।
নির্লিপ্ততা আবারো ঘিরে ধরলো।
পরশুদিন বিয়ে কালকে গায়ে হলুদ। বাড়ি ভর্তি মেহমান গিজ গিজ করছে। বাড়িতে অনেক দিন পরে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এলো। শুধু আমিই যেন মরে আছি। আর নিয়ম করে ওই দুঃস্বপ্নটা দেখছি।
বালিশে মাথা রাখার পরপরই ঘুম নেমে আসে কিন্তু দুঃস্বপ্নটা দেখার পর আর ঘুম হয়না। আর সারাদিনই চোখ জ্বলতে থাকে কেন জানি!
রাত দুটো বত্রিশ। কেন জানি মনে হচ্ছে এখুনি অতুলকে ফোন করা দরকার। নাহ! তাকে বরং একটা মেইলই পাঠিয়ে দিই।
পিসি খুলে লিখতে বসে গেলাম।
“অতুল একটা গল্প বলি তোমাকে। মন দিয়ে শোন। একটা মেয়ের কথা। মেয়েটার কিশোরীকালের কথা। যে কথা কাওকে বলতে পারেনি মেয়েটি!
অন্তু ভাইয়াকে খুব ভালো লাগতো তার।
অসম্ভব সুদর্শন মানুষটার কাছে রাজ্যের বই। বই পড়ার ইচ্ছা না থাকা স্বত্ত্বেও মানুষটাকে একবার দেখার জন্যে প্রতি শুক্রবার দুপুরে বই আনতে যেত। মানুষটার গা থেকে ভুরভুর করে সিগারের গন্ধ বের হয়। মেয়েটা অসহ্য লাগে গন্ধটা। তাকে দরজার ফাক দিয়ে দেখতেই ভালো লাগে।
ভাইয়াও হয়তো খেয়াল করেন জিনিশটা। দরজার ফাঁকে আমাকে দেখা মাত্রই ইংরেজি বানান ধরেন।
- সিস্টেমেটিক বানান কর তো?
- ক্যানো? পারবো না। আমি এখানে পড়তে আসি নি!
- পারিস না সেটা বল।
- না পারলে নাই তোমার কি? এতপড়া ভালো লাগে না।
- কি ভালো লাগে তাহলে তোর?
- জানি না। একটা বই দাও তো অন্তু ভাইয়া। পড়বো। গল্পের বই দিবা। ভয়ের যেন হয়।
- ভয়ের গল্প পড়ে কি করবি? একটা কবিতার বই নিয়ে যা। দেখিস মুখস্ত করে ফেলিস না। কবিতা পড়তে হয় শব্দ গুলো মাথায় রাখতে হয়। মুখস্ত করতে হয় না।
মেয়েটা লজ্জা পেয়ে গেল।
এর আগের বার একটা কবিতার বই দিয়েছিলেন অন্তু ভাইয়া। বলেছিলেন সত্তর পৃষ্ঠার কবিতাটা তার সবচেয়ে প্রিয়। মেয়েটা রাতে পড় শেষ করে বসে বসে কবিতাটা মুখস্ত করে ফেলেছিলো। দুষ্ট পিপলুটাকে কোন আক্কলে বলেছিলো কথাটা সে অন্তু ভাইয়াকে বলে দিয়েছে।
মেয়েটা বইটা নেবার জন্যে হাত বাড়ায়।
কিন্তু বিস্ফোরিত চোখে আবিষ্কার করে যে অন্তু ভাইয়ার শক্ত আঙ্গুল গুলো তার ডান হাতের বাহুতে গেথে গেল। কিশোরী দেহের নরম মাংস ভেদ করে তার আঙ্গুল গুলো চেপে বসে যায় মেয়েটার বাহুতে। ছুটে পালিয়ে যাবার বৃথা চেষ্টা তার হাতের আঙ্গুল গুলোকে আরো কঠোর করে দেয়! রক্তশুণ্য মুখে তার দিকে তাকায়! কই এটাতো একটা হায়েনা! চোখ রক্ত বর্ণ জিভ দিয়ে লালা পড়ছে। মেয়েটার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। সিগারের গন্ধ প্রবল ভাবে নাকে লাগছে এবার।
দেয়ালের ক্যালেন্ডারে মে মাসের পৃষ্ঠাটাতে একটা সাদা ছিট ওয়ালা হলুদ প্রজাপতি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সিগারের গন্ধ আরো প্রবল হলো। গন্ধটা সরাসরি মাথার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে যেন!
এটাই গল্পটা। তুমি বুঝতেই পারছো মেয়েটা আমি ছাড়া কেউ না। বাকিটা তোমার কাছে অতুল!”
লেখাটা এটাচ করে পাঠিয়ে দিই অতুলের ঠিকানায়।
অতুলকে বলতে হবে মেইলটার কথা সে হয়তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে।
- অতুল তোমাকে একটা মেইল পাঠিয়েছি। এখুনি দেখো। ইটস আর্জেন্ট।
- ওকে আমি এখুনি দেখছি।
- দেখে আমাকে তোমার মত জানিও। হ্যাঁ হলে ফোন করো না হলে ফোন করার দরকার নেই। রাত তিনটার আগে ফোন করবে। এরপর আমি ফোন অফ করে দিবো!
- কি হয়েছে নওরীন?
আমি ফোন কেটে দিলাম। বারান্দায় অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না।
আমি তাই দেখতে থাকি মুগ্ধ হয়ে। কাওকে খুব করে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হচ্ছে কৃষ্ণচূড়া সংক্রান্ত প্রশ্নটা। আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করি মানুষটা অতুল। অতুলও অন্তু ভাইয়ার মতো অসম্ভব সুদর্শন একটা মানুষ। তাই তাকে কাছ থেকে অসহ্য মনে হয়।
কিন্তু সেকি জানে দুর থেকে আমি কিভাবে তাকে ফিল করি! না জানবেও না কথনো। রাত তিনটা বাজতে একমিনিট বাকি। আমি আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম আমি একটা ফোনকলের জন্যে ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছি। আমার গাল ভিজে গেছে কেন জানি! স্বপ্ন নাকি সাদাকালো হয়। কিন্তু সাদাকালো দুঃস্বপ্নেও হলুদ পাখার প্রজাপতিটার কথা আমি ভুলতে পারছি না।
ভুলতেও হয়তো চাই না। একপাল হায়েনার মাঝে ওটাই যেন একটুকরো আলো আমার কাছে। লালায়িত হায়েনার হাসিতে চমকে চমকে উঠি আর প্রজাপতিটা আমাকে আস্বস্ত করে। ও হ্যাঁ হায়েনার কথা বলতে ভুলে গেছি। এরা এক আশ্চর্য জীব।
নাহ এরা জঙ্গলবাসী হায়েনা নয়। এরা মনুষ্যসমাজ বাসী। তবে এরাও মাংশাসী প্রাণী, এদের হাসিতেও চমকে উঠতে হয় যা আদৌ হাসি কিনা সন্দেহ। এদের চোখের দৃষ্টি বুভুক্ষুর মতো। চোখ দিয়ে যেন এরা সব গিলে নিতে চায়।
চোখ দিয়ে সব গ্রাস করা গেলে পৃথিবীতে কিছুই অবশিষ্ট থাকতো না। নরম নারী মাংস লোভী প্রাণীগুলো ধারালো দাঁতে সব কিছু ছিন্নভিন্ন করে দিতে চায়। এই অন্ধকার ভেজা রাতে কেন জানি মনে হচ্ছে সেই হলুদ প্রজাপতিটা অতুলও হতে পারতো! দুটো ঊনষাট মিনিট তিপ্পান্ন সেকেন্ড! আর সাতটি সেকেন্ড বাকি!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।