[img|http://ciu.somewherein.net/ciu/image/119053/small/?token_id=671953b0e9991a80cf91d9c34e4a2896
তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালে। তাঁর শিশুকাল কেটেছে চাঁদপুরে। শৈশবে ময়মনসিংহ স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। কৈশোরে কলকাতার কাছাকাছি বিষ্টুপুর শিক্ষাসঙ্গ উচ্চবিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন। যৌবনের প্রারম্ভে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেন।
মহাযুদ্ধের সমাপ্তিতে কুমিল্লার অনিতা চৌধুরীকে জীবনসঙ্গী করে আতাইকুলায় পিতৃভবনে স্থায়ী হন। আতাইকুলা থেকে পাবনা স্কয়ার ওষুধ শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের মধ্য দিয়েই তাঁর শিল্পোদ্যোগ শুরু। দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তা এই অজাতশত্রু মানুষটি জীবনের সব ক্ষেত্রে অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে আছেন।
শিল্পজগতের ‘রেটিং এজেন্সি’ ড্যান এবং ব্রড স্ট্রিট শিল্প খাতে তাঁকে প্রাইভেট সেক্টরে কোম্পানিগুলোর শীর্ষতম স্থান প্রদান করেছে। তিনি ছিলেন ওষুধ, টেক্সটাইল, কনজ্যুমার প্রোডাক্টসহ ২৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা।
এ ছাড়া ব্যাংক, বিমা, মুদ্রণ, মিডিয়া—কী ছিল না তাঁর সাম্রাজ্যে। ‘জীবন বাঁচাতে এবং জীবন সাজাতে’ সবই ছিল তাঁর স্কয়ার সাম্রাজ্যে।
তিনি একজন গৃহপতি বা গোষ্ঠপতি ছিলেন। পারিবারিক শৃঙ্খলা ধরে রাখতে ‘পরিচ্ছন্নতা’ শব্দটিকে তিনি বারবার ব্যবহার করতেন। স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, পিতা-কন্যা, জীবনের বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে তিনি শব্দটির যথার্থ ব্যবহার করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন প্রবল ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। প্রাতঃকালীন প্রার্থনা না করে তিনি বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা প্রাতরাশ গ্রহণ করতেন না। প্রাতঃকালীন প্রার্থনায় অনুপস্থিত হলে তাঁর নির্দেশ ছিল—নো বাইবেল নো ব্রেকফাস্ট। তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজনকে অবহেলা করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, নীতিবোধ ও মূল্যবোধ একমাত্র ধর্মাচরণের মাধ্যমেই সম্ভব।
স্কয়ারের সূচনা থেকেই তিনি দেশের ক্ষুদ্রতম খ্রিষ্টীয় সমাজের জন্য তাঁর মেধা ও সময় দিয়েছেন। ১৯৫৬ থেকে আমৃত্যু তিনি চার্চের মাধ্যমে খ্রিষ্টীয় সমাজ ও দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে তিনি দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সমবায় নিয়ে ভেবেছেন। এ কাজে তাঁর প্রিয় সহকর্মী ছিলেন আমেরিকান ম্যারি মিলনার ও জিম ওয়েকার। এ সময় তিনি ইস্ট পাকিস্তান খ্রিষ্টিয়ান কাউন্সিলের (ইপিসিসি) সম্মানী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
এ পদে থাকা অবস্থায় ব্রিটিশ কৃষিবিদ ডেভিড স্টকলি ওবিইকে নিয়ে কৃষিবিপ্লবে এগিয়ে গেছেন। ইরি চাষ, উন্নত ফ্রেজার গরু ও রোড আইল্যান্ড মুরগি প্রচলন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর তিন ছেলের অবদান অনস্বীকার্য। জ্যেষ্ঠ ছেলে স্যামুয়েল স্বপন ভারতের আশ্রয়কেন্দ্রে কাজ করেছেন। দ্বিতীয় ছেলে তপন দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য, ওষুধ এবং অন্যান্য সাহায্য জুগিয়েছেন।
ছোট ছেলে অঞ্জন রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছেন। জীবন রক্ষার জন্য স্যামসন এইচ চৌধুরী আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। পরে পাকিস্তানি বাহিনীর চাপে স্কয়ার কারখানা চালু করতে হয়েছে। ইপিসিসি ছিল ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেসের (ডব্লিউসিসি) আঞ্চলিক সংগঠন। ডব্লিউসিসি তাঁকে জানাল, তারা এক জাহাজভর্তি খাদ্য ও ওষুধ পূর্ব পাকিস্তানের জেনোসাইড ভিকটিমদের জন্য পাঠাচ্ছে।
মি. চৌধুরী বুঝেছিলেন, এ খাদ্য ও ওষুধ পাকিস্তানি বাহিনী নিজেরাই ব্যবহার করবে। তাই তিনি ডব্লিউসিসিকে জানালেন, যেন এই শিপমেন্ট ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে পাঠানো হয়। হয়েছিলও তাই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছেন। সুজানগরে তিনি প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
এই অভিজ্ঞতাকে তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ গঠনের জন্য জার্মানির স্টুটগার্টে গিয়ে ডোনার কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ ইকুমিনিক্যাল রিলিফ রিহ্যাবিলিটেশন সার্ভিস (বিইআরআরএস) গঠন করেন। বিইআরআরএস পরবর্তীকালে খ্রিষ্টিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশে (সিসিডিবি) রূপ নেয়। সিসিডিবি আরিচা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল ও মহেশখালীর মৎস্যজীবীদের জাল, নৌকা, কোল্ডস্টোর প্রদান, নরসিংদীতে তাঁতিদের পুনর্বাসন; রাজশাহীতে ১২ মিলিয়ন ডলারের কৃষি প্রকল্প, বাংলাদেশ সরকারকে দূরপাল্লার ওয়াকিটকি ও বার্জ প্রদান; বরিশাল ও গোপালগঞ্জে ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলারের ইরি প্রকল্প তাঁর ঐকান্তিক উদ্যোগে বাস্তবায়িত হয়েছে। কৈননীয়া নামক এনজিওরও দীর্ঘদিন চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
বর্তমানে তাঁর ছেলে তপন চৌধুরী এর চেয়ারম্যান।
তিনি ছিলেন ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’-এর সভাপতি। তিনি কখনোই কর্মচারীদের বঞ্চিত করেননি। তাঁর কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কখনো ধর্মঘট হয়নি। কর প্রদান সম্পর্কে তিনি যিশুর নির্দেশ অনুসরণ করতেন।
তিনি ছিলেন দেশের অন্যতম শীর্ষ করদাতা এবং কর ফাঁকিকে ঘৃণা করতেন। তিনি ঋণখেলাপি ছিলেন না, পুঁজিবাজারে নয়ছয় করেননি।
অনেকে বলেন, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা’র ভাবনাটি পাশ্চাত্য থেকে এসেছে। না, এটি পাশ্চাত্য দর্শন নয়, এটি স্যামসন এইচ চৌধুরীর দর্শন। ৩৩ হাজার সন্তানের (স্টাফ) লাঞ্চ ও লভ্যাংশ, ভাতা, বোনাস প্রদান—ভাবলে অবাক লাগে।
কেন তিনি এ ফ্রি লাঞ্চ প্রথা চালু করেছেন? কেন তাঁর শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কখনো স্ট্রাইক হয়নি? কেন সেখানে শ্রমিক অসন্তোষ নেই? কেন তিনি স্টাফদের নিজের সন্তান হিসেবে বিবেচনা করতেন?
স্যামসন এইচ চৌধুরী ছিলেন অজাতশত্রু। অসাধারণ সৌজন্যবোধ ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য তাঁর খ্যাতি ছিল। সত্যকথনে তিনি অবিচল, কিন্তু তাতে কেউ আহত হয়নি। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ যেমন আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন ছিল, তেমনি তাঁর চলনবলন ও কথন ছিল ঈর্ষণীয়।
তিনি ছিলেন দানশীল।
কত ছাত্র, কত দরিদ্র, অনাথ, কত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার তাঁর নীরব দানে সঞ্জীবিত হয়েছে। দান করার ক্ষেত্রে তিনি যিশুর আদেশ কঠোরভাবে অনুশীলন করতেন। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে একটি গরিব ছাত্রকে ১০ লাখ টাকা দিয়ে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।