আমরা হেরে যাইনি। এশিয়া কাপ না জিতলেও তোমরা আমাদের হৃদয় জয় করেছ। আমরা গর্বিত আজ ১৬ মে। ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের এই দিনে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে মরণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো জনতার লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে এই দিন বাংলার সর্বস্তরের মানুষের বজ্রকণ্ঠ দিল্লির মসনদ পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়।
ওই দিন রাজশাহীর মাদরাসা ময়দান থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে।
ভারতবিরোধী নানা স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে গোটা এলাকা। বেলা ২টায় লাখ লাখ মানুষের স্রোত গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টায় লংমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে রাত যাপনের জন্য সে দিনের মতো শেষ হয়। মাঠেই রাত যাপন করার পরদিন সোমবার সকাল ৮টায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে।
ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। লাখ লাখ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত যোগ দেন এই লংমার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না।
কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। তিনি বলেন, আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে। মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লংমার্চ সমাপ্ত হলেও সে দিন জনতার ভয়ে ভীত ভারতীয়রা সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে।
আধিপত্যবাদী শক্তি ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী সে দিন ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ও এর বিভিন্ন তিকর দিক তুলে ধরে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, তার সেই সাহসী উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস্য হয়ে আছে আজও।
ভারতের একতরফা ও আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ একটি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চল ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। দেশের বৃহত্তম নদী পদ্মা আজ পানির অভাবে শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। ফলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অর্ধশত নদী বিলুপ্তির পথে। অন্য দিকে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে।
গত কয়েক বছরে পানির স্তর স্থানভেদে ২৫ ফুট থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে।
বিশ্বে আন্তর্জাতিক নদীসমূহে বাঁধ নির্মানের ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান সম্ভব হলেও 'ফারাক্কা বাঁধ আজও মারণফাঁদ'।
মরুভূমির পথে বাংলাদেশ- মারণফাঁদ ফারাক্কার পরে এবার টিপাইমূখ হচ্ছেই-বিশ্বে আন্তর্জাতিক নদীসমূহে বাঁধ নির্মানের ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান সম্ভব হলেও মুজিব-ইন্দিরা সমস্যা কমাতে পারেননি। বরং বাড়িয়েছিলেন। হাসিনা-সোনিয়া পারবে কি?
আমরা সময় থাকতে সোচ্চার না হওয়ায় আমাদের সুজলা সুফলা প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি সোনার টুকরো বাংলাদেশটির ভৌগলিক অস্তিত্বকে কৃত্রিমভাবে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে।
জোড়ালো দাবীর অভাবে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ে বিশ্বের নজিরবিহীন বাঙ্গালী জাতি তথা জীবন উৎসর্গকারীদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছে। তেমনি আমরা সময় থাকতে সোচ্চার না হওয়ায় আমাদের সুজলা সুফলা প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি সোনার টুকরো বাংলাদেশটির ভৌগলিক অস্তিত্বকে কৃত্রিমভাবে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। নিষ্ঠুর সত্য ভবিষ্যৎ বানী যাতে বাস্তবায়ন যেন না হয় সেজন্য আসুন আন্তর্জাতিকভাবে সোচ্চার হই। এক্ষেত্রে ব্লগারদের পক্ষ থেকে ব্যাপক ভিত্তিক জনমত গঠন ও আন্তর্জাতিক ভাবে চাপ প্রদান করা যেতে পারে।
আজকে একজন ভাসানীর বড় বেশি দরকার ছিল-
বাংলাদেশ তার জন্ম লগ্ন থেকেই ভারতের সাথে বিভিন্ন সময় পানি সমস্যা নিয়ে বিরোধে জড়িত।
বিষয়টি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবি মহল থেকে শুরু করে সাধারণ জনগন পর্যন্ত সকলেই অবগত। ১৯৭৬ সালে ঐতিহাসিক লং মার্চ, বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সরাসরি আলোচনা ও কূটনৈতিকভাবে সমাধানের প্রচেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোন প্রচেষ্টাই কাজে আসে নি। বরং ফারাক্কা সমস্যার সমাধান করতে গেলে ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের দাবী করে। স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশ জোর করে কোন কিছু বলতে পারে না।
আন্তর্জাতিক নদী সংক্রান্ত আইনের দাবি বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও ভারত তাতে কোন গুরুত্ব দেয়নি। অসমভাবে ৩০ বছরের জন্য নদীর পানি বন্টন চুক্তি হলেও ভারত বাংলাদেশের প্রাপ্য অংশ কখনোই দেয়নি । অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ যখন সবচেয়ে কম থাকে তখন ভারত প্রায় সম্পূর্ন পানি প্রত্যাহার করে নেয়। এই নীতি শুধু ফারাক্কা নয় বরং ভারত যে ৫২ টি নদীতে বাঁধ দিয়েছে তার সবগুলোর ক্ষেত্রেই করে থাকে।
এ নিয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও আন্তর্জাতিক নদীর পানি বন্টনের দোহাই দিয়ে পত্র পত্রিকায় বিভিন্ন কলাম ও প্রতিবেদন লেখা হলেও তা কোন কাজে আসেনি।
তবে কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যাক্তিই উল্লেখযোগ্য এমন কোন পদক্ষেপ নেয়নি যার মাধ্যমে জানা যায় যে, পৃথিবীর অন্যান্য নদীর পানি বন্টনের ক্ষেত্রে কোন দেশের অধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এ প্রবন্ধে মেকং, নীল, জর্দান ও দজলা ও ফোরাত নদীর পানি বন্টন ব্যবস্থা ও চুক্তি উল্লেখ করা হল।
বাংলাদেশ - ভারত আর্ন্তজাতিক নদীর পানি বন্টন সমস্যা :
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্য ৫৪ টি আর্ন্তজাতিক নদী রয়েছে । এর মধ্য ভারত বিভিন্ন সময়ে তার উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ৫৪ টি নদীর মধ্য ৫২ টি নদীতেই বাঁধ নির্মান করে। যখন শুষ্ক মৌসুমে পানি হ্রাস পায় তখন এসব নদীর প্রবাহ একেবারে বন্ধ করে দেয় ফলে বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক অধিকার নদীর পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে।
বাদ থাকে ব্রক্ষপুত্র ও সুরমা (মেঘনা) নদী । ব্রক্ষপুত্র নদীতে বাঁধ নির্মান না করলেও ভারত স্পার নির্মানের মাধ্যমে ১০ হাজার কিউসেকের ও বেশী পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এরপর বাকি থাকে সুরমা নদী কিন্তু এখন সকলেই অবগত যে ভারত সুরমা নদীর পানি প্রত্যাহারের জন্য কি প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। নিম্নে ভারত বাংলাদেশের পানি বন্টন সংক্রান্ত নীতি সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
ভারতের আন্ত নদী সংযোগের মহাপরিকল্পনা (লাল দাগের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করার জন্য সংযোগ লাইন দেখানো হয়েছে)
বাংলাদেশ ভারত কূটনৈতিক তৎপরতাঃ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই ফারাক্কা ইস্যু দেশ দুটির আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পায়।
স্বাধীনতার দেড় মাস পরে মি. বি এম আব্বাস প্রধান মন্ত্রী শেখ মুজিবের বন্যা নিয়ন্ত্রন ,সেচ ও বিদ্যৎ বিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রি সরদার সরণ সিং এবং সেচ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রি ড. কে এল রাও এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এবং ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্প ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সেচ ও বিদ্যৎ সম্পর্কিত বিষয়ে উভয় দেশের পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন। তার পূর্বে পাকিস্থানী করাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফেরার পথেই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী শেখ মুজিব কলকাতায় মিসেস গান্ধির সাথে সাক্ষাত করেন। ৭২ সাল ফেব্রুয়ারী মাসেও সাক্ষাৎ করেন এবং বিভিন্ন বিষয় সমঝোতার জন্য অলোচনা করে। অলোচনার ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ উভয়দেশ ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
১৯৭৫ সালে১৮ ই এপ্রিল বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্য ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে ৪১ দিনের একটি স্বল্প মেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষর হয় যাতে করে ভারতকে ১১ হাজার থেকে ১৬ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহারের সুযোগ দেয়া হয় এবং বাংলাদেশের জন্য ৪৪ থেকে ৪৯ হাজার হাজার কিউসেক পনি। কিন্তু এ চুক্তি ছিল অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী।
১৯৭৫ সালে ৩১ মে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ভারত একতরফা ভাবে প্রায় সম্পূর্ন পানি ( ৪মি হাজার কিউসেক) প্রত্যাহার করতে থাকে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর এক মারাত্বক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্ট হয়। ফলে অর্থনীতির এক তৃতীয়াংশ ধংসের মুখে পতিত হয়।
১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের নতুন সরকারের সাথে ভারতের মধুর সম্পর্কের ইতি ঘটলে বাংলাদেশের পক্ষে গঙ্গার পানি নিয়ে ভারতকে আলোচনায় বসানো অসাধ্য ব্যাপার হয়ে পড়ে।
শেষ পর্যন্ত সমস্যা সমাধানের পথ খুজে না পেয়ে বাংলাদেশ ১৯৭৬ সালে ওআইসির পররাষ্ট্র মন্ত্রিদের বৈঠকে, ১৯৭৬ এর আগষ্টে কলোম্বতে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে এবং ১৯৭৬ সালে নভেম্বর মাসে জাতিষংঘের সাধারণ পরিষদে আলোচ্য সূচিতে বিষয়টি পেশ করে। ১৯৭৭ সালে ভারতে নির্বাচনে মিসেস গান্ধির পরাজয় এবং মোরাজি দেশাই ক্ষমতা গ্রহন করলে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রি দেশাই এর নেতৃত্বে দু'দেশের সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। এই সুযোগে ১৯৭৭ সালে নভেম্বর মাসে দু'দেশের মধ্য গঙ্গার পানি বন্টন একটি পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কার মোট প্রবাহের ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৩৪ হাজার ৫ শত কিউসেক এবং ভারতের জন্য ২০ হাজার কিউসেক বরাদ্দ করা হয়।
এই সরবরাহ ছিল শুষ্ক মৌসুমের জন্য ২১ এপ্রিল থেকে ৩০ মে।
যদিও এখানে পানির পরিমান পূর্বের তুলনায় কম ছিল, তথাপি এই চুক্তিতে একটি গ্যারান্টি ক্লজ ছিল যাতে স্পষ্ট বলা ছিল যে, শুষ্ক মৌসুমের যে দশ দিনে পানির প্রবাহ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায় সে দশ দিন মোট প্রবাহের ৮০ শতাংশ পানি বাংলাদেশ পাবে। এই গ্যারিন্টি ক্লজ ছিল এই চুক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
দৃশ্যত এবং বাস্তবিক পক্ষে এই চুক্তি ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়ার অন্যতম সাফল্য। মোরাজি দেশাই সরকারের পর মিসেস গান্ধি পুনরায় ক্ষমতা গ্রহন এবং বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে ১৯৭৭ সালের চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার অগেই ১৯৮২ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল এরশাদ সরকার মিসেস গান্ধির সাথে চুক্তির পরিবর্তে ১৮ মাস দীর্ঘ একটি সমঝোতা স্বারকে স্বাক্ষর করে । চুক্তির পরিবর্তে সমঝোতা স্বরের কারণ ছিল এইযে, এখানে গ্যারান্টি ক্লজের কোন উল্লেখ ছিল না।
ফলে ভারত একতরফাভাবে পানি নিয়ন্ত্রন করত। ১৮ মাসের সমঝোতা সমাপ্তি ঘটে ১৯৮৪ সালের মে মাসে । একই শর্ত অনুয়ায়ী পরবর্তি ৩ বছরের জন্য এই সমঝোতার জন্য ৩ বছর বাড়ানো হয়। পরবর্তি ১৯৮৫ সালে নভেম্বর মাসের এর মেয়াদ তিন থেকে পাঁচ বছরে উত্তীর্ন করা হয। এর পর থেকে ১৯৯৬ সালের ১২ ই ডিসেম্বর নয়া পানি বন্টন পর্যন্ত ভারতের সাথে আর কোন চুক্তি হয়নি।
১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সময় গঙ্গার পানি সমস্যা সমাধানের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহন করা হলেও ভারতের গড়িমসির জন্য কোন স্বারক বা চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। দ্বিপাক্ষিক ভাবে পানি সমস্যার সমাধানকল্পে ভারত এগিয়ে না এসে আধিপাত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করলে ১৯৯৫ সালের সেপ্টেমবর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিষয়টি বাংলাদেশ উত্থাপন করে। তবে এই প্রস্তাব জাতিসংঘে উত্থাপনের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র রাষ্ট্র সমূহের উপর প্রয়োজনীয় গ্রাউন্ড ওয়ার্কের অভাবে বিষয়টি ব্যাপক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পানি সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহন করে। ভারতের সাথে ভাল সম্পর্কের কারণে ভারত সরকার পানি সমস্যা সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহন করে।
ইন্দিরা গান্ধীকে মওলানা ভাসানীর লেখা একটি চিঠি
প্রিয় মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত সরকার আপনার ১৯৭৬ সালের ৪ মে’র পত্র ফারাক্কা সমস্যা সম্পর্কে সরকারি বিবৃতির পুনরাবৃত্তি মাত্র। আপনার প্রখ্যাত পূর্বপুরুষ— মতিলাল নেহরুর নাতি এবং জওয়াহেরলাল নেহরুর কন্যার নিকট থেকে এরূপ পত্র আশা করিনি। আপনি নিজে বঞ্চিত লোকের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সকল ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সকল সময় সংগ্রাম করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে আপনি এবং ভারতের সকল জনগণ যে সাহায্য করেছে এজন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
ফারাক্কা সম্পর্কে আপনাকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পরিদর্শন করে কৃষি এবং শিল্প উত্পাদনের যে ক্ষতি হবে তা পরিমাপ করা জন্য পুনরায় অনুরোধ করছি।
সম্পূর্ণ সরকারি প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর না করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি। কারণ তাতে বর্তমান অবস্থা প্রতিফলিত হয় না।
এককভাবে গঙ্গার পানিপ্রবাহ প্রত্যাহার করার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা আমি ব্যাপকভাবে পরিদর্শন করি।
পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার উদ্যোগকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। কিন্তু সমাধান স্থায়ী ও বিস্তারিত হতে হবে।
দু’মাসের নিম্ন প্রবাহের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না; সারা বছরের স্রোত অন্তর্ভুক্ত থাকার ভিত্তিতে ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের জন্য পূর্বে আপনাকে কয়েকবার টেলিগ্রাম করেছি। বাংলাদেশের সাড়ে তিন কোটি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা অন্যদের দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। দুই দেশের নেতাদের একত্রে বসে সমাধানে পৌঁছা উচিত।
সম্মুখ বিরোধ ও সংঘর্ষ বাদ দিয়ে আমি অনুরোধ করছি আপনি নিজে হস্তক্ষেপ করে নিজে সমাধান করবেন, যা আট কোটি বাংলাদেশীর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে।
যদি আমার অনুরোধ আপনি গ্রহণ না করেন, তাহলে অত্যাচারিত মানুষের নেতা আপনার পূর্বপুরুষ এবং মহাত্মা গান্ধীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সমস্যা সমাধানের জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করতে বাধ্য হব।
এ সঙ্কট সমাধানে আমার সর্বোচ্চ সহযোগিতা এবং দু’দেশের বন্ধুত্ব সম্পর্ক শক্তিশালী করার জন্য নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
শুভেচ্ছান্তে—
আপনার বিশ্বস্ত
আবদুল হামিদ খান ভাসানী
ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি
প্রিয় মওলানা সাহেব, আমি আপনার ১৯৭৫ সালের ১৮ এপ্রিলের পত্র পেয়ে দুঃখ পেলাম এবং বিস্মিত হলাম। এটা কল্পনা করতে কষ্ট হচ্ছে যে, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছেন এবং পরবর্তীতে তার নিজের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুঃখ-কষ্টে ও উত্সাহে অংশগ্রহণ করেছেন— তিনি আমাদের এমন সাংঘাতিকভাবে ভুল বুঝছেন এবং আমাদের সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছেন। আমি বিশ্বাস করতে পছন্দ করি যে, আপনি ভারতের বিভক্ত ভারত প্রতিষ্ঠার আক্রমণাত্মক অভিসন্ধি এবং ফারাক্কা বাঁধ ভাঙার ভীতি প্রদান সম্পর্কে যে ভাষণ দিয়েছেন তা উত্তেজনা মুহূর্তে বলেছেন। কোনো বাংলাদেশী সত্যি বিশ্বাস করে যে, ভারত এত দ্রুত বাংলাদেশ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করেছে— সে কী করে তার প্রতিবেশীর প্রতি বৈরী ভাব পোষণ করতে পারে! মুক্তিযুদ্ধে অবদান এবং যুদ্ধ-উত্তর সহযোগিতার বিবরণের প্রেক্ষিতে ভারত সরকার ও তার জনগণকে বিচার করার প্রত্যাশা করে।
আমাদের নিজেদের প্রয়োজন অধিক এবং আমাদের জনগণের দায়িত্ব অনেক বেশি। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের দুই দেশের জনগণের মঙ্গল একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের উভয়ের স্বার্থে এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা, সহযোগিতা এবং দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব প্রয়োজন।
আপনি অবগত আছেন যে, ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ পূর্ব ভারতের প্রধান বন্দর কলকাতাকে রক্ষার জন্য একমাত্র উপায়। এ বাঁধকে কোনো প্রকারে পরিত্যাগ করা যায় না।
আপনি আরও জানেন যে, একমাত্র গ্রীষ্মকালে দু’মাসে গঙ্গায় পানির অভাব দেখা দেয়। উপায় অবশ্য পাওয়া যাবে। ভবিষ্যতে যদি কোনো ঘটতি দেখা দেয় তাহলে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের উভয়ের প্রয়োজন মেটানো যাবে। হুগলীর জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পানি না দিয়ে আমরা বাংলাদেশে পানির প্রবাহ এ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছি। মনে হয়, আপনাকে ফারাক্কা বাঁধের সংযুক্ত খালের বাংলাদেশ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে একতরফা এবং অত্যন্ত ভাবানো বিবরণ দেয়া হয়েছে।
আপনি বললে আমাদের হাইকমিশনার আপনাকে বিপরীত বিবরণ সম্পর্কে অবহিত করবেন।
প্রতিবেশীদের সঙ্গে অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়। সমঝোতা ও সহযোগিতার মধ্যে সমাধান খুঁজে পাওয়াই গুরুত্বপূর্ণ। সংঘর্ষ ও শত্রুতা পোষণ করে আমরা একে অন্যের ক্ষতি করতে পারি না। আপনাকে সম্পূর্ণ সরলতার সঙ্গে পুনরায় বলতে চাই যে, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতাকে সংহত এবং শান্তিতে উন্নতি করুক।
আমাদের পক্ষ থেকে প্রতিবেশী বন্ধু এবং উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে আমরা আমাদের অবদানের প্রস্তাব অব্যাহত রাখব।
আপনি হয়তো অবগত আছেন যে, আমাদের দুই সরকার গ্রীষ্মকালে গঙ্গার পানি বণ্টন এবং সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। এর জন্য উভয় পক্ষের কল্যাণকামী মানুষের উত্সাহ ও সমর্থন প্রয়োজন। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা প্রদান করছি যে, আমরা অনুসরণ ও চুক্তিপূর্ব আলোচনায় উন্মুক্ত কিন্তু কেউ যেন আশা না করে যে, ভারত কোনো প্রকার ভয় এবং অযৌক্তিক ও অন্যায় দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করবে।
আপনার বিশ্বস্ত,
ইন্দিরা গান্ধী
৩০ বছর মেয়াদী পানি চুক্তিঃ
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে বাংলাদেশ ও ভারত পানি চুক্তি হলেও ভারত বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য কখনোই দিচ্ছে না।
বিশেষ করে এ চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ না থাকায় ভারত শুষ্ক মওসূমে যখন পানি সর্বনিম্ন প্রবাহ তাকে তখন ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়।
টিপাইমুখঃ
অপরদিকে ২০০৪ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্তী মনোমহন সিং টিমাইমুখ নামক স্থানে বিদ্যৎ উৎপাদনের কথা বলে সেখানে বাঁধ নির্মানের জন্য ভিত্তি স্থাপন করে।
ভারতের জলকমিশন ১৯৮৪ সালে প্রথম টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তাব করে । যদিও তা প্রত্যাখ্যান হয় তথাপি ১৯৯৫ সালে ব্রক্ষপুত্র বোর্ড একটি প্রতিবেদন তৈরী করে এবং ১৯৯৯ সালে উত্তর পূর্ব বিদ্যুৎ কর্পোরেশন এর কাছে হস্তান্তর করে। ২০০৩ সালে তা অনুমোদন লাভ করে ।
২০০৪ সালের ২৩ নভেম্বর ড. মনমহনসিং ভিত্তি প্রস্তর স্থাপানের ঘোষনা দেন । ২০০৬ সালে ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে ভারতের কেন্দীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রিও ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে । ২০১১ সলের মাঝে এ বাঁধের কাজ শেষ হবে বলে তারা ঘোষনা করে।
ইন্সটিটিউট অব অয়াটার মডেলিং (আসামের) পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা এ বাঁধ চালু হলে বরাক নদীর অমলশিদ পয়েন্টে পানি প্রবাহ কমে যাবে । জুন মাসে ১০% জুলাইয়ে ২৩% আগষ্টে ১৬% সেপ্টেম্বর ১৫% পানি কমে যাবে।
পানির গড় উচ্চতা অমলশিদ পয়েন্টে জুলাই মাসে এক মিটারের নীচে নেমে যাবে । এবং এর গড় উচ্চতা ১.থেকে ০.২৫ মিটারে নেমে যাবে। একই সময়ে সুরমা নদী , কানাইঘাট ও সিলেট স্টেশনে পানির গড় উচ্চতা হ্রাস পাবে .৭৫ থেকে .২৫ মিটার পর্যন্ত । এর ফলে নদীতে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। সুনামগন্জ, সিলেট, মৌলভিবাজার ১০ হাজার হেক্টর জলাভূমি একেবারে শুকিয়ে যাবে এবং এই এলাকার হাওড়গুলো তার অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারবে না।
বর্তমান নতুন সরকার ক্ষমতায় অসার পর ভারত টিমাইমুখ বাঁধের কাজ শুরু করে দিলে পানি নিয়ে বাংলাদেশ ভারতের মধ্য পানি নিয়ে বিরোধের মাত্রা নতুন রুপ লাভ করতে থাকে। ফলে গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ থেকে একটি প্রতিনিধি দল টিপাইমুখ পরিদর্শনে যায়। প্রতিনিধি দলটি নাকি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ২৯ জুলাই (২০১০) টিপাইমুখ বাঁধের নির্মাণাধীন এলাকায় যেতেই পারেনি। তারা যখন বাংলাদেশে ফিরে এসে বলেছিলেন ভারত টিপাইমুখে কোনো বাঁধ নির্মাণ করছে না দেশের শতকরা নব্বইভাগ মানুষই তাদের এই মিথ্যাচার বিশ্বাস করেনি। যার সাক্ষ্য আমরা পেলাম ভারতের নর্থ-ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রেমাচান্দ পংকজ এর ভাষ্যে ।
তিনি গত ১১ জুলাই স্থানীয় একটি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে, টিপাইমুখে বরাক নদীতে প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেই। তিনি জানান, প্রস্তাবিত ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম টিপাইমুখ প্রকল্পের কাজ যথারীতি এগিয়ে নেয়া হবে (আমার দেশ, ১২ জুলাই, ২০১১)।
দেশের প্রায় প্রতিটি দৈনিকে প্রেমাচান্দের এই বক্তব্য ছাপা হয়েছে। ভারতের মনিপুর রাজ্যের চোরা-চাঁদপুর জেলার তুইভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ বাঁধটির নির্মাণ কাজ আগামী ২০১২ সালের মধ্যে শেষ হবার কথা। পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে আসাম ও মনিপুরের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এই বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা করছে।
ভারতের পরিবেশবাদীরা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করলেও, আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গটস বলেছেন বৃহৎ নদী বাঁধ যেকোনো মূল্যে হচ্ছেই। কেউ বাঁধের কাজ আটকাতে পারবে না। এখন মুখ্যমন্ত্রী গটস কিংবা প্রেমাচান্দের বক্তব্যের পর এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, টিপাইমুখ বাঁধ হচ্ছেই।
টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের ক্ষতি করবে না: দীপুকে প্রণব; টিপাইমুখ প্রক্ল্প উপকার করবে: দিল্লিস্থ হাইকমিশনার
সূত্র: আজ ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস- মারণফাঁদের সমাধান হলোনা আজও! নতুন করে হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।