আমি পেশায় একজন স্পীচ থেরাপিষ্ট কিন্তু ব্লগ পড়া আমার নেশা। আর একটা নেশা আছে সেটা হল মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস প্রতিটা মানুষের কাছে পৌছে দেয়া। আমি সে চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। আমি কোন ভালো লেখক নই কিন্তু আমি একজন ভালো পাঠক। আইয়ান দুই বছরের ফুটফুটে শিশু ।
বাবা-মায়ের সাথে চেম্বারে ঢুকেই অস্থির। মা থামানোর চেষ্টা করছিল কিন্তু সে ফিরেও তাকায় না, যেন কানে কিছুই শুনছেনা। বললাম,”ওকে ওর মত থাকতে দিন, বলুন ছেলের কি সমস্যা। বাবা-মা খুবই উদ্বিগ্নের সাথে শুরু করলেন সমস্যার কথা-
তাদের প্রথম সন্তান আইয়ান- কথা বলে না, আগে যা একটু বলতো এখন তাও বলেনা; সবসময় অস্থির,চঞ্চল; যা পাই তা দিয়ে একা-একা খেলে, ভেঙ্গে ফেলে অনেক কিছুই; নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয়না কিন্তু টেলিভিশনে এডের শব্দ শুনলেই দৌড়ে যায়, অকারণে চিৎকার চেচামেচি করে, শরীরের এমন সব অঙ্গ ভঙ্গি করে যা তার সমবয়সী বচ্চাদের মত না।
মায়ের প্রশ্ন: আইয়ানের আসলে কি হয়েছে?
কেউ বলে প্রতিবন্ধী, কেউ বলে অটিজম।
আচ্ছা, অটিজমটা কি? এর কারণ কী? কেন হল? সন্তানের এই অবস্থার জন্য মা কি দায়ী? যদি অটিজম-ই হয়ে থাকে- এই সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাব? কি করব? সে সুস্থ স্বাভাবিক হবে তো? দেশে বিদেশে এর কি কোন চিকিৎসা আছে? ইত্যাদি প্রশ্ন করতে করতে মা অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। মাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম, চেষ্টা করলাম তার সব প্রশ্নরে উত্তর দতি। ে কিন্তু আমার মন অতৃপ্ত। সত্যিই কি পেরেছি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে?
এবার আসুন বোঝার চেষ্টা করি- অটিজম কী?
অটিজম শিশুর স্নায়ুবিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা যা জন্মের ১-৩ বছরের মধ্যে প্রকাশ পায়। অনেকের ক্ষেত্রে এর আগে থেকেও বোঝা যেতে পারে।
অটিজমের প্রধান সমস্যাগুলো কী কী?
(ক) মৌখিক ও অমৌখিক যোগাযোগে সমস্যা।
(খ) ক্রিয়া এবং কল্পনা-যুক্ত খেলায় সমস্যা।
(গ) স্বাভাবিক সামাজিক আচরণে সমস্যা।
এ সবের প্রকাশ ঘটে শিশুর স্বাভাবিক আচার-আচরণের মাধ্যমে। যেমন-
একা-একা থাকতে ও খেলতে পছন্দ করে, ডাকলে সাড়া দেয়না, অকারণে হাসে বা কাঁদে, কোন কোন জিনিসের প্রতি বিশেষ আসক্তি, বুড়ো আঙ্গুলের ওপর ভর দিয়ে হাঁটে, অকারণে শরীর দোলায়, কথা বলতে না পারা বা যে শিশু আগে কথা বলতো পরবর্তীতে কথা বলা বন্ধ করে দেয়া, অস্থির প্রকৃতির ইত্যাদি।
প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু সংকেত দেখে অটিজম হতে পারে সন্দেহ করা যায়-
রেড ফ্ল্যাগ-লাল সংকেত
১/ ৬ মাস বয়সে যদি কোন শিশু ভাল ভাবে আনন্দ প্রকাশ করতে না পার। ে
২/ ৯ মাস বয়সে যদি কোন শিশু শব্দ বা ডাক শুনে যথাযথ সাড়া না দেয়।
৩/ ১২ মাস বয়সেও কথা বলতে না পারা এবং কোন রকম চাহিদা প্রকাশ করতে না পারা।
৪/ ১৬ মাস বয়সের মধ্যে কোন চাহিদা প্রকাশ করতে না পারা।
৫/ ২৪ মাস বয়সের মধ্যে দুই শব্দের অর্থপূর্ণ বাক্য বলতে না পারা।
৬। বলতে পারা কথা বন্ধ করে দেওয়া
কোন শিশুর মধ্যে এসব অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গেলে তার অটিজম আছে কিনা জেনে নিতে হবে।
অটিজম আছে কিনা তা জানতে কোথায় বা কার কাছে যাবেন
যাওয়া উচিত নিউরোডেভালপমেন্টাল পেডিএট্রিশিয়ানের কাছে। আমাদের দেশে এর সংখ্যা খুবই নগণ্য। প্রাথমিকভাবে অটিজম সনাক্ত করেন শিশু চিকিৎসক তাই কোন শিশুর মধ্যে উক্ত কোন অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন, যিনি আপনার কথা মন দিয়ে শুনবেন, শিশুকে পর্যবেক্ষণ করবেন এবং যথাযথ পরামর্শ প্রদান করবেন।
পরবর্তীতে শিশু মনোবিজ্ঞানী এবং অকুপশেনাল থেরাপিস্ট নিবিড় পদ্ধতিগত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অটিজম নিশ্চিত করেন। অটিজম নির্ণয়ের জন্যকোন ল্যাবরোটরি পরীক্ষা নেই । অটিজম সনাক্তকরণ হয় আচার আচরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিশেষ পদ্ধতিতে। আমাদের দেশে এই সেবা খুবই অপ্রতুল । এই সেবা দিয়ে আসছে হাতে গোনা কয়েকটি সেন্টার যেমন-
সেন্টার ফর নিউরোডেভালাপমেন্ট ও অটিজম ইন চিলড্রেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
শিশু বিকাশ কেন্দ্র, বিভিন্ন্ সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অটিজম সনাক্ত করণে যথাযথ ব্যবস্থা আছে।
এছাড়াও সি আর পি (মিরপুর, ঢাকা) ও সি আর পি (সাভার, ঢাকা)-তে এই কাযক্রম চালু আছে।
অটিজমের কারণ কি?
সঠিক কোন কারণ এখনো পর্যন্ত জানা নেই, তবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে এর জন্য দায়ী ক্রোমোজোম বা জিন-গত সমস্যা।
পরিবেশগত সমস্যা (এনভায়রালমেন্টাল পলিউশান) তার সাথে কোন কোন ক্ষেত্রে মনে করা হয় ইমোনলজিক্যাল ফ্যাক্টর।
অটিজমের ভয়াবহতা
যদিও আমাদের দেশে অটিজম আক্রান্তদের সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই, সি.ডি.সি. আমেরিকার সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী এখনো পযর্ন্ত সারা বিশে প্রতি ৮৭জন শিশুর মধ্যে ১জন অটিজম আক্রান্ত ও প্রতি ৫৪জন ছেলে শিশুর মধ্যে ১জন অটিজম আক্রান্ত।
উত্তর কোরিয়াতে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ৩৯জন শিশুর মধ্যে ১জন অটিজম আক্রান্ত। সারা বিশ্বে আক্রান্তদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ের আনুপাতিক হার ৪ঃ১। আক্রান্তের এই ভয়াবহতাকে জাতিসংঘ মহামারী রূপে চিহ্নিত করেছে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে ২০০৭ সালে ২রা এপ্রিল কে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসাবে উৎযাপনের জন্য ঘোষণা করেছে।
পরিবারে একটি শিশুর অটিজম সনাক্ত হওয়া ঃ অটিজম শব্দ টি একটি পরিবারের জন্য বজ্রাঘাত বা সুনামির মত। কারণ, এখনো পর্যন্ত এর কোন ওষুধ বা যাদুকরী চিকিৎসা আবিষ্কার সম্ভব হয়নি।
তাহলে করণীয় কি?
প্রয়োজন প্রাথমিক পর্যায় থেকে কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করা, পরিবারে সবার সহযোগতিার হাত প্রসারতি করা। শিশুটির দৈনন্দিন প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজন-
চাইল্ড সাইকোলজিস্ট
অকুপেশনাল থেরাপিস্ট
স্পিচ ল্যাঙ্গুইজ প্যাথলজিস্ট
স্পেসাল এডুকেটর
বিশেষায়িত স্কুলে বা সাধারণ স্কুলে যেখানে সাধারণ শশিুদের ও অটিজম শিশুদেরকেও বিশেষ ব্যস্থাপণায় শিক্ষা প্রদান করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে থেরাপিস্ট এবং বিশেষায়তি স্কুলের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া স্বল্প শিক্ষিত থেরাপিস্ট বা প্রশিক্ষক নামধারী অনেকেই অটিজম আক্রান্ত শিশুদের প্রশিক্ষণের নামে প্রশিক্ষণ বাণিজ্য করছে এ ব্যাপারে অভিভাববক এবং সমাজের সবার সচেতনতা একান্তভাবে কাম্য। শিশু বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
শিশু বিশেষজ্ঞ অটিজম বিষয়টি যুক্তিযুক্ত ও ইতিবাচক ভাবে অবভিাবকের কাছে তুলে ধরতে পারেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে যথাযথ সাহায্য করতে পারেন।
অটিজম সনাক্তকরণের পর প্রতিটি অটিজম আক্রান্ত শিশুর জন্য তার ক্ষমতা অনুযায়ী পরিবারে একটি গঠনমূলক কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। পরিবারের স্বাভাবিক রুটিনের সাথে পরিবারের সকলের অংশ গ্রহণ খুবই জরুরি। প্রতিটি অটিজম আক্রান্ত শিশু স্বতন্ত্র¿, তাই তাদের প্রশিক্ষণের রুটিনও হবে ভিন্ন ভিন্ন। ধাপে ধাপে কাজ শুরু করতে হবে খেলার ছলে।
শিশুর অর্জিত দক্ষতা কে প্রশংসা করতে হবে, তিরষ্কার বা মারধর করা যাবে না।
প্রয়োজনে থেরাপিস্টের সহায়তা নিতে হবে। শিশুটির ভাই বোন থাকলে তাদের সহযোগতিা নিতে হবে এবং সমভাবে স্বাভাবিক শিশুটিকেও সময় দিতে হবে। শিশুটির সামাজিকতা বৃদ্ধির জন্য আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে ও তাদেরকেও আসতে উৎসাহতি করতে হবে। সম্ভব হলে যত দ্রুত সম্ভব উপযুক্ত বিশেষায়িত স্কুলে ভর্তি করাতে হবে।
এসব বিশেষ শিশুর সাথে কাজগুলো দুভাবে করা যায়- ওয়ান ইস্টু ওয়ান পদ্ধতি ও দলগতভাবে। শিশুটির যোগাযোগ ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনার কোন বিকল্প নেই এবং এই কর্ম পরিকল্পনা স্কুল ও বাসার সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। প্রতিটি কাজের সাথে যথাযথ শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করতে হবেযেমন- ছবি , ব্লক ইত্যাদি। এই বিশেষ শিশুর সবচেয়ে বড় প্রশিক্ষক তার বাবা-মা। সেজন্য্ অটিজম বিষয়ে বাবা-মার প্রশিক্ষন অত্যাবশ্যক।
শিশুর উপযুক্ত স্কুল খুঁজে নিন
অটিজম তীব্রতার উপর নির্ভর করে স্কুল হতে পারে বিশেষায়িত অথবা সাধারণ এক্সক্লুসিভ স্কুল। এখানে সকলের জানা দরকার আমাদের দেশে বিশেষায়তি স্কুল মাত্র কয়েকটি তাও আবার ঢাকা, চট্টগ্রামের মত বড় শহরে। গ্রামে গঞ্জে এ ধরনের কোন স্কুল নেই।
এসব স্কুলের মান যেমন ভিন্ন তেমনি অনেক ব্যয়বহুল প্রতিটি অভিভাবকের এই ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। তাই বর্তমান সময়ে প্রয়োজন অটিজমের ভয়াবহতা নিরিখে প্রতিটি সাধারণ স্কুলে এইসব বিশেষ শিশুদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ। এই বিশেষ শিশুদের প্রশিক্ষণ দেশে বিদেশে সর্বত্র ব্যয়বহুল, তাই সরকারী ও বেসরকারি পর্যায়ে সার্বিক সহযোগতিা প্রয়োজন, যেমন- অটিজম আক্রান্ত পরিবারের আয়করের ব্যাপারে বিশেষ ছাড় এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রশিক্ষণে বেসরকারি উদ্যোগ। আমেরিকার মত দেশে প্রতিটি অটিজম আক্রান্ত শিশুর জন্য বছরে প্রতি পরিবারের ৬০,০০০ ডলার খরচ হয়।
সুতরাং আমাদের দেশে প্রয়োজন এসব শিশুর জন্য গ্রামে ও শহরে সমভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। নিত্য নতুন তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে এই বিষয়ে অনেক নতুন নতুন ধ্যান ধারনা অর্জন করা সম্ভব।
বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অটিজম বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি সম্ভব। অটিজম আক্রান্ত শিশুর অভিভাবকরা সুসংগঠিত হয়ে নিজেদের মধ্যে ভাব আদানপ্রদানের মাধ্যমে এসব শিশুর শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনে সক্রিয় ভুমিকা রাখতে পারেন,সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধিতে হতে পারেন বড় এডভোকেট।
পরিশেষে, এইসব শিশুদের বোঝা না ভেবে এদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম করে তোলাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রতিটি পিতামাতার অন্যতম দুশ্চিন্তা, তাদের অবর্তমানে এই বিশেষ শিশুদের দায়িত্ব নেবে কে? কারণ অটিজম যেমন হতে পারে মৃদু তেমনি মারাত্মক। এমনকি যথাযথ প্রশিক্ষণ পাওয়ার পরও এদের প্রায় ৬০-৮০ শতাংশ নিজে একক ভাবে চলার দক্ষতা অর্জন করতে পারেনা সারাজীবন অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।
আমাদের দেশেও প্রাপ্তবয়স্ক পর-নির্ভরশীল অটিজম আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এখন থেকে প্রয়োজন এদের পুনর্বাসনের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া। এব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া অতীব জরুরি।
তাই প্রতিটি অটিজম আক্রান্ত্র শিশুর অভিভাবকের আকুল আহবান, সবাই সচেতন হোন সাহায্যের হাত প্রসারিত করুন। অটিজম পরিবারের সহায়তায়- যথাযথ পদক্ষেপ এবং কর্মপরিকল্পনা একান্ত ভাবে কাম্য।
লেখক :ডা. বাসনা মুহূরি |
সহযোগী অধ্যাপক, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।