আমার অনুমতি ছাড়া এই ব্লগের লেখা কোথাও প্রকাশ করা যাবে না। ৭ মে, ২০০২. আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের সবচেয়ে স্মরনীয় দিন। এদিন আমরা ২৫তম ব্যাচের পঞ্চাশজন কিশোর মনের মধ্যে ভয়, উৎকন্ঠা, কৌতুহল আর গর্ব মিশ্রিত আশ্চর্য এক অনুভূতি নিয়ে প্রবেশ করেছিলাম পাবনা ক্যাডেট কলেজ অঙ্গনে। ঠিক সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল আমার ক্লাশ সেভেনের দুঃসহ দিনগুলো। ক্যাডেট কলেজে ক্লাস সেভেনের সময়টা যে কত কষ্টের সেটি আমি সেদিন থেকেই খুব ভালভাবে বুঝেছিলাম।
ক্যাডেট কলেজ সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা পাওয়ার আগেই আমার cadet life- এর দ্বিতীয় দিনেই আমার গাইড আজহার ভাইয়া আমাকে পাঙ্গাইছিল। কারন আমি প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে রুমের বাইরে গিয়েছিলাম। আরে ভাই, আমি তো নিজের প্যান্টের পকেটে হাত দিয়েছি, অন্যের পকেটে তো দেইনি। এতে punishment দেয়ার কি আছে? কিন্তু পরে বুঝলাম ক্যাডেট কলেজের জীবনটা খুবইইই কঠিন। এখানে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে কিছু নেই।
এরপর প্রায় প্রতিদিনই ক্লাস এইটের ভাইয়ারা আমাদের উপর punishment নামক Steam Roller চালাতো। দেখতে দেখতে আমাদের জীবন অতিষ্ট হয়ে গেল। প.ক.ক. অর্থাৎ “পাবনা ক্যাডেট কলেজ” কে মনে হতে লাগলো “পাবনা কেন্দ্রীয় কারাগার। ” ভাবতাম, কবে মুক্তি পাব এই আজিব কারাগার থেকে।
ঠিক সেই সময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন Assistant house Prefect পারভেজ ভাইয়া।
তার কাছে আমরা পেয়েছি বড় ভাইয়ের স্নেহ-ভালোবাসা। ক্লাস সেভেনের সময়টা যে শুধু punishment এর উপর দিয়েই গেছে তা কিন্তু নয়। সে সময় আমরা অনেক মজাও করতাম। মাঝে মাঝে আমরা মোজার বল দিয়ে রুমে ক্রিকেট-ভলিবল খেলতাম। মনে পড়ে ক্লাস সেভেনের সেই রাতটির কথা, রাত ২টার পরে আমরা ২০২ এবং ২০৩ নং রূমের অধিবাসীরা শ্যাম্পু গোলানো পানি দিয়ে এক রুম থেকে অন্য রুম ভিজিয়ে দিয়েছিলাম।
২০৩ নং রুমের দেয়ালের সেই কালো দাগটি আজও সেই রাতের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। এখনো মনে পড়ে আইয়ুব ও মামুনের সেই রেসলিং এর কথা। মাঝে মাঝে যখন আশীষ ভাইয়া, রুহুল ভাইয়া, সিরাজ ভাইয়া রুমে এসে গল্প করত কিংবা জুনিয়র প্রিফেক্ট রহমত ভাইয়া এসে “চাপাবাজি” করত তখন ভাবতাম ভালোই তো এই জীবন।
ক্লাস সেভেনে যখন সিনিয়ররা punishment দিত তখন ভাবতাম আমি আমার জুনিয়রদের কখনোই punishment দেব না। অথচ সেই আমিই আবার নতুন জুনিয়র আসার পর সবচেয়ে বেশি punishment দিয়েছি।
এজন্য অবশ্য House Prefect শাহরিয়ার ভাইয়া কাছে অনেক পাঙ্গা খেয়েছি। Oh sorry, আমি একাই না। আমরা তিন রুমমেট, আমি জেসান ও সাদাত। এমন কোন দিন খুজে পাওয়া যেত না যেদিন এই ত্রিরত্নকে শাহরিয়ার ভাইয়া, সিরাজ ভাইয়া অথবা মফিজুর ভাইয়া punishment দিত না।
ক্লাস নাইনের সময়টা হল বিভিন্ন Games & Sports- এ নিজেকে প্রমাণ করার সময়।
এসময় আমি অবাক হয়ে দেখেছি রাসেল, ইশতিয়াক, মামুনের নিপুন ভলিবল শিল্প। ফুটবল খেলার সময় রশীদের পায়ের নৈপুন্য দেখে মনে হতো ভবিষ্যতে ও হবে একজন জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়ার। Inter House Cricket Competition- এর সময় রেজওয়ান যখন অবলীলায় ছয়-চার মারত তখন তার সামনে সব বোলারকেই অসহায় মনে হত। ভাবতে অবাক লাগে জামানের মত Swimmer আর কখনো অংশগ্রহণ করবে না কোন Swimming Competition- এ। মাহমুদ, রকিব, রেজওয়ান, সাদাতের মত Runner দের আর দেখা যাবেনা পাবনা ক্যাডেটের ট্র্যাকে।
মেহরান, ফারুক, ইকবালের মত বাস্কেটবল প্লেয়ারদের দেখা যাবে না কোন বাস্কেটবল প্রতিযোগিতায়। আর হকি খেলতে দেখা যাবেনা আব্দুল্লাহ, নূরের মত হকি প্লেয়ারদের। হাসিব তার ভাঙা পা নিয়ে আর কখনোই এই মাঠে ফুটবল খেলবে না। গোলকিপার ইসলাম আর কখনোই Easy গোল খেয়ে বলবে না “গোলটা Save করা খুবইইই কঠিন ছিল। ” ফুটবল খেলার সময় আসিফ আর কাউকে ইচ্ছা করে kick করে বলবে না,“আমার সামনে থেকে বল নিয়ে যায়, সাহস কত!!!!”
Class Ten এ ওঠার পর অবাক হয়ে লক্ষ করেছি আমাদের ব্যাচের হঠাৎ করে বদলে যাওয়াটা্।
এই সেই ব্যাচ, ক্লাস নাইনে থাকতে রফিকুল ইসলাম স্যার যাদের আখ্যায়িত করেছিলেন তার দেখা সবচেয়ে দুষ্টু ব্যাচ হিসেবে। আমাদের যন্ত্রণায় কলেজের শিক্ষকরা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের দুষ্টুমির কথা ছিল স্যার-ম্যাডামদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এখনো মনে পড়ে একাডেমি পিরিয়ডের সময় মাসুদ, ইকবালের সেইসব দুষ্টুমির কথ। সবচেয়ে মজা হত নাদিরা ম্যাডামের ক্লাসে জেসান, মোহাইমিন, মেহেদী, রোমান জোকস করত আর ম্যাডাম ‘এই ছেলে, এই!’ বলে ধমক দিতেন।
মনে পড়ে কত প্রেপ যে নষ্ট করেছি ফারুক, আবিদের সাথে বোরিং জোক করে। সামান্য কোন ঘটনা নিয়ে সম্পূর্ণ অকারনে শাহাদুজ্জামানের সাথে কত যে মারামারি করেছি, কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি, আবার প্রেপ শেষে একজন আরেকজনের কাধে হাত দিয়ে একসাথে হাউসে গিয়েছি। প্রেপ টাইমের বোরিং সময়গুলোতে মনির ও সায়েমের জোকস গুলোর কথা আমি কোনদিনও ভুলতে পারব না। মনে পড়ে কত পিরিয়ডের পর পিরিয়ড ক্লাস ফাঁকি দিয়ে টয়লেটে গল্প করেছি আমি, মাসুদ, শাহাদুজ্জামান, ইকবাল, ইমরান, তায়িফ, জেসান, মোর্শেদ, নাফিস, আশফাক, তানভীর, আরাফাত সহ আরও অনেকে।
ভাবতে অবাক লাগে, নূর-রকিবের ভরাট কন্ঠে কবিতা আবৃতি আর মোনা হবে না।
আর কোন Cultural Night- এ Mr. Bean অভিনয়ের জন্য কন্ঠ দেবে না আনিস, অভিনয় করবে না ইফতেখার, রায়হান, মেহরান, শাহরিয়ার। ২৫তম ব্যাচের ব্যান্ড দলের ড্রামার সাইদ, বেজ গিটারিস্ট রোমান, লীড গিটারিস্ট ফারুক,কিবোর্ডিস্ট রাসেল, ভোকাল ইমরান আর কোনদিন Perform করবে না মোস্তফা মিলনায়তনের মঞ্চে। জেসান তার ট্রেডমার্ক ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটি নিয়ে আর উপস্থিত হবে না আমাদের সামনে। শোভনের লেখা কোন কবিতা আর কোনদিন ছাপা হবে না কলেজের প্রসূণ বা বার্ষিকীতে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, ইশ আমি যদি আবার সেই Candidates’ time- এ ফিরে যেতে পারতাম।
নিঃসন্দেহে সেই সময়টা ছিল আমাদের Cadet Life- এর সবচেয়ে মজার সময়। মনে পড়ে কত রাত যে না ঘুমিয়ে শুধু গল্প করে কাটিয়েছি আমি, জেসান, আতিক। ২৩তম ব্যাচের সাথে বিদায়ের আগের দিন ২৩৬নং রুমের সেই আড্ডামুখর রাতের কথা আমার মনে থাকবে চিরকাল। সেইরাতে নাসিম ভাই, রাহাত ভাই, মুক্তাদির ভাই, সজিব, মামুন, রেজওয়ানের কান্না দেখে আমিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি, সেই রাতেই আমি বুঝেছিলাম আমরা ক্যাডেটরা একজন আরেকজনের কত আপন।
English Department এর প্রাক্তন প্রভাষক রফিকুল ইসলাম স্যার একদিন ক্লাসে বলেছিলেন, “Life is just like an intercity train. অর্থাৎ জীবনটা একটা আন্তঃনগর ট্রেনের মত।
সবাই চায় জীবন নামের সেই ট্রেনের first class compartment এ উঠতে। কিন্তু কেউ পারে, কেউ পারে না। ” আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরে আমাদের নামতে হবে সত্যিকারের জীবনযুদ্ধে। জীবন নামের সেই ট্রেনের জন্য আপেক্ষা করছি আমরা ২৫তম ব্যাচের ৪৮ জন।
আমরা সবাই এই ট্রেনের first class compartment- উঠতে চেষ্টা করব। কিন্তু সেটি হয়তো বা সম্ভব নাও হতে পারে। আমাদের ভিতর কেউ হয়তো first class compartment এ উঠতে পারবে, কেউ পারবে না। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার প্রার্থনা, আমরা ২৫তম ব্যাচের সবাই যেন জীবন নামের এই ট্রেনের first class compartment এ উঠতে পারি, সবাই যেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারি।
যখনই ভাবি আর মাত্র কয়েকদিন পরেই এই কলেজ ছেড়ে চলে যেতে হবে, তখনই কি জানি এক অজানা কষ্টে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
এই কলেজে এসেই আমি পেয়েছি শাহাদুজ্জামান, মেহরান, শফিক, মাহমুদ, মুহিব, সোহেলের মত ভাল বন্ধু। কলেজ থেকে চলে যাবার পর এদের অনেকের সাথে হয়তোবা কোনদিনও দেখা হবে না। অনেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে চলে যাবে। জহির, রায়হান, মামুন, মুরাদ. আসিফ, আমিন,রেজোয়ানের মত super brilliant রা হয়তো বা ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে। তারপরও জীবনের চলার পথে এদের অনেকের সাথেই হয়তো দেখা হবে।
১০-১৫ বছর পর হয়তো সাইদের সাথে দেখা হবে ইতালির কোন ক্যাফেতে কিংবা ইকবালের সাথে দেখা হবে থাইল্যান্ডের কোন রাজপথে।
৩১তম ব্যাচের কলেজে যোগদানের দিন তাদের দেখে আমার মনে হয়েছিল এই সেদিনই তো আমরা তাদেরই মত নবাগত ক্যাডেট হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম এই পবিত্র শিক্ষাঙ্গনে। দেখতে দেখতে ছয়টি বছর পার করে আজ আমরা Cadet life এর শেষ প্রান্তে। আর কিছুদিন পর আমাদের এই প্রাণপ্রিয় শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমরা চলে যাবার পরেও প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে ডিউটি ক্যাডেটের ডাকে সমস্ত ক্যাডেটের ঘুম ভাঙবে, স্টাফের বাশিতে সবাই পিটিতে যাবে, পিটি শেষে ব্রেকফাস্ট করে সবাই একাডেমিতে যাবে।
বিকেলে গেমস, সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ, রাতের প্রেপ সহ কলেজের সমস্ত কর্মকান্ডচলবে তাদের নিজস্ব গতিতে। সবই ঠিক থাকবে, শুধু থাকবে না ভালবাসার ২৫তম ব্যাচ, আমরা ৪৮ জন। কলেজ থকে চলে যাওয়ার সময় এই কলেজকে এবং কলেজের সব ক্যাডেটকে দিয়ে যাব আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, আমার ভালবাসা, আর নিয়ে যাবো আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়, আমার কৈশোর এবং তারুণ্যের অসংখ্য স্মৃতি।
আজ শুধু মনে হচ্ছে, কত পূর্ণিমার রাতে না ঘুমিয়ে করিডোরের গ্রিলের ফাক দিয়ে মুগ্ধ হয়েদেখেছি কোমল চাঁদের আলোয় মাখা আমাদের এই প্রাণপ্রিয় কলেজকে। তখনতো মনে হয়নি এই রাত আর কোনদিন ফিরে আসবে না আমার জীবনে, তখনতো ভাবিনি এই রাত দিয়ে যাবে এমন দুঃখের আচড়।
আগে ভাবতাম কবে এই কারাগার থেকে মুক্তি পাব, আর আজ এই কলেজ ছেড়ে চলে যেতেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট । এই কষ্ট বিদায়ের, এই কষ্ট কলেজ ছেড়ে চলে যাওয়া, যেই কলেজ আমাকে মায়ের মত আগলে রেখেছে ছয় ছয়টি বছর। Cadet life এর গোধুলী লগ্নে এসে আমি মাঝে মাঝে এইসব পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করে দীর্ঘশ্বাস ফেলি আরিএকটা কথাই শুধু ভাবি,“দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না। ”
পুনশ্চঃ এই লেখাটি আমি লিখেছিলাম ২০০৮ সালের ২৫ মে, কলেজ থেকে চলে আসার মাত্র কয়েকদিন আগে। এটি এতদিন ডায়রিবন্দী ছিল।
দু’দিন আগে আমার মনটা অনেক খারাপ ছিল, কেন জানি বারবার কলেজের কথা মনে পড়ছিল। কলেজের কথা মনে হলেই আমি এই ডায়রিটা বের করে পড়ি। পড়তে পড়তেই হঠাৎ আমার মাথায় আইডিয়াটা এল।
By Hasan (Ex _PCC) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।