মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত। শত বিপ্লবীর কথা : শহিদুল ইসলাম
ভোরের কাগজ / মুক্তচিন্তা : ০৭/০৫/২০১২
আমার যতোদূর মনে পড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রথম বিপ্লবীর যে নামটি আমার কানে আসে, তিনি হলেন ক্ষুদিরাম। তারপর তো তার নামের সেই বিখ্যাত গানটি আমাদের কণ্ঠস্থ হয়ে যায়। এরপর যার নাম আমার কানে আসে তিনি হলেন সূর্যসেন। এরপর একে একে জগৎ সিং, প্রফুল্ল চাকী, সুভাষ চন্দ্র বসু, ইলা মিত্র প্রমুখ বিপ্লবীদের কাহিনী আমি জানতে পারি।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে হাসতে হাসতে তারা তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে গেছেন। তখন আমার মনে যে প্রশ্নটি জাগে তাহলো ঐসব নামের বিপ্লবীরা তো সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। মুসলমান নাম তখন পর্যন্ত আমার একটাও জানা ছিল না। যারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। প্রশ্ন জাগে মুসলমান সম্প্রদায় কি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি? এ নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করতে গেলে দেখতাম তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না।
যারা ‘লাড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ সেøাগানে শরিক হয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ পঞ্চাশের দশকের শেষভাগেও বলতেন ‘ও তুমি বুঝবে না। পাকিস্তান না হলে ইংরেজ চলে গেলে ভারতবর্ষ পুরো হিন্দুদের দখলে চলে যেতো। তাই মুসলিম লীগ ও তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা জিন্নাহ ইংরেজ শাসকদের সমর্থন করেছিলেন। তাই ভারতবর্ষের মুসলমান সম্প্রদায় ইংরেজ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমর্থন করেনি। ’ প্রশ্ন করতাম, তাহলে কি মুসলমানরা ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করতো?’ অনেকেই এ প্রশ্নের সম্মুখে বিব্রতবোধ করতেন।
ক্রমে জানতে পারি ‘হ্যাঁ, মুসলিম লীগ ও জিন্নাহ সাহেব ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ সমর্থন করেছিলেন। ’ এ খবরে আমি ভীষণ লজ্জিত হয়েছিলাম। তাই সমগ্র পাকিস্তান আমলে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী নেতাদের নাম এ দেশে উচ্চারিত হতে শুনিনি।
স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম সূর্যসেনের নামে করাটা বেশ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রে সংবিধান অনুসারে যেমন মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীর মানুষ সে দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না, তেমনি ব্রিটিশ সামাজ্যবাদ বিরোধী ওই বিপ্লবীদের নামে রাস্তাঘাট, হল, স্কুলসহ কোনো কিছুর নামকরণ করাও সম্ভব ছিল না।
পাকিস্তান ছিল মুসলমানদের রাষ্ট্র। সে সময় ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের ইতিহাস ছিল এ দেশে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ হওয়ার পর অবস্থার তেমন উন্নতি হয়েছে মনে হয় না। এ দেশে কোনো কিছুর নামকরণ করতে গেলে আজো মুসলমানের নাম খোঁজা হয়। দেশে যদি তেমন বিখ্যাত নাম খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আরবি নাম ধার করতে হয়।
এ দেশে আজো ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের গল্প বা ইতিহাস শেখানো হয় নাÑ শোনানো হয় না। কিন্তু এ দেশের যুব সমাজের মাঝে সে নামগুলোর প্রতি এক শ্রদ্ধার জায়গা আছেÑ তৈরি হচ্ছে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের ইংরেজপ্রীতি এ দেশের প্রগতিশীল যুব সমাজকে আজ লজ্জার মাঝে ঠেলে দেয়। এ নিয়ে আমার মনে সেই ছোটবেলা থেকে এক ক্ষোভ লুকিয়ে আছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জায়গা নেইÑ এ যে কতো বড় লজ্জা, তা দেশপ্রেমিক নাগরিকরাই জানেন।
দুই. তবে আমাদের সে লজ্জার কথা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আর মানতে রাজি নয়। ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত নির্বিশেষে ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের কথা স্মরণ করতে চায় তারাÑ তাদের প্রতি বীরের সম্মান জানাতে চায়। এটা শুভ সংবাদ। এ দেশের মানুষ পাকিস্তান নামক একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ধ্বংস করেছেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বীজ উচ্ছেদ হয়নি।
স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতাদের স্মরণ করে, আমাদের পূর্ব পুরুষের লজ্জার ইতিহাস থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে। সে বিপ্লবে সেদিনের মুসলমানরা অংশগ্রহণ না করে যে পাপ করেছিল, আজকের নতুন প্রজন্ম সে পাপ মোচন করতে চায় এবং সেইসব বীর বিপ্লবীদের ইতিহাসে অংশগ্রহণ করতে চায়। তেমনি একটি প্রয়াস নিয়ে এগিয়ে চলেছে ‘বিপ্লবীদের কথা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ২০০৯ সাল থেকে তারা ‘বিপ্লবীদের কথা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করছেন। পত্রিকার মূল লক্ষ্য সম্পর্কে সম্পাদক শেখ রফিক আমাদের জানাচ্ছেন ‘বাংলা এবং ভারতীয় উপ-মহাদেশের ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে সমকালীন বিপ্লবীদের জীবনী এবং তাদের আদর্শের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দেয়া।
’ ২০১০ সালে তারা বিপ্লবীদের একটি এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করে http://www.biplobiderkotha.com ওয়েবসাইট। এদের দর্শনের জায়গাটি নতুন। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস কেবল পাকিস্তানি ২৪ বছরের মধ্যে সীমিত রাখতে চান না। চান না কেবল বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বন্দী রাখতে। তাই ২০১২ সালে তারা ‘শত বিপ্লবীর কথা’ নামে ৫৯১ পৃষ্ঠার এক বড় বই প্রকাশ করেছেন।
সে ১০০ বিপ্লবী বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ নন। তারা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে ছড়িয়ে আছেন। ১৯৮২ সালে ১ মার্চে জন্ম নেয়া তরুণ শেখ রফিক। একেবারেই বাচ্চা ছেলে। ২০০৮ সালে সে মুকুন্দ দাসের ওপর প্রথম বই প্রকাশকালে আমার একটা ভূমিকার জন্য এসেছিল।
২০১২ সালের মধ্যে শেখ রফিক ও তার কজন সমবয়সী বন্ধু আরো দুখানা বই প্রকাশ করেছে। বিশ্বাসের শেকড় কতোটা শক্ত হলে এটা সম্ভব। ‘মুকুন্দ দাস রচনাসমগ্রের’ (২০০৮) পর যে ছটি বই প্রকাশ করেছে শেখ রফিক সেগুলোর নাম জানিয়ে রাখি। ‘বিপ্লবী নলিনী দাস রচনাসমগ্র’ (২০০৯); সরদার ফজলুল করিমের অগ্রন্থিত প্রবন্ধ সংকলন (২০০৯), সঙ্গ-প্রসঙ্গের লেখা : সরদার ফজলুল করিমের অগ্রন্থিত প্রবন্ধ (২০১২); অগ্নিযুগের বিপ্লবী জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ (২০১১); জিতেন ঘোষ স্মরণ সংখ্যা (২০১২) ও সর্বশেষ- শত বিপ্লবীর কথা (২০১২) ও খাপড়াওয়ার্ড : উপমহাদেশের প্রথম জেল হত্যাকাণ্ড। এ সবগুলো বই-ই সম্পাদনা করেছে শেখ রফিক।
তার সঙ্গে আছে একঝাঁক তরুণ বন্ধু। নেলসন, মীর মোশাররফ হোসেন, অভিনু কিবরিয়া ইসলাম, মিফতাহুর রহমান চৌধুরী, রাশেদুন্নবী সবুজ, মাহাবুব হাসান, কামরুস সামাদ সংসদ, মুজাহিদুল ইসলাম উইন, সুবীর নন্দী, রিয়াদ রিয়াজ খান, মিতুল, রাতুল প্রমুখ। খুবই আশার কথা। অগ্নিযুগের নায়কদের স্মরণ করার জন্য এতোজন টগবগে যুবক কাজ করে চলেছে। তাদের সবার প্রতি আমার ব্যক্তিগত আশীর্বাদ ও কৃতজ্ঞতা।
তাদের এই প্রয়াস কেবল সেইসব বীরদেরই যুব সমাজের সামনে নিয়ে আসবে তাই নয়, এ ধরনের ইতিহাস রচনা সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজাল ভাঙতেও সাহায্য করবে। তাদের এ কাজের গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী।
তিন. এবারে ‘শত বিপ্লবীর কথা’ সম্পর্কে দুচারটি কথা। বিপ্লবী বলতে আমরা সাধারণত মার্কসবাদী ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদেরই মনে করে থাকি। আলোচ্য বইটিতে যে একশ জনের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে, তারা বিভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী।
কেউ যে কমিউনিস্ট ছিলেন না, তা নয়। তবে এ বিপ্লবীদের এক জায়গায় মিল রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জায়গাটিতে তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ। তাদের পথ ভিন্ন হতে পারে। তাদের সবার রাজনৈতিক ভাবাদর্শের সঙ্গে সব পাঠকের ঐকমত্য আছে বা থাকতেই হবে এমন নয়।
এ সংকলনের শুরুতেই যেমন মঙ্গল পান্ডে জায়গা পেয়েছেন, তেমনি স্থান পেয়েছেন জ্যোতি বসু। এছাড়া জীবন্ত কিংবদন্তি বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী, জসিমউদ্দিন ম-লও স্থান পেয়েছেন এ বইটিতে। সত্যের পূজারী শহীদ কানাইলাল দত্তের কথা দিয়ে বইটি শেষ করা হয়েছে। নানা বিশ্বাসে বিশ্বাসী মানুষ এরা। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর এ দেশের মানুষ এদের কথা মনে রাখেনি।
শত বিপ্লবীর কথা বইটি প্রায় ৬৫ বছর সেই ভুলে যাওয়া বিপ্লবীদের জাতির সামনে তুলে ধরেছে। এ কাজের গুরুত্ব কোনো ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না। রফিককে যখন ব্যক্তিগতভাবে আমাদের অপারগতার কথা জানিয়ে তাকে ও তার বন্ধুদের ধন্যবাদ জানাই, উত্তরে সে বলেছিল ‘স্যার আমরা যে যুবক। ’ আমরাও এক সময় যুবক ছিলাম। এ রকম কাজ যে করা দরকার, আমাদের সময় ছিল তার প্রতিকূলে।
বইটির ভূমিকা লিখেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বইটি প্রকাশ করেছেন প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। শেখ রফিকের সম্পাদনার গল্পটিও বেশ উপভোগ্য। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের মতো আমিও নিশ্চিত যে এই বইটি একটি বড় ধরনের কাজ। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।
শহিদুল ইসলাম : সাবেক অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।