এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয় ইন্ডিয়া থেকে বিদ্যুৎ আমদানি - দরপত্রে জামানত বাদ দেয়ার আবদার
আশরাফুল ইসলাম
তারিখ: ১০ এপ্রিল, ২০১৩
ইন্ডিয়ান বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির দরপত্র থেকে এবার জামানত রাখার বিধান বাদ দেয়ার আবদার করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) দেয়া এক চিঠিতে সে দেশের কোম্পানিগুলো এ আবদার করেছে। এর আগে ইন্ডিয়ার দাবির কাছে নতি স্বীকার করে সে দেশের রাষ্ট্রীয় কোম্পানিকে যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রির মুনাফার ওপর ১০ বছরের করমুক্তি সুবিধা দেয়া হয়েছে। পিডিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যুৎ আসুক আর না আসুক ইন্ডিয়া একের পর এক অযৌক্তিক দাবি করেই আসছে। দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও সেব আবদার মানা হচ্ছে।
ইন্ডিয়ান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এনটিপিসির কাছ থেকে আড়াই শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত ছাড়াও বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আরও আড়াই শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত ছিল। এ জন্য গত জানুয়ারি মাসে পিডিবি দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্রে একটি শর্ত ছিল, যেসব কোম্পানি দরপত্রে অংশগ্রহণ করবে, তাদের জামানত হিসেবে প্রতি মেগাওয়াটের জন্য এক কোটি টাকা করে জামানত দিতে হবে। কিন্তু এখন এ জামানত রাখার শর্ত দরপত্র থেকে বাদ দেয়ার জন্য পিডিবিকে চাপ দেয়া হচ্ছে। পিডিবির একজন কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, যেভাবে ইন্ডিয়ান কোম্পানিগুলোকে ছাড় দেয়া হচ্ছে, তাতে এটিও বাদ দেয়া হয় কি না তা নিয়ে সবার মধ্যে আলোচনা চলছে।
জানা গেছে, ২০১০ সালের শুরুর দিকে শেখ হাসিনার ইন্ডিয়া সফরের সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে এক সমঝোতা স্মারক হয়েছিল। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ইন্ডিয়া প্রতি বছর বাংলাদেশকে সাশ্রয়ী মূল্যে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে সম্মত হয়েছিল। তা ছাড়া যৌথভাবে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এর বিনিময়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ইন্ডিয়ার এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে পণ্য পরিবহনের সুবিধা চেয়েছিল তারা। ওই সময় তড়িঘড়ি করে বেশ কিছু পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবতা হলো এ সমঝোতা স্মারকের সাড়ে তিন বছর অতিবাহিত হতে চললেও ইন্ডিয়া থেকে এক ইউনিট বিদ্যুৎও বাংলাদেশে আসেনি। অথচ ইন্ডিয়া বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন সুবিধা ঠিকই ভোগ করে চলেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ সময়ে শুধু দুই দেশের মন্ত্রী ও সচিবপর্যায়ে বৈঠকের পর বৈঠকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বাংলাদেশের প্রাপ্য আদায়ের বিষয়গুলো। প্রথমে বলা হয়েছিল, ইন্ডিয়ার রফতানি করা বিদ্যুৎ ২০১২ সালের মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে আসবে। কিন্তু পরে দুই দেশের এক সচিবপর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ২০১২ সালের মার্চ নয়, ২০১৩ সালের মার্চে ইন্ডিয়ার সাশ্রয়ী মূল্যের বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জনগণ ভোগ করতে পারবেন।
২০১৩ সালের মার্চও ইতোমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু সাশ্রয়ী মূল্যের বিদ্যুৎ আজো পায়নি বাংলাদেশ।
বাড়তি মূল্যে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি : বলা হয়েছিল, ইন্ডিয়া সাশ্রয়ী মূল্যে বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করবে। ২০১১ সালের মার্চে দুই দেশের সচিবপর্যায়ে বৈঠক শেষে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সচিব আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, প্রথমপর্যায়ে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ইন্ডিয়ার সরকারি মূল্যে পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়পর্যায়ে ২৫০ মেগাওয়াট আমদানি করা হবে বাণিজ্যিক মূল্যে। ইন্ডিয়া যেখানে ভর্তুকি মূল্যে তাদের দেশে বিদ্যুৎ দেয়, সেখানে বাংলাদেশে ভর্তুকি মূল্যে তারা কী কারণে বিক্রি করবে এমন প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ সচিব জানিয়েছিলেন, ‘এটা মূলত বন্ধুত্বের খাতিরে তারা বিক্রি করবে।
বন্ধু যেমন বন্ধুর জন্য নদী পার হয়। ’
কিন্তু বাস্তবতা হলো ইন্ডিয়া থেকে বিদ্যুৎ আমদানির যে চুক্তি হয়, তাতে মূলত উচ্চমূল্যই পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি ইন্ডিয়ান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানির (এনটিপিসি) আওতাধীন কোম্পানি ন্যাশনাল বিদ্যুৎ ভিকাশ নিগামের সাথে পিডিবির আড়াই শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানিতে প্রতি ইউনিটের জন্য বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে গড়ে ৪ টাকা ৬৬ পয়সা। তবে তারা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ করলে প্রতি ইউনিটের জন্য পরিশোধ করতে হবে সাত টাকা থেকে ৯ টাকা।
গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ করা হলে প্রতি ইউনেটের জন্য পরিশোধ করতে হবে ৪ টাকা ৮০ পয়সা। আর সরকারি মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ করা হলে প্রতি ইউনিটের জন্য পরিশোধ করতে হবে আড়াই টাকা থেকে সাড়ে তিন টাকা। তবে তারা যেকোনো একটি থেকে সরবরাহ করতে পারে। এ অবস্থায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ করলে উচ্চমূল্য পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।
চুক্তির পর সংশোধিত ঘোষণায় বলা হয়েছিল এ বছর জুনের মধ্যে এ বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে।
ইন্ডিয়ার বহরমপুর থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পর্যন্ত ৪০০ কেভি হাইভোল্টেজ সাব স্টেশন ও সঞ্চালনলাইন নির্মিত হবে। সাব স্টেশন ও সঞ্চালনলাইন নির্মাণের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ঋণ নেয়া হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জুন মাস তো দূরের কথা, বর্তমান সরকারের মেয়াদের বাকি সময়ের মধ্যেও ইন্ডিয়া থেকে বিদ্যুৎ আসবে কী না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একের পর এক অযৌক্তিক দাবি : ইন্ডিয়ার সাথে যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও বিগত দিনে দেখা গেছে, একের পর এক অযৌক্তিক দাবি করা হয় ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে। প্রথমে বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল্য নিয়ে অযৌক্তিক দাবি করা হয়।
পিডিবি ইন্ডিয়ার এনটিপিসিকে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণের জন্য প্রাক-সমীক্ষা করতে দায়িত্ব দিয়েছিল। এনটিপিসি প্রাক-সমীক্ষা শেষে পিডিবির কাছে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ১৪ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করে। এনটিপিসি পুনরায় প্রাক-সমীক্ষা করে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য আট টাকা ৫৫ পয়সা করার ধারণা দেয়। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এনটিপিসি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মধ্যে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের যৌথ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হওয়ার আগে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পিডিবি কী দামে বিদ্যুৎ কিনবে, জ্বালানি হিসেবে কয়লার মূল্য কত হবে এসব বিষয় চূড়ান্ত করার কথা ছিল। কিন্তু পরে এ বিষয়ে এক মত না হওয়ায় মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হওয়ার পর মোট ব্যয় ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির মূল্য সমন্বয় করে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।
যৌথভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র করার কথা বলা হলেও জ্বালানি হিসেবে কয়লা আমদানির দায়ভার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে পিডিবির ওপর। তারা বলছে কয়লা কোথা থেকে আমদানি করা হবে তা নিষ্পত্তি করবে বাংলাদেশ।
সর্বশেষ তারা এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রি করে যে পরিমাণ মুনাফা করবে তার পুরোটাই দেশে নিতে কর রেয়াত সুবিধা চায়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথমে তা নাকচ করে দেয়া হলেও ইন্ডিয়া অনড় থাকায় পরে বিষয়টি সুরাহা করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়।
পিডিবির এক সূত্র জানিয়েছে, দেশের স্বার্থবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়ে ইন্ডিয়ান কোম্পানির এ অযৌক্তিক প্রস্তাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠানো হয়। ইন্ডিয়ার এ কোম্পানির আবদার প্রথমে সরাসরি নাকচ করে দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক সূত্র জানিয়েছে, ইন্ডিয়ার দাবিমতো করমুক্ত সুবিধা দিলে দেশে বিদ্যমান অন্য বিদেশী কোম্পানিগুলোও একই রকম আবদার করবে। এতে দেশ বিপুল অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে।
এনবিআর থেকে এ প্রস্তাব প্রথমে ফিরিয়ে দেয়া হলেও শুধু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনার জন্য এনবিআরের কাছে পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে পিডিবি সূত্র জানিয়েছে, ইন্ডিয়ান কোম্পানিকে করমুক্ত সুবিধা না দিলে তারা প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো চুক্তি করবে না। এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে অনড় থাকায় সর্বশেষ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পরে ১০ বছরের করমুক্তি সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক সূত্র জানিয়েছে, সরকারের এ সিদ্ধান্ত ইন্ডিয়ান কোম্পানিকে জানানোর পর প্রকল্প বাস্তবায়ন ও এ প্রকল্পের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ক্রয়ের ওপর দু’টি চুক্তি স্বাক্ষর করতে কোম্পানিটি সম্মত হয়েছে। আগামী ১৭ এপ্রিল থেকে চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
মূল এইখানেঃ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।