আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাহাত্তরে জন্ম নেয়া ব্যক্তি ’৭১ সালের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী

খলিলুর রহমানের জন্ম ১৯৭২ সালের ১৩ এপ্রিল। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে খলিলুর রহমান যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতে মাওলানা সাঈদী কর্তৃক ১৯৭১ সালে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটন তিনি নিজে দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে পাক হানাদার ও রাজাকার বাহিনী কর্তৃক হিন্দু সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক অনেকের দোকানপাট ও বসতবাড়ি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, নির্যাতনের অনেক ঘটনাও তিনি দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। মাওলানা সাঈদী ও অন্য রাজাকার কর্তৃক রইজ উদ্দীন পসারীর বাড়ি আগুনে দেয় এবং লুটপাটের ঘটনার তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেছেন জবানবন্দীতে। রইজ উদ্দীনের বাড়িতে লুটপাটের ঘটনা দেখার সময় মাওলানা সাঈদী তাকে ধাওয়া দেন বলেও উল্লেখ করেছেন।

অথচ জন্ম সনদ অনুযায়ী ১৯৭১ সালে তার জন্মই হয়নি। মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে খলিলুর রহমান যে জবানবন্দী দেন তাতে তিনি ১৯৭১ সালে তার বয়স উল্লেখ করেছেন ১৩-১৪ বছর। তবে খলিলুর রহমানের জন্ম সনদে জন্ম তারিখ লেখা রয়েছে ১৯৭২ সালের ১৩ এপ্রিল। ভোটার তালিকায় ও তার কর্মস্থলের তথ্য বিবরণীতেও জন্ম তারিখ একই লেখা আছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে যে ৬৮ জন মূল সাক্ষীর তালিকা জমা দেয়া হয়েছিল তাদের একজন ছিলেন এই খলিলুর রহমান।

তবে তার সাক্ষ্য দেয়া হয়নি শেষ পর্যন্ত। গত ৭ ডিসেম্বর মামলার বাদি মাহবুবুল আলম হাওলাদার আদালতে সাক্ষ্য দেন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে। ওই সময় তিনিও সাক্ষী খলিলুর রহমানের নাম উল্লেখ করেন ১৯৭১ সালের ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে। খলিলুর রহমান সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন ‘২ জুন সকাল বেলা আমি নিজ বাড়িতে ছিলাম। সাক্ষী খলিলুর রহমান খুব ভোরে আমার বাড়ি এসে গোপনে জানিয়ে দেয় যে, আপনি এবং আপনার ঘরে যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধারা আছে তাদের লিস্ট হয়েছে ধরার জন্য।

’ খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে ছয় মামলা খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জমিদখলসহ নানা অভিযোগে মামলা এবং থানায় জিডি করেছেন অনেক ভুক্তভোগী। তার বিরুদ্ধে মোট ছয়টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। একটি ফৌজদারি মামলায় তার এক বছর তিন মাসের সাজা হয় পিরোজপুর অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। পিরোজপুর সেশন জজ আদালত এবং হাইকোর্টও সে সাজা বহাল রাখেন। সর্বশেষ আপিল বিভাগে আবেদন করেন খলিলুর রহমান।

সাবেক প্রধান বিচারপতি রুহুল আমিন এবং অপর সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেনের বেঞ্চ আবেদনটি শুনানি শেষে খারিজ করে দেন। ফলে নিম্ন আদালত তাকে যে সাজা দিয়েছিলেন তা বহাল থাকে। রাষ্ট্রপতি বরাবর ক্ষমা প্রার্থনা খলিলুর রহমান ২০০৮ সালে রাষ্ট্রপতি বরাবর ক্ষমা প্রদর্শনের দরখাস্ত করেন। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। গত বছর আবারো খলিলুর রহমানসহ পাঁচজন আসামিকে ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর আবেদন পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।

এ উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে খলিলুর রহমানসহ পাঁচজনের বিষয়ে অবহিত করে ২০১১ সালের ২৪ জুলাই পিরোজপুর জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) কারা মহাপরিদর্শক বরাবর একটি চিঠি পাঠান। চিঠির শিরোনাম ছিল ‘কয়েদি নং ৪৯/এ মো: খলিলুর রহমানসহ ০৫ জনের ক্ষমা প্রদর্শনের কাগজপত্র প্রেরণ প্রসঙ্গে’। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আবেদনকারী কয়েদিরা ২৪-০৪-১৯৯৫ তারিখে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আগমন করেন এবং ২৪-০৫-১৯৯৫ তারিখে জামিনে মুক্তিপান। এরপর তারা আর কারাগারে আগমন করেননি। তাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করা হয়েছে এবং মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রেরণ করা হয়েছে এতদসঙ্গে।

পিরোজপুর জেল সুপারের চিঠিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা অধিদফতরের ২০১১ সালের জুন মাসের চিঠির সূত্র উল্লেখ করা হয় বরাত হিসেবে। অভিযোগ রয়েছে, মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি হওয়ার বিনিময়ে খলিলুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা পাইয়ের দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১১ সালে। ক্ষমা পাওয়া বিষয়ে সর্বশেষ উদ্যোগের ফলাফল কী হয়েছিল সে সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেননি খলিলুর রহমান। গত ২০ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে একটি আবেদন পেশ করা হয়। আবেদনে বলা হয় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ৪৬ জন সাক্ষীকে হাজির করা আদৌ সম্ভব নয়।

তাই সেই ৪৬ জন সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা তাদের অনুপস্থিতিতে আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হোক। এই ৪৬ জন অনুপস্থিত সাক্ষীর মধ্যে একজন ছিলেন খলিলুর রহমান। তবে আদালত যে ১৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দী তাদের অনুপস্থিতিতে গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে খলিলুর রহমান নেই। সাজা মাথায় নিয়ে চাকরি খলিলুর রহমান বর্তমানে পারেরহাট শেখ হাসিনা অ্যাকাডেমিতে একজন নাইটগার্ড হিসেবে চাকরি করছেন। শেখ হাসিনা অ্যাকাডেমির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি স্থানীয় এমপি এ কে এম এ আউয়াল।

খলিলুর রহমান জানান, তিনি ১৯৮৫ সালে এ স্কুলে যোগদান করেন। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের মাসিক সরকারি বেতন ও অন্যান্য ভাতা উত্তোলন বিবরণী বইয়ে উল্লেখকৃত তথ্যে দেখা যায় খলিলুর রহমান ২-৩-১৯৯৬ তারিখে শেখ হাসিনা অ্যাকাডেমিতে যোগদান করেন। তার ইনডেক্স নম্বর ২৯২০১৬। সেখানে তার বেতন, ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ অন্যান্য তথ্যও রয়েছে। সেই বইয়েও খলিলুর রহমানের জন্ম সাল উল্লেখ রয়েছে ১৯৭২।

বইয়ে স্কুল পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান স্থানীয় এমপি এ কে এম এ আউয়ালের স্বাক্ষর রয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত মামলার বিবরণ খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে ইন্দুরকানী থানায় যে মামলা হয় তাতে পিরোজপুর অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তাকে এক বছর তিন মাস সাজা দেন। ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল মামলার রায় হয়। ওই দিনই তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এক মাস সাজাভোগের পর তিনি ২৪ মে জামিনে মুক্ত হন।

ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে প্রদত্ত সাজার বিরুদ্ধে তিনি পিরোজপুর সেশন জজ এবং হাইকোর্টে গেলে সেখান থেকেও সাজা বহাল রাখা হয়। এরপর তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করলে ২০০৩ সালের ১৬ নভেম্বর আপিল বিভাগ তার আবেদন খারিজ করে দেন। তবে সাজা বহাল থাকলেও মাহবুবকে পরে আর জেলে যেতে হয়নি। যে মামলায় খলিলুর রহমানের সাজা হয় সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ১৯৯৩ সালের ৯ মার্চ খলিলুর রহমান ও অন্যরা মিলে আবুবকর সিদ্দিক এবং তার ভাগিনা ও ভাতিজা কলাই ক্ষেত মাড়াইয়ের সময় তাদের ওপর হামলা চালায় এবং কুপিয়ে তাদের জখম করে। কুপিয়ে জখম করা বিষয়ে মামলার বিবরণ : ইন্দুরকানী থানা মামলা নম্বর ০২, তারিখ ১৪-০৩-১৯৯৩, জি আর ৪৭/৯৩, ধারা ৪৪৭/৩২৩ ।

সাক্ষ্য দেয়ার জন্য দুই দফা ঢাকায় আসেন খলিল অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য খলিলুর রহমানকে দুই দফা ঢাকায় আনা হয়। প্রথম দফায় তাকে ঢাকা আনা হয় ৪-১২-২০১১ তারিখে। ১৪-১২-২০১১ তারিখে তাকে প্রসিকিউশনে হাজির করা হয়। পরের দিন ১৫-১২-২০১১ তারিখ তাকে বাড়ি পাঠানো হয়। এরপর তাকে আবার ঢাকায় আনা হয় ৩-১-২০১২ তারিখে।

৪-১-২০১২ তারিখে তাকে অন্য সাক্ষী আলতাফ হোসেন, মাহতাব উদ্দিন ও আব্দুল লতিফের সাথে প্রসিকিউশন কক্ষে হাজির করা হয়। কিন্তু সে দিনও তার সাক্ষ্য দেয়া হয়নি। পরের দিন ৫-১-২০১২ তারিখ তাকে আবারো বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ হেফাজতেই তাকে ঢাকা আনানেয়া এবং থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সাজা বহাল থাকা অবস্থায় পলাতক আসামির প্রকাশ্যে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগদান এবং চাকরি চালিয়ে যাওয়া, তাকে সাক্ষী নির্বাচন করা এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ঢাকায় আনার বিষয়টি অনেকের কাছে বিস্ময়কর।

খলিলুর রহমানের বক্তব্য খলিলুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০০৩ সালে আপিল বিভাগে তার আবেদন খারিজ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে দায়ের করা মার্সি পিটিশনের একটি কপি থানায় জমা দেয়া হয়েছে। ফলে তাকে আর গ্রেফতার করা হয়নি। তিনি ক্ষমা পেয়েছিলেন কি না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে পরে কোনো কিছু জানতে পারিনি আর। আপিল বিভাগে আবেদন বাতিল হওয়ার পর তিনি জেল এড়াতে কখনো পালিয়ে ছিলেন কি না জানতে চাইলে বলেন, তিনি পালাননি। তিনি বর্তমানেও বাড়িতেই আছেন।

তার বিরুদ্ধে ছয়-সাতটি মামলা ও জিডি বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে খলিলুর রহমান জানান, এগুলো সব নিষ্পত্তি হয়েছে ও আমার পক্ষে রায় পেয়েছি। এরপর টেলিফোন লাইন কেটে দেন তিনি। লাইন কেটে দেয়ার দুই দিন পর আবার তার সাথে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে সাথে সাথে আবারো লাইন কেটে দেন খলিলুর রহমান। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।