বিকট
সুহাস এবং তার বন্ধুরা, অল্পদিনের পরিচয়েই তারা একে অপরের খুঁতগুলো পরিপূর্ণরূপে আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছে। সুহাস, অজ্ঞাতকূলশীলই বলা যায় তাকে, তবে বৈকালিক চায়ের আড্ডায় আসর জমাতে খুব বেশি চিন- পরিচয় হবার দরকার পড়ে না। আড্ডাটা বিস্তৃত হবার সাথে সাথে অন্যদের খুঁতগুলো ছাপিয়ে সুহাসের একটি বিশেষ দোষ প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হতে লাগলো।
সে সন্দেহবাতিকগ্রস্থ।
সুহাসের সন্দেহপ্রবণতা বেড়েই চলেছে দিনকে দিন।
সবকিছুতেই তার সন্দেহ। বাসের ড্রাইভারটা বেশি গিলে ফেলে বেপরোয়া চালাচ্ছে কী না, হোটেলের বেয়াড়া তার সিঙ্গারায় সস কম দিলো কী না, এসব দৈনন্দিন ব্যাপারতো আছেই, তার সাথে যোগ হয়েছে এমন সবকিছু, যা তার জীবনে কখনও ঘটেনি, খুব সহসা ঘটবে এমন সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে। কালো চোখের মায়াবতী প্রেমিকা যার আদতে কোন অস্তিত্ব নেই, সে বেচারীকেও সুহাসের সন্দেহবাণে বিদ্ধ হতে হয়। ব্যাপারটা নিয়ে তার বন্ধুবান্ধবেরা হাসাহাসি করে। হোটেলে অহেতুক হল্লা, লোকাল বাসে চিল্লাচিল্লি জাতীয় ঘটনাগুলো ক্ষেত্রবিশেষে বিব্রতকর এবং বিরক্তিকর হলেও প্রেম এবং প্রেমিকার মত আড্ডা গরম করা বস্তু হাতে পেলে কে আর ছাড়ে!
-কী রে তোর মায়াবতীর খবর বল! নতুন কোন স্ক্যান্ডাল এসেছে নাকি তাকে নিয়ে!
-দেখ, সব ব্যাপার নিয়ে ফাজলামি করবি না।
ব্যাপারটা সিরিয়াস।
-আরে হ্যাঁ, সিরিয়াস তো বটেই, এজন্যেই তো জানতে চাইছি।
-আমি ঠিক করেছি এসব ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আর বলবো না। তবে সময় হলে জানতে পারবি সব।
ঠোঁটের কোণে ক্রূর একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখে সে।
অনেক পীড়াপীড়িতেও কোন কাজ হয় না। সেদিনের আড্ডাটা আর জমেনা তেমন। রসবিলাসী বন্ধুরা কিছু খিস্তি খেউড় করে এবং সুহাসের মানসিক অপরিপক্কতা নিয়ে গালমন্দ করে ফুচকার বিল না দিয়েই ভেগে যায়। ক্রূর হাসিটাকে একটা মোলায়েম রূপ দিয়ে মিটমিটিয়ে হেসে সুহাস এরপর ঝগড়া করেছিলো ফুচকঅলার সাথে আরো বেশি টক কেন দেয়া হয়নি এ নিয়ে। সুহাসের বন্ধুরা দূর থেকে দেখে দ্বিধাণ্বিত হয়;আরো মজা লুটতে যাবে নাকি পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে ঘনিষ্ঠ জোড়াদের পর্যবেক্ষণ করতে করতে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ব্যাপার নিয়ে কিছুক্ষণ খেয়োখেয়ি করবে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি চলার পরেও তারা কোন স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারে না।
তাদেরকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুহাসই বরঙ এগিয়ে যায়। এতে অবশ্য একটা সাময়িক সান্ধ্যবিনোদনমূলক অচলাবস্থার নিরসন ঘটে। সুস্বাদু ফুচকার স্বাদ এবং একটা তাজা ঝগড়ার স্মৃতি সুহাসের মনকে প্রফুল্ল করে তোলে। সে যেচে পড়েই জানতে চায়,
-কী যেন বলছিলি তোরা তখন?
সুহাসের আগ্রহ দেখে তারা একটু বাজিয়ে নেবার তাল করে,
-না থাক, তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমরা শুনে কী করব! এই চল সব, ভাগি এখন। অনেক রাত হয়েছে।
-আচ্ছা, ভাগলে ভাগবি, রাত তো বেশি হয় নাই। আমার কথা শুনতে না চাইলে নাই। চল আরো কিছুক্ষণ আড্ডা মারি।
-রাত বেশি হয় নাই, এই ব্যাপারে তুই শিওর? কোন সন্দেহ নাই তো?
বন্ধুদের একজন মওকা পেয়ে টিপ্পনি কাটে।
-এটা একটা ভেবে দেখার মত কথা বটে দোস্ত।
রাত কী খুব বেশি হয়েছে, নাকি হয় নাই? ব্যাপারটা আপেক্ষিক। একেকজনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একেকরকম লাগতে পারে।
-আরে তোর সন্দেহ হচ্ছে কী না বল!
মজা পেয়ে আরেকজন ফোড়ন কাটে।
সুহাস ভাবে তার সন্দেহবাতিকগ্রস্থতার কয় প্রস্থ বন্ধুরা দেখতে পেরেছে? সুহাস দেখে তাদের নিবিড়ভাবে। বন্ধুদের সে কখনও সন্দেহ করারও যোগ্য মনে করেনি।
ঢাকার কোন এঁদো গলিতে জটলা পাকানো ছেলেদের দল দেখে সে ভাবতে পারে কার কোমড়ে ছুরি গোঁজা আছে, অথবা উৎসবের দিনে ভীড়ে কোন লোকটা সম্ভাব্য পকেটমার হতে পারে, কিন্তু বন্ধুদের সে আদৌ গোণায় ধরে না। ব্যাপারটা এমনভাবেও দেখা যেতে পারে, তাদেরকে সে গোণায় ধরে না বলেই তারা এখনও তার তথাকথিত বন্ধু হিসেবে আছে। প্রকৃত বন্ধু হিসেবে ভাবলে সন্দেহবাদ না এসে পারতো না। এর চেয়ে এই ভালো...! আধো অন্ধকারে তার ক্রূর হাসিটা আবার ফুটে ওঠে। কিন্তু তার বন্ধুরা তা দেখতে পায় না।
-এখন অনেক রাত! অনেক অনেক রাত। বেশি রাত করে বাসায় ফিরলে কি তোদের বাবা-মা-বউ-বাচ্চা সন্দেহ করবে?
-আমাদের আবার বউ বাচ্চা পেলি কোথায় বেকুব! শালা আজকে তুই ফুচকার সাথে বেশি ঝাল খেয়ে টাল হয়ে গেছিস। তোর সাথে আজ জমবে ভালো! চল আড্ডা দিই!
-নাহ, আজকে দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমার মায়াবতীটা ঢং করবে। কালো চোখের গর্বে বাঁচে না!
-তুমি আসলে শালা কী বলত? ডিল্যুশনে ভোগো? নাকি আমাদের সাথে মজা নাও?
-হাহা! দেখ, এখন তোরাই উল্টো সন্দেহ করছিস!
-আমাদের ব্যাপারটা তো তোমার মত বাতিল বাতিক না।
যেখানে যেখানে দরকার, সন্দেহ করব! ইহা অতি মানবিক আচরণ। কিন্তু তোরটা যে আসলে কী, নাহ আজকে তোকে জেঁকে ধরব! কেন তোর মধ্যে এত সন্দেহ। রাস্তার মানুষ, বাজারের মেয়েছেলে, মুদীর দোকানদার, এমন কী কল্পনায় প্রেমবিলাসিনীকেও সন্দেহ করিস! তা, কল্পনায় নিঃসঙ্গ যুবকদের এরকম কিছু থাকতেই পারে, তাকে ভালো না বেসে সন্দেহ, ডিল্যুশন...সত্যি সত্যি যদি কেউ আসে তো তখন কী করবি? লুজার!
-সন্দেহ নেই, কেউ না কেউ আসবে। তবে লুজার কে বা কারা হবে এটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে বটে! হয়তোবা আমি, হয়তোবা সে, অথবা...তোরা!
-অনেক হইছে! অনেক তর্ক হইছে, অনেক গবেষণা, সন্দেহের কূটচাল, তোরা চালাতে থাক, আমি যাইগা, কারণ রাতও অনেক হইছে।
বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে উৎসাহী জনের আগ্রহে ভাটা পড়ে।
-যাবি, তো এত তাড়া কীসের! রাত সত্যি অনেক বেশি হয়ে গেছে। এখন বাড়ি ফেরাটা নিরাপদ হবে না। অন্তত এই এলাকা থেকে। চারিদিকে দেখিস না, কেমন সন্দেহজনক লোকজন! কখন কী হয় কিচ্ছু বলা যায় না।
সুহাসের বন্ধুরা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে তাদেরকে ঘিরে আছে ষন্ডাগুন্ডা চেহারার মানুষজন, যাদের কোমড়ে ছুরি-পিস্তল থেকে শুরু করে ইহকালের আমলনামাতক সব থাকতে পারে।
-আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম, এই ব্যাটা ঘোড়েল মাল। তর্কের ফাঁদে ফেলে কোথায় নিয়ে এসেছে দেখেছিস! তুই কী চাস আমাদের কাছে বলত? জানিসই তো আমরা বেকার ছেলেপুলে, টাকাপয়সা থাকে না, নাকি মুক্তিপণ আদায় করতে চাস? দেখ, আমাদের বাপেরাও কেউ মালদার পার্টি না, তবু কেন খামোখা হেনস্থা করছিস, যেতে দে...যেতে দে আমাদের!
-সত্যি, অদ্ভুত তোদের আচরণ। আমি শুধু এই এলাকার অপরাধপ্রবণতা সম্পর্কে তোদের অবগত করে একটু সাবধানী হতে বলেছিলাম। আর তোরা আমাকে কী বানালি! কী কী বললি! আমি ঘোড়েল, ধান্দাবাজ, অপহরণকারী, ব্ল্যাকমেইলার কত কী! অবশ্য ভাবলে দোষই বা দিই কী জন্যে! ভাববার মত পরিস্থিতিই তো বটে!
সুহাস আবারও তার সেই ক্রূর হাসিটি সাফল্যের সাথে ঠোঁটের কোণে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। স্ট্রিটলাইটের আলো নিকটস্থ ষন্ডাগোছের ব্যক্তির ছুরিতে প্রতিফলিত হয়ে তার ঠোঁটে বিলি কেটে গেলে সবার মধ্যে একটা শীতল শিহরণ বয়ে যায়।
-তোরা যেখানে খুশি যেতে চাইলে যা, আমি বাঁধা দেবো না। তবে কী, আমার সন্দেহদ্ভুত ডিল্যুশন অথবা ভাইস ভার্সা যেটাই হোক, সেটা নিয়ে তোদের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম, অল্প কিছুক্ষণের জন্যে। তোরা তো আমার বন্ধু, এটুকু সাহায্য করবি না!
এতদিনকার গরম টপিকটা, যা আড্ডার ঊনুনে ছেড়ে দিলে গরম জিলাপীর মত ফুটতো আর রস বেরুতো, তা হঠাৎ করেই মিয়ানো মুড়ির মত বিস্বাদ ঠেকে সবার কাছে। তবে উন্নত বক্ষের গার্মেন্টস ফেরতা একটা মেয়েকে দেখে এলাকাবাসী সিটি বাজিয়ে দেশের নারী আইনের লংঘন করলে মিয়ানো মুড়ির মধ্যে তারা টমেটো, সরিষার তেল আর পেঁয়াজ-মরিচের গন্ধ পেয়ে আমোদিত হয়ে পুণঃআগ্রহে জিজ্ঞাসা করে,
-হ্যাঁ দোস্ত বল, কী সাহায্য লাগবে তোমার!
-তোদের সবার তো প্রেমিকা আছে, কিন্তু আমার তো নাই। হিংসা হয় বুঝলি! তাই আমিও নিজের মত করে একটা বানিয়ে নিয়েছিলাম।
কিন্তু বাঁধ সাধলো কী? আমার সেই সন্দেহপ্রবণ মন। তোরা তো জানিসই আমি সামান্য ব্যাপার নিয়ে কেমন ক্ষেপে উঠি, আর এটাতো কেঁপে ওঠার মত ব্যাপার। ব্যাপারটা নিয়ে তোদের সাথে একান্তে আলাপ করতে চাই। তবে প্রত্যেকের সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই আমি। যেহেতু তোরা দুজনেই প্রেম করিস, দুজনের অভিজ্ঞতালদ্ধ উপদেশ আলাদাভাবে নিয়ে বিশ্লেষণ করব, নইলে ভজঘট লেগে যেতে পারে।
অতঃপর মাস্তান, পতিতা, আর খদ্দেরদের অস্বস্তিকর সংস্পর্শ পাশ কাটিয়ে আলাপপর্ব শুরু হয়। সুহাসের অভয়বাণীতে তাদের প্রারম্ভিক অস্বস্তি কেটে যায়।
-ভয় পাসনে। এখানে সব উটকো লোকজন এবং তাদের অপরাধপ্রবণতা চোখ রাঙালেও কেউ খামোখা তোদের ঘাঁটাবে না। সন্দেহ করবে না।
-তুই এতসব জানলি কীভাবে?
-এটাতো আমারই এলাকা। এখানেই তো বেড়ে উঠেছি আমি।
একটা খুপড়ি জাতীয় ঘরে সুহাস তার বন্ধুদের মধ্যে
প্রথমজনকে নিজের সন্দেহবাতিকতাযুক্ত বিমূর্ত প্রেম বিষয়ক সাহায্য তথা জেরার জন্যে নিয়ে এলে সেখানকার বদ্ধ পরিবেশ, স্যাঁৎস্যাঁতে আবহাওয়া এবং অন্ধকারে ওৎ পেতে থাকা গুবড়ে পোকাদের কর্কশ শব্দ তার স্নায়ুর ভেতর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করে। তার সাহায্য করার মানসিকতা এবং সংবেদনশীলতা উবে যায়, সে চিৎকার করে ওঠে,
-আমি এইখানে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো না। ইউ আর সিক! তুই এই ঘরেই দিনের পর দিন কাটিয়েছিস, তাই না? এজন্যেই তোর মানসিকতা এরকম।
এখন আমাকে বেরুতে দে দয়া করে!
-আরে দাঁড়া না! কুল ডাউন। এই কাহিনীবিহীন ঘরের উদরে ভ্রূণ জন্ম দিয়েছিস, এখন সন্তানাদি হতে দে! হাহা! দেখা যাক কাহিনিটা কদ্দুর গড়ায়। তোর সুবিধার্থে চল্লিশ পাওয়ারের একটা লাইট জ্বালিয়ে দিচ্ছি। এখন তুই একটা ফ্যামিলি পোট্রেট আর বিশ বছরের পুরোনো কিছু এ্যালকোহলের বোতল দেখতে পাবি। এবার বল, কাহিনীটা কীভাবে এগিয়ে নিলে ভালো হয়।
এখানে একজন নির্যাতিত, অবহেলিত শিশু থাকতো, তার বাবা ছিলো এ্যালকোহলিক, তার বাবা-মা'র বিচ্ছেদ হয়ে যায়, তাই ফ্যামিলি পোট্রেটটা এরকম ধূলি ধুসরিত। কেমন হচ্ছে কাহিনীটা? তোর মনমত?
বন্ধুটির নীরবতায় কিঞ্চিৎ ক্ষুদ্ধ হয়ে সুহাস তার কলার চেপে ধরতে গিয়ে ভুল করে গলা চেপে ধরে। একটু বেশি জোরেই হয়তো চেপে ধরেছিলো। তার বন্ধুটির গলা থেকে হাঁসের মত ফ্যাঁসফ্যাঁসে শব্দ বের হয়।
-ওহ স্যরি! হাহা! বিশ্বাস কর ওটা অনিচ্ছাকৃত ছিলো।
হাহাহা! ভয় পাসনে। ভয় পেলে চলবে? কাহিনীর তো অনেক বাকি এখনও। অবশ্য এখন তোর যে অবস্থা দেখছি, তাতে তুই কোন গল্প বানাতে পারবি বলে মনে হয় না।
হতাশ কন্ঠে শ্রাগ করে সুহাস।
-এর চেয়ে তোকে নিয়েই একটা গল্প বানাই বরঙ, কি বলিস? আর আমার যে কালো চোখের প্রেমিকার কথা বলতে এসেছিলাম, তার চোখটা নাহয় বাদামীই হোক! বাদামী চোখের প্রেমিকা, কেউ লৌহহস্তে চেপে ধরে আছে গলা কারও, চমৎকার সব গল্পের উপাদান! আছা দাঁড়া, ফ্যামিলি এ্যালবামটা একটু ঝেড়ে নেই।
কত ধূলো জমেছে!
-প্লিজ প্লিজ আর ধূলো ঝাড়িস না, আর না।
-হুম আসলেই বড় অদ্ভূত ব্যাপার, তাই না? ধূলো ঝাড়ার পর ছবিটা কেমন স্পষ্ট আর পরিবর্তিত হয়ে গেছে। দেখতো ভাল করে চিনতে পারিস কি না কাউকে?
-আমি দেখতে চাই না। আমাকে যেতে দে!
-তোকে আটকে রেখেছে কে? আচ্ছা যাবার আগে শুধু এটা বলে যা, আমাদের স্থগিত আলোচনার বিষয়-বস্তু ডাগর কালো চোখের বিমূর্ত প্রেমিকা নাকি বাদামী চোখের পান্ডুর আর্তনাদরত পাড়াতো ছোটবোন? আহ ভয় পাচ্ছিস কেন এত! যাহ শালা, তোকে এখানে নিয়ে আসাই ভুল হয়েছে। তুই আমাকে সাহায্য করবি কী, উলটো ঘেমে কেঁদে এবং সম্ভবত. . . হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম তাই, পেচ্ছাব করে পুরো ভেজা কাক হয়ে গেছিস।
আমার নামের প্রথম অক্ষরটা তোকে গিফট করলাম যা। ওখান থেকে একটা সুন্দর শব্দ বানিয়ে নিস। কি, পাচ্ছিস না? অবশ্য পারার মত অবস্থায় তুই নেইও। তোর নাম এখন থেকে 'সুসিক্ত'। আর আমার নাম 'হাস'।
ঠিক আছে? হা হা হা!
সুহাস পাড়া কাঁপিয়ে হাসতে থাকে। এলাকার অন্যান্য অধিবাসীরাও এতে যোগ দিলে একটা
সুন্দর
সমবেত
সত্য
কিন্তু ভয় জাগানিয়া হাসির সৃষ্টি হয়। হাসিটা যে একটু বিদঘুটে এবং ভয় জাগানিয়া তাতে কোন 'সন্দেহ' নেই। এই সমবেত হাস্য-কলরবের ভেতরে সুসিক্তকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যায় গাট্টা-গোট্টা গালে পট্টি লাগানো কিছু লোক এলাকাবাসী হিসেবে সুহাসকে (ওহ না,এখনতো সে হাস!) সহযোগিতার খাতিরে। সেইসাথে পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসে দ্বিতীয় বন্ধুটিকে।
এলাকাবাসীর সহায়তায় ইতোমধ্যেই সুহাস খুপড়ি ঘরটিকে বাসযোগ্য না হলেও বসার যোগ্য করে তুলেছে।
-কি রে এতক্ষণ কি আলাপ করলি ওর সাথে? সোফায় আরাম করে বসে জিজ্ঞাসা করে দ্বিতীয় বন্ধুটি।
-সুসিক্তের কথা বলছিস?
-সুসিক্ত?
-হ্যাঁ, সে সুসিক্ত আর আমি হাস। আমাকে হাঁসও বলতে পারিস চাইলে। তুই হাঁসের মাংস খুব পছন্দ করিস, তাই না?
-হ্যাঁ, তা করি।
তা তুই এসব আবোল-তাবোল বকেই যাবি নাকি তোর সন্দেহজনক বিমূর্ত প্রেমিকাকে নিয়ে কিছু বলবি? অবশ্য তোর আবোল-তাবোল শুনতে খারাপ লাগছে না।
-আমারও ভালই লাগছে। শীতকালতো এল বলে, হাঁসের মাংসের স্বাদ এখন ভাল হবে। তোর জিএফকে বল না একদিন রান্না করে খাওয়াতে। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাসফরে জঙ্গলে গিয়ে সে কাকে কি খাওয়াচ্ছে কে জানে!
-হারামজাদা! তোর এত বড় সাহস! এমন একটা কথা তুই কিভাবে বলতে পারলি? দেখ সব কিছু নিয়ে জোক করা ভাল না।
বিশেষ করে ওর মত একটা মেয়েকে নিয়ে।
-আয়্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি। আসলেই ওটা একটা বাজে রসিকতা ছিল। তবে ব্যাপার কি জানিস, সেমিস্টার ফাইনালগুলোতে গ্রেড ইম্প্রুভমেন্টের জন্যে অনেক মেয়েই অনেক কিছু করে।
তার বন্ধুটি এবার সরোষে উঠে দাঁড়াল।
-আরেকবার ওকে নিয়ে বাজে কথা বললে প্লায়ার্স দিয়ে ঠোঁট তুলে নিবো বাঞ্চোৎ।
তার মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা যায় না। সে ধীরে-সুস্থে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতেই মগ্ন থাকে। তার এরকম নির্বিকার ভাব-ভঙ্গী দেখে ওপাশ থেকে আরো তীব্রবেগে গালির তুবড়ি ছুটতে থাকে। সে এসব গ্রাহ্য না করে ধীরে ধীরে পোষাক পাল্টায়, টিশার্ট পাল্টে ফুলশার্ট পরে, জিন্স পাল্টে একটা গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট এবং চোখে একটা চশমা যা সে কোনদিনই ব্যবহার করে নি।
-নেহায়েত খেয়ালের বশে বুঝলি?
সাজ-সজ্জা শেষ করে সে বন্ধুর দিকে তাকায়।
-নেহায়েত খেয়ালের বশেই একটু সাজ-গোজ করলাম। আমাকে কেমন দেখাচ্ছে? প্রফেসর আশফাক সজলের মত না? হুবহু?
তার বন্ধুর বিস্ফোরিত চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলে চলে, এবার বল ডাগর কাল চোখের প্রেমিকার কথা শুনবি নাকি নাভিতে জন্ম-মানচিত্র দাগওয়ালা কোন মেয়ের কথা?
বন্ধুর স্থির বিস্ফোরিত চোখ সচকিত হয়ে ওঠে আশ্রয়ের খোঁজে। সেও পালাবার পথ খুঁজছে। একটা টহলকারী প্রহরীদের গাড়ি ঘন্টা বাজিয়ে চলে গেলে সে ওদিকে ছুটে যায়।
কিন্তু সুহাসের পায়ে পা হড়কে গিয়ে পড়ে যায়।
-আমি আবারও দুঃখিত অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনার জন্য। আসলে মেয়েদের নিয়ে বেশি কথা বলাই ঠিক না। ছেলেদের নিয়ে, ভাল হয় আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে কথা বললে। যেমন ধর, সুসিক্ত।
সুসিক্ত নামকরণের শানে-নজুল ওর কাছ থেকেই জেনে নিস। ওর সাথে শুনলাম যৌথ বিনিয়োগে ব্যবসা করছিস। ওই শালাতো একটা বোকা-চোদা। হিসেব বোঝে কম। তুই খাবি খা, তবে একটু দিয়ে-থুয়ে খেলে ভাল হয় না? যে গতিতে সাঁটাচ্ছিস, সে যখন টের পাবে যে সে নিঃস্ব হয়ে গেছে, জানিসইতো দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ইঁদুরও হাতিকে লাথি মারার জন্য মরিয়া হয়।
তাই বলছি কি, তোর বন্ধু হিসেবেই, তোর ভালর জন্যই বলছিলাম অন্যভাবে নিস না। এই যাহ সুসিক্ত কখন এসে গেছে টেরই পাইনি। এখন তোরা কি ফয়সালা করবি কর।
-প্রতারক, হামবাগ!
সুসিক্ত দরদর করে ঘামে ভিজছে, স্নান করছে যেন। হয়তোবা কিছুক্ষণ পর রক্তস্নানও করতে পারে।
সুসিক্ত নামটা খারাপ হয়নি।
-তোরা মারামারি করার আগে আমার শেষ কিছু কথা শোন।
প্রসন্ন কন্ঠে বলে সুহাস।
-আমার নাম সুহাস। সুহাসের 'সু' অর্থাৎ 'সুন্দর' আমি একজনকে দিলাম।
আর তা হয়ে গেল 'সুসিক্ত'। আর আমি হয়ে গেলাম 'হাস' অথবা 'হাঁস'। জলে সাঁতরাই, গা ভেজে না হাহা! বাকিটা তোদের আরেকজনকে এখন দিচ্ছি। 'হা' অর্থাৎ 'হাসি', আর তোর কাছে গিয়ে তা হয়ে গেল 'হামবাগ'। আমার আর বাকি থাকি কি? 'স'।
'স' এর জন্য বরাদ্দ রেখেছি সমর এবং সন্দেহ। আমি দুটোই তোদের দিয়ে দিলাম। এখন তোদের পালা! এইবার তোমার আপন দেশে চল!
মুয়াজ্জিনের আজান আর পাখির কল-কাকলির শব্দে ভোর জেগে ওঠে। বিমূর্ত প্রেমিকার ডাগর কাল চোখের ভেতর, সুহাস নামের কেউ (যে ছিল কি ছিল না কখনো এ নিয়ে পরবর্তিতে ব্যাপক বিতর্ক হতে পারে তার বন্ধুদের মাঝে), ঢুকে পড়ে। ডাগর কাল চোখের শিরা-উপশিরায় আঁকা হতে থাকে সন্দেহ এবং সমরের মানচিত্র।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।