আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বায়োগ্যাসঃ নবায়নযোগ্য গ্রামীণ জ্বালানি

১৯৬০ সালে ফেঞ্চুগঞ্জে প্রাকৃতিক গ্যাস সারখানার উৎপাদন শুরুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের বানিজ্যিক ব্যবহার আরম্ভ হয়। এখন দেশের পূর্বাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি শহরের নাগরিকরা রান্নার কাজে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করছেন। বর্তমানে গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক দেশের পূর্বাঞ্চল ছাড়িয়ে পশ্চিমাঞ্চলের সিরাজগঞ্জ, বাঘাবাড়ী, পাবনা হয়ে ঈশ্বরদী পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও দেশের ৬০% মানুষ এখনো গ্যাস সুবিধা বঞ্চিত। শহরে গ্যাস সরবরাহ থাকলেও সন্নিহিত গ্রামে গ্যাস সরবরাহ হয়নি। কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক ও বানিজ্যিক।

গ্যাস বিতরণ পাইপলাইন নির্মান ব্যয়সাপেক্ষ। শুধুমাত্র রান্নাঘরে গ্যাস সরবরাহের জন্য গ্যাস বিতরণ পাইপলাইন নির্মান বানিজ্যিকভাবে লাভজনক নয়। বাসা-বাড়ীতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত প্রতিটি দুই-চুলার জন্য গ্যাসের মূল্য প্রতিমাসে ৳৪৫০.০০। অপরদিকে, রান্নার কাজে এলপিজি ব্যবহার করলে একটি সাধারণ পরিবারের মাসে খরচ হয় ১,৫০০.০০ থেকে ২,০০০.০০ টাকা। লাকড়ি ব্যবহার করলেও একটি সাধারণ পরিবারের জ্বালানি খরচ বাবদ প্রতিমাসে ন্যূনপক্ষে ৳১,০০০.০০ খরচ হয়।

এটি অবশ্যই নাগরিক বৈষম্য। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাষ্ট্রের উচিৎ এই বৈষম্য দূর করা। জৈববর্জ্য থেকে উৎপাদিত বায়োগ্যাস লাগসই বিকল্প গ্রামীণ জ্বালানি হতে পারে। কেবলমাত্র রাসায়নিক সারের অব্যহত ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে আমাদের কৃষিজমি আজ বন্ধ্যাপ্রায়। মাটিতে শস্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জৈবপদার্থ ও অনুখাদ্যের অভাব প্রকট।

জৈবপদার্থের অভাবে মাটির পানিধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে, রাষায়নিক সার প্রয়োগ করেও কাঙ্খিত পরিমান ফসল উৎপাদন হচ্ছেনা। বায়োগ্যাস প্লান্টথেকে নিঃসৃত গাদ ও পানিকে পরিশ্রুত করে পাওয়া কঠিনবর্জ্য শুকিয়ে কৃষিজমিতে সার হিসাবে প্রয়োজনমত ব্যবহারের জন্য বস্তাবন্দি করে মজুদ করা যায়, আর তরল অংশ তরলসার হিসাবে সরাসরি জমিতে প্রয়োগ করা যায়। বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে বর্জ্যহিসাবে পাওয়া জৈবসার কৃষিজমিতে ব্যবহার করলে একদিকে যেমন মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি পাবে, অপরদিকে রাসায়নিক সারের চাহিদাও কমবে। ভিয়েতনামে বায়োগ্যাস প্লান্টথেকে পাওয়া তরলবর্জ্য ক্ষুদিপানা (Duck weed) উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে।

৪৩% আমিষসমৃদ্ধ (Protein) ক্ষুদিপানাকে গো-খাদ্য ও পোলট্রি খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা প্রকারান্তরে ঐ দেশের আমিষচাহিদাপূরণে সহায়তা করছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশে পরিবারভিত্তিক বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনে সরকার ৳৭,৫০০.০০ ভর্তুকি দিত, কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে থেকে ঐ ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। ভারত অনেকদিন আগেই গ্রামীণ জ্বালানির জোগান দিতে গ্রামে কম্যুনিটি বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন শুরু করেছে। উপরি হিসাবে পাওয়া জৈবসার তারা কৃষি উৎপাদনকাজে ব্যবহার করে উপকৃত হচ্ছে। এছাড়া, ওখানে বায়োগ্যাস প্লান্ট-এর গ্যাসদিয়ে ছোট ছোট বিদ্যুৎ উৎপদানকেন্দ্রও স্থাপন করা হয়েছে যা তাদের গ্রামীণ বিদ্যুৎ চাহিদার কিয়দাংশ পরিপূরণ করে।

আমাদের দেশেও প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ সুবিধাবঞ্চিত ৬০% জনগোষ্ঠির জন্য সরকারী সহায়তায় কম্যুনিটি বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করা যেতে পারে। ঐ কম্যুনিটি বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে গ্রামের প্রতিটি রান্নাঘরে গ্যাস সরবরাহ করা এবং উদ্বৃত্ত গ্যাসদিয়ে ছোট ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রও স্থাপন করা যেতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ সুবিধাবঞ্চিত বৃহৎ জনগোষ্ঠি গ্যাসসুবিধা লাভ করবে, অপরদিকে কৃষিকাজে জৈবসারের ব্যবহার রাসায়নিক সারের চাহিদা কমিয়ে দেবে। বাড়তি লাভ হবে জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি। বায়োগ্যাস প্লান্টথেকে প্রাপ্ত গ্যাসের চাপ বেশি না হওয়ায় সাধারণ পলি-ইথাইলিন (পলিথিন) পাইপ দিয়ে অল্প খরচে গ্যাস সরবরাহ নেটওয়ার্ক নির্মাণ করা যাবে।

আঘাতজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হলে এই পাইপ দীর্ঘদিন টিকবে। কম্যুনিটি বায়োগ্যাস প্লান্ট পরিচালন ও রক্ষণাক্ষেণের জন্য ওয়ার্ড বা পাড়াভিত্তিক পরিচালন পর্ষদ গঠনকরা যেতে পারে। এই পরিচালন পর্ষদের দায়িত্ব হবে ঐ এলাকার গোয়ালগুলো এবং বাড়ী-ঘরথেকে জৈববর্জ্য সংগ্রহ করা, বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে নিঃসৃত গাদ থেকে কঠিন বর্জ্য আলাদা করে শুকিয়ে সার হিসাবে ব্যবহারের জন্য মজুদ করা ও সুলভমূল্যে তা কৃষকদেরকে সরবরাহ করা। যেহেতু গ্রামের জনগোষ্ঠির অনেকেই প্রকৃতি থেকে প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া গাছের ঝরেপড়া পাতা, খড়, নাড়া, ইত্যাদি জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করে এবং যেহেতু কম্যুনিটি বায়োগ্যাস প্লান্ট-এর জন্য প্রয়োজনীয় গোবর ও জৈববর্জ্য সংগ্রহের জন্যএলাকাবাসীদের উপর নির্ভর করতে হবে, সেহেতু কম্যুনিটি বায়োগ্যাস প্লান্টের গ্যাস বিনামূল্যে বা নামমাত্রমূল্যে সরবরাহ করা যেতে পারে। এরফলে সরকারের যে আর্থিক ক্ষতি হবে তা জৈবসার ব্যবহারের কারণে চাহিদা কমে যাওয়া রাসায়নিক সারের পরিমানের উপর ভর্তুকি এবং জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধির ফলে বাড়তি উৎপাদন সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেবে।

আওয়ামী লীগ তার নির্বচনি ইশতেহারের ৩.১ উপ-ধারায় বলেছিল, ‘‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত স্বার্বিক জ্বালানি নীতিমালা গ্রহণ করা হবে। তেল, গ্যাস, কয়লা, জলবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস ও জৈবশক্তি, বায়ুশক্তি ও সৌরশক্তিসহ জ্বালানির প্রতিটি উৎসের অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। .....’’ ২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এই প্রস্তাব অতিশীঘ্র বাস্তরায়ন করবে বলে আমার আশা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.