শফিক হাসান পান্তা-ইলিশ সংস্কৃতি
সারা বছর আমরা বাঙালি থাকি না, কেবল বৈশাখ এলেই বাঙালি হয়ে ওঠার উপলব্ধি জাগ্রত হয়! শার্ট-প্যান্ট জায়গা হঠিয়ে আসে পাজামা-পাঞ্জাবি। গ্রীষ্মের দাবদাহে ঘর্মাক্ত নধরকান্তি দেহ জুড়াতে তালপাখাটা হাতে তুলে নিই। তারপর কেউ কেউ ভাবতে চেষ্টা করি, কোন গাছের পাতা দিয়ে তালপাখা বানানো হয়! বছরভর বুঝে না বুঝে হিন্দি উর্দু ইংরেজি গান শুনলেও পয়লা বৈশাখে আমাদের গান একটাই- আহ্বানের গান! যদিও আহ্বানের আর প্রয়োজন থাকে না, বেচারা এমনিতেই এসে গেছে! রমনায় গিয়ে ইলিশ (এতো বেশি কাঁটা সমৃদ্ধ একটি মাছ কীভাবে জাতীয় মাছের মর্যাদা পায়- এই প্রশ্নও ভাবায় কাউকে কাউকে!) সহযোগে পান্তাভাত গলাধঃকরণ করা হয়। পান্তা-ইলিশ সংস্কৃতি নব্য সাহেবরা আমদানি করেছেন। হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসের কোথাও পাওয়া যায় না পান্তা-ইলিশের এই সংস্কৃতি।
উৎসব করে পান্তাভাত খাওয়া দরিদ্র মানুষের প্রতি প্রচণ্ড এক প্রহসন। বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি বিদ্রƒপও। আজও বাংলার ঘরের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষরা পান্তা খেয়েই দিন শুরু করে। তাহলে পান্তার সাথে শুধু পহেলা বৈশাখের যোগসূত্র স্থাপিত হলো কীভাবে, করলোই বা কে?
একদিন বাঙালি ছিলামরে
কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া জনপ্রিয় গান ...একদিন বাঙালি ছিলামরে গানটিকে একটু অন্যভাবে ব্যবচ্ছেদ করা যায়! একদিন বলতে পহেলা বৈশাখকে ধরে নিতে পারি। কারণ এদিনই আমাদের বাঙালি বাবু সাজার দিন।
বাংলা সন বলে একটা জিনিস আছে, কেউই জানি না বাংলা কোন মাস কখন আসে আর কখন যায়। তারিখটুকু মনে রাখার গরজটুকুও নেই। তাহলে বৈশাখ মাস কেন ব্যতিক্রম হলো? বছরের প্রথম দিন আমরা বৈশাখ বরণে মেতে উঠি। তারপর খোঁজ রাখার চেষ্টা করি না, কী হলো বা কী হচ্ছে। না রাখার কারণ হচ্ছে, আধুনিকতা।
আমরা আধুনিক (!) হচ্ছি। আর আধুনিক হতে গেলে ব্যাকডেটেড জিনিসগুলো ভুলে যেতে হয়। সুতরাং ভুলে যাই, আমরা- শহুরে নাগরিকরা একদিন গ্রামে ছিলাম; আমাদের বাবা-দাদা কৃষিকাজ করতেন; সকালবেলা লাঙল কাঁধে নিয়ে মাঠে যেতেন...!
পুনর্নিমাণ
গত কয়েক বছর ধরে নতুন একটি শব্দ খুব শোনা যাচ্ছে রিমেক। সচরাচর গানের ক্ষেত্রেই শব্দটা প্রাধান্য পায়। দীর্ঘদিন প্রচলিত কোনো জনপ্রিয় গানকে ভেঙেচুরে নতুন করে গাওয়ার নামই রিমেক।
রবীন্দ্রসঙ্গীত, লালনগীতি, ফোকগান এবং চিরসবুজ গানগুলোকে রিমেকের নামে, অকারণ বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারে যে ছ্যারাব্যারা অবয়ব দেয়া হচ্ছে- সংশ্লিষ্ট শিল্পী বা গীতিকাররা বেঁচে নেই বলেই রা! নতুনা তাদের হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দিতো। সবকিছুকেই আমরা পুননির্মাণের চাঁছে ফেলার মওকায় আছি। সেকেলে জিনিসের ওপর হালজামানার প্রলেপ দিয়ে সেটাকে চলনসই ভদ্রলোকের ব্যবহার উপযোগী করতে উৎসাহের কমতি নেই যেন! তাই তো দেখা যায়, শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাচ্ছি টি শার্ট পরে; টি শার্টের সামনে-পিছনে লেখা আই লাভ নিউ ইয়র্ক! আবার অতি আধুনিক কেউ হয়তো শহীদ মিনারেই হিন্দি গান চালিয়ে দিই!
বেনোজলের জোয়ারে
বাংলা মানে বাংলা ভাই নয়, বাংলা মদ কিংবা কাটপিস সমৃদ্ধ বাংলা ছবিও নয়। বাংলা মানে বাংলা। এই সহজ সূত্রটা বুঝতে অনেকেই ব্যর্থ হই।
আমাদের মা কমবেশি সবার কাছেই বড্ড সেকেলে। মা কিচ্ছু বোঝে না, মাকে যেভাবে বোঝাবো মা ঠিক সেটাই বুঝবে। এমন মনোভাব নিয়ে মায়ের সাথে নানারকম টাল্টিবাল্টি করি আমরা। মা-ও সন্তানের মুখ চেয়ে অনেক সময় বুঝে না বোঝার ভান করেন। ুদ্র কিংবা অপ্রয়োজনীয় প্রয়োজনে আমাদের জন্য মায়ের আত্মত্যাগ ভুলে যাই লহমায়।
দুঃখিনী মা নিষ্পেষিত হয় পদে পদে।
তথ্যপ্রযুক্তি বর্তমানে অনেকদূর এগিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মোবাইলফোন, ফেসবুক ইত্যাদির জয়জয়কার। এগুলো আমাদের আরো একটি ভাষা শিখিয়েছে- খিচুড়ি ভাষা।
বাংলা জানি আর না জানি, ভালো ইংরেজি না বুঝি কিন্তু বাংলিশ ভাষাটা ভালোভাবে শেখা চাই চাই! নইলে যে মোবাইলফোনে এসএমএস থাকবে না, ফেসবুকে ‘স্ট্যাটাস’ থাকবে না! মোবাইল কোম্পানিগুলোকে সরকার বাধ্য করতে পারে, প্রতিটি ফোনে বাংলা অপশন যুক্ত করার জন্য। ব্যবসার খাতিরেই কোম্পানিগুলো তা মেনে নিতে বাধ্য। কিন্তু আমরা জানি, কোনো সরকারই এটা করবে না! ফেসবুকে এখন ইউনিকোডে চমৎকার বাংলা লেখা যায়; কিন্তু কজন বাংলায় স্ট্যাটাস এবং কমেন্ট করতে আগ্রহী হই! সব মনোযোগ তো খিচুড়ি ভাষার দিকেই!
রং মেখে সঙ সাজা
একটা সময় সর্বস্তরে বাংলা চালু কর কথাটা শোনা গেলেও বর্তমানে ঝিমিয়ে এসেছে স্লোগানটি। সর্বস্তরে বাংলা চালু করার দিন বোধহয় ফুরিয়েছে। আমাদের সন্তানরা পড়বে ইংরেজি শিক্ষা মাধ্যমে, পাশ্চাত্যের উন্নত (!) শিক্ষা এবং রুচির সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য সদা তৎপর আমরা।
বাংলা তো মায়ের ভাষা, ওটা আবার শেখার কী! সন্তান ইংরেজির জাহাজ হবে- ভাবতে বুক ফুলে ওঠে আমাদের! হিন্দি সিরিয়াল দেখে ছোট বাচ্চাটি যখন হিন্দি ভাষার তুবড়ি ছোটায় তখনও আমরা পুলকিত হই- সন্তান বহু ভাষাবিদ হয়ে যাচ্ছে! অনায়াসে নতুন ভাষা শিখে ফেলছে!
বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ উপলে পত্রিকাগুলো বিশেষ আয়োজন করে; বুদ্ধিজীবী, কলামিস্টরা জ্ঞানগর্ভ লেখা লিখে পাতা ভরান পত্রিকার। এতে হয়তো তাদের মন ভরে, পকেটও ভরে কিন্তু রং মেখে সঙ সাজা ‘আচানক বাঙালি’দের কোনো পরিবর্তন কি ঘটে- আচরণ এবং মানসিকতায়? যারা ভুলে গেছে, বাঙালি সাজার নয়- হয়ে ওঠার বিষয়!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।