আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লন্ডন জীবন ও একটি চাকরি পাওয়ার বাস্তব গল্প - পর্ব ১

অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও কবিতার মানুষ অবশেষে বহু দেশ ডিঙ্গিয়ে লন্ডনে এলাম । লক্কড় ঝক্কর এয়ার পোর্ট । এর চাইতে আমাদের দেশের এয়ারপোর্ট অনেক ভাল । প্রথমে হিথরো বিমান বন্দরে নেমে তিন নাম্বার টার্মিনাল থেকে ট্যাক্সি ক্যাবে চেপে ইস্ট লন্ডনে আসি । ভাড়া নিয়েছিল ৫০ পাউন্ড,সময় ২০০৯ সাল ।

বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সারে ৫ হাজার টাকা । কলজে ফেটে গিয়েছিল । যা হোক, আমার খালু লোক পাঠিয়েছলেন, একজন আমাকে হোয়াইট চ্যাপেল জুবলি স্ট্রিট এ একটা বাসায় নিয়ে আসে। বাংলাদেশ থেকে সকাল ৯টায় প্লেন ধরছিলাম, লন্ডন যখন আসি তখন রাত ৯ টা । ১২ ঘন্টা জার্নি করে ক্লান্ত ।

দেশের বাহিরে প্রথম আসি। অভিজ্ঞতা শুন্য। খাবার সাথে ছিল না। লজ্জায় খাবার চাইতেও পারলাম না। দেশে কোনদিন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি।

সারা রাত ক্ষুধা নিয়ে এপাশ ওপাশ করে কাটল । ভোর সকালেও কি করব বুঝতেছি না । ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, তা বুঝতে পারছিলাম । অতঃপর প্রায় সকাল ৯ টায় বাসার বাংলাদেশি আপা বললেন খেয়ে নাও। ভাবলাম এবার তাহলে আমার সকল জল্পনা কল্পনার অবসান হল।

তার ২ বছরের বাচ্চা যা খায় আমাকেও তাই দিলেন । কর্ণ ফ্লাক্স উইথ মিল্ক। অতি চমৎকার উপাদেয় খাবার । কিন্তু ওই খেয়ে আমার কি পেট ভরবে? মনে মনে প্রচন্ড রাগ হল । যতক্ষন প্লেন এ ছিলাম, প্লেনে ক্ষিধেটা তেমন লাগেনি ।

তার ওপর প্রথম প্লেন জার্নি । পানি আর দুধ খেয়ে আমার শরীরই দুর্বল হয়ে গেল । দরকার ছিল ড্রাই ফুড। যা হোক খাবার বলতে ভাতের চেহারা দেখলাম প্রায় বিকেলের দিকে । প্রান রক্ষা হল ।

ভাতের কি দাম , সেদিন বুঝলাম । লন্ডনে এসে আর সবার মত আমি চিন্তিত ছিলাম না । যখন সবাই একটা যে কোন জব পাওয়ার আশায় ঘর থেকে প্রতদিন অচেনা পরিবেশে এদিক সেদিক ছুটে বেড়াত সে সময় শুয়ে আমি ঘরেই ঘুমিয়ে কাটাতাম। তাদের হতাশা কেন তখন ও টের পাইনি। একটা চাকরি ৬ মাস ধরে খুজে বের করতে পারছে না , এই গল্প অনেক শুনেছি।

বাংলাদেশ থেকে আসার সময় আব্বু আমাকে ২ লাখ টাকা , মানে ১৫০০ পাউন্ড হাতে দিয়ে দিয়েছিল । বাংলাদেশের অই টাকার উপরই আমার চলতে হচ্ছিল । সত্যি বলতে দেশে আমার নিজের হাতে খুব বেশি টাকা হিসাব কিতাব করে খরচ করিনি। যা লাগত বাবা মাকে বলতাম সাথে সাথে পেয়েও যেতাম । আসলে ২লাখ টাকা দিয়ে লন্ডনে কয়দিন যায় এটা আমার মাথাই আসে নি ।

স্নাতক হওয়া পর্যন্ত যে মুডে ছিলাম তাতে জীবনে দায়িত্ব কি জিনিস জানতাম না । অবশেষে বের হলাম ১ দিন পর। আমার লন্ডন লাইফ শুরুতেই দরকার হল হাড়ি পাতিল। ছুটলাম ডুভেট (লেপ) বিছানার চাদর বালিশ এই সব কিনতে । দেশ থেকে লাগেজ ভরা এনেছিলাম, কাজের জিনিস কিছু আনা হয়নি।

কোথায় এসব পাওয়া যায় জানতাম না । মার্কেট খুজছিলাম । পরে জানলাম বাংলাদেশের মত এখানে এসব মার্কেটে পাওয়া যায়না । সেইন্সবেরী বলে একটা সুপার সপ আছে সেখানে সব পাব নিত্য প্রয়জনীয় । গেলাম সেইন্সবেরিতে ।

বিরাট দোকান । আগা মাথা নাই । ফ্যাক্টরি দেখতে বাহিরে থেকে যেমন হয় অনেকটা ওরকম। যা হোক , বেড শিট , কভার , ডুভেট , হাড়ি পাতিল পুরা সংসার, শুধু একটা বউ বাকি রইল । সব মিলে বিল ভালই আসল , দিলাম ৪৫ পাউন্ড ।

মোবাইলের জন্য সিম কিনলাম ৫ পাউন্ড টপ আপ করা । বাসায় এসে দেখি আছে আর ১৪০০ পাউণ্ড । দেশে যেমন ডাক দিলেই রিক্সা পাওয়া যায়। এখানে তেমন নেই। যে কারনে সব জিনিস আমাকেই টান্তে হল ।

একদিনে ১০ হাজার টাকা শেষ । প্রথম মাসের এডভান্স সহ বাসা ভাড়া দিলাম ৪০০ পাউন্ড । এক বেড শেয়ার , সাথে আরেকজন মানে এক রুমে ২জন । এক বেড দেশি টাকায় ৫০ হাজার টাকা ভাড়া । পাউণ্ড বাতাসের মত উড়ে যাচ্ছে।

না দিয়ে উপায়ও নাই । ৫ পাউন্ডের টপ আপ ১০ মিনিট ও কথা বলা যায়না , তার আগেই শেষ । দেশ থেকে এসে গায়ে আগুন জলতেছিল অক্টবরের শীতে । ৬০০ টাকায় দেশে কত ক্ষন কথা বলা যেত ! বাকি থাকল আর ১ হাজার পাউন্ড । আমি তখনও ঘোরের মধ্যে।

কিভাবে এত খরচ সামলাব এমন কিছু মাথায় ভাবনাতেই আসেনি । পরের মাসে গাড়ি ভাড়া ,বাসা ভাড়া , খাবার ,ফোনবিল আর কিছু কেনা কাটা করে হাত খালি হয়ে এল । ছিল ৪০০ পাউন্ড । এইবার আমার টনক নড়ল । এম্নিতেই অনেক টাকা পয়সা খরচ করে ফেলেছি।

বাসা থেকে এতগুল কাচা টাকা দিয়েছে । এখন আবার টাকা কিভাবে চাই ?? শেষ পর্যন্ত অন্য ছেলেরা কেন এত দিন জব জব করছে তা বুঝতে পারলাম সেদিন ই বুঝলাম আমি অনেক বোকা । আর বাস্তব জ্ঞান আমার একেবারে ছিল না । থাকবে কিভাবে, বাসায় থাকতে কোন দিন কোন কাজ করতে হয়নি। এক গ্লাস পানিও নিজের হাতে নিয়ে এসে খেতাম না।

তাই কাজের কথা মাথায় আসেও নি। বাসায় বাবা মা চিন্তা করবে , তাই আর টাকার প্রয়জনের কথা বললাম না । বেমালুম চুপ করে থেকে ভাবছিলাম কি করব । ৫-৬ লাখ টাকা দিয়ে এসেছি । ফিরে গেলে সম্মান শেষ অকর্মা হিসেবে নাম রটে যাবে ।

যত যাই হোক একটা কিছু করে থাকার চিন্তা করলাম । রান্না করতে পারিনা । প্রতিদিন সকালে নুডুলস , বিকেলেও তাই , রাতেও তাই চলে । দেশে থাকতে কেন রান্না শিখিনি সে জন্য আফসোস লাগছিল । না খেয়ে ৭-৮ ঘন্টা ক্লাস করা যায়না ।

যা হোক আমার রুম্মেট হিসেবে যাকে পেলাম , সে বাংলাদেশী , বাড়ি ফেনি , নাম সালাউদ্দিন , বাচ্চা ছেলে । ইন্টার পাশ করে ভিসা নিয়ে লন্ডন এসেছে । এত অল্প বয়সেই বাবা মা বিদেশে ছেড়ে দিল কিভাবে , ভেবে অবাক হয়েছিলাম । সে আরেক ভাইয়ের পরিচিত । আমার সাথে থাকবে ।

আমাকে প্রথম দিন জিজ্ঞেস করেছিল ''আইন্নের দেশ কোনাই'' ? একটু আঞ্চলিক ধাচে কথা বলত। আমিও খুব মজা পেতাম । বললাম আমার বাড়ি ঢাকা । সে বল্ল , অ ঢাকা নি ? কি নতুন বাড়ি কইচ্চেন , না আগে আছিল ? আমি বললাম না আমাদের বিভাগ ঢাকা। পরের মাসেও ভাড়া দিলাম ।

হাত প্রায় খালি । ২ মাসেই ১৫০০ থেকে মাত্র ৫০ পউন্ড হাতে । বাসা থেকে আম্মা প্রতি দিন ফোন দিত । জিজ্ঞেস করলে বলতাম ভাল আছি । মিথ্যা বলতাম ।

ইচ্ছা করে । আসলে সত্য বললে আমার মা চিন্তা করবে । ফোন কেটে দিয়ে আমি কল করতাম আর বলতাম যেন চিন্তা না করে আমি ভাল আছি । বাংলাদেশে বাহিরে কথা বলা সাংঘাতিক খরচ । সালাউদ্দিন খুব এক্টিভ ছেলে ।

সে আমার সাথে থেকে কিছুটা অনুমান করতে পারত আমার ভেতরের ঘটনা কি ? একদিন বললাম টাকা প্রায় শেষ । সে আমাকে বল্ল '' ঘরে শুই শুই ফুটাঙ্গি করেন, হুতি থাইকলে আম্নেরে কে কাম দিব ? '' । আম্নে কাম টোকান না কিল্লাই ?? চলবে...। পর্ব ২- এখানে , Click This Link আগের পোস্ট মনালিসা ১) Click This Link ২)নবাব সিরাজ উদ-দৌল্লা-মীর জাফর ও বাংলার সকল পুতুল নবাব(ছবি ব্লগ) Click This Link ৩)মুঘল সম্রাট-সম্রাজ্ঞী , রাজকন্যা-রাজপুত্র আর তাদের সম্রাজ্য --এক্সক্লুসিভলি অন আমার ব্লগ বায়স্কোপে Click This Link ৩) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কিছু অনন্য সুন্দর মসজিদ--সাজিদ এহসান Click This Link ৪)বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর নামকরনের গল্প - Click This Link ৫)ইভ টিজিং , বাংলাদেশের মেয়েদের পোশাক পরিচ্ছদ কেমন হওয়া উচিৎ ? Click This Link  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।