আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লোডশেডিংও স্মৃতিময়

শুনলাম লোডশেডিং নাকি ভুলে যাওয়া ঠিক না। তাই স্মৃতিটা একটু ঝালাই করেই নিচ্ছি। ছোটবেলায় লোডশেডিং বলতে শুধু সন্ধ্যার পর একবার বা দু'বার এক ঘন্টার জন্য বিদ্যুৎ যাওয়া বুঝতাম। মাঝে মাঝে দিন আর সময় হিসাব করে যেত। যেমন প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর মঙ্গলবার রাত ৯ টায় বিদ্যুৎ চলে যেত।

ঐ সময় মঙ্গলবারগুলোতে বিটিভিতে ধারাবাহিক দেখাত পাক্ষিকভাবে। মানে এক মঙ্গলবার এক ধারাবাহিক, আরেক মঙ্গলবার আরেকটা। তাই এমন হত যে একটা ধারাবাহিক আমাদের একেবারেই দেখা হত না। প্রথম যেদিন দিনের বেলায়ও বিদ্যুৎ গেল, খুব অবাক হয়েছিলাম। যা হোক, আস্তে আস্তে যে পরিস্থিতি কোথায় গিয়েছে তা তো সবাই জানেই।

ছোটবেলায় বিদ্যুৎ গেলেই শুরু হত আমাদের খেলা। এই খেলাগুলো শুধু এই সময়ই খেলতাম। এগুলো নিয়ে আগে একবার লিখে ফেলেছি বলে এখন আর লিখলাম না। মাঝে মাঝে গরমের দিনে সন্ধ্যার পর লোডশেডিং-এর জন্য বিদ্যুৎ গেলেই ভাই-বোনরা সবাই ছাদে চলে যেতাম। এক ঘন্টা ছাদে হাঁটাহাঁটি করে গল্প করে বিদ্যুৎ আসার পর নেমে আসতাম।

মেজপাকে দেখতাম এইচএসসি পরীক্ষার সময় চার্জার লাইটসহ বই-খাতা নিয়ে ছাদে চলে যেত। আশেপাশের অনেক ছাদেই এই দৃশ্য দেখা যেত। আমি অবশ্য ঘরেই মোমবাতি বা হারিকেনের আলোয় পড়তাম। একবার বড় ধরণের একটা বিদ্যুৎ বিপর্যয় হয়েছিল। সম্ভবত আশুগঞ্জের পাওয়ার স্টেশনে কোন ঝামেলা হয়েছিল।

ঢাকা শহরের বিশাল এলাকা জুড়ে সারাদিন-রাত বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনরকমে ঘরে কাটিয়ে দিলেও এরপর সবাই ছাদে ছুট লাগালাম। এমন অন্ধকার ঢাকা শহর আর কখনই দেখিনি। তার উপর সেদিন ছিল অমাবশ্যা। আমি আবার তখন নবম শ্রেণীতে, নতুন নতুন ভুগোল পড়ে মহাকাশ সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করছি।

রাতে ছাদে গেলেই সপ্তর্ষিমন্ডল খুঁজে বের করি। এবারও তাই করলাম। সপ্তর্ষিমন্ডল তো খুঁজে পেলামই, সেই সাথে অবাক হয়ে লক্ষ করলাম এই গাঢ় অন্ধকারেও কালো কুচকুচে আকাশে একটা লম্বা সরলরেখার মত মেঘ দেখা যাচ্ছে যেটা মনে হচ্ছে আকাশের অনেক উপরে। চিন্তা করছিলাম এত অন্ধকারে মেঘ দেখা যাচ্ছে কিভাবে, আর মেঘটা এমন লম্বা রেখার মতই বা কেন। তখনই ধাঁ করে মাথায় এল, আরে এই লম্বা মেঘটা তো উত্তর থেকে দক্ষিণে গিয়েছে, এটা তো মেঘ না, এটা আমাদের মিল্কি ওয়ে।

চিৎকার করে সবাইকে ডেকে আমার আবিষ্কার () দেখালাম। মেজপা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুগোলের ছাত্রী। সেও আমাকে সমর্থন করল। আর সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলাম। এই দৃশ্য হয়তো আর কোনদিনও দেখা হবে না।

আস্তে আস্তে আরও অনেক তারা একে একে ফুটতে থাকল আর মিল্কি ওয়ে মিলিয়ে যেতে থাকল। আমরা গবেষণা করতে থাকলাম তারাগুলো নিয়ে। ঢাকার আকাশে এত তারা একসাথে কখনও দেখিনি। অনেক রাত পর্যন্ত ছাদেই কাটালাম। এরপর খাওয়া আর ঘুমের জন্য ঘরে ফিরলাম।

তবে আরেকদিন এমনটা হয়েছিল। সেদিন একটু মেঘলা ছিল। ভ্যাপসা গরমে এত লম্বা সময় বিদ্যুৎ না থাকায় মোটামুটি ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা। ছাদে তো আমরা গেলামই, আম্মাও থাকলেন না ঘরে, আমাদের সাথেই চললেন। শুধু আব্বা রয়ে গেলেন গরমের মধ্যে।

আম্মা পাটি বিছিয়ে বিছানা পেতে দিলেন ছাদে। শুয়ে পড়লাম সবাই। সেই রাতে ছাদেই ঘুমালাম আমরা। ভোরের দিকে হঠাৎ মনে হল এক ফোঁটা পানি পরল মুখের উপর। নিশ্চিত হতে আরেকটু অপেক্ষা করলাম।

হ্যাঁ, ঠিকই ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে কিছুক্ষণ পরপর। চমকে উঠে বললাম, পানি পড়ে কোত্থেকে? আম্মা আমার পাশে শুয়ে ছিলেন। বললেন, বৃষ্টি পড়ে, চুপ করে ঘুমা তো। আমি বলি, বৃষ্টির মধ্যে ঘুমাবো নাকি? আম্মা বললেন, কী হয়েছে তাতে, অল্পই তো বৃষ্টি। তা অবশ্য ঠিক, গরমের মধ্যে আরামই লাগছিল পানির ফোঁটাগুলো গায়ে পড়তে।

কিন্তু বেরসিক বৃষ্টি তোড়জোড় বাড়িয়ে দিল। বাধ্য হয়ে বিছানা-বালিশ গুটিয়ে দৌড় দিতে হল। ছাদ-ঘুম সেদিনের মত সেখানেই শেষ। যতদিন বাড়িতে আইপিএস লাগানো হয়নি, ততদিন এভাবেই কেটে যেত লোডশেডিং-এর সময়গুলো। অবশ্য আমি জঙ্গলে চলে আসায় আইপিএস-এর সুবিধা খুব বেশি উপভোগ করতে পারিনি।

এমন না যে জঙ্গলে আইপিএস লাগানো যায় না, কিন্তু কেন যেন একটা রাগ ধরে গিয়েছে এই জিনিসটার উপর। মাঝে মাঝে মনে হয় এই আইপিএস চার্জ করতে গিয়েই লোড শেডিং আরও বেড়ে গিয়েছে। জঙ্গলের লোড শেডিং-এর অবস্থা ঢাকার চেয়েও আরও ভয়াবহ। একবার বিদ্যুৎ গেলে আবার আসতেই ভুলে যায়। আর আসলে খুব তাড়াতাড়ি আবার যাওয়ার কথা মনে পড়ে যায়।

তাই বলতেই হয়, এখানে বিদ্যুৎ যায় না, মাঝে মাঝে আসে। ল্যাপটপ যখন নতুন কিনেছিলাম, লোডশেডিং হলেই গান ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে হাতপাখা চালাতাম। এই করে করে আমার ল্যাপটপের ব্যাটারীই গিয়েছে বিরক্ত হয়ে। এখন সে বিদ্যুৎ গেলেই শুয়ে পড়ে। বাতাস করেও তার মান ভাঙানো যায় না।

তাই তাকে ঘুমাতে দিয়ে আমিও শুয়ে থাকি। এখন অবশ্য আমি চার্জার ফ্যান চালিয়ে রাখি। যদিও এটা চার্জ হওয়ার সময় পায় খুব কম। তাই সেও প্রায়ই রাগ করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। তখন আবারও সেই হাত-পাখাই ভরসা।

আগে একটা কাজ করতাম মাঝে মাঝে। বিদ্যুৎ চলে গেলে ছাদে উঠে বসে থাকতাম বা হাঁটাহাঁটি করতাম একা একাই। সেটা যত রাতই হোক না কেন। একবার রাত একটার সময় আমি ছাদে উঠে চাঁদ দেখছি। অন্য ফ্ল্যাটের লোকজন হঠাৎ দেখতে পেয়ে মোটামুটি ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।

পরদিন ফলাও করে তারা প্রচার করে দিল যে আমি গভীর রাতে ছাদে ভুতনীর মত ঘুরে বেড়াই। লোকজন মনে মনে আমাকে জ্বীনে ধরা পাগলী ভেবে নিল কি না কে জানে। সেই লোক ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে আরও কয়েক রাত পরীক্ষা করেছিল, প্রতিরাতেই লোডশেডিং-এর সময় আমাকে ছাদেই পাওয়া গেল। এরপর থেকে আমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাত সে। এখনও কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি যে একা থাকেন, ভয় পান না? আমি বলি, না ভয় পাই না, আমি ভয় দেখাই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.