আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক জ্ঞানীর পতন,অথবা উত্থান

শেষ বারের মতো সতর্ক করছি... অনার্সে ভর্তী হয়েই এটা সেটার সাথে যুক্ত হতে থাকি। বছর খানেক হলো শিল্পকলায় আবৃত্তি শিখছি। নতুন নতুন কবিতা পড়ি। নতুন কবিতা শুনি, মাঝে মাঝে কবিতা লেখার চেষ্টাও করি। কি লিখি তা নিজেও ভাল জানতাম না।

এই আবোল তাবোল, যখন যা মনে আসে তাই লিখি, সবাই লিখে আমি না লিখলে প্রেসটিজ থাকে না। সবাইকে দেখাবার জন্য মাঝে মাঝে আবৃত্তির ডাইরিতেও লিখতে হতো। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের কবিতা পড়ার জন্য যখন আমার ডাইরিটা কেউ চাইতো, আমি সাগ্রহে এগিয়ে দিতাম। আবৃত্তি ক্লাসে কবিতা রচনার মোটামোটি একটা ধুম পরে যেত। আমি এই বিষয়ের বাইরেও অনেক আওল-ফাওল কাজের সাথে যুক্ত থাকার কারনে কবিতাকে খুব বেশি সময় দিতে পারতাম না।

আর দিলেই কি হতো? আমি তো আর কবি নই। কিন্তু অন্যরা যখন খাতা ভরে কবিতা দেখাত আমার কিছুটা হিংসে হতো। এত কবিতা! আমাদের আবৃত্তি ক্লাসে অনেকের মাঝে একজন ছিলেন ফ.রহমান। আমাদের সবার চেয়ে সিনিয়র। তিনি তখন মাস্টার্স পড়ছেন তাও আবার বাংলায়।

মুখ ভর্তী জামাতী কায়দার দাঁড়ি। সব সময় সাদা শার্ট কাল প্যান্টের ভেতরে ঢুকিয়ে ক্লাসে আসতেন। তিনি কেবল জামাতীদের মতো দাঁড়িই রাখেন নি তাদের সমর্থনও করতেন। জামাতিদের একটা প্রতিষ্ঠানের প্রন্সিপাল হিসেবেও দ্বায়িত্ব পালন করেছেন অনেক দিন। অতএব সকল বিবেচনায় তিনিই সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি।

একটা ব্যপার আমার ভালই জানা ছিল। বাংলাতে যারা পড়েন তাদের বেশির ভাগই অন্য বিষয়ে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বাংলায় ভর্তি হয়েছেন। এতএব তারা এই বিষয়ে পড়লেও তাদের বাংলার প্রতি আগ্রহ থকতো কম। সিলেবাসের মধ্যে আছে,পরীক্ষায় আসতে পারে এমন দু একটা বই এর বাইরে তাদের পড়াশোনা নাই বল্লেই চলে। তিনিও এর ব্যতিক্রম নন।

বই নিয়ে যখন কোন আলোচনা আসতো তিনি তখন থাকতে প্রায় নিরব। কখনো তার পড়ার বইয়ের প্রসঙ্গ আসলে আর কারো কথা বলার সুযোগ থাকতো না। তো সেই জ্ঞানী যখন কবিতা লিখতেন, কথা বলার সাহস খুব কম মানুষেরই হতো। তার কবিতা সব সময় আমাদের পড়তে দিত। অন্যদের কবিতাও সে পড়তো।

শুধু পড়তো নয়। কলম হাতে কাটাকাটিও করতো। এখানে ছন্দ ঠিক হয়নি, এখানের শব্দের ব্যবহারটা হয়নি,এই উপমাটা ভাল নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ পাঁচ লাইন কবিতা লিখেছেন তিনি তার মাঝে দশটা ভুল ধরতেন। যে যত যত্ন করেই কবিতা লিখুক না কেন ভুল তিনি ধরবেনই ধরবেন।

এটা আমার মোটেও পছন্দ হতো না। প্রত্যাকেই তার নিজস্ব ভাবনা চিন্তা,নিজস্ব ছন্দ, নিজস্ব ভাল লাগা নিয়েই কবিতা লিখবে এটাই তো স্বাভাবিক। সব কবিতা ফ.রহমানের পছন্দ মতো হতে হবে এটা কেন? আর তার পছন্দ হলেই যে তা যথার্থ কবিতা তাই কি ভাবে নিশ্চিত হই? হোস্টেলে থাকি, জমিয়ে আড্ডা দেই। রাত জেগে বই পড়ি,একাডেমিক বই ছাড়া। সালমা প্রকাশনীর সঞ্চয়ীতা কিনে খুবই ফূর্তিতে আছি।

রাত জেগে কবিতা পড়ি। কখনো মনে মনে, কখনো উচ্চ স্বরে। জীবনানন্দ শুরো করেছি। টাকার সমস্যা আছে কিন্তু পুরাতন বই এর দোকান তো আছে। নিজের পছন্দ মতো নয় দোকানে যা পাওয়া যায় তার মধ্য থেকে বেছে বেছে কিনি।

সেদিন ক্লাসে সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছি। কবিতার আলাপ শুরো হলো। আমি আমার ডাইরিটা এগিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম দেখেন তো কবিতাটা কেমন? প্রথমেই ফ.রহমান নিলেন, পড়তে শুরো করেই কলম চালালেন। এই খানে শব্দটা ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। এই লাইনের কথাটা ভুল এই খানে এমন, এই খানে তেমন ইত্যাদি ইত্যাদি।

মোটা মোটি আগের চেয়ে আজকের কর্তন অনেক বেশি। তার কথা মতো সংশোধন করতে চাইলে পুরো কবিতাটাই পরিবর্তন করতে হয়। আমি চুপ করে বসে আছি। সবাই ডাইরিটা হাতে নিচ্ছে, আর হাসছে, আমাকে নিয়ে অল্প বিস্তর সবাই ঠাট্টা করছে, হাসা হাসি করছে। তবু কিছু বললাম না, আমি ভাল করেই জানি শেষ হাসিটা আমিই হাসবো।

স্যার আসার পরে কবিতা পড়া শুরো হলো। আমি সেই কবিতাটাই পড়তে শুরো করলাম। কবির নামের জায়গাটা রবীন্দ্রনাথকে ফিরিয়ে দিলাম। আমার নামের পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথের নাম হা হা হা...। সবাই বুঝতে পারছে এতক্ষন , রবীন্দ্রনাথের কবিতাই কাটাকাটি করেছে।

সেদিন রবীন্দ্র নাথের একটা কবিতা পড়তে পড়তে বেশি ভাল লেগে যায়। পরদিন ক্লাসে পড়বো বলে ডাইরিতে লিখেফেলি। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভাষা শুদ্ধ করার ব্যপারটা সবাইকে আবার দেখতে দিলাম। পরে আর কোন দিন তিনি অন্যের কবিতা নিয়ে নাক গালাতে দেখি নাই। কয়েক মাস আগে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে সেই ফ.রহমানের সাথে দেখা।

তিনি নতুন একটি কলেজে জয়েন করেছেন। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পরে বঙ্গবন্ধু নামে অনেক কলেজ হয়েছে,এই নামের কলেজ এমপিও ভুক্ত হতেও সময় লাগেনা। অতএব সেই বঙ্গবন্ধুর নামে কলেজের তিনি এখন বাংলা পড়ান। মুক্তিযুদ্ধের মহানাকয়ের নামে কলেজ। আওয়ামীলীগ এখন ক্ষমতায়।

সেই কলেজে জামাতে ইসলাম শিক্ষা দান করেন। সেই শিক্ষাটা আবার বাংলা । যারা বাংলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা বলে গালী দিয়েছে, যারা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অবস্থান করেছে। এখনো জামাতীদের অনেক নেতাই নাকি বাড়িতে উর্দুতে কথা বলেন। আমরা জামাতীদের কাছে থেকে বাংলা শিখছি! এই আমাদের বাংলা...... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।