আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সৌম্যদর্শন নুরানী সার্জন

সময়ের সমুদ্রের পার--- কালকের ভোরে আর আজকের এই অন্ধকারে সার্জারী ক্লাশে যেতেই একজন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধের সাথে দেখা হল। চেহারা দেখেই তাকে পছন্দ হয়ে গেল। ভালোবেসে ফেললাম। দূর থেকে ভালোবাসার প্রকাশ হয় না। ভালোবাসার প্রকাশ করতে কাছে যেতে হয়।

আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। স্যারের নুরানী চেহারা দেখে আবিভুত হয়ে গেলাম। তার শরীরের নুরের ছটা আমিও একটু নিতে চাই। তার আলোয় আলোকিত হতে চাই। এতো বড় চাঁদ যদি সুর্যের আলোয় আলোকিত হতে লজ্জা না পায়, আমি পাব কেন? ভালোবেসে আরো কাছে এগিয়ে গেলাম।

সামনে একটা পুরাতন মডেলের টেলিভিশন চলছে। সবাই মিলে সিনেমা দেখছে। এখন নাকি সালমান খানের সিনেমা ব্লকবাস্টার হিট হয়ে যাচ্ছে। এই স্যারের সালমান ভক্ত হওয়ার সখ কিভাবে হলো বোধগম্য হচ্ছে না। সিনেমা চলছে সাউন্ড নেই।

স্যাররা মনে হয় নির্বাক চলচিত্র যুগের মানুষ। মিহি স্বরে বললাম, ‘স্যার একটু সাউন্ড দেন না। ডায়ালগ না শুনলে সিনেমার কাহিনী বুঝব কেমনে?’ গলার আওয়াজ খুব নিচু করেই বলেছিলাম। সিনেমার কাহিনী বুঝতে অন্যদের যেন সমস্যা না হয়। স্যার আমার দিকে তাকালেন।

দৃষ্টিতে আগুন। এই আগুন ঝরা দৃষ্টি স্যারকে মানিয়েছে। সৌমদর্শন নুরানী চেহারার মানুষের চোখের দৃষ্টিতে আগুন না থাকলে তাকে পুরুষ পুরুষ লাগে না। মনে হয় শারীরিক ভাবে কিছু একটার অভাব আছে। আমি ভয়ে ভয়ে স্যারকে বললাম, ‘সরি স্যার, মাইন্ড করবেন না।

আমার কথায় আপনার সিনেমা দেখার ব্যাঘাত ঘটেছে। কোন ডায়ালগ মিস করলে আমি আপনাকে পরে বুঝিয়ে দিব। আমি সবাক যুগের মানূষ। সাউন্ড ছাড়া সিনেমা সহ্য করতে পারছি না। দয়া করে কি বক্স লাগানো যাবে? সমস্যা নেই স্যার, হোস্টেলে আমার রুমে দুইটা সাউন্ড বক্স আছে।

নতুন কেনা। দুই হাজার টাকা নিয়েছে। গ্যারান্টি পাঁচ বছর। আমি কি আনব স্যার। এক দৌড়ে হোস্টেলে যাব আর আনব।

’ আমার কথায় সবাই মনে হয় বিরক্ত হলো। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সবার দৃষ্টিতে ভয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। সিনেমা দেখার ব্যাঘাত ঘটলে বিরক্ত হওয়ার কথা। ভয় পাবে কেন? কোথাও কিছু ভুল হচ্ছে।

Anithing, thats going wrong? আমি ভয়ে ভয়ে আমার ব্যাচমেটদের কাছে যেতে শুরু করলাম। পেছন থেকে আমার এপ্রোনের কলার টেনে ধরেছে কেউ। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। সামনের বন্ধুরা ভীত চোখে তাকাচ্ছে। ওদের চোখ কোটর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।

আমিও ভয়ে ভয়ে পেছনে ঘুরলাম। সৌমদর্শন নুরানী চেহারার বৃদ্ধ আমার এপ্রোনের কলার টেনে ধরেছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সরি স্যার। আমি কি এখনোই যাব সাউন্ড বক্স আনতে?’ স্যারের গলা হিসহস করছে। অজগর কি এই ভাবে শব্দ করে? আমি অবাক হয়ে গেলাম।

অজগর কিভাবে হিসহিস করে আমি জানি না। এটা আমার জানার কথা না। হিসহিস করে স্যার বললেন, ‘...রের বাচ্চা এটা টেলিভিশন না। এটাতে সিনেমা দেখানো হচ্ছে না। অপারেশন চলছে।

ল্যাপারোস্কপি অপারেশন। ’ ( শুন্যস্থানে একটা চতুষ্পদ প্রানীর নাম বসবে। এই প্রানীগুলো মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ। এদের প্রিয় খাবার কচু। খাওয়ার সময় ঘোঁৎঘোঁৎ জাতীয় শব্দ করে) ‘দুঃখিত স্যার।

আমি আসলে বুঝতে পারিনি। এর পর থেকে আর এমন ভুল হবে না। ’ ‘এই কথা বললে তো হবে না সোঁনাচান। দেরী করে ক্লাশে ঢুকেছ কেন? এতোক্ষন কোথায় ছিলে? নিশ্চয় কোন মাইয়ার পিছে ফিল্ডিং মারছিলে?’ ‘হারাম বলছি স্যার। এই কাজটা আমার বাবাও করতে পারবে না।

আমি তো দুরের কথা। ’ ‘এর মাঝে বাবা মাকে আনলি কেনরে? যাহ তোকে বলায় ভুল হয়েছে। কলিকালের ছেলেদের মাঝে বাপ-মার প্রতি কোন সম্মান নাই। এরা এমন অবস্থায় পৌছে গেছে যে লজ্জায় বমি আসে। মাইয়া নিয়ে রুম ডেটিং করতে এখন বাড়ীতে আসে।

বাপ-মারে বাড়ী থেকে বের করে দেয়। ’ ‘আল্লাহর কসম স্যার, এই কাজ আমার দ্বারা জীবনেও সংঘটিত নাই। হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ’ ‘কেনরে, তুই কি ফেরেশতা? ‘না স্যার। আমি ফেরেশতা না।

আমি একজন মানুষ-সাধারন মানুষ। রুম ডেটিং কিভাবে করব? আমার তো বাসায় নাই। বাপে বাসাবাড়ী বিক্রি করে দিছে। দেনায় ডুবে গেছিল। কাধ পর্যন্ত।

’ এই কথার সাথে সাথে স্যারের মুখের নুরানী ভাব উধাও হয়ে গেল। সেখানে একটা সমদেদনার স্পষ্ট প্রতিবিম্ব ফুটে উঠল। শোনা যায় না এমন ধীরে বললেন, ‘যা সামনে থেকে। ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে দাড়া। অপারেশন দেখ।

কিছু শেখার চেষ্টা কর। বড় হলে কামে লাগব। ’ আমি ব্যাচমেটদের মাঝে এসে বসে পড়লাম। স্যার অপারেশন করছেন। অপারেশনের নাম ল্যাপারোস্কপি।

পেটে চারটা ফুটো করে ক্যামেরা ও কাচি ঢুকানো হয়। এরপর মনিটরে দেখে দেখে পেটের মধ্যে অপারেশন করা হয়। অপারেশন এক ঘন্টা হয়ে গেছে। এতোক্ষনে তিনটা অপারেশন হওয়ার কথা। তিনটা হয় নি।

প্রথম রোগীটাই আছে। পেটের মধ্যে ক্যামেরা ঢুকছে না। পেরিটোনিয়াম নামক পর্দাটিতে গিয়ে বাধা পাচ্ছে। একটা একটা করে পেটের মাঝে সাতটা ফুটো হয়ে গেল। সৌমদর্শন বৃদ্ধ পাশের সহকর্মী ডাক্তারকে অনেকক্ষন আগে থেকেই ঝাড়ি দিয়ে যাচ্ছেন।

বেচারা ভয়ে জাবুথাবু হয়ে আছে। অপারেশন শেষ হলেই বাঁচে। আমি তার নিচের দিকে তাকালাম। কোন পানির প্রবাহ ধারা দেখতে পেলাম না। শীঘ্রই দেখা যাবে বলে আশা রাখি।

স্যারের ধমকের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সহকর্মীর কাঁপুনীও অনেক বেড়ে গেছে। স্যার চিৎকার করে সহকর্মীকে বললেন, ‘গাধার বাচ্চা, কাচি দে। হা করে তাকাই আছিস কেন? মুখ বন্ধ কর। মাছি ঢুকে পড়বে।

সহকর্মী পাশের যন্ত্রপাতিতে দ্রুত হাত চালাচ্ছেন। কাচি খুজে পাচ্ছেন না। এখানে বলে রাখা ভালো, ল্যাপারোস্কপিতে যে ছুরি কাচি ব্যবহৃত হয় সেগুলো আদৌ ছুরি কাচি কিনা সবাই বুঝতে পারবে না। এখানে সুতা দিয়ে সেলাই দেয়া হয় না। স্টেপলেস পিন দিয়ে সুতার কাজ চালিয়ে নেওয়া হয়।

ওদিকে স্যার আবার চিৎকার করছেন, ‘কিরে এখনো পাস নাই? রোগী তো মরে গেল রে। ’ ‘স্যার কাচি তো খুজে পাচ্ছি না। ’ স্যার ভয়াবহ রেগে গেলেন। রাগের মাথায় মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললেন। ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে বলেই ফেললেন, ‘কাচি খুজে পাস না।

এখানে কি জন্যে আইছস? মাগী বাজাইতে আইছস?’ ছাত্রছাত্রী, পোস্ট গ্রাজুয়েশন অধ্যয়নরত সবাই হতভম্ভ। হতভম্ভ ভাব ধরে রাখার জন্য স্যার কাউকে সময় দিলেন না। সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কয়টা ফুটো হয়েছে রে?’ ‘এখন পর্যন্ত সাতটা ফুটো হয়েছে স্যার। আরো লাগবে স্যার? শুধু বলেন। আমি প্রস্তুত।

’ ‘হ্যা রে হারাধন। তুই তো অনেক চালাক। আমার কথা না শুনেই বুঝে গেছিস। তোর বুদ্ধি দেখে আমি চমকিত। কর ফুটা আরো চারটা।

সাতটা ফুটা করার পরও গলব্লাডার দেখা যাচ্ছে না। ’ ‘ওকে স্যার। ’ রোগীর পেটে চারটার বদলে এখন এগারোটা ফুটো। এই ফুটো দিয়ে রোগী কি করবে আমি বুঝতে পারছি না। বাতাস খেতে পারে।

হেমন্ত কালে দখিন দিকে মুখ করে থাকবে। দখিনা বাতাসে পেটের সকল অঙ্গ জুড়িয়ে যাবে। আমিও ভাবতেছি পেটের মাঝে কয়েকটা ফুটা করে নিব কি না! স্যার সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি এখন কি কাটছি রে?’ ‘স্যার কাপড় কাটছেন। ডাক্তাররা নাকি দর্জির মতো। হার্নিয়া-হাইড্রোসিল সেলাই দিলেই বোঝা যায় আমরা দর্জি হিসাবেও কম না।

’ ‘নারে গর্ধব, মনে হয় একটা ধমনী কেটে ফেলেছি। ’ ‘এখন কি হবে স্যার। ’ সহকর্মীর মুখে ভয়ের ছাপ। ‘কিছু হবে নারে গাধা। এখন আমরা দেখব রক্তের ধারা।

কি সুন্দর করে রক্ত প্রবাহিত হয়। কূলকুল করে প্রবাহিত হয়। প্রবাহ দেখে আমরা পুলকিত হব। সাথে একটু চমকিত হব। তুই খূশি নারে?’ ‘অবশ্যই খূশি স্যার।

আপনি ধমনী না কাটলে আমরা বুঝতেই পারতাম না যে মানুষের দেহে ঝরনাধারা আছে। সেই ঝর্নার পানি কুলকুল করে প্রবাহিত হয়। স্যার ঝর্না নিয়ে একটা কবিতা মনে পড়েছে। আমি কি সেই কবিতা বলব?’ স্যারের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সহকর্মী কবিতা বলা শুরু করে দিল। কবিতার সাথে সাথে তিনি মৃদু আওয়াজে হাততালি দিচ্ছেন।

সাথে কোমরও ঝাকাচ্ছেন। ‘ঝর্না ঝর্না সুন্দরী ঝর্না তরলিত চন্দ্রিকা চন্দন বর্না’ স্যারের কন্ঠ আবার হিসহিস করে উঠছে। তিনি কখনোই ভাবতে পারেননি তার সামনে কেউ এভাবে কোমর ঝাকাতে পারে। হাততালি দিয়ে কবিতা বলতে পারে। গগন ফাঁটানো শব্দে চিৎকার করে উঠলেন, ‘শুয়োরের বাচ্চা, একটা মানুষ মরে যাচ্ছে আর তুই নাচছিস? পেট কাট, সেলাই দিতে হবে।

’ দীর্ঘক্ষন পর স্যারকে আরেকবার ভালো লাগল। মেজাজ আর নাচানাচির মাঝেও তিনি তার বোধ শক্তি হারাননি। রোগীর জন্য তার অনেকটা মমতা আছে। সবার মাঝে এটা থাকে না। হাস্য রসাত্মক সহকর্মীর মাঝেও এটা নেই।

আমরা অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হচ্ছি। ক্লাশের সময় শেষ। পরবর্তী লেকচারের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। সৌমদর্শন বৃদ্ধলোকটি আমাকে পিছু ডাকলেন। কাছে যেতেই বললেন, ‘কিছু মনে করিস না বাবা।

মাঝখানে রাগারাগি বাদ দিয়েছিলাম। কেউ কথা শোনে না। আবার শুরু করেছি। দেখ রোগীটার জ্ঞান ফিরেছে। ’ স্যারের সাথে রোগীর সামনে গেলাম।

বৃদ্ধা মহিলা। বয়সে স্যারের চাইতেও অনেকগুন বৃদ্ধা। রোগী স্যারের একটা হাত জাপটে ধরেছেন। অনেক কষ্টে বললেন, ‘কিরে খোকা কেমন আছিস? অপারেশন করতে তোর কোন কষ্ট হয় নি? অনেকক্ষন দাড়িয়েছিলি। পা মনে হয় ব্যাথা করছে।

এখন একটু বস। আমার পাশে বস। ’ বৃদ্ধার চোখে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কে যেন পাশ থেকে বলল, ‘ইনি স্যারের মা। ’ আমি স্যারের দিকে তাকালাম।

স্যারের চোখ দিয়েও পানি পড়ছে। কুলকুল করে। ঝর্না ধারার মতো। চন্দন বর্না ঝর্নার মতো। ‘ঝর্না ঝর্না সুন্দরী ঝর্না তরলিত চন্দ্রিকা চঁন্দন বর্না।

। ” ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.