আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গনসচেতনতায়ঃ আব্দুল মালেক

শিরোনামটি অবশ্যই একজনের পরিচয়। কিন্তু কে সে?তাকে কেনই বা শিরোনাম করতে গেলাম? হ্যাঁ, আমাদের হাজারো ব্যস্ততায় এই ব্যক্তি কেন এত কৌতুহলের কারন হবে? প্রশ্নগুলো আমারও হতো। কেন না আমিও মধ্যবিত্তের স্বভাবসুলভ চরিত্র ধারন করি। অন্যের অনেক লেখাই আমি এড়িয়ে যাই কেন না সেটা আমার সাথে যায় না। এখন আমি সবার মত এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করি।

সামাজিক দায়িত্ব আর দায়বোধ থেকে কিছুই করতে ভাল লাগে না কিংবা করার আগে লাভ ক্ষতির তত্ত্ব ঝেড়ে পিছপা হই বা অন্যকে অনুৎসাহিত করবার ক্ষেত্রে পিছপা হই না। তবে মধ্যবিত্তের বাইরেও একটা জগৎ আছে। এটা প্রথম শুনেছিলাম আমার বড় ভাইয়ের কাছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তখন। আসলেই কি তা সম্ভব।

কুয়োর ব্যাঙের মত অবস্থা হয়েছে আমাদের। নিজের প্রতিবেশী চিনি না, তার বাসায় ছোট যে মেয়েটি কাজ করে তাকে চেনার তো প্রশ্নই আসেনা। নাক গলাই না কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে। বেশ আছি আমরা। আবার টিভির পর্দায় যখন বিভৎস ছবি ভেসে আসে তখন শংকিত হই।

ঘৃন্যসব কর্মকান্ড দেখে দোষ দেই আমাদের আসে পাশের পরিবেশকে। বিবেকের কাছে প্রশ্নগুলো বিটিভির দলীয় পেচাল মনে হয়। হাজারো অপকর্মের প্রত্যক্ষদর্শি হয়েও চুপ থাকাকেই যথার্থ মনে করি। আবার রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে এরকম ইউটোপিয়ায় ভুগি। তাই আমাদের জগতের স্ববিরোধিতার ঘোরপাকে অন্যকিছু থাকতে পারে এটা কল্পনাতেও আসেনা।

যাই হোক খেই হারিয়ে ফেলেছি আমরা, তখন আব্দুল মালেককে কেন জানতে হবে এটা জানা কতটা জরুরী আমাদের জন্য, উত্তরটি দেওয়ার চেষ্টা করি। আব্দুল মালেককে বনানীতে বেশী দেখা যায়, পেশায় তিনি একজন হকার, তার বিক্রিত পন্যের গুনাগুন নিয়ে সঠিকভাবে কেউ জানে কিনা জানিনা, তবে আমি খুব একটা জানিনা। যুষ্টি মধু বিক্রি করে থাকেন তিনি, যারা বনানী থেকে বাসে চড়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করেন তারা হয়ত তাকে দেখে থাকবেন। শর্দি কাশির ঔষধ হিসেবে কাজ করে যুষ্টি মধু। আমার ভেষজ জ্ঞান এই পর্যন্তই।

তবে আরেক বড় রোগের ঔষধ খুঁজে ফিরছেন তিনি, আমাদেরকে অবক্ষয় থেকে বাঁচাবার জন্য যা কাজ করবে। আমি জানি না সে সফলকাম হবে কিনা, তবে আমাদের মাঝে জোরে নাড়া দেবার জন্য তার এই চেষ্টা সফল না হলে ক্ষতি আমাদের সবারই হবে। দেশ বাংলা বাস সার্ভিস সহ ঢাকার সিটিং সার্ভিসগুলোতে তিনি আমাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন। পোস্টারে গ্রামের ভাগ্যপীড়িত অনাহারে থাকা পরিবারের সন্তানদের উপর অমানুষিক নির্যাতনের বিভৎস কিছু ছবি পরিবেশন করা হয়েছে। সবার শরীরেই ধারালো ও উত্তপ্ত অস্ত্রের ক্ষত চিহ্ন।

কি পরিমান ঘৃনা আর পৈশাচিকতা মানুষের মনে কাজ করলে এই ঘৃন্য অপরাধ আমাদের কাছে সহজ মনে হয় জানিনা। কিন্তু নির্যাতনের পরে অনুতপ্ত হই নাকি পুলিশের বা আইনের কাছে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবার কারনে মুখ খানা অনুতাপের আদলে সাজিয়ে নেই। কারন এই একি মুখের ভয়ানক দৈত্যের কাছেই সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে গ্রামের অসহায় কোন ভাগ্যপীড়িত পরিবারের মেয়েটি। এসব দেখে আমরা পরিবর্তন চাইনি। মাঠে নামিনি।

টিভির পর্দায় দেখে তাড়াতাড়ি চ্যানেল ঘুরিয়ে পজিটিভ বাংলাদেশ খুঁজে বেড়িয়েছি কোন জাঁকজমকপূর্ন অনুষ্ঠানে। সামাজিক পরিবর্তন এমনিই হয়ে যাবে এ আশা করা বোকার স্বর্গে থাকা এক কথা। এখন আমরা নিজ বাড়িতে নিরপত্তাহীনতায় ভুগি কিন্তু পাশের বাড়িতে কি ভয়ানক অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে সে ব্যাপারে আমরা উদাসীন, ভাবলেশহীন। আজকে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি। সদ্য সংগঠিত সাংবাদিক দম্পতির নির্মম হত্যাকান্ড এটাই প্রমান করে যে একই সমাজে বসবাসকারীদের একে অপরের বিচ্ছিন্নতার মাত্রা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে।

তাতে নিশ্চয় আমাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বরং এখন জীবন বাঁচানোর তাগিদের জন্য হলেও আমাদের মাঝের দুরত্বগুলো কমিয়ে আনার প্রয়োজন। সেটা অবশ্যই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে পার করে দেওয়া যাবে না। সবার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানোর সামর্থ্যও বিবেচনায় আনতে হবে। ঘরের ভেতর ও বাহিরের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সামাজিক সম্মিলিত উদ্যোগের বিকল্প নেই।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বাসায় শিশু শ্রমের প্রচন্ড বিরোধিতা করি, এর শেষ সামাজিক বৈষম্য নির্মূলের মধ্যদিয়েই সম্ভব। সে এক নতুন সমাজের কল্পনা অবশ্যই। কিন্তু এখনকার যে বাস্তব পরিস্থিতিতে আমরা বসবাস করি সেখানে শিশু শ্রম বন্ধ হবার সম্ভবনা তৈরির মানসিকতা ও বাস্তব অবজেকটিভ কন্ডিশন দুটোই অনুপস্থিত। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে চেষ্টা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, তাতে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায় যে শিশু শ্রমের বন্ধ খুব তাড়াতাড়ি হচ্ছে না। তাই বলে তাদের উপর অমানুষের মত চড়াও হবার বিহিত করতে আমাদের কিছু করার নেই এটা বোধ হয় ঠিক নয়।

আমার পাশের বাসায় কেঁদে ওঠা শিশুটির ব্যাপারে জানবার অধিকার আমার আছে। হোক সে বাড়িওয়ালার শিশু সন্তান। এ অধিকার হয়তবা দেওয়া নেই বা লিখিত নেই তবে মানুষের স্বাভাবিক সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই এটা করা উচিত। একেবারে নুন্যতম দায়িত্বও বলা যেতে পারে। আমি ঢাকায় দেখেছি অনেক বাড়ির কাজের শিশুটিকে ঘরে তালা বন্ধ করে রেখে যাওয়া হয়।

একটি শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার জন্য নিজের বাচ্চার ক্ষেত্রে কি আমরা সেটা করি? এরপরে যদি নির্মম আচরন করি আমরা এই শিশুটি কি কখনই সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে? আমরা অনেক সচেতন দাবী করলেও শিশু সাইকোলজি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান যে নিতান্তই কম তা অবশ্যই আমাদের স্বীকার করা দরকার। বাসায় কাজ করবার ক্ষেত্রে সরকারীভাবে কোন নির্ধারিত বেতন কাঠামো নেই, এটা অনেকটা গ্রামের গরীব মানুষের সাথে শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সাথের দরকষাকষিতে নির্ধারিত হয়। তাই সহজেই অনুমেয় কত পায় তারা। আমি অনেক বাড়িতে গিয়ে দেখেছি, সেগুলোতে এলিট ক্লাসের লোকজনরাই থাকে। কিন্তু তার ঘরের কাজের শিশুটির গায়ে ময়লা একখানা ছেঁড়া জামা।

কষ্ট লাগে এদের বিবেচনা বোধের জীর্ণ দশা দেখে। তারপর আরো খারাপ লাগে যে কথাটা খুব আস্তে বলা যায় সেটা রেগে ফুলে ফেপে গাড়ির শব্দের থেকে জোরে বলার একটা প্রতিযোগিতা আছে এদের মাঝে। এটা যে বাসায় ছোট কাজের মেয়ে আছে সেখানকার স্বাভাবিক চিত্র। তারপর আসে অকথ্য নির্যাতনের খবর। মিডিয়ায় যা দেখি সেটা বাস্তবতার এক ভাগ কিনা সন্দেহ হয় আমার।

আসলে আমাদের সবার মাঝে এক্সপ্লয়েট করার এই মানসিকতা সৃষ্টির শুরু থেকেই চলে আসছে। তাই অবুঝ শিশুটিও যে রেহাই পাবে না যদি না আমরা পরিবর্তন চাই। আব্দুল মালেকের মত হাজারো পরিবারের অসহায় মানুষগুলো যারা দুবেলা ঠিক মত খেতে পারে না বলে, নিজের সন্তানকে অন্যের বাসায় কাজ করতে পাঠিয়েছে তারা চায়। তারা পরিবর্তন চায় এই মানসিকতার। তাই শিক্ষিত সমাজেও যে কুশিক্ষা রয়েছে সেটা উপড়ে ফেলতে আব্দুল মালেকের এই ক্যাম্পেনে আমাদের শামিল হওয়া প্রয়োজন।

আমরা যারা কিছুটা পরিবর্তন চাই তাদের উচিত আব্দুল মালেকের পাশে দাঁড়ানো। এখানেই আব্দুল মালেক আমাদের চেয়ে অনেক বড়। উচু দালানের মাঝে থেকেও আমরা তার থেকে অনেক ছোট। একটি আবেদন রাখব, যারা আমার লেখাটি দ্বারা এই মানুষটিকে কিছুটা হলেও চিনতে পেরেছেন, তারা নিশ্চয়ই এই মানুষটি যখন জীবিকার তাগিদে আপনাদের কাছে আসবেন তখন তাকে ফিরিয়ে দেবেন না। কারন তিনি শুধু নিজেকে নিয়ে নয় এই সমাজ সম্পর্কে ভাবছেন।

আমাদের অবক্ষয় গুলোকে তিনি শুধরানোর চেষ্টা করছেন। এদের সংখ্যা আমাদের সমাজে খুব কম। শেষ করতে চাই এক অন্ধ লে.কর্নেল এর কাহিনী দিয়ে। তার নাম ছিল স্লেইড। এক ছাত্রের জীবন নিয়ে যখন সমাজের এলিট শ্রেনীর লোকের ছিনিমিনি খেলবার চেষ্টা করছিল তখন স্লেইড তার বিচক্ষন বাগ্মিতায় বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল এই ছাত্র সততা আর মানবিকতার এক ঊজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বলেছিল “youyouf you have his life in your hand committe, embrace it, he is going to make you proud oneday”. আব্দুল মালেকের ব্যাপারে আমারও একই আবেদন থাকবে আপনাদের কাছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.