সাইফ শাহজাহান
শান্তনু কায়সার, লেখক
শুচি সৈয়দ
“প্রকাশকরা বলতে পছন্দ করেন, একুশের এক বইমেলা শেষ হলে পরবর্তী বইমেলার জন্য তাদের প্রস্তুতি শুরু হয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, আগের বছরের ডিসেম্বরে তাড়াহুড়া থেকেই শুরু হয় তাদের ‘প্রস্তুতি’। সারা বছরের শিথিল তৎপরতা ডিসেম্বরে এসে ‘গতি’ পায়। ব্যাপারটা কতটা স্বাস্থ্যকর, বই প্রকাশের পক্ষে প্রকৃতই কতটা অনুকূল, সে কথা সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন। তবু বৃত্তাকারে তাই চলতে থাকে।
” অমর একুশের গ্রন্থমেলা প্রসঙ্গে লেখক শান্তনু কায়সার এ কথাগুলো বলেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের গণতন্ত্রের মতোই বইয়ের অবস্থাও সাংঘাতিক করুণ। অমুক মহান ব্যক্তি অমুককে অমুক করেছেন বলে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানোর নানা ডিজিটাল পোস্টার এবং ব্যানার শোভা পায়। করুণা দান ও গ্রহণের এ প্রক্রিয়ার নামই নাকি গণতন্ত্র, যেভাবে বইয়ের সংখ্যা জানান দেয়া হয় ব্যানারে, পোস্টারে, বিলবোর্ডে পর্যন্তÑ তা থেকেই এ সত্য অনুমেয় যে, আমরা আসলে কী ব্যক্তি, কী সামাজিক জীবনে প্রকৃতই কতটা গ্রন্থপ্রেমিক!
তিনি বলেন, সান্ধ্য ও নৈশ সময় কাটানোর বিকল্প হয়ে উঠছে কি বইমেলা? অনেকটা নাগরিক বিনোদনের আয়োজন বলে মনে হয়। বইমেলাকে ঘিরে বুদ্ধিবৃত্তিক সাংস্কৃতিক তৎপরতার কথা ভাবা প্রয়োজন।
যে তৎপরতা বইকে সত্যিকার অর্থে আমাদের জীবনে পরম বন্ধু, সহযাত্রী প্রতিপন্ন করবে। এক্ষেত্রে একমাত্র আশার কথা, সংখ্যাগত বিষয়টি যদি গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়!
এভাবে মেলায় তার ‘সার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ, না নিন্দা না স্তুতি, না দূষণ’ আগেই বেরিয়েছে, সদ্য বেরিয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ : চার অধ্যায়’; বেরুনোর কথা ‘নজরুল কেন নজরুল’ এবং ‘নাট্যত্রয়ী’।
ধুলার জন্য মানুষ ঘরে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়ে
Ñহরিপদ দত্ত, লেখক
শুচি সৈয়দ
কথাসাহিত্যিক হরিপদ দত্ত অমর একুশের গ্রন্থমেলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এবারের বইমেলা খুব একটা সুখকর নয়। বাংলা একাডেমীর এক চিলতে মাঠে ধারণক্ষমতার অধিক স্টল। অসংখ্য অলিগলি।
এতটা সংকীর্ণ গলি, সামান্য ভিড় হলে নাভিশ্বাস ওঠে। অন্য জেলা থেকে আসা ক্রেতা তো দূরের কথা, যাদের নিত্যদিন একাডেমিতে আসা-যাওয়া তাদের পক্ষেও প্রয়োজনীয় স্টলটি খুঁজে গলদঘর্ম হতে হয়। দৃষ্টিভ্রম ঘটে। গোলকধাঁধায় পড়তে হয়। এই অবস্থায় শিশু কিংবা বয়স্করা মেলামুখী হতে ভয় পান।
ধুলার কথা তো বলাই বাহুল্য। ধুলার জন্য মানুষ ঘরে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ’ তিনি বলেন, বই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। উচ্চমূল্য তো মুনাফার হাত ধরেই আসে। এখানে মুনাফার প্রতিযোগিতা, সৃষ্টিশীলতার নয়।
তার ভাষায়, ‘একুশের বইমেলা নিয়ে সমাজের নানাজন নানা কথা বলেছেন এবং বলছেন, বলবেন। গুণীজন থেকে শুরু করে বই বিক্রেতা, ক্রেতা, বিনোদনপ্রিয় যুবক-যুবতী, পিতার হাতধরা শিশু-কিশোর এমনকি মেলায় আগত রাস্তার ফেরিওয়ালা মায় ভিক্ষুক। সব কথার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অর্থনীতি। এমনকি যারা উচ্চ আদর্শ কিংবা জ্ঞানচর্চার কথা বলেন, সেখানেও অতি সূক্ষ্মভাবে থাকে সেই অর্থনীতিই। কথা ওঠে মেলাটাকে বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে।
গভীর বিবেচনায় যে বাস্তবতাটি বেরিয়ে আসে তা হচ্ছে পুঁজির মুনাফা। একটি পুঁজিবাদী দেশে এর বাইরে কোন অন্য বাস্তবতা নেই। বই বাজারেও পুঁজি থাবা ফেলেছে। তাই অধিক মুনাফাই বই প্রকাশকদের উদ্দেশ্য। সেসব বই এ মুনাফার উপকরণ বা সাহিত্য পদবাচ্য নয়।
বরং শিশু-কিশোর, যুবকদের খেলনাতুল্য। বইমেলায় সেসব বই বেচা-বিক্রি অধিক। প্রকাশকরা সেসব বই প্রকাশে আগ্রহী। বাংলা একাডেমী তাদেরই পৃষ্ঠপোষক। ’
তিনি বলেন, এ অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।
বইমেলার স্থান এমনই একটা বিষয়, এ যুক্তি অনেকের কাছেই মানা কঠিন হবে, এটা সরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে নেয়া হোক। কেননা বাঙালি বড়ই ঐতিহ্যপ্রিয় এবং স্মৃতিকাতর। মেলাটি যেন একাডেমির মাঠেই হয়, জায়গার যতই অভাব হোক। এমনটা ভাবা হয় না, আগামীদিনে কি হবে যখন প্রকাশনার সংখ্যা বাড়বে, বাড়বে এর ক্রেতা জনতাও। এ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করে গভীর পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
তা না হলে বইমেলা হবে উপদ্রব আর নৈরাজ্যের স্থান।
এবারের বইমেলায় তার গল্পের বই ‘একুশ ও একাত্তরের গল্প’ বের করেছে ঝিনুক প্রকাশনী, ‘গল্পসমগ্র’ জিনিয়াস পাবলিকেশন্স এবং ‘একাত্তরের যুদ্ধ ও গণকবর’ উৎস বের করবে।
‘ই-বুক’ যতই প্রকাশনাকে গ্রাস করুক না কেন,
মুদ্রিত বই সেকালের স্মৃতিতে পরিণত হবে না
Ñশাহাবুদ্দীন নাগরী, লেখক
শুচি সৈয়দ
‘বইমেলা এবং অমর একুশের বইমেলার চরিত্রগত পার্থক্য থাকলেও মূল ও প্রধান পার্থক্য আত্মার সম্পর্কে। বিষয়টি বিবেচনা করলে এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ১৯৭২ সালে স্বল্প পরিসরের মেলা আজ বিশ্বের অন্যতম সেরা বইমেলা হিসেবে স্বীকৃত।
এই বইমেলার কোন তুলনা হয় না। বইমেলাটিকে জায়গার স্বল্পতার কারণ দেখিয়ে অন্যত্র সরাতে বলেন অনেকে, আমি মনে করি এ মেলার যথাযথ স্থান বাংলা একাডেমী। ’ বইমেলা প্রসঙ্গে এ কথা বলেন লেখক শাহাবুদ্দীন নাগরী।
এক সময় একুশে ফেব্র“য়ারিকে কেন্দ্র করে সারাদেশের আনাচে-কানাচে প্রকাশ পেত একুশের স্মরণিকাÑ এখন সে রীতি স্তিমিত হয়ে গেছে প্রায়Ñ এখন বেরোয় একুশের বই। এই পরিবর্তন বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ ও অভিমত, ‘এ কথা সত্যি যে, এক সময় একুশের ভোরে প্রকাশিত হতো নানা লেখায়-রেখায় সজ্জিত হয়ে নানা বর্ণের একুশে স্মরণিকা বা একুশে সংকলন।
আমি নিজেও কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ার সময় এ ধরনের নানা সংকলন প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত থেকেছি। কাঁচা গন্ধের সেই সংকলন প্রভাতফেরি আর গণজমায়েতে, শহীদ মিনারের পাদদেশে হাতে হাতে বিক্রি করেছি। মানুষ অনেক আগ্রহ নিয়ে সেসব সংকলন কিনতেন। এসব সংকলন-স্মরণিকার প্রকাশক ছিল তরুণ-নবীন-কিশোর লেখকরা। বহু কষ্ট করে দরোজায় দরোজায় ঘুরে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে রাতভর প্রেসে বসে হ্যান্ড-কম্পোজের প্র“ফ দেখে আর কাঠের ব্লকের রঙরঙা প্রচ্ছদ দেখে কী যে উদ্বেলিত হয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
এসব সংকলনের ছাপা খরচও অনেক পড়তো। কিন্তু বাংলা কম্পিউটার চালু হওয়ার পর প্রকাশনা খরচ অনেক কমে গেছে। ফলে কিশোর-তরুণ লেখকরা যে বই প্রকাশের জন্য এক সময় অপেক্ষা করতো মাসের পর মাস, প্রকাশকের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিত, তারা নিজেরাই বই প্রকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং একুশে সংকলনের পেছনে খরচ না করে নিজের বইয়ের পেছনে তা খরচ করে ফেলে। তাছাড়া প্রভাতফেরি বা জমায়েতের মানুষজনও এখন সংকলন কেনার চেয়ে বই কিনতেই বেশি আগ্রহী। ফলে ওই ঐতিহ্যটি আমরা হারাতে বসেছি।
আমার মনে হয়, ঐতিহ্যটিকে ফিরিয়ে আনা উচিত। ’
তার মতে, বই প্রকাশনা এবং ব্যবসায় অবশ্যই শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে। কিন্তু সমস্যা হল, যারা নীতিনির্ধারণে রয়েছেন তারা মনে করেন লেখকরা বই লেখেন মনের আনন্দে, আর প্রকাশকরা বই প্রকাশ করেন দোকান সাজানোর জন্য। কিন্তু বই প্রকাশে যে বিশাল পরিমাণ অর্থ লগ্নী করতে হয় তা তারা বুঝতে চান না। এই বই বিক্রয় করেই প্রকাশকদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।
এটাই তাদের কর্মজীবন। ফলে আমি মনে করি, তাদের এই দাবি ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত।
তিনি বলেন, নব্বই শতাংশ লেখকই রয়্যালটি পান না। রয়্যালটি আসে প্রধানত বই বিক্রির ওপর। লক্ষ্যযোগ্য পরিমাণ বই বিক্রি হলেই শুধু লেখককে রয়্যালটি দেয়া যায়।
তবে দিক না দিক, আমার মনে হয় প্রত্যেক প্রকাশকের সঙ্গে লেখকদের লিখিত চুক্তি থাকা উচিত। এটা করতে পারলে লেখক অবশ্যই একদিন তার রয়্যালটি পাবেন।
তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির বই বলতে যদি ইলেকট্রনিক-বুক বা ই-বুক বোঝানো হয়ে থাকে, তবে আমি বলব সেটাকে অস্বীকার করা যাবে না। এখন বিশ্বজুড়ে ফিকশন বা নন-ফিকশন সব বইয়ের ক্ষেত্রে ই-বুকের জয় জয়কার। ই-বুক বিষয়টি এসেছে প্রধানত খুব দ্রুত সময়ে পাঠককে বই পড়ার সুযোগ করে দেয়ার উদ্যোগ থেকেই।
ইউরোপ-আমেরিকায় একটি বই প্রকাশিত হলে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশে সেই বই সহজে পাঠকের হাতে এসে পৌঁছতে পারে না। আমদানিকারকরা আর কত বই আমদানি করবেন, তাদেরও তো একটা মাত্রা আছে। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন কত বই প্রকাশিত হয়, সেসব বই লাইব্রেরিতে এনে বিক্রয়ের জন্য রাখতেও প্রচুর জায়গার প্রয়োজন। এ সব বিষয়কে মোকাবেলা করার জন্য বিশ্বের সেরা প্রকাশকরা মূল বইয়ের পাশাপাশি ই-বুক বিক্রয়ের পদ্ধতি চালু করেছে। আমাজন, বার্নস এবং নোবেলের মতো ওয়েব-বেস্ড সংস্থাগুলো এখন খুব স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ই-বুক প্রেরণ করছে ক্রেতার কাছে।
এ বই হাতে ছোঁয়া যায় না, কম্পিউটারের সামনে বসে বসে পড়তে হয়। আমি ‘ই-বুক’কে স্বাগত জানাই। তবে কথা হল, সাধারণত বই হাতে নিয়ে পড়লে লেখক-পাঠকের ভেতর যে যোগাযোগ সৃষ্টি হয়, অনুভূতি জাগে, তা ‘ই-বুকে’ সম্ভব নয়। এই অনুভূতির জন্যই পাঠক মূল বই কেনেন, সংগ্রহে রাখেন, সময় পেলেই হাত বুলিয়ে দেখেন। ফলে প্রযুক্তির ‘ই-বুক’ যতই প্রকাশনাকে গ্রাস করুক না কেন, মুদ্রিত বই কখনোই সেকালের স্মৃতিতে পরিণত হবে না।
মুদ্রিত বই হাতে ছুঁয়ে দেখার আনন্দ থেকে কেউ দূরে থাকবে না।
তরুণ লেখক এবং পাঠকদের প্রতি তার পরামর্শ, তরুণ লেখকরা এখন অনেক ভাগ্যবান। আমাদের তরুণবেলায় আমরা অনেক কিছুই পাইনি, যা পাওয়ার জন্য আমাদের প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হয়েছে, বিদেশী বই-পত্রপত্রিকা ছিল না, ছিল না ইন্টারনেটের কল্যাণে ‘সব পেয়েছির দেশে’ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ। এখন ওদের হাতে সব সুযোগ বর্তমান, এ সুযোগটা ওরা যেন কাজে লাগায়। ভালো ভালো গদ্য-প্রবন্ধ-গল্প-কবিতা ওরাই লিখবে, যদি ওরা ইন্টারনেটের সুবিধার সদ্ব্যবহার করে।
আর পাঠকদের কাছে অনুরোধ, বই পড়–ন, দেশের বই পড়ুন, দেশের ভালো বইটি পড়–ন, প্রতিবছর দেশে অনেক ভালো ভালো বই বের হয়, খুঁজে নিন ভালো বইটি প্রিয় পাঠক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।