ফ্ল্যাটটির প্রতিটি দেয়ালে ও ঘরে টাঙানো অনেক পারিবারিক ছবি। দেশ-বিদেশের সুন্দর সব জায়গায় তোলা হয়েছে ছবিগুলো। সবগুলোতেই হাস্যোজ্জ্বল-প্রাণবন্ত ছোট পর্দার অভিনয়শিল্পী মিতা নূর। নিজের সাজানো-গোছানো এই ফ্ল্যাটের বৈঠকখানা থেকেই গতকাল সোমবার সাবিনা ইয়াসমিন ওরফে মিতা নূরের (৪২) ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
পুলিশ বলছে, পারিবারিক কলহের জের ধরে মিতা নূর আত্মহত্যা করতে পারেন।
আর এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো তাঁর প্রায় ২৪ বছরের অভিনয়জীবনের। এ বিষয়ে মিতার বাবা ফজলুর রহমান গুলশান থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছেন।
রাজধানীর গুলশান এলাকার ১০৪ নম্বর সড়কের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ছয়তলায় স্বামী ও দুই ছেলেসহ থাকতেন মিতা নূর। তাঁর স্বামী শাহ নূর রহমান তৈরি পোশাক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ১৯৮৯ সালের ২৩ জুলাই তাঁদের বিয়ে হয়।
ওই বছরই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাগর সেঁচা সাধ নামে একটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন মিতা নূর। এই দম্পতির বড় ছেলে শেহজাদ নূর (১৭) এ বছর ও-লেভেল শেষ করেছে। আর ছোট ছেলে সাদমান নূর (১১) পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে।
গতকাল সকাল পৌনে সাতটার দিকে গুলশানের ওই ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে মিতার ঝুলন্ত দেহ দেখতে পান তাঁর স্বামী। ফ্যানের সঙ্গে লাল ওড়না দিয়ে দেহটি ঝুলছিল।
এরপর তিনি গুলশান থানায় ফোন করেন। থানার পুলিশ এসে লাশ নামায়নি। তারা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) খবর দেয়। পরে সিআইডির কর্মকর্তারা এসে ওই ঘর থেকে প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ শেষে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠান।
মিতা নূরের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে অভিনয়জগতের লোকজন ছুটে আসতে শুরু করেন তাঁর ফ্ল্যাটে।
শিল্পীরা তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি শোক প্রকাশ করেন। দাবি করেন ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত।
এ বিষয়ে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পারিবারিক কলহের জের ধরে এ ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি জানান, দুই দিন আগে নিকেতনে শাহ নূরের বায়িং হাউসের অফিসে যান মিতা নূর। সেখানে তাঁদের মধ্যে বাগিবতণ্ডা হয়।
খবর পেয়ে একপর্যায়ে সেখানে পুলিশ গিয়ে হাজির হয়। পুলিশের মধ্যস্থতায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা হয়। তবে মিতা নূরের সঙ্গে তাঁর স্বামীর কী নিয়ে কলহ চলছিল, এ ব্যাপারে পুলিশ কিছু জানায়নি।
মিতার বাবা ফজলুর রহমান ওই বাসায় সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, তাঁর মেয়েকে মাঝেমধ্যেই নির্যাতন করতেন স্বামী শাহ নূর। নির্যাতন সইতে না পেরে আগেও দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
একবার ঘুমের ওষুধ সেবনের পর মিতার পাকস্থলী পরিষ্কার (ওয়াশ) করা হয়েছে। পরে স্বজনেরা ফজলুর রহমানকে সরিয়ে নিয়ে যান। এ বিষয়ে তিনি আর কোনো কথা বলেননি। গুলশান থানায় দায়ের করা মামলায়ও এ বিষয়গুলো উল্লেখ করেননি ফজলুর।
আত্মহত্যা!: ওই অপমৃত্যুর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আনোয়ারা খাতুন বলেন, মিতা নূরের বাঁ পায়ের গোড়ালিতে পুরোনো জখমের দাগ পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া শরীরে আর কোনো জখম ছিল না। সুরতহাল প্রতিবেদনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাহ্যিকভাবে মিতা নূরের শরীরে আত্মহত্যার সব রকম লক্ষণ দেখা গেছে।
এদিকে মিতা নূরের লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ বলেছেন, আত্মহত্যার লক্ষণগুলো মিতার শরীরে পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা বলেই মনে হচ্ছে।
কারণ বলেননি স্বজনেরা: মিতা নূরের স্বামী শাহ নূর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, কয়েক দিন ধরেই মিতা নূর বিষণ্নতায় ভুগছিলেন।
শুধু শুয়ে থাকতেন। বাইরে কাজে যেতেন না। তিনি মিতাকে কাজে যেতে উৎসাহিত করেছেন একাধিকবার, তবে কাজ হয়নি।
কেন এ রকম হলো, জানতে চাইলে শাহ নূর বলেন, ‘আমরা কেউই জানি না কোথায় সমস্যা। জিজ্ঞাসা করলেও ও কিছুই বলত না।
’
সর্বশেষ মিতা গত শনিবার স্বামীর অফিসে গিয়ে ভাঙচুর করেন ও পুলিশ ডেকে আনেন। এ বিষয়ে শাহ নূর বলেন, শনিবার মিতার ছোট বোনকে পাত্রপক্ষের দেখতে আসার কথা ছিল। কিন্তু জরুরি কাজ থাকায় তিনি ওই দিন নন্দীপাড়ায় শ্বশুরবাড়ির ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাননি। এতে মিতা রাগ করেন। বিকেলের দিকে তাঁর নিকেতনের কার্যালয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে হাজির হন মিতা।
এরপর বাগিবতণ্ডার একপর্যায়ে তিনি অফিসের কম্পিউটারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন। ফোন করে ডেকে আনেন পুলিশকে। শাহ নূরের দাবি, ‘কিছুক্ষণ পরেই সব স্বাভাবিক হয়ে আসে। ’
গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নূরে আযম সেদিন নিকেতনের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ওই দম্পতির মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব ছিল।
তবে স্বামী শাহ নূরের দাবি, রোববারও তাঁরা একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়েছেন। রোববার রাতে ঘরে শোয়ার সময় দেখেন, মুঠোফোনে গান শুনছেন মিতা। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল বলে দাবি শাহ নূরের।
ঘটনা সম্পর্কে মিতা নূরের ছেলে শেহজাদ নূর প্রথম আলোকে বলে, ‘মধ্যরাতের কোনো একসময় ঘটনাটি ঘটেছে বলে আমাদের ধারণা। তবে কী কারণে এটা ঘটেছে, এখন পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারছি না।
’।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।