সময়টা ১৭৮৮, প্যারিস, ফ্রান্স। রোববার সকাল। কাউন্টেস ডি আইমের তৈরি হচ্ছিলেন বাইরে যাবার জন্য। রানী হয়তো অপেক্ষা করছেন তার জন্য। এইসময় গৃহভৃত্য এসে জানালো এক ভদ্রলোক এসেছেন দেখা করতে।
কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় নেই এখন, কিন্তু চলে আসা অতিথিকে ফেরত পাঠাতেও ইচ্ছে করলো না কাউন্টেসের।
বসার ঘরটাতে ঢুকেই চমকে গেলেন কাউন্টেস। কে বসে আছে ওখানে? খুবই পরিচিত মুখ। অনেক অনেক বার দেখা হয়েছে লোকটার সাথে। কাউন্ট দ্য সেইন্ট জারমেইন।
শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় চৌদ্দ বছর আগে। রাজা পঞ্চদশ লুই মারা গেলেন যে বছরটায়। এতোদিন কোথায় ছিল লোকটা? আর চেহারার কোন পরিবর্তন নেই কেন? বসার ঘরে সাজানো আয়নাটার দিকে এক নজর তাকিয়ে নিলেন কাউন্টেস। এই চৌদ্দ বছরে তার চুলে প্রায় পাক ধরে গেছে অথচ এই লোকটার বয়স তখন ছিল পয়তাল্লিশের মতো, এখন দেখে মনে হচ্ছে একদিনও বয়স বাড়ে নি ওঁর।
‘শুভ সকাল, মাদমোয়াজেল,’ উঠে দাঁড়িয়ে কাউন্টেসকে সম্ভাষন জানালেন ভদ্রলোক।
‘আপনাকেও,’ বলে উল্টোদিকের সোফায় বসলেন কাউন্টেস।
‘এই সকালে এসে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী আমি, কিন্তু ব্যাপারটা এতোই জরুরী, না এসে থাকতে পারি নি,’ ভদ্রলোক বললেন মার্জিত সুরে।
কাউন্টেস তাকিয়ে আছেন লোকটার দিকে। বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি এখনো তার। এতো সজীব, এতো প্রানবন্ত চেহারা! চোখ দু’টো যেন জ্বলজ্বল করছে।
কেমন একটা সম্মোহন আছে যেন ওখানে, তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে।
‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি ঠিক আগের মতোই আছেন, কাউন্ট,’ কাউন্টেস বললেন, মুখে একটু হাসি নিয়ে, যাতে লোকটা আবার কিছু মনে না করে বসে।
‘আমি রানীর সাথে দেখা করতে চাই, আগেও আমাদের দেখা হয়েছে, কিন্তু এবার আমি আপনার মাধ্যমে তার সাথে দেখা করতে চাই, সরাসরি দেখা করা হয়তো নিরাপদ হবে না আমার জন্য,’ কাউন্টেসের কথা এড়িয়ে গেলেন সেইন্ট জারমেইন।
‘কিন্তু দরকারটা কি সেটা আমাকে জানতে হবে, আমি যদি মনে করে সত্যিকারের কারন রয়েছে তাহলে অবশ্যই আপনার সাথে রানীর দেখা হবে,’ কাউন্টেস বললেন।
সেইন্ট জারমেইন ভাবছেন।
সময় নিচ্ছেন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য।
‘আপনার জন্য চায়ের কথা বলি,’ কাউন্টেস বললেন।
‘ধন্যবাদ, আমি চা খেয়ে এসেছি,’ মৃদু স্বরে বললেন সেইন্ট জারমেইন।
লোকটাকে চিন্তা করার সময় দিলেন কাউন্টেস। নিজেও ভাবার চেষ্টা করলেন আসলে কি কারনে আসতে পারে লোকটা।
পঞ্চদশ লুইয়ের খুব ঘনিষ্ট এবং প্রিয় মানুষ ছিলেন সেইন্ট জারমেইন। বিশাল বড় একটা প্রাসাদ উপহার দিয়েছেলন লুই তাকে। নানাধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে নাকি গবেষনা করা হতো সেই প্রাসাদের ভেতরের একটা আলাদা অংশে। যেখানে একমাত্র রাজা ছাড়া বাকি সবার প্রবেশ নিষেধ ছিল।
‘আপনাকে বললে ক্ষতি নেই, কারন রাজতন্ত্রের বিশ্বস্ত এবং যোগ্য কর্মচারী আপনি, পরিস্থিতির গুরুত্ব নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পারবেন,’ খুব ধীর গতিতে কথাগুলো বললেন সেইন্ট জারমেইন।
‘আপনি বলুন এবং নিশ্চিত থাকুন। ’
‘রাজতন্ত্র চরম বিপযর্য়ের মুখে আছে, বিশাল এক বিপ্লবের সম্ভাবনা কড়া নাড়ছে দরজায়। এখনই সাবধান হতে হবে রাজাকে, বিপ্লব শুরু হবার আগেই থামিয়ে দিতে হবে একে,’ কাউন্টেসের মুখের দিকে তাকালেন সেইন্ট জারমেইন কথাগুলো বলে, প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যই হয়তো।
‘এই বিপ্লব মারাত্মক আকার ধারন করবে যদি আগেই দমন করা না হয়, পুরো ফ্রান্স এবং ইউরোপ এই ঝুঁকির মুখে আছে। একমাত্র মহামান্য রাজাই পারেন সব ঠিক করে ফেলতে।
’
‘আপনি কি নিশ্চিত?’ কম্পিত কন্ঠে বললেন কাউন্টেস।
‘আমি নিশ্চিত। ’
‘ঠিক আছে, আজ আমি রানীর কাছে খবরটা জানাবো। ’
‘আমি মহামান্য রানীর সাথে দেখা করতে চাই। ’
‘ওহ, আচ্ছা, ঠিক আছে, কাল সকালে আপনি চলে আসবেন রাজপ্রাসাদে, আমি দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবো।
’
‘অনেক ধন্যবাদ,’ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন সেইন্ট জারমেইন, লক্ষ্য করলেন কাউন্টেস লোকটার আসলেই কোন পরিবর্তন হয় নি, ঠিক আগের মতো পিঠ সোজা করে দাঁড়ায় লোকটা, বয়সের কোন ছাপই নেই।
‘কাল দেখা হচ্ছে,’ আবার বললেন সেইন্ট জারমেইন। একটু নিচু হয়ে সম্মান জানিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলেন বাইরে।
কাউন্টেস তাকিয়ে রইলেন লোকটার গমন পথের দিকে। তারপর নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
মানুষ মাত্রই কি মরনশীল!
পরদিন সকালেই হাজির কাউন্ট। পরিপাটি করে সেজে এসেছেন। অবশ্য এমনিতেও তার রুচির প্রশংসা পুরো ইউরোপ জূড়ে। প্রতিবার নিত্যনতুন জুতো পড়েন তিনি এবং দামী সব পাথর লাগানো থাকে সেই জুতোগুলোয়। পাথরগুলোর মধ্যে হীরেই বেশি।
কাউন্টেস আগেই তৈরি ছিলেন। রানীকেও বলা আছে সব। উনি দেখা করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন লোকটার সাথে। বাইরে চারঘোড়ায় টানা জুড়ি গাড়ি তৈরি। কাউন্টেস বেরিয়ে এলেন বাইরে।
আরো একটা জুড়িগাড়ি দাঁড় করানো আছে। কাউন্ট হয়তো সাথে করেই নিয়ে এসেছেন। দামী সব উপাদান ব্যবহার করে বানানো হয়েছে জুড়িগাড়িটা। মনে মনে লোকটার রুচির প্রশংসা না করে পারলেন না কাউন্টেস।
রাজপ্রাসাদের ভেতরের অংশে রানী থাকেন।
সেইন্ট জারমেইন গাড়ি থেকে নামলেন ধীরে সুস্থে, চারদিকে তাকালেন। যেন কারো চোখে পড়তে চাচ্ছেন না, ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়াল না কাউন্টেসের। ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। কাউন্টকেই ইশারা করলেন অনুসরন করার জন্য।
বেশ কিছু বারান্দা এবং করিডোর পার হয়ে বড় একটা হলরুমে চলে এলেন দুজন।
রানীর এলাকা এটা। অতিথি এলে এখানেই বসার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও রানীর সামনে বসার অনুমতি নেই কারো।
রানীকে খবর দিতে হলো না। বড় একটা সিংহাসনের মতো একটা চেয়ারে বসে আছেন তিনি।
‘অভিবাদন, মহামান্য রানী,’ মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন সেইন্ট জারমেইন।
‘কোন বিশেষ কাজে আমার সাথে দেখা করতে চান বলে শুনলাম,’ রানী বললেন।
‘আপনি হয়তো জানেন আমি ফ্রান্স রাজতন্ত্রের একজন অনুগত সেবক, মহামান্য রাজা পঞ্চদশ লুই আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন,’ মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে বললেন সেইন্ট জারমেইন।
‘এখনো ফ্রান্সে আপনাকে সেই একই মযার্দা দেয়া হবে। আপনি কি আবার ফ্রান্সে স্থায়ী হবেন?’
‘হয়তো এই শতকে না।
আমি বিশেষ একটা বার্তা দিতে চাচ্ছিলাম আপনাদের, দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন না এই বার্তার ভিত্তি কি-’ বলে একটু থামলেন সেইন্ট জারমেইন, তাকালেন চারদিকে, পুরো হলরুমটায় আর কেউ নেই, কাউন্টেস অবশ্য আছে, কিন্তু তার উপর চোখ বন্ধ করেই বিশ্বাস করা যায়।
‘- একটা বিপ্লব সমাগত, সেই বিপ্লবে এমনকি রাজতন্ত্রের ভিত টলে যেতে পারে, কাজেই বিপ্লব হওয়ার আগেই রাজা ষোড়শ লুই যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন, তাহলে হয়তো এই বিপ্লব এড়ানো সম্ভব। ’
‘বিপ্লব করবে কারা?’
‘সাধারন জনগন, তাদের সাথে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ও হয়তো যোগ দেবে, সবার আক্রমনের শিকার হতে হবে রাজতন্ত্রে অনুগত এবং সমাজের উচ্চশ্রেনীর লোকদের। শুরুতে রাজপরিবারের গুরুত্বপুর্ন কেউ থাকবে এর পেছনে, পরবর্তীতে তাকেও ছাড় দেবে না দুষ্কৃতিকারীরা। ’
‘আপনার এই ধারনা ভিত্তি কি?’
‘মহামান্য রানী, শুরুতেই আমি বলেছি এর পক্ষে কোন বাস্তব প্রমান দেয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে, কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হতে হয় নি কেউ।
’
‘কিন্তু মহামান্য রাজা যথেষ্ট যুক্তি-প্রমান ছাড়া আপনার এই ধারনায় বিশ্বাস করবেন না। ’
‘আপনি যদি আমাকে মহামান্য রাজার সামনে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন, তাহলে হয়তো আমি তাকে বোঝাতে পারবো ব্যাপারটার গুরুত্ব। ’
‘ঠিক আছে, আমি দেখছি কি করা যায়। ’
‘আপনার অশেষ কৃপা। ’ মাথা নিচু করে বললেন সেইন্ট জারমেইন।
সেদিন চলে এসেছিলেন সেইন্ট জারমেইন, রাজার সাথে দেখা করেছিলেন তার পরদিনই। কিন্তু রাজাকে ঘটনার গুরুত্ব এবং ভয়াবহতা বোঝাতে সক্ষম হন নি তিনি, এছাড়া রাজার অনুগত কিছু মোসাহেব সেইন্ট জারমেইনের এই ধারনা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন। এমনকি পুলিশ লাগিয়ে দেয়া হয় তার পেছনে, বন্দী করার আদেশ দেন রাজার মন্ত্রীদের একজন। ব্যথিত মনে প্যারিস ত্যাগ করেন তিনি। জুলাই ১৪, ১৭৮৯-এ একটা চিঠি পাঠান তিনি রানীকে, তার ভাষা ছিল, ‘আমার কথায় আপনারা কর্নপাত করেন নি এবং সেই সময় এসে গেছে।
আপনার চারদিকের সব বন্ধু এবং বাকি সবাই এগিয়ে চলেছে নির্মম মৃত্যুর দিকে। ’
এরপর একটি বিদায়ী চিঠি পাঠান তিনি কাউন্টেসকে উদ্দেশ্য করে, সেখানে লিখেছিলেন, ‘সব শেষ, কাউন্টেস। এই রাজতন্ত্রের আলো নিভে যেতে বসেছে। আমার কথায় বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেয়া হয় নি। এখন সেই সময়ও নেই।
কিছু করার নেই এখন। হাত-পা বাঁধা আমার। ’
তার কিছুদিন পরই শুরু হয় বিখ্যাত ফরাসি বিপ্লব। প্রান হারান রাজা ষোড়শ লুই এবং রানী মেরি। গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ করা হয় তাদের।
ষোল থেকে চল্লিশ হাজার মানুষকে মৃত্যুর সম্মুক্ষীন করা হয় এই বিপ্লবকালীন সময়ে। এরপরই উত্থান ঘটে এক মহানায়কের। তিনি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।