খবরে ধান্দাবাজি ২০১১ সালের ২১ নভেম্বর ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটি অনুষ্ঠানে দাবি করা হয়, ইংরেজিকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা করা হোক।
ব্রিটিশ কাউন্সিলে অনুষ্ঠিত হে উৎসবে বক্তৃতা দিতে গিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) ইংরেজির অধ্যাপক কায়সার হক বলেন, ‘কেন আমরা ইংরেজিকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করছি না ... অথচ ইতিমধ্যে এটাকে আমরা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করছি। ’ পরের দিন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার খবরটির শিরোনাম করে, ‘দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ইংরেজির ব্যবহার- ঢাকায় হে উৎসবে বক্তাদের পরামর্শ। ’ প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন, ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালক রোজমেরি আরনট এবং দেশি-বিদেশি তরুণ লেখক-সাংবাদিক।
এর আগে ১৭৭৮ সালে স্যার উইলিয়াম জোনস প্রথম রোমান হরফে (ইংরেজি বর্ণ) বাংলা লেখেন।
তখন ইংরেজরা ভারতীয় ভাষাগুলোকে রোমান হরফে লেখার সুপারিশ করেন। ওই সময়ের ইটন কলেজের সহকারি শিক্ষক ড্র– সাহেব ও প্রফেসর মনিয়র এর পক্ষে ছিলেন। লাহোর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও পাঞ্জাব মহাবিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ডাক্তার লাইটনর এবং আরও দুইজন ইংরেজ এর প্রতিবাদ করেন। ভেস্তে যায় ইংরেজদের পরিকল্পনা। ১৯৩৯ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করেন।
এর পক্ষে ছিলেন মওলানা আকরাম খাঁ ও কবি গোলাম মোস্তফা প্রমুখ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখের বিরোধীতায় এ প্রস্তাব ব্যর্থ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করেন। এর আগে ১৯ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে নাগরিক সংবর্ধনায় তিনি এটা বলেছিলেন। কার্জন হলে বলার পর আবদুল মতিনসহ অন্য ছাত্ররা ‘নো, নো’ বলে প্রতিবাদ করেন।
বাঙালিদের আন্দোলনের মুখে ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ অনুযায়ী ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান সংশোধন করা হয়। বাংলা পায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। এর পথ ধরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশ স্বাধীন হয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ৪০ বছর পার হয়েছে।
কিন্তু, সত্যিকার অর্থে বাংলা আজও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পুরোপুরি প্রয়োগ হয় নি।
উল্টো আমরা দেখছি, মুক্তবাজার আর অবাধ তথ্যপ্রবাহের নামে বিদেশি চ্যানেল ও পণ্যের দৌরাত্ম্য। পৃথিবীতে প্রায় ৫৪টি দেশে ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে কিছু দেশ আছে যেখানে ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষা। আমরা উদাহরণ হিসেবে ভারত (শতকরা ১২) নাইজেরিয়া (শতকরা ৫৩) ও ফিলিপাইনের (শতকরা ৫৮ জন লোক ইংরেজি বলতে পারে) কথা বলতে পারি।
যেসব দেশ মাতৃভাষার পাশাপাশি বা মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে, তাদের মাতৃভাষার অবস্থা করুণ। কিছু স্বাভাবিক প্রবণতা এসব দেশে দেখা যায়। প্রথমত, আনুষ্ঠানিক কাজে কেউ মাতৃভাষা ব্যবহার করে না। দ্বিতীয়ত, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাটির চর্চা তেমন হয় না। তৃতীয়ত, মাতৃভাষার সঙ্গে ইংরেজি মিশে মূল ভাষাটি হারিয়ে যায়।
এক্ষেত্রে আমরা পাশের দেশ ভারতের কথা বলতে পারি। হিন্দি ভাষাটি যে আজ স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছে তা আমরা নির্দ্ধিধায় বলতে পারি। ইংরেজি আগ্রাসনে অন্যন্য ভাষার অবস্থাও শোচনীয়। উইকিপিডিয়ার মতে, বাংলাদেশের শতকরা ২ দশমিক ২১ জন লোক ইংরেজি বলতে পারে। এ থেকেই বোঝা যায়, যারা ইংরেজিকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলছেন তাদের দাবি কতটা ফাঁকা ও ফাঁপা।
১৯৪৭ সালে ইংরেজরা শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু তারা উন্নত, সভ্য ও প্রগতিশীলতার এক অন্ধ বিশ্বাস রেখে গেছে। এই বিশ্বাসটা যে অনেকাংশে ভুল তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শেষ জীবনে বুঝেছিলেন। ৮০ তম জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে লিখলেন, ‘জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেলো।
’ আমরা যদি এর চেয়ে পেছনে গিয়ে চিন্তা করি তাহলে সে ভুলের মাশুল আমাদেরই দিতে হবে।
শঙ্কার বিষয়, ক্রমে বাংলার ব্যবহার কমে যাচ্ছে। উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সুবিধাপ্রাপ্ত একটি গোষ্ঠী বাংলাকে দেখছে, গেঁয়ো (আনস্মার্ট) ভাষা হিসেবে। আমাদের উচ্চ আদালতে, প্রযুক্তি-চিকিৎসা-বাণিজ্যের উচ্চ শিক্ষায় বাংলা চালু হয়নি। চিকিৎসকরা আজও রোগীকে ইংরেজিতে ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন।
যদিও অধিকাংশ রোগী এ ভাষা বোঝে না। বহুজাতিক কোম্পানি, দেশীয় কর্পোরেট হাউজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম ও সংস্করণের বিদ্যালয় এবং এফএম রেডিওতে ব্যাপকভাবে ইংরেজি ব্যবহৃত হচ্ছে। কোথাও কোথাও ইংরেজি-বাংলার মিশ্রনে উদ্ভট ভাষা বলা হচ্ছে। এছাড়া ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনে ইংরেজি বর্ণে বাংলা লেখা হচ্ছে। ঈদ, নববর্ষ, জন্মদিন, ব্যক্তিগত যোগাযোগ এমনকি বিজয় দিবস বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা বার্তাটিও আমরা ইংরেজি বর্ণে লিখছি।
অনাবাসি বাঙালিদের পরের প্রজন্ম বাংলা বলছে না। দেশে শহরকেন্দ্রিক ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়, ইংরেজি সংস্করণ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বাণিজ্য-চিকিৎসা-প্রযুক্তির উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতদের পরের প্রজন্ম বাংলা বিমুখ হচ্ছে। ঢাকা শহরের সাইনবোর্ডে ইংরেজির প্রাধান্য দেখলে মনেই হয় না, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ’
এতসব বিপত্তি ঠেকাতে ১৯৮৭ সালে জাতীয় সংসদে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ পাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।
’ যদি কেউ এ আইন অমান্য করে, ‘তাঁহার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। ’ কিন্তু এ আইনও শেষ পর্যন্ত কার্যকার হয় নি।
আজও সত্যিকারের বাংলা ব্যাকরণ লেখা হয় নি। বাংলা বানান নিয়ে আছে বিতর্ক। ‘প্রমিত বাংলা’ বলে যাকে আমরা গ্রহণ করেছি, সে ভাষাটিও আমাদের নয়।
এতসব সমস্যার মধ্যে ইংরেজিকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া কতটা যৌক্তিক? জিজ্ঞেস করেছিলাম বায়ান্নর ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনকে। বয়সের ভারে ন্যুজ আব্দুল মতিন বললেন, ‘ইংরেজি আমাদের জানতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হলে আমরা এত ভার সামাল দিতে পারবো না। এটা আমরা এই মুহূর্তে সহ্য করতে পারবো না। যে যতদূর পারে ইংরেজি শিখুক।
কিন্তু এটা কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। ’ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।