আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রক্তেরাঙা অমর একুশ : গণতন্ত্র ও সাম্যের চেতনা

মানুষ প্রতিমুহূর্তের স্পন্দন ও প্রবাহের মধ্য দিয়ে তার জীবিত ও জাগর সত্ত্বাটাকে অস্তিত্বময় করে রাখে৷ আর তার অস্তিত্ব, অবস্থান, গতি-প্রকৃতি ও শক্তির অন্বয় রচনা করে৷ অস্তিত্বের জন্য, মনুষ্যত্ব ও মানবিক অর্জনের জন্য তার ভাষা ব্যবহার করে৷ ভাষার চালিত শক্তির প্রয়োগে তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন সঞ্চালিত হয়, মস্তিষ্ক কোটর, স্মৃতিকোষ, চেতনা- চৈতন্য, অনুভূতি ও উপলব্ধি তেমনি ক্রিয়াশীল হতে থাকে৷ ব্যক্তিসত্ত্বা ভাষার মাধ্যমে জাগরিত হয়-বিকশিত হয়৷ একটি জাতির সত্ত্বাও প্রথমত এবং শেষত ভাষার মাধ্যমে বিকশিত হতে থাকে৷ ভাষা মানুষের অস্তিত্বকে ধারণ করে এবং স্পন্দমান করে৷ বিশ্বাসকে বাক্সময় ও বিভাসিত করে৷ আন্ত:সলিলার মত বয়ে যেতে থাকে অন্তর্লোকের সমস্ত অন্দর-কন্দর পেরিয়ে৷ আমরা আমাদের মায়ের হৃদয়ের স্পন্দন শুনি এই ভাষায়৷ আমাদের ঘুম নেমে আসে মাতৃভাষার ছন্দে৷ মাতৃভাষার আদরে নেমে আসে রাতের নিরালা৷ ভোরের নরম আলো জ্বলে ওঠে আমাদের মাতৃভাষার সৌন্দর্যে৷ এখনো এই সুন্দরই আমাদেরকে তৃপ্ত করে৷ সুতরাং মাতৃভাষা আমাদের মুখের ভাষা নয়, আমাদের অস্তিত্বের ভাষা৷ মাতৃভাষাকে বাদ দিলে আমাদের পরিচয় গৌণ হয়ে যায়৷ শেকড় ছিন্ন বৃক্ষের মতো দুর্বল হয়ে যায়৷ মাতৃভাষার জন্যই প্রতিটি জাতি সর্বদা বদ্ধপরিকর৷ মাভৃভাষাকে আঁকড়ে ধরেই তাদের পথচলা৷ মানুষের ভাষাকে কোনোভাবেই অবরুদ্ধ করা যায় না৷ ভাষাকে ধ্বংস করাও সম্ভবপর নয়৷ তবে বাংলা ভাষার জন্যে বাংলা ভাষাভাষীরা যে ত্যাগের মহিমা প্রদর্শন করেছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল৷ ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার চেতনা: ১৭৭৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম মত পোষণ করেন একজন ব্রিটিশ লেখক৷ তার নাম ন্যাথিনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড৷ ১৯১৮ সালে ভারতের ঐতিহ্যবাহী শান্তিনিকেতনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ভারতের সাধারণ ভাষা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়৷ সভায় রবিঠাকুর ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে হিন্দির পক্ষে মত পোষণ করেন৷ এ প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করেন ওই সভায় অংশগ্রহণকারী ড. মুহম্মদ শহীদুল্ল্লাহ৷ তিনি তার বক্তব্যে বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষা করার প্রস্তাব পেশ করেন৷ ওই সময়ে হিন্দি- প্রেমিকরা হিন্দিভাষাকে সমর্থন করে গান্ধীজীর বরাবরে একটি পত্র লেখেন তা হলো- the only possible national language for intercourse is Hindi in India. ১৯২১ সালে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী লিখিত আকারে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রস্তাব পেশ করেন৷ ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক কাউন্সিলের কাছে পেশকৃত খসড়া ম্যানিফেস্টোতে বাংলাকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন৷ ১৯৪৭ সালের ৩০ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা প্রবন্ধে আব্দুল হক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন৷ ১৯৪৮ সাল নবগঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে করাচিতে৷ বৈঠকের শুরুতেই উর্দু ও ইংরেজিকে গণপরিষদের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করা হয়৷ পূর্ব বাংলার বিরূপ প্রতিক্রিয়া: গণপরিষদ সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (কুমিল্ল্লা) সভায় একটি মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করেন৷ তাতে তিনি উর্দু-ইংরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবি জানান৷ পূর্ব বাংলার সব মুসলিম সদস্য ও পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যরা এক জোটে এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন৷ পূর্ববাংলায় এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া হয়৷''রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'' দাবিতে ছাত্রসমাজের বৈপ্লবিক পদক্ষেপে ঢাকার রাজপথ সরগরম হয়ে ওঠে৷ ভাষা-বিক্ষোভ ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ: বঙ্গীয় সমাজে বাংলাভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালি মুসলমানদের আত্ম-অন্বেষায় যে ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়৷ ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যার চরম প্রকাশ ঘটে৷ এইদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়৷ এতে বরকত, জব্বার, আবদুস সালাম, রফিক সহ ছয়জন ছাত্র-যুবক হতাহত হন৷ রাজপথে প্রতিবাদী মিছিল: এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে সমবেত হন৷ নানা-নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জমাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে৷ এদিন নবাবপুর, রণখোলা ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে৷ এ দিনে শহীদ হন শফিউর রহমান, আব্দুল আউয়াল ও অহিদুল্ল্লাহসহ একাধিক ব্যক্তি৷ শহীদ মিনার স্থাপন ও ভাঙ্গন: ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখের রাতে ছাত্রজনতার এক বৈঠকে নেতৃবৃন্দ শহীদদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য একটি শহীদ মিনার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই রাতের অন্ধকারেই গুলিবর্ষণের স্থানে নিজেদের নকশা অনুযায়ী ইট দিয়ে নির্মিত হয় শহীদ মিনার৷ কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ তারিখে পুলিশ এ শহীদ মিনার ভেঙ্গে দেয়৷ সে জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ তারিখে প্রথম শহীদ দিবস পালনের জন্য কাগজ দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়৷ পরের দুই বছরও ঐ স্থানে কালো কাপড় দিয়ে ঘিরে শহীদ মিনারের অভাব পূরণ করা হয়৷ যুক্তফ্রন্টের বিজয় লাভ: ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিমলীগ হক-ভাসানী- সোহরাওয়ার্দীর মিলিত যুক্তফ্রন্টের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করে৷ যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয় বিপুল ভোটে৷ এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মাঝে ২২৩ টি আসন পায়৷ মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯ টি আসন৷ বাংলাদেশিদের দাঁতভাঙ্গা জবাবে পূর্ব পাকিস্তানে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মুসলিম লীগ৷ বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি: অনেক প্রতিবন্ধকতা পার করে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে সরকার বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়৷ মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি পাওয়ার পিছনে রয়েছে দীর্ঘ সাধনা, সংগ্রামের ইতিহাস৷ একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে শোকার্ত দিনই ছিলনা৷ রক্তের আলপনা এঁকে যে ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আমাদের বাঙালি সন্তানরা, রাজকীয় ভাষা হিসেবে৷ অধিকার আদায়ের সংগ্রামের এই চেতনাই স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার চেতনাকে সুদৃঢ় করেছে৷ আজও স্বাধীন এই দেশকে গড়তে হলে একুশের চেতনার বিকল্প নেই৷ শহীদ দিবস থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পর্যনত্ম রক্তস্নাত পথ বেয়ে অর্জিত এই সাফল্য সারা বিশ্বের মানুষ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পালনের মাধ্যমে মৃতু্যঞ্জয়ী ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানায় এবং সমগ্র চেতনায় লালনকারে কালজয়ী ভাষা বাংলাকে৷ অমর একুশে আমাদের প্রেরণার উত্‍স৷ আমাদের সম্মিলিতভাবে দাঁড়াবার ভিত্তিভূমি রচিত হয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারির দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমেই৷ বাংলাদেশের মানুষের গৌরবান্বিত ইতিহাস ও অজেয় অহংকার অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এক অভূতপূর্ব অনুভূতি৷ ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা ও বাংলাদেশের অভু্যদয় কিছু প্রতিবাদ শিখা অনির্বাণের মতো, কিছু ঘটনা চেতনার আলো ছড়ায় সারা বিশ্বে , সে চেতনার দৃপ্ত শপথে সত্ত্বা জুড়ে আছ তোমরা, শুধু তোমরাই মোদের গরব৷ সময়ের সিঁড়ি বেয়ে বিদ্রোহের বিবর্তন ধারায় মশালটির মাতা বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, শফিকসহ বহু পৌরুষ- প্রোজ্জ্বল তাজা প্রাণ তরুণের-আত্মদান আজকালের এচক্রনেমি ঘোরাতে ঘোরাতে কাল থেকে কালান্তরের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়েছে৷ এ পরিব্যাপ্তি যেন মানবসভ্যতার ইতিহাসের আগ্রেয় অধ্যায়ের পরিব্যাপ্তি৷ একুশ থেকে আমরা পাই গণতন্ত্রের চেতনা, পাই সাম্যের চেতনা৷ একুশ আমাদের শিখিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠার অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে৷ একুশের চেতনা যেমন সমানাধিকারের চেতনা তেমনি একুশের চেতনা মানে অসামপ্রদায়িকতার মহান চেতনা৷ একুশের চেতনা থেকেই এজাতি এমন শিক্ষা পেয়েছিল যে জীবন বাজি রেখে আন্দোলন সংগ্রামে সাহসী ভূমিকা পালনে কখনই পিছপা হয়নি৷ সে শিক্ষাগুলো ছিল- ঐক্য ও সমপ্রীতির শিক্ষা: মহান একুশ আমাদের সবার মধ্যে ঐক্য ও সমপ্রীতির সেতুবন্ধন বচন করে৷ একুশের সবচেয়ে বড় দান হলো গোটা জাতিকে সে একত্রিত করতে সফল হয়েছে৷ জাতির ওপর যত বড়ই আঘাত আসুক না কেন, জাতি আত্মকলহে যতই নিমজ্জিত থাকুক না কেন একুশকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে সবাইকে একত্রেই আসতে হয়৷ এভাবে একুশ সকলের মধ্যে ঐক্য ও সমপ্রীতি সৃষ্টি করেছিল৷ ভাষার মৌলিক অধিকার শিক্ষা: একুশ বাংলাদেশের মানুষের জীবনে একটি সচেতন প্রবাহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল৷ একুশ শিখিয়েছে-আমি ভিখারি হতে পারি, দুঃখ-অশ্রুর কঠিনভারে চূর্ণ হতে আপত্তি নেই৷ আমি মাতৃহারা অনাথ বালক হতে পারি, কিন্তু আমার শেষ সম্বল ভাষাকে ত্যাগ করতে পারি না৷ মানসিক ও নৈতিক বিকাশ: মানুষের মানসিক আর নৈতিক বিকাশের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়৷ ভাষার পথ বেয়েই তার সব রকম বিকাশের সূত্রপাত৷ আর এই ভাষাকে আমাদের সামনে জাগ্রত করে রেখেছে ২১ ফেব্রুয়ারি৷ একুশ আমাদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশের পথপ্রদর্শক৷ মাথা নত না করার শিক্ষা: একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণীয় শহীদদের স্মৃতি আমাদের এ প্রেরণা দিয়েছিল আমরা ইতিহাসের পাতায় নেহায়েত্‍ হতভাগ্য ও করুণার পাত্র হয়ে থাকবো না৷ আমাদের জাতীয় জীবনের খাতায় আমরা নব নব স্মরণীয় তারিখ সংযোজন করবো৷ আমরা পৃথিবীর বুকে স্থান করে নেব৷ ভাষার প্রতি ভালবাসার শিক্ষা: ভাষাবিহীন জীবন রূহবিহীন দেহের ন্যায়৷ রূহ ছাড়া যেমন দেহের কেনো মূল্য নেই, ঠিক তেমনি ভাষা ছাড়া জীবন অচল৷ যা আমরা বুঝতে পারি একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের ত্যাগের মাধ্যমে৷ ভাষার প্রতি অগাধ ভালবাসার কারণেই তারা তাদের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিল৷ ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন: আমাদের করণীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় জীবনের আদর্শ সংযুক্ত হলে সে আন্দোলন দেশে একটি শাশ্বত রূপ নিয়ে জীবনকে গতিশীল করে তোলে৷ ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন একটি ব্যতিক্রমী আন্দোলন, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল একটি দেশের সমগ্র জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ভাষার প্রশ্ন৷ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাংলাদেশের জনগণ যে ত্যাগ স্বীকার করেছে বিশ্বের ইতিহাসে তার কোনো নজীর নেই৷ গত শতাব্দীতে আমাদের যে দুটি শ্রেষ্ঠ অর্জন নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি তার একটি হল স্বাধীনতা অর্জন এবং অন্যটি হল রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা ও বাংলাকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করা৷ দুটি অর্জনই অনন্যসাধারণ৷ যুদ্ধ করে মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ত দিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা এই দুটি কোনো জাতির পক্ষেই একসাথে করা সম্ভব হয়নি৷ সে বিচারে আমরা অবশ্যই বিশেষ মর্যাদাবান জাতি হিসেবে পরিগণিত হবার দাবি রাখি৷ বাংলাদেশের জনগণকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে৷ শুধু বাংলাদেশে নয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বিশ্বের অন্যান্য জাতির জন্যও শিক্ষণীয় অবদান রেখেছে৷ ২১ ফেব্রুয়ারি আজ "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" যা শুনলেই আমাদের বুক গর্ভে ভরে উঠে, অহংকার আমাদেরকে শক্ত করে পেয়ে বসে৷ তাই আমাদের করণীয় হচ্ছে, গৌরব অক্ষুণ্ন রাখা: সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউর, অহিদুল্লাহ প্রমুখ আজ দেশে কাল থেকে কালে, শতাব্দী থেকে শতাব্দী অমর হয়ে থাকবেন৷ তারা আমাদের যে গৌরবে অভিষিক্ত কবে গেলেন-তাকে ধরে রাখা আজ আমাদের প্রধান দায়িত্ব৷ আমাদের মায়ের ভাষাকে নিয়ে যেতে হবে ভাষার আন্তর্জাতিকতায়৷ আমাদেরকে সততা, ঐক্য, মেধা, শ্রমের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে শিক্ষায়-উন্নয়নে ও দেশপ্রেমে৷ আর তখনই আমরা খুঁজে পাব আমাদের রক্তেরাঙা অমর একুশের সার্থকতা৷ ঐতিহ্য থেকে প্রেরণা গ্রহণ: একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত৷ এ ঐতিহ্য থেকে আমরা প্রেরণা গ্রহণ করবো, সঞ্চয় করবো শক্তিও সাহস৷ কিন্তু আমাদের পদক্ষেপ হবে সামনের দিকে, দৃষ্টি থাকবে ভবিষ্যতের প্রাণে এবং আমরা এগিয়ে যাবো মহত্তর ত্যাগের নবতর সংকল্প বুকে নিয়ে৷ মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হওয়া: মূল্যবোধ মানে সত্যবোধ-আমাদের ইতিাসে একুশে ফেব্রুয়ারি অমর হয়ে আছে৷ এ সত্যবোধের এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে এদিন এগিয়ে এসেছিল আমাদের তরুণ ছাত্র সমাজ জীবনের মূল্যবোধ তথা সত্যরক্ষায়৷ এরা সত্যরক্ষার মৌলিক-এদের হাতে ছিল মূল্যবোধের অদৃশ্য হাতিয়ার৷ আমাদের উচিত এ নদ-নদী আর সমুদ্র-মেলা, সবুজের ছায়া যা প্রিয় মাতৃভূমিতে যারা জন্মাবে তাদেরকে মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত করা৷ যাতে কবে তারা বুঝতে পারে মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে কি করে জীবন তুচ্ছ করে এগিয়ে যেতে হয় সত্য আর মনুষ্যত্ব রক্ষায়৷ একুশের অঙ্গিকার বাস্তবায়ন: একুশে চেতনার উত্তরাধিকার বহনের গর্ব নিয়েও একুশের কিছু অঙ্গিকার বাস্তবায়নে আমাদের দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতা এমন এক পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে, সাধারণ মানুষ তার ফলে একুশ থেকে দূরে, অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে৷ অথচ এ দিনটির রাজনৈতিক তাত্‍পর্য সাধারণ মানুষের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা হলে একুশের ইতিহাস তাদের চেতনায় দাগ কেটে যেতে পারে, একুশের স্পর্শে তাদের রক্তস্রোত তীব্র হৃত্‍স্পন্দন দ্রুততর হতে পারে, স্নায়ুতন্ত্র আবেগে বেজে উঠতে পারে৷ আমাদের উচিত একুশের অঙ্গিকারকে বাস্তবায়নে সজাগ হওয়া৷ কল্পনা করুন তো ভাষাবিহীন একটি পৃথিবীর কথা, একেক জন মানুষ যেন এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, একে অপরের থেকে দূর-দূরান্ত, কেবল নির্বাক চোখে তাকিয়ে রয়, যেখানে মা কোনোদিন সন্তানের মুখে ''মা'' ডাক শুনতে পায় না৷ ভাবুন তো অক্ষরবিহীন একটি পৃথিবীর কথা! জগতের সকল পুস্তক যেখানে শোকে সাদা! পিতার কাছে টাকা চেয়ে পুত্র আর চিঠি লেখে না, রানার যেখানে অলস ঘুমায়, কিন্তু আমরা জানি এটা অসম্ভব, কথা ছাড়া পৃথিবী অচল, লেখা ছাড়া সভ্যতা স্থবির৷ আমাদের ভাষা বেঁচে থাকে আমাদের কথায় আর লেখায় আর আমরা বেঁচে থাকি আমাদের ভাষায়৷ মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য প্রতিটি জাতি বদ্ধপরিকর৷ বাঙালি জাতি তার জলন্ত প্রমাণ৷ কৃষ্ণচূড়ার রক্তলালে রঞ্জিত আমাদের ভাষা শহীদদের আত্মবলিদান৷ বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপতে তারা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য৷ যার ফলে এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছি৷ আমরা পেয়েছি আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা৷ ইতিহাস যে শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতকেও গর্ভে ধরে রাখে তার এক জ্বলজ্বলে নজীর রেখে গেছেন আমাদের ভাষা শহীদেরা৷ তারা আজ পৃথিবীর সকল ভাষাভাষী মানুষের নিকট শ্রদ্ধেয়৷ সমগ্র বিশ্বের মানুষ তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে৷ তাদের আত্মত্যাগকে কেন্দ্র করেই তারা একুশকে নিজেদের মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে পালন করে৷


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.